সলিলসংগীত

Salil Chowdhury

পাঁচের দশকের প্রথম দিক। কোদালিয়া গ্রামের এক সাতাশ-আঠাশ বছরের সাদামাটা যুবক চললেন বম্বে। ইতিমধ্যে তাঁর একের-পর-এক গণসংগীত উত্তাল করেছে বাংলাকে, সেই আগুনের আঁচ পেয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সৃজনশীল এবং চিন্তাশীল মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলনের জন্য তাঁর বাঁধা গান ‘আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি’ পেয়েছে শ্রেষ্ঠ শান্তি সংগীতের পুরস্কার। সোভিয়েত কিংবদন্তি চেরকাসভ থেকে পুডোভকিন তাঁর গানের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত।

এহেন যুবক বম্বে যাচ্ছেন, কিন্তু মিউজিক কম্পোজার হিসেবে নয়। তিনি চললেন তাঁর এক গল্প নিয়ে, যা থেকে ছবি করবেন বিমল রায়। মার্ক্সবাদে দীক্ষিত এই কর্মী তাহলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পিঠে ছোরা মেরে, বুর্জোয়া উৎপাদন শিল্পের সঙ্গে আপোষ করে কেরিয়ার করতে বম্বে চললেন! চোখ রাঙানি শুরু হল কিছু তাত্ত্বিক ড্রয়িংরুম পলিটিক্স করা নেতাদের। প্রতিক্রিয়াশীল তকমা দিয়ে পার্টির কাজে নিষিদ্ধ হল সলিলের বেশ কিছু গণসংগীত। কেন সলিল গাঁয়ের বধুর ‘আশাস্বপনের সমাধি’ ঘটিয়েছেন? পালকির গানের শেষে, পালকি-বাহকদের সুরে এতো ক্লান্তি হলে, শ্রমজীবী মানুষ কীভাবে উদ্দীপ্ত হবে? আয় বৃষ্টি ঝেপে গানে ‘হায় বিধি’ শব্দবন্ধের মাধ্যমে সলিল ভাগ্যবাদের প্রচার করেছেন— এমন নানা অভিযোগ দায়ের করল রনদিভে পিরিয়ডের কিছু নেতারা।

আরও পড়ুন: উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ-র নিটোল গল্প বলার ধরনই বেজে উঠত তাঁর সেতারে! লিখছেন তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার…

পার্টি সেল মিটিঙে এর জোরদার জবাব দেন সলিল। একজন মার্ক্সবাদে দীক্ষিত শিল্পী তার শিল্পের মাধ্যমে কি শুধুই পার্টির উপরতলার নির্দেশ প্রচারের কাজ করে যাবে? তার কি নিজস্ব কোনও বক্তব্য থাকতে পারে না? তার আশা-আকাঙ্ক্ষা ভালবাসা-বিরহের কথা? সেসব গানও যে সেই সময়ে সলিলের বেশ কিছু লেখা হয়ে গেছে। সে-সব ভাবের প্রকাশ না ঘটলে শিল্পীর পূর্ণতা আসবে কীভাবে? সলিল বলেছেন, সত্যিকারের ভাল গান কোনও বিশেষ সময়ের জন্য লেখা হলেও, তার আবেদন সর্বজনীন। ভিক্টর হুগোর কথাটা মনে রাখা দরকার— Music express that which cannot be said and on which it is impossible to be silent.

বাবার মৃত্যুর পর, বড় সংসারের চরম আর্থিক দুরাবস্থার চাপে সলিল পাড়ি দিলেন বম্বে, কিন্তু নিয়ে গেলেন তাঁর এমন এক গল্প (রিক্সাওয়ালা) যাতে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সামন্তবাদ থেকে আমাদের দেশে পুঁজিবাদের বিবর্তন ঘটল। সলিল জানেন, Once a Marxist, always a Marxist. আর এই চেতনা যে তাঁর সঙ্গে শ্মশান পর্যন্ত যাবে সেই বিশ্বাস ছিল সলিলের।

বম্বেতে গিয়ে সংগীতকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও, সলিল তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তাঁর বিভিন্ন গানে ফিরে-ফিরে এসেছে সেই শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন, সাধারণ মানুষের প্রতি বিশ্বস্ততা। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল এবং জ্যাজের প্রয়োগে তাঁর সংগীতে এল পলিফনি যা জীবনের বহুমুখীতার রূপক। এই বিষয়ে ১৯৫৪ সালে বম্বের আইপিটিএ কনফারেন্সে সলিল এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মধ্যে বেশ জোরালো ডিবেট হয়। হেমাঙ্গের বক্তব্য, বিদেশি বাজনার প্রয়োগে সলিলের গণসঙ্গীত দেশজ ভাব হারাচ্ছে। সলিলের জবাব, নিউটন ইংল্যান্ডে বসে গ্র্যাভিটেশন আবিষ্কার করেছে বলে আমরা তো বলতে পারি না যে, আমরা এই বিদেশি বিজ্ঞান মানব না! চিত্রকলায় অবন ঠাকুরের থার্ড ডাইমেনশন আনা, সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ, ছোট গল্প ইত্যাদি বিদেশি ফর্ম যদি আমরা গ্রহণ করতে পারি তাহলে সঙ্গীত কী এমন দোষ করল, যে তাকে অচলায়তনে থাকতে হবে?

ইওরোপে মনোফনিক গ্রেগোরিয়ান চান্টের চার্চ একসময় হারমোনিকে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু আটকে কি রাখা গেল? হারমোনি জন্ম দিল বাখ, মোৎজার্ট, বেঠোফেন, ডেবুসির। তাঁদের সৃষ্টির অনুপ্রেরণায় থ্রি পিস ভোকাল হারমোনি এবং কাউন্টারপয়েন্টের প্রথম প্রয়োগ ঘটালেন সলিল বাংলা গানে। সবিতা চৌধুরীর গাওয়া ‘সুরের এই ঝরঝর ঝরনা’ গানটি বাংলা গানের এক নতুন অধ্যায় সূচনা করল।

‘বিছুয়া’ গানের সুর, বাঁশি আর মাদলের মাদকতা আসলে সলিলের এই একেবারে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের জীবনযাত্রা আত্মস্থ করার মহাপ্রসাদ। ঠিক যেমন গঙ্গা ছবির ‘গঙ্গা গঙ্গার তরঙ্গে’ গানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মাছমারাদের জীবনযাত্রা জলজ্যান্ত হয়ে শ্রোতাদের ভাসিয়ে নিয়ে চলে গঙ্গার উজানে।

‘একদিন রাত্রে’ ছবিতে এক মাতালের মাতলামির গান ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়’-তে সলিল ফক্সট্রট মিউজিক ফর্মে তুলে ধরলেন নব্য স্বাধীন সুবৃহৎ গণতন্ত্রে টাকার তুলনায় মানুষের কলজের অকিঞ্চিৎকর বাজারি মূল্য। মধুমতী ছবির গানে সলিল প্রয়োগ করলেন তাঁর শৈশবে আসামের চা বাগানের কুলিদের আসরে শোনা বিহু সংগীত। ‘বিছুয়া’ গানের সুর, বাঁশি আর মাদলের মাদকতা আসলে সলিলের এই একেবারে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের জীবনযাত্রা আত্মস্থ করার মহাপ্রসাদ। ঠিক যেমন ‘গঙ্গা’ ছবির ‘গঙ্গা গঙ্গার তরঙ্গে’ গানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মাছমারাদের জীবনযাত্রা জলজ্যান্ত হয়ে শ্রোতাদের ভাসিয়ে নিয়ে চলে গঙ্গার উজানে। যৌবনকালে খেপুদা এবং হরিধনদার মতো গুরুর সঙ্গে এসব অঞ্চলে মজে যাওয়া বিদ্যেধরী নদী সংস্কারের মতো কাজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই সলিলের এই সাংগীতিক বোধের শিকড়। আর সেই শিকড় থেকে তাঁর শাখাপ্রশাখার বিস্তার ঘটিয়েছে গণনাট্য সংঘের কনফারেন্সে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লোকশিল্পীদের সংস্পর্শে আসার অভিজ্ঞতা।

জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে এক সুরে বাঁধা— এই চেতনার তাগিদে সলিল তৈরি করলেন দেশের প্রথম সেকুলার কয়ার— বম্বে ইউথ কয়ার। ভারতের তাবড়-তাবড় সংগীত-শিল্পীদের তিনি সংঘবদ্ধ করলেন। লতা মঙ্গেশকরের মতো তারকা শিল্পী তাঁর চেয়ে অনেক কম পরিচিত দ্বিজেন মুখার্জির গাওয়া ‘এয় দিল কাঁহা তেরি মঞ্জিল’ গানে কোরাসে গলা মেলাচ্ছেন, এই অসম্ভব কাণ্ড সলিল চৌধুরী এবং তাঁর বম্বে ইউথ কয়ারের হাত ধরেই সম্ভব হয়েছিল। সলিল যে লতার সঙ্গে বাংলাতেই কথাবার্তা বলতেন, লতাকেও যথাসম্ভব বাংলা বলতে উৎসাহিত করতেন।

এহেন সলিল চৌধুরী পরিণত জীবনে এক অদ্ভুত শ্যামাসংগীত রচনা করেছিলেন, ‘কারণ অকারণের বেড়া’— যাতে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এবং ভক্তিরস— দুই বিপরীত মেরুর অসামান্য স্যাটায়ারিকাল মেলবন্ধন তিনি ঘটালেন। পাঁচালিকার দাশরথি রায়ের প্রভাব কোন চোরাপথে সলিলকে দিয়ে এই গানের কথায় দুর্দান্ত কিছু অনুপ্রাসের ব্যবহার করিয়ে নিল। এই গানের গায়ক মান্না দে বলেছিলেন, এমন ভক্তিগীতি সলিল ছাড়া আর কে বানাবেন! কলেজ জীবনে আইএনএ-র যুদ্ধবন্দীদের বিচারের প্রহসনের বিরুদ্ধে সলিল যে গণসংগীত বেঁধেছিলেন এই ভক্তিগীতি কীর্তনের ফর্মে—‘বিচারপতি তোমার বিচার’।

রবীন্দ্রনাথের ‘ময়নাপাড়ার মেয়ে’কে সলিল আবিষ্কার করেছিলেন তেতাল্লিশের মন্বন্তরের এক দুর্ভিক্ষপীড়িতা মেয়ের মধ্যে। এর থেকে সৃষ্টি হয়েছিল সুচিত্রা মিত্রের কন্ঠে সলিলের ‘সেই মেয়ে’ গান। জীবন সায়াহ্নে সেই ময়নাপড়ার মেয়েকে আবার সলিল ফিরিয়ে এনেছেন ছোটদের গানে। আয় ছুটে রে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে— অন্তরা চৌধুরীর কন্ঠে, এই গানে সলিল বাচ্চা মেয়েটিকে দিয়ে ময়নাপাড়ার মেয়ের হাতে তুলে দিচ্ছেন পুজোর নতুন জামা। সাধারণ মানুষের প্রতি বিশ্বস্ততা— সলিলের সারা জীবনের পুঁজি। এতে ভরসা করেই সলিল বম্বের এক বুটপালিশওয়ালা পান্ডুরাংকে একজন প্রতিষ্ঠিত ম্যান্ডোলিন বাদক করে তুলেছিলেন।

বেঠোফেন তাঁর তৃতীয় সিম্ফনি ‘Eroica’ প্রথমে উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর নায়ক নেপোলিয়ানকে। কিন্তু সেই নেপোলিয়ান যখন গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করলেন তখন সেই প্রতিবাদে বেঠোফেন তাঁর সিম্ফনির স্কোরে নেপোলিয়নের নাম কেটে উৎসর্গ করলেন— To any hero. সলিল বেঠোফেনের এই স্কোরের একটা কপি নিজের কাছে রাখতেন। বেঠোফেনের সেই কাটা দাগ থেকে সলিল প্রেরণা পেতেন নিজের প্রতিবাদের ভাষা আর প্রতিরোধের আগুনকে জ্বালিয়ে রাখার।

সাতের দশকের শেষদিকে দেশজোড়া বেকারত্ব এবং এমার্জেন্সির আস্ফালন শুরু হল। সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলন ভেঙেচুড়ে চিন আর সোভিয়েত একে অপরের শত্রু হয়ে উঠল, ভারতের সাংস্কৃতিক জগতে প্রবেশ ঘটল ভিন্ন রুচির। ক্যাবারে জাতীয় সংগীতে পড়ল অপসংস্কৃতির ছাপ। বিরক্ত সলিল লিখলেন— ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও, আমি নেমে যাব।’ বম্বে ছেড়ে সলিল ফিরে এলেন কলকাতায়— যে কলকাতা তাঁকে দিয়েছে রাজনৈতিক চেতনা, দেশকে মানুষকে ভালবাসতে শিখিয়েছে, নতুন চেতনার গান সৃষ্টি করতে শিখিয়েছে, সব রকমের সংকীর্ণতাকে জয় করতে শিখিয়েছে, শিল্পী হতে শিখিয়েছে। বন্ধু সুকান্তর মত সলিলের বলতে ইচ্ছে করেছিল— কলকাতার প্রতিটা রাস্তায়, প্রতিটা ফুটপাতে, অলিতে-গলিতে, ঘরে-ঘরে আমার ঠিকানা লেখা আছে।

সলিলের ভাষায়, ‘আমি শুধুমাত্র বহু মানুষের প্রতিফলনের সমষ্টি। আমার অস্তিত্ব, আমার ক্রিয়াকলাপ, আমার প্রকাশ, আমার সৃষ্টি বহু মানুষে যা-যা প্রতিক্রিয়ার পলিফনি তৈরি করেছে, আমি শুধু সেই পলিফনিতে নিজেকে যাচাই করেছি। এ-ছাড়া আমার আর কোনও অস্তিত্ব নেই।… দুঃখ, যন্ত্রণা, অবহেলা, প্রেম, স্নেহ, ভালোবাসা, নিন্দা, যশ— সবকিছু কুড়োতে-কুড়োতে ঝুলি ভরেছি, আবার একদিন দেখেছি ঝুলিটাই হারিয়ে গেছে। সঞ্চয় আমার কোনওদিনও কুষ্ঠীতে লেখা নেই।’ এমন স্রষ্টাই তো লিখতে পারেন—  

‘আমি সপ্তসিন্ধু পার হয়ে
গোষ্পদে বাঁধা পড়ে গেছি
বলো না কী করে চলব!’