বাঙালির মধ্যবিত্ত চিন্তা-চেতনায় সমষ্টিবদ্ধতা জন্মানোর নির্দিষ্ট কোনও সন-তারিখ না-থাকলেও এ-কথা বলাই যায়, ব্যক্তিগত পরিসরকে ডিঙিয়ে যাওয়ার অভ্যেস তখনই মানুষকে আক্রান্ত করেছে, যখন সে আত্ম-সংস্কারের তাগিদে আপন-হতে-বাহির হয়ে দাঁড়াতে পেরেছে। দশকওয়ারি বিন্যাসে চারের দশক থেকে লেখালিখি শুরু করা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী শুধুমাত্রই কবি নন, হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির হারিয়ে যাওয়া বিবেকের একজন সকরুণ সন্ধানী। তিনি নিজে অবশ্য বিবেকবাবুটি নন; কিন্তু বিবেকের সন্ধান করেন, বিবেকের প্রতিমূর্তিকে খুঁজে বেড়ান পথে ও প্রবাসে। তার একটি নিদর্শন যদি হয় ‘উলঙ্গ রাজা’, অন্যটি ‘কলকাতার যীশু’। ‘উলঙ্গ রাজা’ বেরিয়েছিল ১৯৭১ সালে; ‘কলকাতার যীশু’-র প্রকাশকাল ডিসেম্বর ১৯৬৯। অর্থাত্ দুটি কবিতা রচনার দূরত্ব খুব বেশি নয়। ‘কলকাতার যীশু’ কি বড়দিনের কবিতা? একেবারেই নয়। এ-কবিতা লেখা হচ্ছে ২৬ ভাদ্র, ১৩৭৬ ( ১৪ এপ্রিল, ১৯৬৯)।
তুমুল গ্রীষ্মের খররোদে পুড়তে থাকা একটি দিনের প্রেক্ষিতে লেখা এই কবিতায় বড়দিনের কোনও আঁচ নেই; তবু যিশু এলেন অনিবার্যভাবে এবং তাঁর আসাটাই এই বর্ণনার নির্ঝরকে কবিতায় উত্তীর্ণ করল। চারের দশকের বাংলা কবিতা ততদিনে সমর সেনের হাত ধরে নিপাট এক ঝরঝরে গদ্যভাষার সন্ধান পেয়ে গেছে। কৌম-চেতনার কথাগুলো বলবার জন্য তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় খুঁজে নিয়েছেন এই মাধ্যমকেই। নীরেন্দ্রনাথও কিন্তু এই মধ্যবিত্ত বাঙালির সংশয়াচ্ছন্ন, চিন্তাশীল সংঘবদ্ধতারই আর একজন প্রতিনিধি; যাঁদের উচ্চারণের সঙ্গে গণপরিসর নিজেকে একাত্ম করে ফেলছে কখনও-কখনও। ১৯৬৯ সালের কিছু পূর্বেই পশ্চিমবঙ্গে জারি হওয়া রাষ্ট্রপতি শাসনের জরুরি পরিস্থিতি পেরিয়ে, নিতান্ত অ-কাব্যিক ভঙ্গিতে কবিতার সূচনা হয়ে যায় ইতিহাস ও সময়কে সাক্ষী রেখে। ‘লাল-বাতির নিষেধ’ না-থাকা সত্ত্বেও ‘ঝড়ের-বেগে-ধাবমান কলকাতা শহর’ অতর্কিতে থেমে গেল। এখানে দাঁড়ি বসলেও ততক্ষণে পাঠকের মনে উত্কণ্ঠা জাগাতে সক্ষম হয়েছে ‘অতর্কিতে’ শব্দ। অতর্কিতে গোটা শহর তো আর থামেনি, থেমেছে শুধুমাত্র কলকাতার ব্যস্ততম কোনও রাস্তা। তবু পুরো শহরের এই থমকে যাওয়া একটা বিশেষ কিছুর আবির্ভাব সূচিত করলো; যেন এমন একটা কিছু আসতে চলেছে, যার জন্য এ-শহর প্রস্তুত নয়। ‘ঝড়ের বেগে ধাবমান’ এই শব্দবন্ধকে হাইফেন দিয়ে জুড়ে তার মধ্যে দৈনন্দিনতার মরিয়া গতিকে সচেতন পাঠক কি দেখতে পাবেন না? এই উৎকণ্ঠাকে আরও বাড়িয়ে তোলা হল এর পরেই, ‘অতর্কিতে’-র কারণ না-বলে। বরং সেই আবির্ভাবের ফলে কী কী হচ্ছে- তার একটা নাতিদীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত হল:
“ভয়ঙ্করভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেম্পো, বাঘমার্কা ডবলডেকার
‘গেল গেল’ আর্তনাদে রাস্তার দু-দিক থেকে যারা
ছুটে এসেছিল—
ঝাঁকামুটে, ফেরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার—
এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
লগ্ন হয়ে আছে।”
পুরো শহরের কৌম শ্রেণিচরিত্রকে ধরে ফেললেন কবি; যেন তাঁর ওই আবির্ভাবের আগেই জানিয়ে দিতে হবে ভিন্ন ভিন্ন আর্থ-সামাজিক পরিসরের মানুষের কাছে, যারা ঠিক পেন্টিং-য়ের মতো এই দৃশ্যটি দেখছেন বা দেখতে বাধ্য হচ্ছেন তাদের সাময়িক বা অতি-সাময়িক ব্যস্ততার বিরুদ্ধে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে। ট্যাক্সির মধ্যবিত্ত, প্রাইভেটের উচ্চবিত্ত, ডবল ডেকারের কেরানি, টেম্পোর খালাসি থেকে ঝাঁকামুটে, ফেরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার—এককথায় পুরো কলকাতাটাই যেন হামলে পড়ছে এই দৃশ্যে। স্মার্টফোনহীন দুনিয়ায় কোনও ভার্চুয়াল দৃশ্যের বোধ ছাড়াই মানুষ দেখছে- টালমাটাল পায়ে ‘রাস্তার এক-পার থেকে অন্য-পারে হেঁটে চলে যায়/ সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটি শিশু।’ এই শিশুরূপ ব্লেকের অপাপবিদ্ধ অজ্ঞতার মগ্নচৈতন্য থেকে উঠে আসা যেন-বা; যে-অবশ্য সরাসরি কোনও কথা বলে না; যার বাক্-সারল্য আমাদের মনে জাদু ছড়িয়ে কোনও প্রাজ্ঞের প্রতিধ্বনি ঘোষণা করে দেবে— এমন কোনও সম্ভাবনাও দেখা দেয় না। এখানে ওই শিশু নিশ্চুপ, তাই সে-বাঙ্ময়; কিংবা তার উপস্থিতির চেয়েও এখানে জরুরি বিষয়–তার উপস্থিতিকে সামনে রেখে শহরের সমাজতাত্ত্বিক চেহারাটা ক্রমশ প্রকাশ্য করে তোলা; যার শৈলীগত নৈপুণ্যের দিকটিও নজর এড়ায় না। ব্লেকের শিশুজগতের ঘনিষ্ঠ বলেই এই শিশুটিও বিশুদ্ধ উলঙ্গ। ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতাতেও নগ্নতা স্থান-কাল-পাত্রকে অতিক্রম করে একটি রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট হয়ে উঠেছিল। এখানেও, এই নগ্ন শিশুটি অভিপ্রায়গতভাবে কলকাতার আধিপত্যকামী মানুষের কাছে অস্বস্তিস্বরূপ। ক্রুশকাঠ বহনকারী যিশুও কি ওই যন্ত্রণাকাতর ও রক্তাক্ত শরীরে অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠেননি পথচারী ও দর্শকদের চোখের সমীপে? এই শিশুকে নগ্ন দেখার মধ্যে দিয়ে এমন-কিছু-দেখে-ফেলেছে কলকাতার নাগরিক সমাজ, যা-তারা অস্বীকার করে ভুলে থাকতে চায়। এই স্থিরচিত্রটি ইজেলের মতো মনে হয়েছিল, কারণ কিছুক্ষণ আগেই অফিসপাড়া চৌরঙ্গি-তে বৃষ্টি হয়ে গেছে। মায়াবী আলোয় ভাসছে কলকাতা, কারণ অতিতীক্ষ্ণ বল্লমের মতো মেঘের হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে রোদ্দুর নেমে এসেছে। কবিতাটি যার বয়ানে প্রস্তুত হয়েছে, তিনি এই খণ্ডিত দৃশ্যটি দেখছেন স্টেট বাসের জানলায় মুখ রেখে; বোঝাই যাচ্ছে, তিনিও একজন নিত্যযাত্রী যাঁর চোখ দিয়ে আমরা এই অভূতপূর্ব দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করলাম। এমত দৃশ্য তো আকছার হয়ে থাকে; তাহলে এই দৃশ্য সাধারণ হয়েও অ-সামান্য হয়ে উঠছে কীভাবে? এই দৃশ্য দেখা ওই সময়ে ওই চৌরঙ্গি-র বিপুল জনগণের মধ্যে একমাত্র কবির চোখটিই আমাদের চোখ হয়েছে। কেননা তাঁর চোখ পড়েছে বলেই ফুটপাথবাসী এক হতদরিদ্র শিশু পরিণত হয়েছে যিশুখ্রিস্টে। সমস্ত ট্রাফিক সেই থামিয়ে দিতে পেরেছে কোন অলৌকিক মন্ত্রবলে। ভিড়ের সমাজ অতিশয় বিরক্ত ও বিভ্রান্তিকে উপেক্ষা করে ; অসহিষ্ণু ড্রাইভারের দাঁত ঘষটানির মধ্যে দিয়েই সে-শিশু এগিয়ে গেছে- পৃথিবীকে ধরতে চেয়ে অনাবিল হাতের মুঠোয়।
এপিফ্যানির দুটি অর্থ আছে। Oxford Advance Learner’s Dictionary-র মতে: “a Christian festival, held on 6th January in memory of the time when the MAGI came to see the baby jesus at Bethlehem”। যিশুর অলৌকিক আবির্ভাবকেই এপিফ্যানি বলা হয়ে থাকে, তেমনি আবার এর অর্থ বিষয়কেন্দ্রিকতা ছাড়িয়ে হয়ে পড়েছে সাধারণ অর্থ: “a sudden and surprising moment of understanding”। এই কবিতায় দ্বিতীয় ব্যাপারটাই ঘটেছে, হঠাত্ এবং চমকপ্রদ ঘটনা হচ্ছে শিশুটির মাঝরাস্তায় নির্ভয়ে এসে পড়া; কিন্তু সে তো আর দৈবিগুণসম্পন্ন কোনো শিশু নয়, সে সাধারণ ফুটপাথবাসী যে, না-জেনেবুঝেই মাঝরাস্তায় চলে এসেছে। বিষয়টি স্রেফ উদ্বেগের, কিছুজনের কাছে বিরক্তির—আর কিছু নয়। এই সামান্য বিষয়টাই কবির অন্তর্দৃষ্টি মিলিয়ে দিচ্ছে উপনিবেশ-উত্তর পৃথিবীর কৌম-চেতনার সঙ্গে। যে নীরেন্দ্রনাথ বিষণ্ণ হয়ে পড়েন, ব্যস্ত কলকাতায় বাড়ি খুঁজতে-খুঁজতে কিংবা আত্মসন্দেহের বশে বুঝে ফেলেন এই কলকাতার মধ্যেও আর একটা কলকাতা আছে যেখানে নাগরিক হৃত্পিণ্ডের আড়ালে সেখানে পুরোনো দুঃখের পুড়ে যাওয়ার গন্ধ পাওয়া যায়; রক্তমাখা স্মৃতির গম্বুজে মনে হয়: “সমস্ত রাস্তাই যেন চলে গেছে শৈশবের দিকে”। উপনিবেশ-আক্রান্ত অসহায় সেই কবিমন বুঝতে পারে, এই শিশুকে সেই জন্ম-জন্মান্তরের রাস্তা পার করে আসতে হয়েছে। হাজার বছর পৃথিবীকে মাড়িয়ে চলার জেদই এই পবিত্র পথচলাকে ক’রে দেয় একাকী মানুষের লং-মার্চ। সবকিছুকেই করে দেয় নিজের রক্তের মতো চেনা। সেই রক্তের পথ ধরেই এসেছে ওই শিশু সারল্যের গান নিয়ে। এই হাঁটা তাই নিছক পথচারীর জীবন ও জীবিকার অস্তিত্বরক্ষার ফুটপাত বদল নয়, যে-পেরোচ্ছে তার তো কোনোরূপ চেতনা ও স্মৃতিই নেই ফুটপাত সম্পর্কে; সে যাচ্ছে চলার বিস্ময় ও আনন্দে—এই চলা ‘পৃথিবীর এক-কিনার থেকে অন্য-কিনারে’। কাঁধে তার অলৌকিক ক্রুশকাঠ; মানুষের অনন্ত দুঃখের ভার তিনি গ্রহণ করেছেন। আলো এসে পড়েছে তার টালমাটাল পায়ে। কলকাতার বুকে–এপ্রিলের নিষ্ঠুর প্রহরকে নন্দিত করা এক অকাল বড়দিন।