গানে-নাচে মান্না দে

Representative Image

মান্না দে-র গানের সঙ্গে নাচ! এ কীভাবে সম্ভব! বাঙালি রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে নাচের সম্মিলন দেখেছে, দেখেছে নজরুল-এর গানের সঙ্গেও। ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ তো স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেছে। ‘মান্না দে-র গানের সঙ্গে নাচ!’— প্রাথমিকভাবে শুনে বিস্ময়কর মনে হলেও, সম্প্রতি কলকাতা শহর সাক্ষী থাকল এক বিরল শিল্পভাবনার। এই বিস্ময়কে বাস্তব করে তুলেছেন ‘কলামণ্ডলম’ সংস্থা ও তার শিল্পীবৃন্দ।

১৯৬৮ সালে কেরল থেকে এসে, কলকাতায় এই সংস্থার শাখা তৈরি করেন কিংবদন্তী শিল্পীদ্বয় গুরু গোবিন্দন কুট্টি ও থাঙ্কমণি কুট্টি। মূলত তাঁদের হাত ধরেই দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যকলার ‘কথাকলি’, ‘ভারতনাট্যম’, ‘মোহিনীঅট্টম’, ‘কুচিপুরী’ আঙ্গিক পশ্চিমবঙ্গের শিল্পধারায় প্রবেশ করে। সেই থেকে শুরু করে আজ অবধি বহু ঐতিহাসিক প্রযোজনা আয়োজন করেছে এই সংস্থা, এঁদের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও কয়েক হাজার, যাঁরা আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

আরও পড়ুন: গৌরী দেবী-কে লেখা উত্তম কুমার-এর চিঠি! যে-প্রদর্শনী চমকে দেবে বাঙালিকে…

‘কলামণ্ডলম’ গত ২৫ অক্টোবর, গলফ গার্ডেন্স-এর ‘গুরু গোবিন্দন কুট্টি অডিটোরিয়াম’-এ আয়োজন করল এমন এক অনুষ্ঠানের, যেখানে মান্না দে-র গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করলেন প্রায় সতেরোজন শিল্পী। প্রসঙ্গত এঁরা প্রত্যেকেই ‘কলামণ্ডলম’-এর প্রাক্তনী। কেউ-কেউ বর্তমানেও অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত রয়েছেন ‘কলামণ্ডলম’-এর সঙ্গে। সকলেরই সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল মান্না দে-কে উৎসর্গীকৃত এই অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের পৌরহিত্য করেছেন সোমনাথ. জি. কুট্টি। তিনি গুরু গোবিন্দন কুট্টি ও থাঙ্কমণি কুট্টির পুত্র, একইসঙ্গে ‘কলামণ্ডলম’-এর কর্ণধারও বটে। এ-দিন এই অনুষ্ঠান আয়োজনের নেপথ্য কাহিনি জানতে চাইলে তিনি বলেন, মান্না দে-র মুগ্ধ শ্রোতা তিনি। ছোট থেকে মান্না দে-র গান শুনে বেড়ে ওঠা, পাশাপাশি ধ্রুপদী নৃত্যের আবেশ-ছন্দ তাঁর মর্মে প্রোথিত। এই জায়গা থেকেই মনে হয়েছে, মান্না দে-র গানের কথা, সুর, তাল, লয়, ছন্দকে যদি ধ্রুপদী নৃত্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়।

নাচের মুদ্রাই হোক কিংবা গানের কথা, ব্যঞ্জনার মাধ্যমে মান্না দে-র গানকেই তুলে ধরা ছিল এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। প্রসঙ্গত এ-দিন সোমনাথ বাবু অনুষ্ঠানের সূচনাকথার সময়ে জানান,  একটি ক্লাবে কোনও এক ছবির শুটিংয়ের সময়ে, তাঁর সঙ্গে দেখা হয় মান্না দে-র। সে-সময়েই মান্না দে, তাঁকে গুরু গোবিন্দন কুট্টির নাচের প্রতি নিজের মুগ্ধতার কথা জানান। সবমিলিয়ে এক কিংবদন্তীর গানের প্রতি মুগ্ধতাই এহেন অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।  থাঙ্কমণি কুট্টি চাইতেন, মৃত্যুদিনে যেন কোনও উদ্‌যাপন না হয়, তাই-ই অনুষ্ঠানের দিন হিসেবে মান্না দে-র মৃত্যুপরবর্তী দিনটিকে বেছে নেওয়া।  

এ-দিন সামগ্রিক অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন দেবলীনা ভট্টাচার্য; প্রতিটি নাচের মাঝে যেভাবে তিনি মান্না দে-র জীবনের নানা ঘটনার উল্লেখ করছিলেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

এদিন আরও অনেকের সঙ্গে নাচ পরিবেশন করলেন— জনপ্রিয় অভিনেত্রী, শিল্পী মালবিকা সেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী, আজও যুক্ত রয়েছেন এঁদের সঙ্গে, এদিন তিনি একটি শুটিং থেকে এসে, সরাসরি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ‘রঙ্গিনী কত মন, মন দিতে চায়’ গানটির সঙ্গে তিনি নৃত্য পরিবেশন করলেন। তাঁর সামগ্রিক পরিবেশনা, গানের প্রতিটি কথার সঙ্গে যথাযথ মুদ্রার প্রয়োগ মুগ্ধ করে রাখে। মুগ্ধ করে রাখেন, ইলিনা বসু, সুগত রায় সৌমিতা ঘোষ প্রমুখ।  

এদিন দর্শকাসনও ছিল মুগ্ধ করার মতন। বিপাশা মল্লিক জানালেন, শান্তিনিকেতনে শৈলজারঞ্জন মজুমদার প্রতিষ্ঠিত ‘সুরঙ্গমা’ নৃত্য-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি। এই প্রতিষ্ঠান আয়োজিত প্রায় প্রতিটি প্রযোজনাতেই নায়কের ভূমিকায় মঞ্চে অবতীর্ণ হতেন তিনি। পাশাপাশি বিপাশা দেবী নিজে মান্না দে-র গুণমুগ্ধ শ্রোতা। তাই এই অনুষ্ঠান নিয়ে তিনি ও তাঁর মতো অনেকেরই প্রত্যাশা তুঙ্গে ছিল। যা পূরণে সক্ষম হয়েছে ‘কলামণ্ডলম’।