আলোর নিশানা

representative image

যুবকের নাম বিজয়, মা আয়ারল্যান্ডের, বাবা কলকাতার। প্রেম, বিয়ে, জন্ম— সবটাই বিদেশে। বিজয় আমেরিকান একটা জাহাজের হেড শেফ, বহু মাতাল মদ খেয়ে মুখের বুলিতে বিশ্বভ্রমণ করে, আর বিজয় সারা পৃথিবী ঘুরে-ঘুরে মদ খেয়েছে, ফলে ২৬ বছরেই ট্রিটমেন্ট সেন্টারে।

দিনে দেড়-দু’বোতল মদ আর কুড়ি থেকে পঁচিশটা রথম্যান সিগারেট খাওয়া রাজার ছেলে, এমন এক সেন্টারে এল, যেখানে মাটিতে একটা তোশক, তার ওপর সস্তা চাদর— আর সারা পৃথিবীর ম্যাপ আঁকা বালিশ মাথায় ঘুম দিতে হয়, নেশা বলতে গুনে-গুনে ছ’টা বিড়ি। সেই বিড়ির ক্লাইম্যাক্স অবধি যেতে, দু’আঙুলে ফোস্কা পড়ে গেছে, ইংরেজিতে যত গালাগাল আছে, সারাদিন বলে যাচ্ছে বিড়বিড় করে; প্রশাসন বা বাকি পেশেন্ট, কেউ এর মানেও বুঝছে না, জানলা দিয়ে আকাশ দেখে আর কাঁদে, কারণ এখন ও রিহ্যাবে।

আরও পড়ুন: মেয়েরা পর্দায় আসে কেবল মিনমিনে নাচ আর তুলতুলে সংলাপ নিয়ে? লিখছেন উদয়ন ঘোষচৌধুরি

রিহ্যাব সেন্টার। এর বাঙলা মানে করলে জেলখানা। আমি কখন ঘুমোব, আমি কখন পটি করব, স্নান করব, কটা রুটি খাব— সব ঠিক করে দেবে অন্য লোকে! বলছি মাথা ধরেছে, বলছে বাবলা গাছে পিঠ ঘষে আয়, সেরে যাবে; এর নাম ট্রিটমেন্ট! বিজয়ের পেট ভরত না, আড়ালে গিয়ে ভাতের মাড় নুন দিয়ে খেয়ে নিত ঢকঢক করে, যত রুগি, সবার একটাই গান, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম…

কে হৃদয় জুড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে? কপাল দোষে শুধু বাঙলা বোঝা ‘আমি’-র জায়গা হল ওর পাশের তোশকে। ফলে শুতে এসে মনে হয়, পাশে বিবিসির খবর চলছে— তবু দোস্তি হয়। বিড়িতে কাউন্টার। এখন আমাদের বারোটা বিড়ি, আধাআধি খাই, ওর ফোস্কা সারতে থাকে, বাঙলা বলা বাড়তে থাকে। মায়ামি আর মন্দারমণির দূরত্ব কমতে থাকে। কতদিন? এক হপ্তা, তারপর দেখা গেল, আমরা দু’জন হাঁদা-ভোঁদা জুটি হয়ে, কেল্টুদা নামের কর্তৃপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টায় আছি দিনরাত, তারও দিন দশেক পরে, আমরা দু’জন প্রশাসকের সবচেয়ে কাছের। ততদিনে রিহ্যাবের আকাশ থেকে, মেঘ সরে-সরে যাচ্ছে।

আমার মতো নেশার আসক্তিতে যারা জড়িয়েছে, তাদের জন্য রিহ্যাব কিন্তু উপযুক্ত ঠিকানা, কথায় বলে, ‘দানে-দানে পে লিখা হ্যায় খানে ওয়ালে কা নাম’; যখন নেশা করেছি, ভাতের থালা নিয়ে মা অপেক্ষা করেছে, সে খাবার নষ্ট হয়েছে, একটু অপছন্দ হলেই, থালায় পেনাল্টি প্র্যাকটিস; নেশা ছাড়ার মুহূর্তে খিদে যখন হাঁ মুখ বার করেছে বহুদিন পর, তখন গুনে-গুনে রুটি, বাটি মেপে ভাত-ডাল, ঈশ্বর অলক্ষ্যে সলিলের মতো ডায়লগ দেন, দেখ কেমন লাগে! নেশা মুক্তি পুনর্বাসনে থেকেছি, তাই জানি— ওটা আদপে খায় না মাথায় মাখে। রাজার ছেলে থেকে কেরোসিন তেলওয়ালা— সবার জন্য এক ব্যবস্থা। তুমি হরিদাস তাই তোমার জন্য নরম গদি, দুটো রুটি বেশি— এসব গল্প নেই, সবার শুধু নাম আর পদবীর প্রথম অক্ষর লেখা তালিকায়, কোনও জাতও নেই আমাদের, আমরা বজ্জাত, আমাদের একটাই পরিচয়, আমরা সবাই নেশাড়ি, আর নেশা ছাড়তে এসেছি। কতদিন নিয়ম করে দাঁত মেজেছি, স্নান করেছি? কতদিন নিয়ম করে ঘুমিয়েছি?

রিহ্যাব কী? যেতে পারি কিন্তু কেন যাব?, সংযম কথাটার মানে বোঝায়, ঘড়ি শুধু হাতের অলংকার নয়, সময়ের কাজ সময়ে করতে শেখায়। একটা নিয়মের মধ্যে থাকাটাও বাস্তবিক এটা বুঝতে শেখায়, দিনের শেষে, সামাজিক থাকাটাও তো জরুরি।

একটা অনিয়ন্ত্রিত জীবনকে সামাজিক করতে, রিহ্যাবের দিনগুলো খুব জরুরি ছিল আমার মতো অনেকের কাছে। কী হত সেখানে? রোজ পাঁচটা পনেরোতে ঘণ্টা বাজত, ঘুম থেকে উঠে নীচে নেমে প্রার্থনা, তারপর চা, চায়ের পর পনেরো মিনিট চারদিকের ঘাস ছিঁড়তে হত, তারপর চল্লিশ মিনিটে ব্রাশ, বড়-বড় বাথরুম সব; মনে হতে পারে চল্লিশ মিনিট কি কম নাকি? হ্যাঁ কম, কারণ বাথরুম বারোটা, পেশেন্ট দেড়শো। তারপর পাঁচ মিনিট সময়— নিজের বিছানা প্যাক করে রেখে এসে, গোটা সেন্টার পালা করে ঝাঁট দেওয়া, মোছা, তারপর ব্রেকফাস্ট। এরপরে বাগানে ডিউটি, সেখানে সবজি চাষ হয়, মাটি কোপানো থেকে যা-যা কাজ আছে, মাঝে কুড়ি মিনিটের স্নান বিরতি, তারপর ক্লাস, ক্লাসের পর লাঞ্চ এবং আবার কাজ। বিকেলে একঘণ্টা খেলা বাধ্যতামূলক। ফুটবল বা ক্রিকেট, বাস্কেটবল, যাতে পরিশ্রম হয়, লুডো দাবা নয়। এরপর আবার ক্লাস, ডিনার — তারপর একঘণ্টা ইনভেনট্রি লেখা এবং সবার সামনে পড়া, নটা পঞ্চাশে বেল। শুতে যাবার সময়ে, আবার বিছানা পেতে নাও জলদি, কারণ দশটায় সব আলো নিভে যাবে। তার খানিক পরেই নাইট গার্ড এসে, শুধু নাক ডাকার শব্দ শুনত। সারাদিনের ঐ হাড়-ভাঙা খাটুনির পর, সাধ্য কি জেগে থেকে স্বপ্ন দেখার? ভোরে একটা মেডিটেশনের ক্লাসও হত, প্রায় এক ঘণ্টা বাবা লোকনাথ হয়ে, চোখ বুজে বসে থাকাটা যে কী মারাত্মক চাপের, সে আমিই জানি!

অ্যাডিক্ট মন আসলে চঞ্চল, অস্থির, প্রথম-প্রথম বলা হত, ব্যাক কাউন্টিং করো, ৫০০ থেকে এক, এই ভাবে শুরু, পরের দিকে অসুবিধে হয়নি, চোখ বন্ধ করে খানিকপর পাখির ডাক, পাখার ঘুরতে থাকার শব্দটুকুই কানে আসে।

ঐ ইনভেনট্রির খাতা মনে আছে স্পষ্ট। প্রথম-প্রথম বাগানে কাজ করাটাকে লিখতাম, ‘আজ ঘুম থেকে উঠেই ছিঁড়লাম’, কদিন পরে সেই আমিই লিখেছি, আজ দুই বন্ধু মিলে সকালবেলা অনেকক্ষণ বাগানে কাজ করলাম, আসলে যারা নেশাড়ি, তাদের হাত কাঁপতে থাকে ক্রমাগত, এই কুয়াশা মাখা ভোরের ঘাস ছিঁড়তে-ছিঁড়তে একসময়ে হাতের নার্ভ বলে, ভাল আছি। হাত কাঁপা কমতে থাকে।

রিহ্যাব কী? যেতে পারি কিন্তু কেন যাব?, সংযম কথাটার মানে বোঝায়, ঘড়ি শুধু হাতের অলংকার নয়, সময়ের কাজ সময়ে করতে শেখায়। একটা নিয়মের মধ্যে থাকাটাও বাস্তবিক— এটা বুঝতে শেখায়; দিনের শেষে, সামাজিক থাকাটাও তো জরুরি। আমার জন্য অন্য পৃথিবী বলে তো কিছু নেই। রিহ্যাব দায়িত্ব নিতে শেখায়। পেশেন্টদের জন্য থাকত ডিউটি চার্ট, ওটার নাম ছিল— থেরাপিটিক ডিউটি অ্যাসাইনমেন্ট। রিহ্যাবের প্রথমে দেওয়া হত রিফেন্ট্রি, খেতে দেওয়া আর থালা-বাসন ধুয়ে পরিস্কার করা। প্রথম ডিউটিতেই ইগো নামক পাথর— বাপি বাড়ি যা বলে হাওয়া। তারপর রান্না করা, বাগান করা, অফিস ডিউটি করা, রিহ্যাবের একেকটা বিভাগের মনিটর হয়ে যাওয়া থেকে, শেষে নাইট গার্ড এর ডিউটি; সব পেশেন্ট, কাউন্সেলর, স্টাফরা যখন গভীর ঘুমে, তখন ঐ বিরাট সেন্টার পাহারা দিত চারজন নেশাড়ি, তাদের হাতেই সদর দরজার চাবি। রাতে লাইট নেভানো থেকে, ভোরে সকলকে ঘুম থেকে তোলা অবধি সবটা ঐ চারজনের দায়িত্ব। এটা তখনই দেওয়া হত, যখন কর্তৃপক্ষ বুঝতেন, চার দেওয়ালের বাইরে যে প্রলোভনের পৃথিবী— হাঁ মুখে অপেক্ষায়, তার মুখোমুখি হতে এরা প্রস্তুত।

কেউ কি পালায়নি? কেউ কি আবার ফিরে যায়নি নেশায়? উত্তর— অবশ্যই গেছে। রিল্যাপ্স-তো রিকোভারির একটা অংশ, তবু ভাল আছে এমন সংখ্যা কিন্তু কম নয়, আজ নারকোটিক অ্যানোনিমাসে ভাল থাকা মানুষের ভিড় সেটাই প্রমাণ করে। রিহ্যাব এমন কোনও মলম নয়, যে দিলেই সেরে যাবে; এটা একটা অভ্যস্থতা তৈরি করার চেষ্টা মাত্র। নিজে উপকৃত বলে ভাষণবাজি করছি এমন নয়, হাড়ে-হাড়ে বুঝেছি এটা কাজ করে। কারও ক্ষেত্রে আবার, এ-মলমে অ্যালার্জি থাকতেই পারে। রিহ্যাব মলমের, প্রথম দুটো অক্ষর, ‘ম’ এবং ‘ল’ ইহা পরিত্যাগ করতে হয়। আবার কারও কাছে, ‘ল’ বাদ গিয়ে ‘মম’। যদি ‘মল’-ও হয়, তবে সেটা তখন শপিং মলের মতো, জীবনের নানা বৈচিত্র সাদা চোখে উপভোগ করা যায়…

বিজয় আজ ২৬ বছর মদ ছাড়া! আবার সে মহা সমুদ্রে ভেসে বেড়ায়। জাহাজের জীবনে সব আছে, নেশা ছাড়া। বন্দরে জাহাজ ভিড়লে, ব্যাঙ্গালোরের বাড়িতে ছুটিতে আসলে— আমরা ফোনে আগের মতোই আড্ডা দিই। আর ও এখন বিড়িও খায়না। কথায় বলে, জেলের বন্ধু সেল অবধি যায়, রিহ্যাবের বন্ধুত্ব কিন্তু ভালমন্দতে জড়িয়ে থাকে আমৃত্যু।