সামথিং সামথিং : পর্ব ৭৪

Representative Image

সংবাদ দলীয় বস্তু


বিজ্ঞাপন

ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন ‘বিবিসি’-র বিরুদ্ধে মামলা করে এক বিলিয়ন থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার চাইবেন, ‘বিবিসি’-র বড় বড় কর্তা এবং কর্ত্রী পদত্যাগ করছেন, সব মিলিয়ে সংবাদ সংস্থাটি ঝামেলায়। এক তথ্যচিত্রে ট্রাম্পের এক বক্তৃতার (যা তিনি দিয়েছিলেন ৬ জানুয়ারি, ২০২১-এ) সম্পাদনা নিয়ে মূল ঝঞ্ঝাটের সূত্রপাত, সেখানে ট্রাম্পের একটা কথার পর, প্রায় ৫৪ মিনিট পরের একটা বাক্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে এবং মনে হচ্ছে যেন, ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের ক্যাপিটল-হানার প্ররোচনা দিচ্ছেন। বিবিসি ট্রাম্পের কাছে ক্ষমা চেয়েছে, স্বীকার করেছে যে, দর্শকের মনে হতে পারে ওই বাক্যগুলো পর পর বলা হচ্ছে, ওটা বিচ্ছিন্ন অংশের সম্পাদনা নয়। সঙ্গে আত্মসমর্থনে এও বলেছে, এক ঘণ্টার তথ্যচিত্রে একটা ১২ সেকেন্ডের টুকরো থেকেই লোকে ধারণা তৈরি করে নেয় না, তাছাড়া ওই তথ্যচিত্রে ট্রাম্পের অনুকূলে অনেকের মতামতই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আসল ব্যাপার হল, বহুদিন ধরেই সমালোচকরা বলছেন, বিবিসি মোটেও নিরপেক্ষ নয়, তার মধ্যে আপনা-আপনিই বামপন্থী ধারণার প্রতি ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়, এবং পক্ষপাতের চেয়ে দূষণীয় এক সংবাদ-পসারির ক্ষেত্রে কী-ই বা হতে পারে?

এটা খুব অদ্ভুত, আজকের যুগে সংবাদদাতার কাছে তাহলে বেশ কিছু মানুষ নিরপেক্ষতা চাইছেন! যেখানে এই পৃথিবীর আধুনিক মশলা-জোগানের এক বিশাল কারখানাই কিনা স্পষ্ট-পক্ষপাতী খবরকেন্দ্র! সারা বিশ্বে বহু টিভি-চ্যানেল, বহু ডিজিটাল ও মুদ্রিত সংবাদপত্র সম্পর্কে সবাই জানেই, এ অমুক পার্টির ধ্বজাধারী। জেনেই লোকে সেই কাগজ পড়ে, সেই চ্যানেল দেখে ও মহা খুশি হয়ে বাজার যায়। ফক্স নিউজ সারাক্ষণ ট্রাম্পের ঢক্কা সহস্র ডেসিবেলে পেটাবে এবং সিএনএন সারাক্ষণ ট্রাম্পের আদ্যশ্রাদ্ধ বাগাবে, জেনেই ট্রাম্প-ভক্ত ও ট্রাম্প-বিরোধীরা নিজস্ব ধূপধুনো নিয়ে সেই-সেই চ্যানেল দেখতে বসেন। তার মানে, নিরপেক্ষতা এখন বর্জনীয় এবং পক্ষপাতই প্রত্যাশিত। আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই যে বাংলা টিভি চ্যানেল ও কাগজগুলো চলে, তার অনেকগুলো সম্পর্কেই আমরা বলি, ‘অমুক পার্টির চ্যানেল’, বা ‘তমুক পার্টির কাগজ’। কয়েকটা তো স্বঘোষিতভাবেই দলীয় মুখপত্র, কিন্তু সেই চাটাই-সাঁটা কাগজগুলো বাদ দিয়েও, বাকি কাগজ বা চ্যানেলদের প্রাণপণ একবগ্গা ও উগ্র সংবাদ পরিবেশন দেখে বুঝতে বাকি থাকে না, কাদের কোলে ঝোল টানার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এমনকী যে চ্যানেল নিজেকে সমদর্শী রটিয়ে মুখে ফেকো তুলে ফেলল, সেও বিভিন্ন পর্যায়ে কারও না কারও পোষ্য হুতুমের মতোই চলে-ফেরে। হয়তো তার তৃণমূলকে এখন তীব্র অপছন্দ, তাহলে সঞ্চালক অন্য দলের প্রতিনিধিদের দিব্যি কথা বলতে দিলেও, তৃণমূলের প্রতিনিধি বক্তৃতা শুরু করলেই নাগাড়ে নানা আপত্তি ও মন্তব্য ছুড়তে থাকবেন, যাতে সেই প্রতিনিধির ভাবনা ও কথার প্রবাহ তুতলে যায়, বা তিনি প্রখর রেগে সব গুলিয়ে ফেলেন, অন্তত দর্শক তাঁকে ভুলবাজ বলে চিনে যায়। আবার যখন ওই চ্যানেলের তৃণমূলকে পেল্লায় পছন্দ, তখন অন্য দলের প্রতিনিধিদের সমান অসুবিধেয় ফেলা হবে আর তৃণমূলের প্রতিনিধির তাবৎ বাণী শুনেই সঞ্চালক অ্যায়সা ঘটরঘটর ঘাড় নাড়বেন, যেন মুহুর্মুহু বেদবাক্য রচিত হচ্ছে এবং ঘাড় খুলে পড়ে গেলেই বা কী। সাধারণ দর্শক শ্রোতা পাঠক এসব আন্দাজ বা সন্দেহ করেন, অনেকানেক গাল দেন, কিন্তু শেষমেশ এই তামাশাকেই আকুল আলিঙ্গন বিলিয়ে একশা।

আরও পড়ুন: জেমাইমা রদ্রিগেজের ঈশ্বরের প্রতি আস্থা থেকে যা শিখতে পারি আমরা?
চন্দ্রিল ভট্টাচার্যর কলমে ‘সামথিং সামথিং: পর্ব ৭৩’…

এমনকী, যাঁরা একক ইউটিউবার, সমাজ বা রাজনীতির বিশ্লেষণ করছেন আপাত-স্বাধীনভাবে, তাঁদেরও কেউ সর্বক্ষণ তৃণমূলকে গাল দিচ্ছেন, কেউ বিজেপিকে। কেউ পুরো সময় সিপিএমের তাঁবেদারি করছেন। কক্ষনও এঁরা অন্যরকম একটাও কথাও বলেন না। অর্থাৎ, যিনি বিজেপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন, তিনি কোনওদিন সে-দলের একটাও ভাল কাজ দেখতে পান না, এবং অন্য কোনও দলের একটাও খারাপ কাজ দেখতে পান না। যিনি তৃণমূলের অ্যান্টি হিসেবে নাম কিনেছেন, তিনি মনে করেন তৃণমূলের সব খারাপ এবং অন্য সবার সব ভাল। আর সিপিএমের স্তব রচনা করেন যিনি, অনর্গল বিজেপি ও তৃণমূলকে ভিলেন প্রতিপন্ন করেন এবং সিপিএমের কণামাত্র নিন্দে তাঁর মুখ থেকে বেরয় না। আশ্চর্য, এঁদের টিকি কারও কাছেই বাঁধা নেই, অথচ এঁরা খণ্ডদর্শনকে, পুরোপুরি একচোখো অবস্থানকে শ্রেয় মনে করেছেন। তাঁদের মনে হয়নি, সত্য একরঙা হয় না, সব দলেরই ভাল ও খারাপ দিক আছে, এবং আমার দায়বদ্ধতা কোনও দলের কাছে নয়, বরং ন্যায়ের কাছে। হয়তো মূল দায়বদ্ধতা টিআরপি-র কাছে (কারণ পক্ষপাত এখন ফ্যাশন), কিংবা তাঁরা স্বেচ্ছায় কোনও দলের কট্টর ক্যাডার।

সাধারণ মানুষের ফেসবুক-মন্তব্য দেখলেও বোঝা যায়, তাঁরা প্রত্যেক খ্যাত মানুষের কাছে স্পষ্ট জানতে চাইছেন, তুমি কোন দল? যদি কেউ বলেন (বা তাঁর হাবভাবে বোঝান), আমি কোনও নির্দিষ্ট দলেরই চ্যালা নই, তাহলে তাঁকে বলা হবে মেরুদণ্ডহীন, গা-বাঁচানো জরদ্গব। প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই বলে নিরপেক্ষ সাজছ। মানে, নিরপেক্ষতা একটা দুর্বলতা, অক্ষমতা হিসেবে প্রতিভাত। আবার, কেউ যদি ভাল গান করেন, কিন্তু বিজেপি-ঘেঁষা হন, তাঁর গানের তলায় লিখে আসা হবে ‘চাড্ডি’ (লিখবেন যে সাধারণ মানুষটি তৃণমূল বা সিপিএম সমর্থক), তৃণমূল-বন্ধু অভিনেতার সিনেমার প্রোমোর তলায় লেখা হবে ‘চটি-চাটা’ (লিখবেন সিপিএম বা বিজেপি সমর্থক), আর সিপিএম-পন্থী কবির কাব্যের তলায় ‘মাকু’ (লিখবেন তৃণমূল বা বিজেপি সমর্থক)। আর যিনি নিরপেক্ষ, তাঁর ছবির তলায় এই তিনটেই লেখা যেতে পারে, তবে শাসক-দলের বিরুদ্ধে হইচই করছেন না বলে ‘চটি-চাটা’ লেখার সম্ভাবনা বেশি। তার মানে, সাধারণ মানুষও প্রায় সবসময়, একটা নির্দিষ্ট দলেরই (বা একটা নির্দিষ্ট দলের খর-বিরোধী অবস্থানেরই) লোক। সমান স্বচ্ছ নজরে সবার ও সবকিছুর দিকে তাকিয়ে থাকার দায় তার মোটে নেই। এমনকী, সমস্ত দলীয় আঁকড়ানির বাইরে যে আদৌ কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে (ম্যাজিক-শো বা পরিবেশ-দরদি কথকতা) তা সে স্বীকার অবধি করে না। তার দাবি, আমি যা পছন্দ করছি, তুমিও তা পছন্দ করো। নইলে তুমি আমার শত্রু (কারণ তুমি যা-ই হও আমার পক্ষে নও)। লাগাও ট্রোল।

মানে, পক্ষপাত এখন ‘ইন’, এটার বাইরে থাকার চেষ্টা করা মানে বাজার হারানো। রাজনীতির নেতানেত্রী, সমাজের ধারাভাষ্যকার এবং সাধারণ সংবাদভোক্তার মধ্যে আর ফারাক রইল না। রাজনীতির লোকেরা যে একই গৎ মেনে সকল সভায় বাজবেন, কক্ষনও একটাও কথা পার্টির বাঁধা বুলির বাইরে বলবেন না, তা এখন আমরা জানি এবং উচিত-ব্যবহার বলে মানি। কিন্তু অন্যদের কাছে কিছুকাল আগেও আমাদের দাবি ছিল, ঘটনাটা বুঝে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি মত দিন, কে ঠিক এবং কে ভুল। তাহলে, একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে অমুক দলকে ভাল এবং আরেকটা ঘটনার প্রেক্ষিতে সেই দলকেই খারাপ বলার সম্ভাবনা ছিল। এবং সেরকমটা হলেই আমরা হাততালি দিয়ে বলতাম, এই লোকটার নাকে কোনও দড়ি বাঁধা নেই, ফলে মতামত আগে থেকে কোনও কুঠুরিতে ঠুসে গোঁজা নেই, তাহলে একেই বরং বিশ্বাস করা যাক, বা অন্তত এর কথাবার্তায় মনোযোগ প্রয়োগ করা ভাল। কিন্তু এখন রেলগাড়ি পূর্ণ অন্য খাতে বইছে: আমি শুধু আমার পছন্দসই কথাগুলোই বারবার শোনার জন্য খবর খুলে বসব, অন্য ধাঁচের সব কথাকে যাচাই না-করেই মনে মনে কেটে বাদ দেব, এবং বিরোধী কথা যে বলবে তাকে আগ্রাসী তেড়ে গিয়ে ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দেব। 

সাধারণ মানুষের ফেসবুক-মন্তব্য দেখলেও বোঝা যায়, তাঁরা প্রত্যেক খ্যাত মানুষের কাছে স্পষ্ট জানতে চাইছেন, তুমি কোন দল? যদি কেউ বলেন (বা তাঁর হাবভাবে বোঝান), আমি কোনও নির্দিষ্ট দলেরই চ্যালা নই, তাহলে তাঁকে বলা হবে মেরুদণ্ডহীন, গা-বাঁচানো জরদ্গব। প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই বলে নিরপেক্ষ সাজছ। মানে, নিরপেক্ষতা একটা দুর্বলতা, অক্ষমতা হিসেবে প্রতিভাত।

এতে এক চমৎকার প্রতিধ্বনির বাক্স তৈরি হয়েছে। এমনিতেই আমরা সম-মনস্ক মানুষের সঙ্গেই মিশি, হয়তো আমাদের আড্ডায় সকলেই একমত যে বিজেপি-ই ভারতের সর্বোচ্চ সর্বনাশা, এবং আমরা প্রগতিশীল। অথবা আমাদের আড্ডায় সবাই মনে করে হিন্দুদের অকল্প অভ্যুত্থান দরকার এবং বিজেপি-ই মসিহা। কিংবা আমাদের আড্ডায় সকলেই চেঁচাচ্ছে সিপিএম না এলে বাংলার কিস্যু হবে না, ওরা এলেই সাঁইসাঁই বিপ্লব। আবার, আমরা পছন্দসই মতগুলোকেই সামাজিক মাধ্যমে বেশি দেখি-শুনি-পড়ি, সেও তার গাণিতিক ছাঁচ অনুযায়ী ওই মতের প্রতিফলনগুলোই আমাদের কাছে বেশি হাজির করে। এরপর আমরা জোরসে অভ্যাস করে নিয়েছি সেই গণমাধ্যমগুলোর কাছেই আসনপিঁড়ি বসে থাকা, যারা আমাদের ধারণাগুলোই ক্রমাগত আউড়ে যায়। তার মানে, আমরা নিজেরাই নির্মাণ করেছি আমাদের চিন্তা দিয়েই তৈরি বালিশ, তোশক, কফির কাপ, আয়না, চিরুনি ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ— যাতে অস্বস্তিকর কাঁটাময় ভেংচিসংকুল পথে কদাপি না হাঁটতে হয়। ইচ্ছাপূরণের এই যাপন গাঁথতে গিয়ে আমরা সংবাদমাধ্যমের সেই গুণকেই ঝাঁটা দেখিয়েছি, যা তার সর্বাধিক সম্পদ। খবরওয়ালা দেখছে, একটা দিকে ঝুঁকে প্রায় মাটিতে মাথা না ঠেকিয়ে ফেললে, চিল্লিয়ে ইস্তাহার না বিলি করলে, বিশ্লেষণের নামে বাপান্ত না করলে, ভোক্তা বাড়ছে না। তাতে বিজ্ঞাপন মার খাচ্ছে। লে বাবা, কাল থেকে অমুক দল হয়ে যা। শুধু বিবিসি-ই লোকের চোখে নিরপেক্ষ না-থাকার মাশুল দিচ্ছে প্রাণপণ। তাদের বিরুদ্ধে নালিশ: মার্কিন নির্বাচন, বর্ণবৈচিত্র, ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ এবং রূপান্তরকামীর অধিকার বিষয়ে (এবং আরও বহু বিষয়ে) তারা শুধু একগোত্রীয় মনোভাবই প্রকাশ করে। এসব রাগারাগি অবশ্য করছে মূলত রক্ষণশীল ও দক্ষিণপন্থীরা (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও তাদের হুবহু এ-ই কলহ: তোমরা মুক্তমনা ‘উয়োক’ একমেটে সংস্কৃতিরই ধারক), তাই এ বখেড়ারও উদ্দেশ্য সুবিধের নয়, কিন্তু সেটা এক্ষেত্রে গৌণ। সংবাদ-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ শানাতে গেলে যে এখনও একঝোঁকামিকে একটা বিচ্ছিরি দোষ হিসেবে তুলে ধরা যায়, তাতে পৃথিবীর ওপর খিমচি-পরিমাণ ভরসা রইল।