আসছে-আসছে করে প্রায় এসেই পড়েছে। যদিও আকাশের মুখ ভার, অভিমানী বৃষ্টি হঠাৎ হঠাৎ— তবু মাঝেমধ্যেই টুক করে উঁকি দিয়ে ফেলছে শরতের নীল আকাশ আর ছোটবেলার রচনায় লেখা আমাদের চির-পরিচিত পেঁজা তুলোর মত মেঘ।
‘জলবায়ু সংকট’ একশো ভাগ সত্যি, (এবং তার হাতে-নাতে প্রমাণ মিলছে মাঝে-সাঝেই) কিন্তু সেই সঙ্গে এও সত্যি যে, পুজো এসে গিয়েছে আমাদের দোরগোড়ায়। আমাদের প্রিয় দুর্গা পুজো, আমাদের একান্ত আপন উৎসব। একথা ঠিক যে, সময় বদলেছে, বদলেছে মানুষের জীবন-যাপনের ধরন। সেই সঙ্গে বদলেছে, আমাদের উৎসবের চেহারাও। বিগত বেশ কয়েক বছরে জাঁকজমক তো বেড়েছেই— ‘থিম’এর বাড়াবাড়ির সঙ্গে-সঙ্গে কার পুজোয় কত চমক তাই নিয়ে প্রতিযোগিতার শেষ নেই। আর হাজারো পুরস্কারের প্রলোভন তো আছেই। পঞ্চমী অব্দি প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে মায়ের মূর্তি এসে গেলও, তাঁর মুখ ঢেকে রাখা, ষষ্ঠীর দিন আরতির সময়ে মায়ের হাতে অস্ত্র প্রদান— সেই সবের দিন গেছে। এখন মহালয়া থেকেই বেশিরভাগ প্যান্ডেল রেডি, রাস্তায় মানুষের ঢল। আন্তরিকতা ঢেকে গিয়েছে আড়ম্বরে, সে-কথা টের পেয়েছে সকলেই। তবু তো পুজো! মা’এর, মেয়ের ঘরে ফেরা। আবার কারও-কারও, মায়ের কাছে ফেরা। চেনা গন্ধে, চেনা বইয়ের তাকে, চেনা নরম বালিশের আশ্বাসে ফেরা। সকলের বাড়ি ফেরার সময়।
আরও পড়ুন: দুর্গাপুজোয় মেয়েদের ভূমিকা কি বিপ্লবের ময়দানে সেবাদাসীর মতো? লিখছেন প্রহেলী ধর চৌধুরী…
আসলে পুজো বললেই ছোটবেলায় ফিরতে ইচ্ছে করে সবারই। একটু অতীত ছুঁয়ে দেখা। এইটুকু পড়েই অনেকে হয়তো বলবেন, বাঙালিরা এই নস্টালজিয়া করে করেই মরল। তবু বাঙালি-মাত্রই জানে, বয়েস যতই বাড়ুক, আর হাঁটুর জোর যতই কমুক— নস্টালজিয়া ছাড়া দুর্গাপুজো অসম্পূর্ণ। একথা কিন্তু জানে আপনার ‘অ্যালগোরিদম’ও। তাই তো একটু ফোন ঘাঁটলেই উঁকি দেয় পুরনো ‘শালিমার’এর বিজ্ঞ্যাপন, কোকা-কোলা’র ‘সপ্তমীতে প্রথম দেখা’ বা মেট্রোর চিরাচরিত ট্যাগলাইন ‘ঘন তাজা, দুধের রাজা!’ – সেই এক্কেবারে ছোটবেলায় যেমন হত। হাজারো নতুন বিজ্ঞাপন বাজারে এলেও পুরনোর সুর’ই কানে বাজে বেশি। কারণ আগমনীর সঙ্গে সেই সব সুর ওতপ্রোত জড়িয়ে গিয়েছে।
তবে সত্যিই অস্বীকার করার উপায় নেই— সময় বদলেছে, সঙ্গে বদলেছে মানুষের যাপন ভঙ্গিমাও। এখন অনেকেই পুজোর ক’টা দিন নিজের শহরে বা বাংলায় কাটাতে চায় না। বেড়িয়ে পড়ে হই-হট্টগোল, এলইডি ব্যানারের চমকে দেওয়া আলো আর ঢাকের শব্দ ছাড়িয়ে দূরে কোথাও— নির্জনে, একান্ত যাপনে, বা আপনজনের সঙ্গে সময় কাটাতে। কথায় আছে, ‘ভ্রমণ-পিপাসু বাঙালি’। সারা বছর-ই তাদের পায়ে সর্ষে লেগে আছে। সুটকেস, ব্যাকপ্যাক সর্বদা রেডি। ঠাট্টা করে হলেও মানুষ বলে থাকে, ‘যদি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়েও দেখতে পান, আপনি ছাড়া আরো কেউ বেড়াতে এসেছে, তবে সে নির্ঘাত কোন বাঙালি’। তাই দেশে-বিদেশে বেড়াতে গিয়েও নিজের মাতৃভাষা কানে আসে, ঠোঁটে ফুটে ওঠে ক্ষনিকের হাসি। আলাপ বিনিময় হয়,— ‘কোথা থেকে আসছেন’? ওহ আমরাও তো কাছাকাছি’ই থাকি!’
এখন প্রশ্ন হল, যারা সারা বছরই কোথাও-না-কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে, তারা এই উৎসবের ক’দিন কেনই-বা নিজের বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকতে চাইবে? স্রেফ রাস্তায় উপচে পড়া ভিড় আর দমবন্ধ আড়ম্বর থেকে দূরে থাকতে? খানিকটা হয়তো তাই, তবে অনেকটা তা নয়ও। আজকাল বেশিরভাগ মানুষই কর্পোরেটজীবী। পুজোয় একসঙ্গে বেশ ক’টা দিন ছুটি পাওয়া যায়। তাই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে শহর থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে অনেকেই। আবার অনেকেরই এই পুজোর কোলাহল, রাস্তায় মানুষের ঢল এক্কেবারে না-পসন্দ। বাড়ি থেকে বেরোতে পারা যায় না। লাউড-স্পিকারের ঠেলায় কানে তালা লাগার জোগাড়। তাদের জন্য শহর ছাড়িয়ে কোন নির্জনতাই পছন্দমতো ছুটি কাটানোর উপায়। তবে এই প্রবণতা মূলত শহরের মানুষদেরই। মফস্সল বা গ্রাম-বাংলার বেশিরভাগ পুজোই ছিমছাম। সেখানে প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে বন্ধুদের আড্ডা, ভোগের খিচুড়ি— অনেকটা আগের মতোই উপাদেয়। তাই পুজোয় বাংলা ছেড়ে দূরে যাওয়ার কথা বেশিরভাগ মানুষই ভাবতে পারে না।
আমরা যদি তিন দশক পিছিয়ে যাই, তখনও কিন্তু পুজোয় শহর ছেড়ে যাওয়ার এত হিড়িক ছিল না। কিছু মানুষ হাওয়া-বদল করতে যেত বটে, তবে তা নেহাতই হাতে-গোনা। বারোয়ারি পুজোগুলো তখনও ‘থিম’এর নেশায় মত্ত হয়ে ওঠেনি। পরিবারগুলো তখনও বদ্ধ দেওয়ালের ভেতরে গুটিয়ে যায়নি। মাসি-পিসি-মামাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। একটাই অ্যাম্বাসাডরে ৮-৯জন ঠেসে-ঠুসে ঠাকুর দেখার রেওয়াজ ছিল। বিজয়ায় ঘুগনি, মিষ্টি তো ছিলই। আসলে এই সবটা জুড়ে ছিল সামগ্রিক উৎসবের আনন্দ। তাহলে বদলাল কী? অনেক কিছু। পরিবার শব্দটার মানেই তো বদলে গিয়েছে। বেশিরভাগই একক পরিবার। মা-বাবা’র চাকরি, ছেলে-মেয়ের স্কুল-টিউশন। অগত্যা পুজোর ক’টা দিন হাঁপ ছেড়ে বাঁচা বই তো নয়! তার মধ্যেও যদি থাকে ভিড় আর কোলাহোল তবে শান্তি পায় কোথায়? তাই পুজোর মাস তিনেক আগে থেকেই খোঁজ শুরু। পাহাড়ের কোলে? সমুদ্রের ধারে? জঙ্গলে ঘন ছায়ায়? নাকি পুরনো কোন শহরের ইতিহাসের পাতায়? এবারের গন্তব্য কোথায়?
কিন্তু বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করা— সে হ্যাপাও তো কম নয়। সময় থাকতে টিকিট বুক না করলেই ওয়েটিং লিস্টের খপ্পরে পড়তে হবে। আবার মুশকিল হল, যেখানে অনেক মানুষই বেড়াতে যাচ্ছে ঠিক এই সময়টা বেছেই— তখন চিরাচরিত কাছাকাছি ঘুরতে যাওয়ার জায়গাগুলোতেও কম ভিড় নয়। সেই বুঝে টিকিটের দামও হচ্ছে আকাশছোঁয়া। এক বন্ধু পুজোর সময়ে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিল। ফিরে এসে জানাল – সেখানকার ম্যাল রোড আর একডালিয়া-র পুজোর ভিড়ে বিশেষ তফাৎ নেই। তাই যারা পুজোয় বেড়াতে যাবে বলে স্থির করে, তাদের জায়গা বাছতে হয় বুঝে-শুনে, টিকিট কাটতে হয় সময় থাকতে, তবেই পুজোর ক’টা দিন শহুড়ে হুল্লোড়, জ্যাম আর ঘাম থেকে মুক্তি মেলে।
আবার অনেকেরই এই পুজোর কোলাহল, রাস্তায় মানুষের ঢল এক্কেবারে না-পসন্দ। বাড়ি থেকে বেরোতে পারা যায় না। লাউড-স্পিকারের ঠেলায় কানে তালা লাগার জোগাড়। তাদের জন্য শহর ছাড়িয়ে কোন নির্জনতাই পছন্দমতো ছুটি কাটানোর উপায়। তবে এই প্রবণতা মূলত শহরের মানুষদেরই।
আগেই বলেছি, পুজো মানে বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া শুধু নয়, অনেকের কাছে বাড়ি ফেরাও। তারা সারাবছর হয়তো এই ক’টা দিনের জন্যই অপেক্ষা করে থাকে। ছেড়ে যাওয়া আড্ডা, ছোটবেলার বন্ধু আর মায়ের হাতের রান্নার কাছে ফিরবে বলে। যে-সময়ে দুগ্গা মা ফেরেন বাপের বাড়ি, সেই সময়ে তাদেরও বাড়ি ফেরার পালা। দূরের কোনও শহর বা শহরতলি থেকে যেখানে চাকরি বা পড়াশোনার রোজকার জীবন শুধু একঘেয়ে নয়, খানিক দমবন্ধ করাও। তাদের কাছে উৎসবের আমেজ আর বাড়ি ফেরার আমেজ মিলেমিশে এক হয়ে যায়। এই সময়ে শহরটা আলোয়-আলোয় সেজে ওঠে। নিঝুম অন্ধকার গলিগুলোও যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে। ঢাকের শব্দে ঘুম ভাঙে রোজ। ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখা হোক না হোক, এই পুজোর আমেজটুকু তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করতে চায় অনেকেই।
এই দু-ধরনের মানুষের কাছেই পুজো মানে নিজের মনের মতো করে সময় কাটানো, আনন্দ করে নেওয়া। তারপর তো ফিরতেই হয় সেই রুটিন-মাফিক জীবনে। মা দুর্গাও তাঁর ছানাদের নিয়ে বাপের বাড়ি আসেন— ছুটি কাটাতে, কয়েকদিনের আমোদ-আহ্লাদ করবেন বলেই তো! তাঁরও ছুটি, সেই সঙ্গে আমাদেরও। ভারতের বেশিরভাগ অংশ ‘সনাতন’ ধর্মে ছেয়ে গেলেও, বাঙালির কাছে দুর্গা পুজো আজও উৎসব। নিয়মের কোনও কড়াকড়ি নয় – বরং নিয়ম ভাঙারই সময় এই ক’দিন। পড়াশোনা মুলতুবি, রাত জেগে ঠাকুর দেখা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, যা ইচ্ছে খাওয়ার স্বাধীনতা, ছুটিতে নিজের শহরে না থাকার স্বাধীনতা। অর্থাৎ সারা বছর যা-যা করা যায় না, বা করা হয়ে ওঠে না, তারই চাবিকাঠি এই পুজো। দুগ্গা মা সেজে ওঠেন মায়েদের যত্নে। তাঁকে ঘিরেই এত আনন্দ-আয়োজন। আবার বিশ্বের অন্যতম শিল্প উৎসবও তাঁকে উপলক্ষ করেই।
অন্য সবরকম পুজো’র মাঝে বাঙালিদের অন্যরকম পুজো। যে-পুজোয় আনন্দ করতে কারও বাধা নেই। দুর্গা পুজোয় আমরা যে শুধু নিজেদের ভাল চাই, ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি, শুধু এমনটাও নয়। সে তো আমাদের বাড়ির মেয়ে! তাই বিদায়বেলায় তাঁকেও আদর করে দিই, মিষ্টিমুখ করিয়ে দিই। কানে কানে বলি— ‘ভালো থেকো মা, আসছে বছর আবার এসো।’ কারণ এই উৎসবই সবার ভাল থাকার, আলোয় বাঁচার মূল রসদ।