ডিগ্রির কৌতুক
নীলা হতাশ হয়ে একটা খবর পড়ছিল মোবাইল ফোনে। নীলাব্জ পাশে এসে বসল।
নীলাব্জ: কী ব্যাপার? মন খারাপ না কি?
নীলা: হুম, বেকারত্বের হার দেখে ভাল লাগছে না। ডিগ্রি নিয়েও ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশের যুবসমাজ।
নীলাব্জ: ও, এই ব্যাপার?
নীলা: এরকম হাবভাব করছ কেন? যেন কোনও ব্যাপারই না?
নীলাব্জ: ওইসব ডিগ্রি-ফিগ্রি দিয়ে কিছু হয় না। সব স্ক্যাম।
নীলা: ডিগ্রি স্ক্যাম? তোমার নেই?
আরও পড়ুন: শরীর দেখানো পোশাক মানেই আধুনিক? লিখছেন অনুপম রায়…
নীলাব্জ: আমাদের করতে হয়েছে। আমরা যখন পাশ করেছি, তখন তাও কিছুটা মূল্য ছিল। যতদিন যাবে এগুলোর তেমন মূল্য থাকবে না।
নীলা: মানেটা কী?
নীলাব্জ: মানে, স্কুলপাশ করেই লোকে অন্য কাজ করা শুরু করে দেবে। ফালতু ডিগ্রি ঝুলিয়ে কী হবে? আসল তো কাজ আর টাকা, তাই না?
নীলা: কলেজ যাবে না?
নীলাব্জ: আচ্ছা তুমিই বলো, চাকরি যে করছ, কলেজের কী তোমার কাজে লাগছে? আমার তো কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি, করি আইটির কাজ। দু’দিন বাদে ম্যানেজেরিয়াল রোলে ঠেলে দেবে। আমার ওই ডিগ্রিটার কী মূল্য?
নীলা: ওই ডিগ্রিটা ছিল বলেই তোমার কোম্পানি তোমাকে চাকরির ইন্টারভিউ-এ ডেকেছিল। সবাইকে ডাকছে? স্কুলপাশগুলোকে ডাকছে?
নীলাব্জ: এগুলো সব বাতিল হয়ে যাবে ধীরে-ধীরে… স্কিলভিত্তিক পড়াশোনা শুরু হবে আরও। ভোকেশানাল লার্নিং যেটাকে বলে। যে-কাজটা তুমি করতে চাও, শুধু সেইটুকু শিখে চাকরির বাজারে তুমি নেমে পড়বে। এমনিতেও এখন আগেকার মতো নেই। সারাজীবন যে শিখে যেতে পারবে, সেই-ই এগোবে। কাজ করতে-করতে আরও শিখবে।
নীলা: তাহলে তো গভীরতা বলে কিছুই থাকল না। রিসার্চ উঠিয়ে দিতে হবে। স্কিলের সার্টিফিকেট তোমাকে শেখাবে কী করে করতে হয়, কেন করতে হয় তো শেখায় না। ক্রিটিকাল ভাবনা চিন্তা, গবেষণামূলক কাজ, থিওরিটিকাল কাজ কী করে হবে?
নীলাব্জ: ক’জন চায় এসব করতে? সবাই তো মূলত শ্রমিক হতেই চায়। কেন নিয়ে কেউ ভাবে না। ফর্মুলাভিত্তিক জীবন চায় সবাই। তুমিও তাই। তুমুল খাটব, মাস গেলে টাকা আসবে। ফ্ল্যাট কিনব, গাড়ি কিনব, লোন নেব এই করতে-করতে জীবন যাবে কেটে। এত ভেবে কী হবে?
নীলা: ইনোভেশন বা উদ্ভাবনের কী হবে তাহলে?
নীলাব্জ: আমাদের দেশে এসবের খুব একটা মূল্য নেই। উদ্ভাবন হবে আমেরিকা, চায়নাতে, আমরা কপি-পেস্ট করতে পারলেই খুশি, তাই না?
স্কিলের সার্টিফিকেট তোমাকে শেখাবে কী করে করতে হয়, কেন করতে হয় তো শেখায় না। ক্রিটিকাল ভাবনা চিন্তা, গবেষণামূলক কাজ, থিওরিটিকাল কাজ কী করে হবে?
নীলা: ডাক্তারি পড়ার ডিগ্রিও তুলে দিতে চাও তাহলে?
নীলাব্জ: উঠে গেছে ইতিমধ্যে! দেশে যে হাজার-হাজার ডাক্তার পাশ করে বেরোচ্ছে, এরা সবাই আদৌ ডাক্তার? কোটি-কোটি টাকা দিয়ে যে-বেসরকারি কলেজগুলো ডাক্তারি ডিগ্রি দিচ্ছে, এগুলোর কোনও মূল্য আছে? এই হতভাগাগুলো বেরিয়ে কোথায় যাচ্ছে? প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে পঁচিশ-তিরিশ হাজার টাকার মাইনে নিয়ে ঢুকছে। মানে, তুমি ভেবে দেখো, এত কোটি টাকা দিয়ে পড়ে এদের মাইনে হল তিরিশ হাজার টাকা! জমিয়ে ‘উবার’ চালালে এর কাছাকাছি রোজগার করা যায়। একজন ভাল কলের মিস্ত্রীর এর চেয়ে বেশি উপার্জন করে। আর এর চাইতে বেশি এদের কেউ দেবেও না। এরা খুব একটা কাজের না। এর সঙ্গে আবার ইউক্রেন, ইরান হাবিজাবি দেশ থেকে ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরছে আরও একদল সেমি ডাক্তারের দল। নাড়ি পরীক্ষা করতে পারে কি না সন্দেহ। ফিরে এসে এদেরকে আবার কীসব পরীক্ষা দিতে হয় প্রমাণ করতে যে, তাদের ডিগ্রিগুলোর সত্যিই দাম আছে।
নীলা: না, তুমি বলতে কী চাও? তখন থেকে অবান্তর কথা বলে যাচ্ছ! ডাক্তারি ডিগ্রির প্রয়োজন নেই?
নীলাব্জ: পাবলিকের জন্য নেই। তোমার কী মনে হয়, দেশ কীভাবে চলছে? শহরের গুটিকয়েক হাসপাতালে ডিগ্রিধারি ডাক্তার রয়েছে। শহর থেকে একটু বের হও। জোকা ক্রস করো, টাকির দিকে যাও, হুগলির ভেতরে যাও, যে-মানুষগুলো রুগি দেখছে, তারা অধিকাংশ কেউ ডিগ্রিধারী নয়! সব হাতুড়ে! হাতুড়ে দিয়েই দেশ চলছে। হাতুড়ে ডাক্তার বোঝো? জেলায় ১জন ডিগ্রিধারী ডাক্তার হলে, ২০জন হাতুড়ে! এরাই চালাচ্ছে।
নীলা: চলছে বলেই যে সেটা ঠিক তা তো নয়! আর গবেষণার কী হবে? ক্যান্সারের ড্রাগ তৈরি কি হাতুড়ে করবে?
নীলাব্জ: হাতুড়ে তা করতেও চায় না। সে দু’পয়সা রোজগার করে চিল করতে চায়। বললাম যে, বেশির ভাগ মানুষই শ্রমিক টাইপের। লাখে একজন গবেষণা করতে চায়। আর দুনিয়ার নিয়ম হল, ওই একজন করলেই হয়ে যাবে। বাকিরা সব ফলোয়ার। কপি-পেস্ট করে দিন কাটানোর পাবলিক। ডিগ্রি নিয়ে কারোর মাথা ব্যথা নেই। ডিগ্রিটা করেছিল দু’পয়সা রোজগার করার জন্য। যেই দেখবে ওই পয়সা আর ডিগ্রি দেখে আসছে না, ডিগ্রি করাও ছেড়ে দেবে।
নীলা: তুমি যতই তর্ক করো না কেন, সামাজিক মর্যাদা ডিগ্রি দিয়েই আসে। একজন আই.এ.এস-কে কিন্তু আমরা সম্মান করি। তারাই আইন বানাচ্ছে, দেশ চালাচ্ছে।
নীলাব্জ: কিন্তু তাদেরকে প্রতিদিন ইয়েস স্যার বলতে হচ্ছে কোনও অশিক্ষিত মন্ত্রীকে!
নীলা: সে আলাদা ব্যাপার। ডিগ্রি ছাড়া ওপরে ওঠার উপায় নেই। ধাপে-ধাপে এগোতে হবে। বড়-বড় কর্পোরেটদের মাথায় যারা বসে, তারা কি ‘ক’ অক্ষর গোমাংস? তাদের ডিগ্রির পর ডিগ্রি। পি.এইচ.ডি করেছে আবার এম.বি.এ-ও করেছে! ডিগ্রি না থাকলে, একটা জায়গার পরে আটকে যাবে। আমাদের সিস্টেমটা সেভাবেই তৈরি।
নীলাব্জ: ওহ্! তুমি বারবার দেশের একশোজনের কথা বলছ। কোটি-কোটি মানুষ এসব চায় না। কোনওরকমে একটা স্কিল শেখাও তাদের, দিয়ে চাকরিতে ঢুকিয়ে দাও। ডিগ্রি-ফিগ্রি ছাড়ো! ওরা ওই করেই খুশি। দেশেরও লাভ। ফালতু-ফালতু তিন-চার বছর কলেজে গিয়ে কিছুই না শিখে বেরিয়ে হতাশ হওয়ার চাইতে, এক-দু’বছরে কিছু একটা স্কিল শিখুক জনতা। কাঠের কাজ শিখুক, কলের কাজ শিখুক, হাতের কাজ কিছু! এতগুলো বাংলায় বি.এ, অঙ্কে পি.এইচ.ডি নিয়ে কী হবে?
নীলা: আশ্চর্য কথা বলছ তুমি! দেশ জুড়ে শ্রমিক বানাতে চাইছ! কোনও উচ্চ শিক্ষায় তোমার মন নেই। আজ যদি এ.আই এসে সবার এই স্কিলগুলো খেয়ে নেয়? যদি রোবট এসে এই কাজগুলো করে দেয়? তখন তাদের কী হবে?
নীলাব্জ: যারা গবেট, তারা রাস্তায় আসবে আর এদের মধ্যেই যাদের ঘটে কিছু আছে, তারা বিকল্প কোনও পথ ঠিক খুঁজে নেবে।
নীলা: মানুষ বেকার থাকলে কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার! হাতে অনেক সময়, কিন্তু কিছু করার নেই! সমাজের জন্য বিপদ!
নীলাব্জ: সবাইকে চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। মেনে নাও! ডিগ্রি থাকুক বা না থাকুক। সব সময়ে সমাজে বেকার থাকবে। এরাই ব্রিগেড যাবে, সিনেমাহলের সামনে নায়কের গলায় মালা পরাবে, নায়ক মরলে দলে-দলে রাস্তায় নামবে, রাজনৈতিক দলের হয়ে গুন্ডামি করবে, কুম্ভমেলায় ডুব দেবে জলে। যার চাকরি আছে সে পারবে এই কাজগুলো করতে?
নীলা: ও বাবা, কুম্ভমেলাকে এর মধ্যে ফেলো না, বড়-বড় কর্পোরেটরা প্রচুর ডিগ্রি নিয়েও চাকরিতে ছুটি নিয়ে ছুটছে। তুমি বড্ড ঘেঁটে ফেল সবকিছু। আমি বলতে চাইছিলাম, সব কাজ স্কিলভিত্তিক নয়। জ্ঞানের একটা বড় জায়গা রয়েছে আমাদের সমাজে। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান— পদার্থবিদ্যা, গণিত, রসায়ন, জীববিজ্ঞান— এখানে প্রয়োগ করার আগে তত্ত্ব বোঝা জরুরি। যেমন, কোয়ান্টাম মেকানিক্স শুধু হাতে-কলমে শেখা যায় না। মানবিক ও সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি বিশ্লেষণ ও চিন্তননির্ভর বিষয়। এখানে ‘দক্ষতা’ (যেমন লেখার কৌশল বা ডেটা বিশ্লেষণ) সহায়ক হলেও, মূল জোর থাকে ধারণা ও সমালোচনায়। শুধু ‘লিগ্যাল ড্রাফটিং’ শিখে, একজন আইনজীবী তৈরি হয় না। হাতে-কলমে দক্ষতা যেমন জরুরি, তেমনি রোগ, দেহতত্ত্ব, জীবরসায়ন ইত্যাদির গভীর জ্ঞান ছাড়া চিকিৎসা অসম্ভব। ছোট কোর্সে সেটা শেখা যায় না। আর কত বলব?
নীলাব্জ: উফ! তুমি যে এত ডিগ্রির পক্ষে আগে জানতাম না! আমি তোমাকে বলতে চাইছি, একটাই কথা। এইসব জিনিস অল্প কিছু মানুষের জন্যেই! বাকি জনতা শ্রমিক। এদের স্কিল শেখাও! জ্ঞান এরা চায় না! দিলেও বুঝতে পারবে না সবাই।
নীলা: কিন্তু যারা ডিগ্রি করে বেরোচ্ছে, তাদের চাকরি হোক! তাদেরকে দরকার সমাজের।
নীলাব্জ: বললাম তো, সবাইকে চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। সবাই ডিগ্রি নিয়ে বেরচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সবার ডিগ্রি পাওয়ার যোগ্যতা নেই। সিস্টেমে গণ্ডগোল আছে।
নীলা: তুমি আসলে উন্নত সমাজ চাও না।
নীলাব্জ: উন্নত সমাজ সম্ভব নয়! সবার মাথায় অত বুদ্ধি নেই। জ্ঞানের কথা শুনলেই সবাই পালায়। কোনও রকমে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারলেই মানুষ খুশি। তুমি থাকো তোমার বুদবুদের ভেতরে!
নীলা: বেশ, আমি তাই-ই থাকব! তুমি থাকো তোমার শ্রমজীবী সমাজ নিয়ে।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী




