ডেকে পাঠানো হয়েছিল বলে ছেলেটি দেখা করতে গিয়েছিল চেনাশোনা আত্মীয়জনদের সঙ্গে। গিয়েছিল তাদের কাছে, যাদের সঙ্গে প্রায়ই সন্ধ্যায় ব্যাডমিন্টন খেলত সে। দেখা করতে গিয়েছিল সেই মানুষটির সঙ্গে, যার সঙ্গে ছয়-সাত বছর আগে সে উত্তরাখণ্ড বেড়াতে গিয়েছিল। ৩২ বছরের মুকেশ চন্দ্রকর জানত না, যাদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে— তারা ওর মাথার খুলি পনেরোটা জায়গায় ফাটাবে। তারা ওর হাত ভেঙে দেবে। পাঁজরের হাড় দুরমুশ করে বুকের খাঁচা থেকে বের করে আনবে তার হৃৎপিণ্ড। তার লিভারে ছেদ হবে চার-পাঁচটা। তাকে মেরে একটা সেপ্টিক ট্যাঙ্কে সিমেন্ট চাপা দেওয়া হবে। মুকেশ চন্দ্রকর জানত না, তার দেহ পাওয়া যাবে মৃত্যুর তিন-চার দিন পর। আর এত কিছু মুকেশের ওপর দিয়ে ঘটে যাবে এমন একটা কাজের জন্য— যা সে করেইনি!
‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট’ বলে একটি ইংরেজি শব্দ আছে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় স্বাধীন সাংবাদিক। এই স্বাধীন সাংবাদিক বস্তুটি কী? আসলে আর কিছু না, অতি অল্প মূল্যের সাংবাদিকতা। বড় বড় কাগজ কিংবা টিভি চ্যানেলের অর্থ, ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই যে-কোনও সমাজে বেশি। রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে তাঁরা কথা বলতে পারেন। পারাই উচিত, আদর্শগত দিক থেকে। আবার সেই রাষ্ট্রের সঙ্গে নির্লজ্জভাবে কখনও কখনও সাংবাদিকতা, যা গণতন্ত্রের একটি স্তম্ভ, গোপন আঁতাঁত গড়ে নেয়। কিন্তু এমন সাংবাদিকও আছেন, যাঁরা ক্ষমতার সঙ্গে হাত মেলানো তো দূর-অস্ত, দিনের শেষে অত্যন্ত স্বল্প মূল্যের কাজ হলেও সাংবাদিকতার প্রকৃত আদর্শ ও ভিত্তি থেকে সরেন না।
মুকেশ চন্দ্রকর ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। বস্তারের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় সাংবাদিকতা করলেও তাঁরা একেকটি ‘স্টোরি’-র জন্য পেতেন নাকি দিনপিছু আড়াইশো থেকে আড়াই হাজার টাকা! পারিশ্রমিক আড়াই হাজার হওয়া ছিল দুষ্কর, যদি না বিরল কোনও সময়ে ‘স্পেশাল স্টোরি’ করা যেত।
আরও পড়ুন : যুগলের একসঙ্গে থাকা নিষিদ্ধ, কিন্তু অনার কিলিং জায়েজ?
মুকেশ এবং তাঁর মতো সাংবাদিকরা কোনওরকম অর্থানুকূল্য ও সুরক্ষা ছাড়াই ক্রমাগত সত্য উদঘাটনের কাজ করে যান। এইসব কাজের বেশিরভাগটা আসলে বড় হাউজের পত্রিকাগুলির সহায়কের ভূমিকা পালন করা। খবর করবে আসলে ওই হাউজের সাংবাদিক— কিন্তু দুর্গম জায়গাগুলিতে তাদের নিয়ে যাতায়াত করবে, খবরের ‘সোর্স’ পাইয়ে দেবে মুকেশরা!
মুকেশের খুন ভারতীয় সাংবাদিকতার সেই ধূসর জায়গাটিও উন্মুক্ত করেছে।
মুকেশের খুন শুধুমাত্র রাষ্ট্রের অন্যায়-অনাচারের বিরূদ্ধে কথা বলে কোতল হওয়ার কাহিনি নয়। মৃত্যুর আগে অবধি মুকেশ নিজেই ছিলেন একজন ‘স্টোরি’! মাত্র দু’বছর বয়সে মুকেশ বাবাকে হারিয়েছিলেন। তাঁর মা কৌশল্যা দুই পুত্রকে বড় করেছেন অঙ্গনওয়ারিতে কাজ করে। সেখানে কৌশল্যার রোজগার ছিল দিনপিছু তিনশো টাকা। ছোটবেলায় মুকেশ আর তাঁর দাদা যুকেশ মহুয়া আর তেঁতুল সংগ্রহ করে সংসারে কিছু অর্থসাহায্য করতেন। প্রথমে বাসগুড়া এলাকায় থাকলেও ২০০৫ সালে সলমা জুড়ুম আন্দোলন শুরু হতেই তাঁদের বলপূর্বক আওয়াপল্লিতে জুড়ুম ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মুকেশের মা কৌশল্যা ক্যান্সারে মারা যান ২০০৯ সালে। তখন মুকেশ ১৮-ও পেরননি। নানা ধরনের কাজ করে গ্রাসাচ্ছাদন করার পর মুকেশ পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা বেছে নেন। বস্তার এলাকার বিভিন্ন ধরনের খবর তিনি তুলে ধরতেন। মাওবাদী আন্দোলনের গলিঘুঁজি, এলাকার মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, সরকারি অসংবেদনশীলতা ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলি বেশিরভাগ সময় তাঁর পরিচ্ছন্ন এবং সাহসী সাংবাদিকতার বিষয় হয়ে উঠত। করোনা অতিমারীর সময়কালে তিনি নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল শুরু করেছিলেন ‘বস্তার জংশন’ নামে। সেই চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার খুব শীঘ্রই এক লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
মুকেশের খুন ভারতে সাংবাদিক নিধনের প্রথম ঘটনা নয়। যদি হাল সরকারি আমলের কথাই ধরা যায়, তবে এই দশ-এগারো বছরে সাংবাদিক খুন হয়েছে এই দেশে বহু। এমন ঘটনাগুলি ২০১৪ সালের আগেও ঘটেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যত সাংবাদিক এই কয়েক বছরে দেশে খুন হয়েছেন— বেশিরভাগই প্রাকৃতিক বিষয়ে নানা ধরনের সত্য উদঘাটনের জন্য নিয়োজিত ছিলেন। অবৈধ জমি আর বালি মাফিয়াদের বিরূদ্ধে তাঁরা কলম ধরেছিলেন। ২০১৫ সালে জগেন্দ্র সিং পুলিশি অত্যাচারে আগুনে পুড়ে মারা যান। তিনি উত্তরপ্রদেশের বালি মাফিয়াদের বিরূদ্ধে লিখতেন। ২০১৬ সালে ‘জনসন্দেশ টাইমস’-এর করুণ মিশ্র এবং ‘হিন্দুস্থান’-এর রঞ্জন রাজদেব যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশ ও বিহার রাজ্যে মোটরসাইকেল চড়ে আসা দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন অবৈধ খাদান মালিকদের বিরূদ্ধে লেখালিখি করে। মধ্যপ্রদেশে ২০১৮ সালে দুষ্কৃতীদের ট্রাক চাপা পড়ে মারা যান স্থানীয় চ্যানেল ‘নিউজ ওয়ার্ল্ড’-এর সাংবাদিক সন্দীপ শর্মা ওই বালি মাফিয়াদের বিরূদ্ধে লিখেই। বালি মাফিয়াদের বিরূদ্ধে লিখে গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হন ২০২০ সালে উত্তরপ্রদেশের ‘কম্পু মেল’ পত্রিকার শুভম মণি ত্রিপাঠী এবং ২০২২ সালে বিহারের স্বাধীন সাংবাদিক সুভাষকুমার মাহাতো। ২০২৩ সালে মহারাষ্ট্রের সাংবাদিক শশীকান্ত ওয়ারিশে মারা গিয়েছিলেন গাড়ি চাপা পড়ে। তিনিও অবৈধ জমিদখলের বিরূদ্ধে সাংবাদিকতা করতেন। এর পাশাপাশি কর্নাটকে ২০১৭ সালে প্রখ্যাত সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের নিজের বাসভবনের সামনেই গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হওয়া তো সর্বজনবিদিত। রাষ্ট্রের সঙ্গে আঁতাঁত না করে সত্য উদঘাটনের সাহস বুকে নিয়ে সাংবাদিকতা করে যে এ-দেশে খুন হতে হয়— তার চরম নিদর্শন এই মানুষগুলির করুণ পরিণতি।
কথা হল, সাংবাদিকদের এমন নৃশংসতার সঙ্গে খুন হতে হয় কেন? আসলে সাংবাদিকদের খুন করে দুষ্কৃতীরা বার্তা দেবার চেষ্টা করে তাদের না ঘাঁটাতে। মুকেশ চন্দ্রকর অতি-প্রতিভাবান একজন তরুণ সাংবাদিক ছিলেন। তাঁকে খুন করা হল এই ত্রাস ছড়ানোর জন্য যে, ভবিষ্যতে কোনও নতুন সাংবাদিক এইসব বিষয়ে সত্য উদঘাটনের সাংবাদিকতা করতে যেন দু’বার ভাবে। তারা যেন অতি অবশ্যই ভয় পায়।
🇮🇳Journalist Mukesh Chandrakar, known for exposing corruption, was found murdered in Chhattisgarh.
— ARTICLE 19 (@article19org) January 9, 2025
His death highlights the dangers faced by journalists reporting on corruption and injustice in India.
We call for a thorough investigation into his murder.https://t.co/WnX3aMtGFN
যদিও মুকেশের ক্ষেত্রে ঘটনা খানিক অন্যরকম ছিল। মুকেশের খুনিরা তাঁর আত্মীয় ছিল। খুন যে করেছে, সেই রীতেশের সঙ্গে মুকেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। মুকেশ যেখানে খুন হয়েছিলেন, সেখানে তিনি প্রায়শই যাতায়াত করতেন। তাঁকে যে খুন করা হবে— তা আগে থাকতে বিন্দুমাত্র টেরই পাননি মুকেশ। আর যে রিপোর্টের জন্য মুকেশ খুন হন, সেটা তাঁর ছিলই না। মুকেশ গিয়েছিলেন বস্তারের কিছু সরকারি স্কুল সম্বন্ধে রিপোর্ট করতে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বড় হাউজের আরেকজন সাংবাদিক। পথে যেতে যেতে সেই সাংবাদিক সেই রাস্তার করুণ অবস্থা নিয়ে একটা রিপোর্ট করে, যা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সরকার কন্ট্রাক্টরকে তলব করে। সেই কন্ট্রাক্টর আর তার ভাইয়েরা মিলে পরে মুকেশকে খুন করে এই মর্মে, যেহেতু মুকেশ ক্রমাগত বস্তার নিয়ে সাংবাদিকতা করেন— তাই ওই রিপোর্ট মুকেশই করেছেন! যে জায়গার অন্যায়-অবিচারের জন্য মুকেশের নির্ভীক সাংবাদিকতা, সেই জায়গার মানুষের হাতেই অতএব মুকেশকে নিহত হতে হল।
শেষ প্রশ্ন থেকে যায়, সাংবাদিকদের, বিশেষত প্রান্তিক জায়গা থেকে যাঁরা স্বাধীন ভাবে কাজ করেন, যাঁদের সাংবাদিকতার গুরুত্ব অপরিসীম, অথচ বড় হাউজ কিংবা টিভি স্টুডিওর প্রতিরক্ষা যাঁদের নেই, তাঁদের সুরক্ষার কথা রাষ্ট্র আদৌ ভাববে কি না? একজনও সাংবাদিকের হত্যা মানে গণতান্ত্রিক দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হত্যা করা। কিন্তু তাঁরা যে জিজ্ঞাসার সামনে রাষ্ট্রকে দাঁড় করিয়ে দেন, সেই অস্বস্তি কাটিয়ে সরকার কি পারবে সাংবাদিকদের রক্ষা করতে?
আসন্ন ‘পাতাল লোক ২’-এর মুক্তি। এই সিরিজের প্রথম সিজনে দু’টি সাংবাদিক চরিত্র আমরা পাই। একজন বড় হাউজের সঞ্জীব মেহরা, যে সত্য উদঘাটনে দ্বিধাহীন হয়েও, নিজের কেরিয়ার বাঁচাতে একসময় রাষ্ট্রের দর্শানো পথই নেয়। অন্যজন, স্থানীয় স্বাধীন সাংবাদিক, অমিতোশ, যে বলে এই সিরিজের মূল চরিত্র হাতিরামকে এক দৃ্শ্যে— পুলিশের থেকে কেবল চোররা পালায় না, যারা সত্যি বলে, তারাও পালায়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘গৃহযুদ্ধ’ সিনেমায় আমরা দেখেছিলাম, সংগঠনের নেতা প্রবীর কোম্পানির লুম্পেনদের হাতে খুন হয়েছিল। বিজন, যে প্রবীরের আদর্শ মেনে চলত, সে ক্ষমতার বিরূদ্ধে লড়াই চালাতে পারেনি। বিজন পালিয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে, সত্যের জন্য লড়তে গিয়ে প্রাণ দিতে হল সাংবাদিক সন্দীপনকে।
মুকেশ চন্দ্রকরের হত্যা আরও অনেক সাহসী মুকেশের জন্ম দেবে, না কি ক্ষমতার সঙ্গে আগামীর মুকেশরা আপস করে নেবে— ভারতীয় সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ ও ভবিতব্যর পরীক্ষা হবে সেখানেই।