ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • বিষণ্ণতার জাতিস্মর

    শ্রীজাত (February 8, 2025)
     

    জগজিৎ সিং যে গজল গাইতে এসে কী অভাবনীয় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন, এবং বেশ পরিকল্পিভাবেই ঘটিয়েছেন, সেটা বোঝার অনেক আগে থেকেই ওঁর গান শুনে আসছি।

    বাড়িতে সবরকমের গানবাজনা শোনার একটা খোলামেলা হাওয়া বইত, আমার ছোটবেলায় সে-হাওয়ার স্পর্শে বা সংস্পর্শে এসে নানা ধরনের সুর ও কথার ছোঁয়াচ পেয়েছি। তারই মধ্যে একটা ধরন হল, গজল। গজল কাকে বলে, ঠিক কোন কোন নিয়ম মেনে লিখলে, তবেই সে-লেখা গজল হয়ে ওঠে, সেসব তত্ত্ব অনেক পরে বুঝেছি, কিন্তু মোটের ওপর গজল যে বাকি গানবাজনার চেয়ে একেবারে আলাদা একরকম আঙ্গিক, কথায়, সুরে এবং গায়নে-তা বুঝতে ওই ছোটবেলাতেও আমার বেশি সময় লাগেনি।

    আরেকটা ব্যাপারও বুঝতে পারতাম, গজলের সুরারোপ, যন্ত্রানুষঙ্গ ও গায়কী, এই তিনটেই মোটামুটি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের ডালপালা ভেঙে সাজানো। নূরজাহান হোন বা মেহেদি হাসান, তালাৎ মেহমুদ হোন বা বেগম আখতার, লতা মঙ্গেশকর হোন বা সদ্য খ্যাতি পাওয়া ছোটে গুলাম আলি, গজলের সুরশৈলী ও পেশকশ, দুটোই নির্ভরশীল শাস্ত্রীয় সংগীতের বোলচালের ওপর। এইসব নামজাদাদের যখন বুঁদ হয়ে শুনছি এবং উপরিউক্ত ধারণায় একেবারে বদ্ধমূল হতে চলেছি, সেই সময় হাতে এল জগজিৎ সিং-এর লং প্লেয়িং রেকর্ড, ‘The Unforgettables’। সহশিল্পী হিসেবে আছেন সহধর্মিনী চিত্রা সিং। সেই প্রথম এও দেখলাম, জুটি বেঁধে গজল গাওয়া যায়। কিন্তু কেবল এতেই যে নিয়ম ভাঙলেন জগজিৎ, তা নয়। এ ছিল কেবলমাত্র তাঁর নিয়ম ভাঙার শুরুয়াত।

    আরও পড়ুন : বড় হয়ে বুঝেছি মহম্মদ রফির গানের যন্ত্রণা!
    লিখছেন রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়…

    ওই রেকর্ড শুনতে গিয়েই বুঝলাম, ভদ্রলোক নতুন কিছু একটা করতে চাইছেন গজলে। নিজের ভাষা খুঁজছেন যে, তা স্পষ্ট। তখনও তাঁর সুরের মধ্যে, গায়কীতে মেহেদি’র প্রভাব বিদ্যমান, তালাতের ছায়া প্রকট, কিন্তু সেসবের ওপরে যেন আছে শেকল ভেঙে বেরিয়ে পড়ার একটা চেষ্টা, স্বাতন্ত্র্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার লড়াই। তখন ছবিতে সুরারোপ ক’রে ও গান গেয়ে মেহফিল মাতাচ্ছেন জগজিৎ-চিত্রা জুটি, আর সেসবের মধ্য থেকেই, একটু একটু ক’রে, গজলের এতদিনকার ঐতিহ্যের মোড়ক থেকে, আঙ্গিকের খোলস থেকে নিজস্বতার বিচ্ছুরণ নিয়ে বেরিয়ে আসছেন জগজিৎ। খুব আস্তে আস্তে বদল ঘটাচ্ছেন গজলের সুরারোপে, যন্ত্রানুষঙ্গে এবং গায়নশৈলীতে।

    পুত্রের সঙ্গে জগজিৎ সিং ও চিত্রা সিং

    বদলগুলো খুব সূক্ষ্ম, কিন্তু খুব বড় মাপের বদল। রাগদারী’র আঙ্গিক ছেড়ে গীতপ্রধান সুরের দিকে ঝুঁকছেন তিনি, কিন্তু এমনভাবে যাচ্ছেন, যাতে তাঁর চলার পথ তৈরি হচ্ছে সুরের নতুন সুড়কি দিয়ে। গজলের সুরারোপ বা কম্পোজিশন যে এতখানি আলাদা হতে পারে তার সমস্ত পূর্বসূরিদের চেয়ে, এতটাই আলাদা যে তাকে প্রথম শোনায় গজল ব’লে চিনে নিতেই বাধছে নিয়ম-মানা মনের, এইটে করে দেখালেন জগজিৎ সিং। কেবল কম্পোজিশন তো নয়। একেবারে সমসাময়িক, নতুন ধরনের আবহ ও যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে এলেন তিনি। গানের পোশাককে ঢেলে সাজালেন নিজের হাতে। যে-সমস্ত যন্ত্রের ব্যবহার গজলে কল্পনাও করা যেত না, তাদের পাত পেড়ে বসিয়ে দিলেন গজলের দাওয়ায়। আর তারই সঙ্গে তাঁর গায়ন হয়ে উঠল বাকি সকলের থেকে আলাদা। জানকারি আছে, কিন্তু দেখনদারি নেই, পেশকারি আছে, কিন্তু লয়কারি নেই, এমন এক নিস্পৃহ অথচ নিবিড়, নির্মোহ অথচ নিটোল গায়নভঙ্গি নিয়ে এলেন তিনি, যা তাঁর আগে কেউ কখনও ভাবেননি বা করেননি। পরেও নয়। খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে, গজলের Sound এবং Vocabulary একই সঙ্গে বদলে ফেললেন তিনি। আর এভাবেই তৈরি হল তাঁর নিজস্ব ও অনন্য ঘরানা, যেখানে গান শুরু আগে Prelude শুনে বলে দেওয়া যায়, এই কম্পোজিশন কার।

    রাগদারী’র আঙ্গিক ছেড়ে গীতপ্রধান সুরের দিকে ঝুঁকছেন তিনি, কিন্তু এমনভাবে যাচ্ছেন, যাতে তাঁর চলার পথ তৈরি হচ্ছে সুরের নতুন সুড়কি দিয়ে। গজলের সুরারোপ বা কম্পোজিশন যে এতখানি আলাদা হতে পারে তার সমস্ত পূর্বসূরিদের চেয়ে, এতটাই আলাদা যে তাকে প্রথম শোনায় গজল ব’লে চিনে নিতেই বাধছে নিয়ম-মানা মনের, এইটে করে দেখালেন জগজিৎ সিং।

    সফরটা সহজ ছিল না। বাঁকবদলের পথ কখনও মসৃণ হয় না। নরম, বিষণ্ণ, আদুরে ও বিবাগী জগজিৎ সিং আসলে ছিলেন শিল্পবিপ্লবী। এক জীবনে শিল্পের একটি ধারায় এত বড় বদল একা হাতে খুব কম শিল্পীই আনতে পেরেছেন। একেবারে অ্যালবাম ধরে বলতে গেলে বলা ভাল, Beyond Time থেকে আমরা এই পরিপূর্ণভাবে বদলে যাওয়া নতুন জগজিৎ সিংকে পেলাম। তাঁর ঘরানার শিলমোহর পড়ল সেই অ্যালবাম থেকেই। ভাবনায়, সুরারোপে, যন্ত্রানুষঙ্গে ও গায়নে। এরই সঙ্গে বলব আরও দু’টি বিষয়। এক, গজল যে কথাপ্রধান গান, সে-বিষয়ে তাঁর সচেতনতার কোনও জুড়ি ছিল না। গজলের কথাকে কীভাবে গানে ফেলতে হয়, এবং প্রতিটি শব্দের উচ্চারণের দিকে আলাদা করে নজর দিতে হয়, জগজিৎ প্রথম সেটা আমাদের দেখালেন। বাকি সকলের নজর অনেক বেশি ছিল সুরের দিকে, অদাকারি’র দিকে, উচ্চারণের দিকটা জগজিৎ খুলে দিলেন, নতুন দিগন্তের মতো। আর দুই, কেবল গজলই নয়, সমগ্র ভারত তথা এই উপমহাদেশের রেকর্ডিং-এ নিয়ে এলেন আধুনিকতার ও প্রযুক্তির ছোঁয়া, যা ওই সময় ভাবনাচিন্তার বাইরে ছিল। এক্ষেত্রেও Beyond Time হয়ে থাকবে অনপনেয় এক মাইলফলক। মানুষের গান শোনার ধরনকে বদলে ফেললেন তিনি।

    সরফরোশ-এর পোস্টার, যে ছবিতে তাঁর গান হোশওয়ালো কো খবর কেয়া হয়ে উঠেছিল অনন্য

    দীর্ঘ সময় ধরে এই সমস্ত কারণে তাঁকে একঘরে করার চেষ্টা কম হয়নি। তিনি যে গজল নামক ঐতিহ্যবাহী শিল্পটির বারোটা বাজাচ্ছেন মানুষের কান ধ’রে, এ-কথা তখনকার শিল্পী ও বোদ্ধামহল প্রচার করতে ছাড়েনি। কিন্তু তাঁর আসরের টিকিটের জন্য মারপিট বেড়েছে প্রতিদিন। দোকানে-দোকানে তাঁর নতুন অ্যালবামের জন্য প্রতীক্ষার পংক্তি দীর্ঘতরই হয়েছে কেবল। একটা গোটা দেশ, উপমহাদেশ, মহাদেশ এবং শেষমেশ পৃথিবীর গজলপ্রেমীদের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে ফিরে এসেছেন সারা জীবন। এর চেয়ে বড় জয় আর কী হতে পারে? মানুষ ওই ‘নতুন’-কে, ‘অদেখা’-কে, ‘অশ্রুতপূর্ব’-কে দু’হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছে, নিজের আনন্দ-বিষাদের সঙ্গী করে নিয়েছে জগজিৎ সিং-এর প্রতিটি গজলকে। তাঁর নামের আক্ষরিক অর্থই হয়ে উঠেছে তাঁর জীবন। নিজের বিশ্বাসে অবিচল থেকে ভাল কাজ ক’রে যেতে পারলে পৃথিবীর মন যে জিতে নেওয়া যায়, এক জীবনে জগজিৎ সিং তা করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। আর কেউ এই জেদের খেলায়, ঝুঁকির জুয়ায় এভাবে জিতেছেন বলে মনে হয় না।

    তরতাজা ছেলের আকস্মিক মৃত্যুর পর গান গাওয়া ছাড়লেন চিত্রা। মঞ্চে বা রেকর্ডিং-এ তাঁকে জগজিতের পাশে পাওয়া গেল না আর। শুরু হল তাঁর একার পথ চলা। সে-পথে বিষাদ আরও গাঢ়, যন্ত্রণা আরও তীক্ষ্ণ। সেই নিরালা সফর চলেছিল তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত। আজ মনে হয়, বিষণ্ণতা যদি জাতিস্মর হয়ে পৃথিবীতে আবার জন্ম নিয়ে থাকে, তাহলে তার আরেক নাম জগজিৎ সিং।  

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook