স্মৃতির চলন
মানুষের সীমিত জীবনে, জড়িয়ে থাকে নানা সুখ-দুঃখ, অম্ল-মধুর মুহূর্ত আর অগুন্তি স্মৃতি। বয়স বাড়ার সঙ্গে স্মৃতিরাও পাহাড় বানায়, একে অপরের সঙ্গে কোন গল্পে যে জড়িয়ে যায়, বোঝার সাধ্য কই? স্মৃতি সতত সুখের হয় না। কারও-কারও স্মৃতিতে লেগে থাকে প্রজন্মবাহিত ট্রমার বাষ্প, যা বইতে থাকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। আবার, স্মৃতি অনেকসময়ে ছলনাময়। বিশ্বাসঘাতক স্মৃতির প্রকৃতি, খুব কম মানুষই ঠিকভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।
সার্বিয়ার অধিকাংশ মানুষেরই নিজস্ব এক ইতিহাস আছে। নয়ের দশকের আগে অব্দিও সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়া এবং এরকম আরও চারটি দেশ একসঙ্গে যুগোস্লাভিয়া বলে পরিচিত হত। তারপর আটের দশকে কমিউনিস্ট সরকারের পতনের পর, ধীরে-ধীরে জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ওই ছ’টি অঞ্চলের পথে-প্রান্তরে।
নয়ের দশকে ঢুকতে না ঢুকতেই, ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসল। ক্রোয়েশিয়া দেখল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও মারদাঙ্গা। অবশেষে ঘটিবাটি ফেলে অনেককে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসতে হল। নিকোলার ঠাকুমাও সে-সময়ে সেখান থেকে পালিয়ে চলে আসেন তৎকালীন সার্বিয়ায়। তার আর ফেরা হয়নি গত তেইশ-চব্বিশ বছরে। ফেরার সুযোগ পেলেন তিনি, তবে মৃত্যুর পর।
আরও পড়ুন: যন্ত্রণা এবং ভালবাসার ইতিহাসকে আশ্চর্য মায়ায় প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য তুলে ধরেছেন ‘নধরের ভেলা’-তে! পড়ুন ফিল্মফিরিস্তি ২! লিখছেন বিশ্বাবসু বিশ্বাস…
সার্বিয়ান চলচ্চিত্রকার নিকোলা লেজাইচের ‘হাউ কাম ইট’স অল গ্রিন আউট হিয়ার?’ ছবিটি মূলত আত্মজৈবনিক। মুখ্য ভূমিকায় এখানেও এক নিকোলা, বছর চৌত্রিশ বয়স তার, কমার্শিয়াল বিজ্ঞাপন পরিচালনা করে, ইচ্ছে আছে আগামীতে নিজের মনের মতো ছবি বানানোর। খুব শীঘ্রই সে বাবা হতে চলেছে। ঘুমঘুম এক সার্বিয়ান শহরে নিকোলা বর্তমানে ক্লান্ত, কেন না, সে তার একঘেয়ে কাজ নিয়ে মোটেও খুশি নয়, যার প্রমাণ পরিচালক ছবির শুরুতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই দর্শকদের দিয়ে দেন। এসবের মাঝে তার কাঁধে দায়িত্ব পড়ে, নিকোলার বৃদ্ধ বাবা ও বংশের আরও কয়েকজন বুড়োবুড়িকে সঙ্গে নিয়ে ক্রোয়েশিয়ার উপকূল অঞ্চল ডালমেশিয়ায় যাওয়ার। নিকোলার ঠাকুমা সম্প্রতি গত হয়েছেন। মৃত্যুর আগে অন্তিম ইচ্ছে ছিল, তার মৃতদেহ যেন তার ভিটেমাটি ডালমেশিয়ার মাটিতে নিজের এককালে ফেলে আসা অঞ্চলে কবর দেওয়া হয়। এক কুয়াশামাখা সকালে নিকোলাকে গাড়িতে করে বাবা ও আরও কয়েকজন আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়।


এই রোডট্রিপ নিকোলার জন্য হতে পারত মোনোটোনাস দিনযাপন থেকে কয়েকদিনের মুক্তি, পরিবর্তে তা তাকে করে দিল চিন্তাবহুল। আপাতভাবে ঘটনাবিহীন এই রোডট্রিপে সে স্মৃতির বিশ্বাসঘাতক প্রকৃতি উপলব্ধি করে বিহ্বল হয়ে যায়। এই যেমন, যেতে-যেতেই বাবার সঙ্গে খোশগল্পের ফাঁকে একটি বিষয়ে দু’জনের মতান্তর হয়ে গেল। বাবার দাবি, এক বিখ্যাত গায়ক নাকি তার স্কুলের বন্ধু ছিলেন, একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু নিকোলা অবাক, সে বলে, না বাবা, তুমি যার কথা বলছ, সে নয়, আমি তো জানলাম অমুক একজন তোমার স্কুলের বন্ধু ছিল।

সেই নয়ের দশকে যখন নিকোলার পিতৃপুরুষেরা ক্রোয়েশিয়া ছেড়ে চলে আসেন, সে-সময়ে নিকোলার বয়স বছর নয়েক। এতকাল তার স্মৃতি বলতে ছিল বসার ঘরের একপাশে টেবিল, আরেকপাশে ছোট্ট একটা টিভি, তাতে ছুটির দুপুরে ‘টোয়াইলাইট জোন’দেখা। কিন্তু পরে যখন বাবার সঙ্গে ঐ পুরনো বাড়ি— যা বর্তমানে ধ্বংসাবশেষ মৃত্যুপুরী— দেখতে যায় নিকোলা আর স্মৃতিরোমন্থন করা শুরু করে, তখন বাবা তাকে সন্দিহানভাবে বলেন, তাদের বাড়িতে কোনও টিভি সেটই ছিল না সে-সময়ে। নিকোলা অবাক হয়, কিছু বলে না, কিন্তু স্মৃতির বেহিসাবি চলন তার সৃজনশীল ও সংবেদনশীল মনকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।
পরিবারের বড়রা অনেকদিন পর নিজেদের একসঙ্গে পেয়ে গল্পে মাতে। কাছাকাছি বসে বুড়োবুড়ির দল হাবুডুবু খায় পুরনো ফেলে আসা স্মৃতির পুকুরে, কারণ এই শেষ বয়সে তাদের সম্বল বলতে ওটুকুই। নিকোলা শোনে তাদের কথা, কিন্তু নিজেকে মানাতে পারে না। পুরনো টাউনের অনেকে তাকে দেখে চিনতে পারে, কিন্তু সে খুব একটা কাউকে মনে করতে পারে না। সমুদ্রে ঘেরা উপকূলবর্তী এই টাউন নিকোলার কাছে ধরা দেয় ধূসর, মেঘাচ্ছন্ন এক ঘুমন্ত জনপদ হিসাবে। তবে পরিচালক হতাশার রেশ রেখে যান না। এই টাউনে আসার পথেই নিকোলা দেখতে পায়, পথের ধারে গাড়ি থামিয়ে একদল যুবতী ক্যাথলিক সিস্টাররা একসঙ্গে গ্রুপ সেলফি নিচ্ছে। মুখেচোখে তাদের নতুন যৌবনের উদ্দীপনা।
নিজের বাবা হওয়া নিয়ে নিকোলার দ্বিধা, পারিবারিক ইতিহাস, বানানো স্মৃতির ভার, আর আমাদের এই ক্রমাগত প্রতারণা— গল্পের মোড়কে হোক, কিংবা ভাল থাকার অভিনয় করেই হোক— নিকোলাকে বিহ্বল করে তোলে ভেতরে-ভেতরে। আমরা দর্শক হিসাবে অতটা বুঝতে পারি না, কারণ পরিচালক ছবিটিতে সবকিছুই বলেছেন অত্যন্ত অস্ফূটে। প্রায় কোনও ঘটনাবিহীন এই ছবি কিছুক্ষেত্রে মনে করায় কিয়ারোস্তামিকে, কিছুক্ষেত্রে আমেরিকান ইন্ডি ফিল্মের রেশও লেগে থাকে এতে। শেষত উপলব্ধিই একমাত্র সম্বল দর্শকের।
যা অতীত, তার অধিকাংশই আমাদের ভাল থাকার অছিলায় বানানো টুকরো-টুকরো স্মৃতির কোলাজ, যা ছলনায় ভরা। আর সামনে রয়েছে অদেখা ভবিষ্যৎ, যা নিয়ে ভাবতে বসলে মন ডুবে যায় অনিশ্চয়তায়। পড়ে থাকে কেবল এই সময়টা।
সমকালীন সার্বিয়ান ইন্ডি ফিল্মের ছোট পরিসরে নিকোলা লেজাইচ খুব একটা অপরিচিত নাম নন। প্রথম ছবিটি বানিয়েছিলেন ২০১০ নাগাদ, নাম ‘তিলভা রোশ’। এই ছবিটিতে তিনি তার ছোটবেলার শহর বোর খনি অঞ্চলের দুই তরুণ বন্ধু, তাদের ছুটির দিনে স্কেটবোর্ড চেপে ঘুরে বেড়ানো, শহরাঞ্চলের ইতিহাস ও বর্তমান, এক নির্ঘুম গ্রীষ্মকাল, খনি বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে ইউনিউনের প্রতিবাদ এবং তা কীভাবে এই দুই বন্ধুর জীবনে প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে কথা বলেছিলেন। তথ্যচিত্রে যে রিয়েলিজমের দেখা মেলে, তাও যেমন ছিল সে-ছবিতে, তেমনি তা ছিল ফিকশনাল ন্যারেটিভও। প্রায় চোদ্দ বছর পরে নিকোলা নতুন ছবি বানালেন এবং কেন্দ্রে রাখলেন নিজেকে।
ধূসর টাউনে একদিন নিকোলা দেখা পায় সবুজের। যে-বাড়িঘর তারা ফেলে গিয়েছিল এককালে, যা এখন ভগ্নপ্রায়, সেখানেই সে খুঁজে পায় সতেজ প্রাণ। ফিরতি পথে স্মৃতির ভারে ন্যুব্জ বাবা নিকোলাকে বলে, তাদের সেই পুরনো বাড়ির উঠোনে থাকা ওক গাছটি, যা এই এত বছর বাদেও নানা মুহূর্ত বুকে আগলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, সেটা যদি কখনও কেটে ফেলা হয়, না জানি কত দুঃখই না হবে তার। নিকোলা অনুভব করে এই স্মৃতির ভার, কিন্তু সে এতক্ষণে হয়তো বুঝে গেছে, জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত কেবল এই মুহূর্তটিই। অতীত বলেও কিছু হয় না, কারণ যা অতীত, তার অধিকাংশই আমাদের ভাল থাকার অছিলায় বানানো টুকরো-টুকরো স্মৃতির কোলাজ, যা ছলনায় ভরা। আর সামনে রয়েছে অদেখা ভবিষ্যৎ, যা নিয়ে ভাবতে বসলে মন ডুবে যায় অনিশ্চয়তায়। পড়ে থাকে কেবল এই সময়টা। এটুকু নিয়েই ভালভাবে বেঁচে থাকা যায়।
বলা ভাল যে, এই ছবিতে যেহেতু ঘটনা সেভাবে কিছুই নেই, আর পরিচালকের বক্তব্যও অত্যন্ত সুপ্ত, তাই সবার সমানভাবে ভাল নাও লাগতে পারে; তবে পরিচালকের এই সংযম প্রশংসার দাবি রাখে।
হাউ কাম ইট’স অল গ্রিন আউট হিয়ার?
পরিচালক: নিকোলা লেজাইচের
সাইবেরিয়া




