শান্তিনিকেতনি আড্ডা
একটা সময়ে শান্তিনিকেতনে আলাপ-আলোচনা, আড্ডার জায়গা ছিল রতনপল্লির কালোর দোকান। সে ছিল সুবীর ঠাকুরের ‘সোহিনী’ বাড়ির সামনে। মাঝারি মাপের মাটির বাড়ি, খড়ের দাওয়া ছাপিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছে তার চালা। সেই চালের নিচে বেশ কয়েকটা কাঠের সরু রংহীন বেঞ্চি আর উঁচু টেবিলে আড্ডা জমে উঠত দারুণ রকমে। সে আড্ডার রেশ সহজে শেষ হওয়ার নয়। কাপের পর কাপ চা এসে যাচ্ছে আর কথার পিঠে কথা। সেই সঙ্গে বিকেলের দিকে শিঙাড়া, চপ। আবার কোনও কোনওদিন পাওয়া যেত প্যারাকি। বারান্দার একপাশে উনুনের আঁচে শিঙাড়ার ঝুড়ি, সেখানেই একপাশে ছিল চপের জায়গা। ঝুড়িখানা প্রতিদিন ভাজা তেলের প্রলেপ মেখে মজবুত। তার রঙ হয়েছে গাঢ়তর। পাশেই বড় থালায় সকালের রোদ্দুরের মতো সোনালি আলুমাখানো, শিঙাড়া আর আলুর চপের পুর হিসেবে রেডি। ‘রক্তকরবী’ নাটকের সেই মাটির নিচ থেকে উঠে আসা একতাল সোনার মতো সেখান থেকে উঁকি দিচ্ছে গাঢ় রক্তবর্ণের শুকনো লঙ্কার কুচি, কোথাও বা জেগে আছে বাদামের টুকরো। গাঢ় হলুদের ওপরে যেন ফিকে হলুদের মোজেইক। আজকের আর্টের ভাষায়, সে এক সুরভিত ইনস্টলেশন। জার ভেসে আসা গন্ধে মন উচাটন করে। পাশেই অ্যালুমিনিয়ামের বড় থালায় সার বেঁধে বসে আছে সদ্য আধা-প্রস্তুত শিঙাড়ার দল। ঠিক যেন পদ্মাসনে উপবিষ্ট একঝাঁক ধ্যানী বুদ্ধ। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা নয়, কেউ চাইলে আর কড়াইয়ের আঁচ খানিক বেড়ে উঠলেই গরম তেলে তাদের এপিঠ-ওপিঠ ভেজে বাদামি অবস্থায় ঝুড়িতে রাখা হবে। ঝুড়ির ওপরে একখানা তেলসিক্ত খবরের কাগজের আচ্ছাদন। আবারে গরম অবস্থায় সেখান থেকে শালপাতার আসনে উপবিষ্ট হয়ে সে পৌঁছে যাবে টেবিলে, খাদকের নাগালে। আহা, কী তার স্বাদ, কী সৌরভ! যার জিহ্বা এই স্বাদ স্পর্শ করেনি, তার মনুষ্যজীবন ব্যর্থ।
আরও পড়ুন : শান্তিদেব ঘোষকে নকল করতাম, প্রশ্রয়ও পেতাম তাঁর থেকে! মোহন সিং খাঙ্গুরার কলমে ‘মশগুল’ পর্ব ১২…
যে যাই বলুক, এই কালোর দোকান যেন শান্তিনিকেতনের কফি হাউস। কিংবা হয়তো তার কিছু বেশিই। কত যে বিশিষ্ট মানুষজন এখানে এসেছেন, এই আড্ডায় মজে চা-শিঙাড়া গ্রহণ করেননি, এমন মানুষের হদিশ পাওয়া মুশকিল। এমনকী, আশ্রমের উৎসব-অনুষ্ঠান উপলক্ষে খাবার তৈরিতে কালোর দোকানের নামই মনে আসত সকলের আগে। আজ তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিছুকাল আগেও আড্ডা জমেছে, পুরনো আশ্রমিকদের অনেকেই এখানে যোগ দিতেন। আগের মতো তার জৌলুস না-থাকলেও চায়ের পেয়ালা-সহ সে ছিল সচল। তবে আজ সবটুকুই হারিয়েছে। কেবল পড়ে আছে রুদ্ধ কুটিরের কাঠামো।

‘কালোর দোকান’ শান্তিনিকেতনের বুকে এক মুছে যাওয়া অধ্যায়, শান্তিনিকেতনের ছিন্নপত্র। আজকের ছাত্রছাত্রীদের কাছে সে ইতিহাসের দাম নেই, থাকার কথাও নয়— সে আজ ফসিলের আকার নিয়েছে। ওরই সামনে নবদ্বীপের দোকানে জমেছে আজকের আড্ডা। নানারকম মিষ্টি আর নোনতার পশরা সাজানো আছে এখানে। ঠান্ডা পানীয় থেকে প্যাকেটবদ্ধ নানা মুচমুচে ভাজাভুজি, চাওমিন থেকে এগ-রোল। বিকেলের দিকে তার উনুনে মস্ত লোহার চাটু বসানো থাকে। তার সীমানায় পর পর সাজানো থাকে শিঙাড়ার দল— ‘বাই-ল্যাটারাল রিলেশনশিপ’ বজায় রাখতে— সার দিয়ে বসে থাকে তারা। দেখে আন্দাজ করা কঠিন নয় যে, তাদের জন্ম হয়েছে আগের দিন। আজ পুনরায় আদের তপ্ত আসনে সেঁকে নতুন জীবনদানের চেষ্টা চলেছে। সেই শিঙাড়ার পশ্চাতে ঘন বাদামি রঙের আপাতকঠিন আস্তরণ জানান দেয়, তাঁরা গতকাল পূর্ণমাত্রায় ছিলেন, আজও টিকে আছেন।
সেকালের শান্তিনিকেতনের আড্ডায় রসিকতার ফোয়ারাও কিছু কম ছিল না। শান্তিনিকেতন তখন একটা গোটা পরিবারের মতো। একজনের আনন্দে যেমন সকলেই অংশীদার, তেমন বিপদের দিনে সবাই একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কোনও সমস্যা তখন কারও ব্যক্তিগত নয়, পুরো আশ্রম পরিবারের সমস্যা হয়ে ওঠে। পাশাপাশি আড্ডার আসরেরও খামতি ছিল না। তবে পুরুষদের আড্ডা ছিল স্বতন্ত্র। সে সব আড্ডায় একে অন্যকে নিয়ে নির্দোষ রসিকতা করতে কেউ ছাড়তেন না। মজার কথায়, ভাষার মাধুরীতে, শব্দের অনুপ্রাসে ঝলমলে করে উঠত সেসব আসর। বরাবর আশ্রমে হোমিওপ্যাথির চল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার পুরোভাগে। উপায়ও ছিল না, শহরের ডাক্তারবদ্যি দুম করে পাওয়া যাবে কোথায়? কেউ কেউ কবিরাজিতেও ভরসা করতেন।
কিন্তু আশ্রম প্রাঙ্গণে কালোর দোকান কি সকলের আগে হয়েছে? তা বোধহয় নয়, শুনেছি এরও আগে ছিল যোগিনের দোকান। সেটা ছিল পান্থশালার পাশে। আজ যেখানে ‘সুবর্ণরেখা’ তারই ডান দিকে, তিনপাহাড়ের প্রায় উল্টোদিকে। শান্তিনিকেতনের সাবেকি রাস্তা আর বিশ্বভারতী পিয়ারসন হাসপাতালে যাওয়ার পথের ঠিক সংযোগস্থলে। না, যোগিনের দোকানে সকলের অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল না। দোকানির পছন্দবোধ ছিল তীব্র, সহজ কথায় নাক উঁচু। তবে তার কাছে শান্তিনিকেতনের শিল্পী সাহিত্যরসিকের খাতির ছিল। মূলত তেমন মানুষজনেরই যাতায়াত ছিল যোগিনের দোকানে। তাঁদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা রাখত যোগিন। শুনেছি, তার দোকানে বিনোদবিহারী, রামকিঙ্কর থেকে মুজতবা আলীর মতো ব্যক্তিবর্গের বিশেষ আদর ছিল। শিল্পসাহিত্যের বিচিত্র আলোচনায় মুখর হয়ে উঠত যোগিনের চায়ের দোকান। যদিও বাহ্যিক আয়োজন ছিল অপ্রতুল, উপকরণ নেহাত সাদামাটা। কাঠের সরু বেঞ্চি, লম্বা বাঁশের বেঞ্চ, কয়েকটা জীর্ণ মোড়া—সাকুল্যে এই ছিল তার অতিথিদের জন্য ব্যবহার্য। এই দোকান ছিল তার ঘর-বাড়ি, তার সংসার, তার ভালবাসার ডেরা। সেখানেই সে থাকত। বড় গাছের ঘন ছায়ায় সেই চায়ের বিপণি যেন শিল্পীর আঁকা একখানা ছবি। নন্দলালের আঁকা ‘জলসত্র’।
সেই যোগিনের অকস্মাৎ মৃত্যু হল। একবার বৈশাখের রাত্রে প্রবল ঝড়-জল-বিদ্যুতের দাপটে আশ্রম যখন কেঁপে উঠেছে, সেই রাতে গাছের একটা বড় ডাল ভেঙে পড়েছিল তার দোকানের ছাউনিতে। সেই ডাল চাপা পড়েই তার মৃত্যু, এই খবরে আশ্রমে শোরগোল পড়ে যায়। যোগিনের মৃত্যু চালচুলোহীন রামকিঙ্করের মনে বড় আঘাত হেনেছিল। ক্যানভাসে আঁকা ‘ডেথ অফ যোগিন’ ছবিতে রামকিঙ্কর তাকে পৌঁছে দিয়েছেন শিল্পের অমরাবতীতে।

সেকালের শান্তিনিকেতনের আড্ডায় রসিকতার ফোয়ারাও কিছু কম ছিল না। শান্তিনিকেতন তখন একটা গোটা পরিবারের মতো। একজনের আনন্দে যেমন সকলেই অংশীদার, তেমন বিপদের দিনে সবাই একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কোনও সমস্যা তখন কারও ব্যক্তিগত নয়, পুরো আশ্রম পরিবারের সমস্যা হয়ে ওঠে। পাশাপাশি আড্ডার আসরেরও খামতি ছিল না। তবে পুরুষদের আড্ডা ছিল স্বতন্ত্র। সে সব আড্ডায় একে অন্যকে নিয়ে নির্দোষ রসিকতা করতে কেউ ছাড়তেন না। মজার কথায়, ভাষার মাধুরীতে, শব্দের অনুপ্রাসে ঝলমলে করে উঠত সেসব আসর। বরাবর আশ্রমে হোমিওপ্যাথির চল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার পুরোভাগে। উপায়ও ছিল না, শহরের ডাক্তারবদ্যি দুম করে পাওয়া যাবে কোথায়? কেউ কেউ কবিরাজিতেও ভরসা করতেন।
তেমনই এক আড্ডায় ক্ষিতিবাবুকে কেউ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কবিরাজি কেমন চলছে?’ ম্লান হাসির সঙ্গে রসিকতা মিশিয়ে আচার্য সেনের কাছ থেকে উত্তর এল, ‘হচ্ছে না। কবি রাজি হচ্ছেন না।’ ক্ষিতিমোহনের এই pun ছিল বিখ্যাত। আবার অন্যরাও তাঁকে ছাড়তেন না। ওঁর সম্বন্ধে রটনা ছিল, উনি সকালে নাকি মন্দিরের উপাসনায় গিয়ে বেদমন্ত্র পড়ে ‘ভূমা’ ‘ভূমা’ বলে সর্বব্যাপী ঈশ্বরের বিরাটত্বের ব্যাখ্যা করতেন। তারপর বাড়ি ফিরে দিগন্তবিস্তৃত মাঠের পাশে তাঁর বাড়ির সীমানার বেড়ার কাছে গিয়ে ‘ভূমি’, ‘ভূমি’ বলে সেই সীমানা একটু একটু করে এগিয়ে নিতেন। রসিকতার ছলে হলেও এসব কথা তাঁর কাছেও গিয়ে থাকবে, শুনে তিনি যে খুব প্রসন্ন হতেন— তাও নয়।
যাই হোক, এক আড্ডায় আশ্রমিকরা অনেকেই জড় হয়েছেন। সেদিনের প্রকাশ্য টার্গেট বুঝি আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন। মহাপণ্ডিত তো কি হয়েছে, তিনি আশ্রমের আপনজন বই তো নন। এখানে বলে রাখা দরকার, ক্ষিতিমোহন সেনের স্ত্রী কিরণবালা ছিলেন সকলের ঠানদি। অসম্ভব গুণী মহিলা, একদা নন্দলালের কাছে ছবি আঁকার চর্চা করেছেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এবং প্রশংসিত হয়েছে সেসব ছবি। এছাড়া তিনি আশ্রমের বিপদে-আপদে মাতৃস্নেহে সকলের পাশে এসে দাঁড়ান। খুবই ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা, তবে চেহারার দিক থেকে ক্ষিতিমোহনের পাশে বেশ ক্ষীণকায়। এই নিয়ে আচার্য সেনের সঙ্গে সকলে রসিকতা করতে ছাড়েন না। আশ্রমের আড্ডায়, আলাপ আলোচনাতে ক্ষিতিমোহনের প্রতি কখনও ঠাট্টামেশানো মৃদু নালিশ এসে পড়ে, ঠানদি ভাল করে খাওয়াদাওয়া করেন না। আর সেদিকে আচার্যর নাকি নজরই নেই, ঠারেঠোরে এই কথা ভেসে আসে তাঁর দিকে। সেদিন আড্ডায় ঠাট্টার ছলে তাঁকে কেউ বললেন, ‘ঠানদি বড় রোগা হয়ে যাচ্ছেন’। ক্ষিতিমোহন সেদিন এর উত্তরে একটু গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘শোনো, তোমাদের ঠানদি বাইরে রোগা, তবে অন্তরে দারোগা’। ব্যস, এরপরে মন্তব্যকারীর মুখে আর বাক্যস্ফূর্তি নেই। আসরের সবাই তখন মুখটিপে হাসছেন আর মনে মনে আচার্য সেনের রসিকতার তারিফ করছেন।
শান্তিনিকেতনে সেই পর্বের আড্ডার আবহ ছিল এমনটাই। ঠাট্টার মধ্যেও ঠিকরে পড়ত বুদ্ধির দীপ্তি।