‘লাভ, ডেথ অ্যান্ড রোবটস’। নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় একটি সিরিজ। যে এপিসোডের কথা লিখছি, নাম ‘অল্টারনেট হিস্ট্রিস’। আমরা দেখতে পাই, অ্যাডলফ হিটলারের মৃত্যুসাল বদলে হয়েছে ১৯০৮। তৈরি হচ্ছে ছ’খানা স্বতন্ত্র সময়রেখা। একজন ফ্যাসিস্টের ছ’ধরনের অল্টারনেট মৃত্যুর দৃশ্যকল্প। যেন অনায়াস খিল্লি! কখনও হিটলারকে পিষে দিচ্ছে সসেজ-বোঝাই ঘোড়ার গাড়ি। দিব্যি সে পার্কে বসে ডায়েরি লিখছিল। বেমক্কা এক খাবলা ঢাউশ জিলেটিন-কিউব গিলে ফেলল তাকে। জানা গেল, এ-সব আসলে রাশিয়ার চক্রান্ত। এহেন অল্টারনেট ইতিহাসের সময়রেখা বলছে, প্রথম চাঁদে পাড়ি দিয়েছে— ভ্লাদিমির পুতিন। আবার কোনও সময়রেখায় দেখছি, ভিয়েনার চারজন দেহোপজীবিনীর সঙ্গে ম্যারাথন যৌনতা করতে করতে মারা গেলেন হিটলার। কোনও বিশ্বযুদ্ধ বাধলই না।
তাহলে কী বোঝা গেল? একজন স্বৈরাচারী, সাইকোপ্যাথ এবং গণহত্যাকারী— আখেরে হয়ে উঠলেন প্রহসনের উপাদান। আপাদমস্তক। অর্থাৎ, পৃথিবীটাকে যে বা যাঁরা পিংপং বল বানালেন, এতোলবেতোল খেলে চললেন আবহমানকাল, হরবখৎ ভাবলেন সাধারণ মানুষ হল পাপেট, মিম অথবা কিচ্ছু-না, ক্রমে ক্রমে তাঁরাই উৎকৃষ্ট জোকার! লোক হাসাচ্ছেন দারুণ।
ইউটিউবের একটি কমেডি-সিরিজের কথা বলি। ‘পাপেট রেজিম’। ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি পাপেট গান গাইছে, ‘আই ব্রট পিস/ইন দ্য মিডল ইস্ট/অল দ্য ওয়ার্স গনা সিজ/ফর এ মান্থ অর টু অ্যাটলিস্ট…’ ব্যাকগ্রাউন্ডে ইতিউতি সাদা পায়রা উড়ে যাচ্ছে। ততই সে পাপেট চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, আমি দেশে দেশে শান্তি বিলিয়েছি। কতশত যুদ্ধ থামিয়েছি। এইবার রসিকতা থেকে সটান রিয়েলিটিতে পড়ে হুমড়ি খাই, শুনি ট্রাম্প বলছেন, তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কার চাই। এ নিখাদ ভাঁড়ামো। তবু ডোনাল্ড ট্রাম্প সচেতনভাবেই তা করছেন। কথার ধরনে কমিক-চরিত্রের ছাপ রাখতে শুরু করেছেন সুচারু।
আরও পড়ুন: কেবলই অপরাধের অন্ধকার নয়, মার্টিন স্করসেসি যেভাবে মার্কিন আঁধারকে চেনান!
লিখছেন সৌহার্দ্য প্রামাণিক…
কিন্তু কেন? কারণ একজন স্বৈরাচারী শাসক, আসলে ভাঁড়। সমষ্টির চোখ থেকে শাসক-সম্পর্কিত ভয় অথবা সম্ভ্রমের মোড়কগুলো খসতে খসতে যেটুকু অবশিষ্ট থেকেছে একবিংশ শতাব্দীতে, তা দিয়ে মিম ছাড়া আর কিছু তৈরি করা সম্ভব নয়। একটি রিল ভেসে উঠল মনে। এআই-নির্মিত। দেখতে পাচ্ছি, ভ্লাদিমির পুতিন। কিম জং উন। ডোনাল্ড ট্রাম্প। নরেন্দ্র মোদি। শি জিনপিং। একসঙ্গে বসে বাংলা মদ খাচ্ছে। তারপর যে যাকে পারছে ধাওয়া করছে। ল্যাং মারছে। যা ইচ্ছে তাই। অথচ খেয়াল করে দেখুন, প্রত্যেকেরই ইমেজ আবিশ্বে দাপুটে ওয়ার লর্ডের মতো। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভিলেন। চাইলেই পৃথিবীটাকে গিলে নিতে পারে একঢোকে। তবু খিল্লি। শাসকের স্বৈরাচার, মাত্রায় যত ফুলে-ফেঁপে প্রকাণ্ড হাঁ-মুখের আকৃতি নেয়— কখনও ইউক্রেনে আক্রমণ, কখনও গণকবরে অসাড় করে দেয় ফিলিস্তিনের মাটি, কেউ-বা সোল্লাসে জানায়, ‘গোলি মারো সালো কো’— ততই সে কমেডি করে। ঠাট্টা নয় কিন্তু। ভ্লাদিমির পুতিন সাইবেরিয়ার একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। ক্লাসরুমের হোয়াইটবোর্ডে এঁকে রাখলেন, একটি বেড়ালের পশ্চাদ্দেশ। তারপরই ছাত্রদের বললেন, ‘দিস ইজ ফর ইউ, টু রিমেম্বার মি!’ আর এ-সভ্যতার স্মৃতি? সেখানে প্রকট হয় ভাঁড়ামোর একশো এক ফিকির। ‘পাওয়ার’ থেকে প্রাপ্ত অগাধ মস্তি।
তা এহেন ভাঁড়ামো কতখানি ছিল অসচেতন আর অজান্তেই কতখানি সহজাত হয়েছে দিনে দিনে, সেইসবের উদাহরণ বিচিত্র। কিন্তু শাসকের যে সচেতন ভাঁড়ামো, তার রাজনৈতিক অভিঘাত গভীর। ধরুন একজন শাসক দুর্নীতিবাজ, খুনি, ধর্ষক। আপনি জানেন। অথচ সে নির্বাচনী জনসভায় কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে বলছে, র্যাপ-সংগীতের সৃষ্টিকর্তা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যে জনতা শাসকের পক্ষে, তারা মস্তি পেল। দাদা খুব ফানি! যারা বিপক্ষে, তারাও। আর নিরন্তর ভাঁড়ামো করতে করতে, তৈরি করা গেল এক ধরনের ‘ডাবলথিংক’-এর পরিসর। কেমন? লোকটা আসলে মানুষ খুন করে, কিন্তু হ্যান্ডসাম আর ফানি। ১৯৮৪ উপন্যাসে জর্জ ওরওয়েল লিখছেন, এ হল সেই ক্ষমতা, যার জাদুবলে দুই পরস্পরবিরোধী ধারণা ব্যক্তির মাথায় গেঁথে যায় এবং তারা উভয়কেই গ্রহণ করতে শুরু করে। একসঙ্গে। ফলে শাসকের যাবতীয় স্বৈরাচারী কর্ম নির্দ্বিধায় ধামাচাপা পড়ে। জ্বলজ্বল করে কেবল ভাঁড়ামোটুকু। ওটুকুই মাস অ্যাপিলিং।
একজন স্বৈরাচারী শাসক, আসলে ভাঁড়। সমষ্টির চোখ থেকে শাসক-সম্পর্কিত ভয় অথবা সম্ভ্রমের মোড়কগুলো খসতে খসতে যেটুকু অবশিষ্ট থেকেছে একবিংশ শতাব্দীতে, তা দিয়ে মিম ছাড়া আর কিছু তৈরি করা সম্ভব নয়। একটি রিল ভেসে উঠল মনে। এআই-নির্মিত। দেখতে পাচ্ছি, ভ্লাদিমির পুতিন। কিম জং উন। ডোনাল্ড ট্রাম্প। নরেন্দ্র মোদি। শি জিনপিং। একসঙ্গে বসে বাংলা মদ খাচ্ছে। তারপর যে যাকে পারছে ধাওয়া করছে। ল্যাং মারছে। যা ইচ্ছে তাই।
সত্যজিৎ রায় সেই ১৯৮০ সালে যখন ‘হীরক রাজার দেশে’ নির্মাণ করছেন, তখন উৎপল দত্তকে অভিনয়ের বিষয়ে তিনি একটি পরামর্শ দেন। বলেন, অভিনয়ের টোন একটু সরস যেন হয়। বিস্মিত হয়ে পড়েন উৎপল দত্ত। এমন নির্মম এক শাসককে এভাবে যে সহজেই ভাঁড় করে তোলা যায়, এবং তার যাবতীয় স্বৈরাচারিতার ধারকে ভোঁতা করে দেওয়া যায় লহমায়, তা উৎপল দত্তকে তখন ভাবিয়েছিল। ভেবে দেখলে, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর সেই দস্যুমন্ত্রী থেকে ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’— যুদ্ধবাজ, শয়তান শাসককে হাস্যকর করে তোলার উদাহরণ শেষ হবে কি সহজে?
অতএব কে কত উৎকৃষ্ট কমেডিয়ান, কার ভাঁড়ামোয় হাততালি বেশি, সেসবেরই প্রতিযোগিতা। সমগ্র পৃথিবীজুড়ে। অথচ কমেডিয়ানদের নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বেরচ্ছে। এ কেমনতর ‘ডাবলথিংক’? ব্যাকগ্রাউন্ডে কিছু সাদা পায়রা ওড়ে। কোনও কোনও পাপেট ভাবতে বসে, আজ কোথায় দাঙ্গা বাধানো যেতে পারে! একজন জিজ্ঞেস করে, ভাই ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগান? উত্তর আসে, আমি অলওয়েজ শান্তির দলে।




