রাজা, রাজা মিত্রর সঙ্গে আমার আলাপ সেই ১৯৬৭ সাল থেকে। আমি, রাজা সকলে মিলে তখন ‘ঋত্বিক গোষ্ঠী’ বলে একটা দল করি। সেখানে শিল্পসাহিত্য নিয়ে প্রচণ্ড উত্তেজনা ছিল। রাজনৈতিক নানা ঘটনাবলি নিয়ে আমরা খুবই ভাবিত ছিলাম তখন, নানাবিধ আন্দোলন-অভ্যুত্থানের মধ্যে ছিলাম। এই গোষ্ঠীতে আমি ছিলাম, যাকে বাংলায় বলে ‘ইঁচড়ে পাকা’। দর্শন, ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা, আগ্রহ তো ছিলই, আর একইসঙ্গে ছিলাম সিনেমাপাগল! রাজারা সেজন্য আমাকে ‘গোদার’ বলে ডাকত। তখন সকলেই জীবিকার জন্য নানা পথ খুঁজে চলেছে। সনৎ দাশগুপ্ত আর রাজা আমার সঙ্গে ভিড়ে গেল তখন। শুটিংয়ে যেত, দেখত, সিনেমা নিয়ে আলোচনা করত। সিনেমার বইপত্র আমি যা বলছি, সেগুলো পড়ত। কিছুদিন আমার সঙ্গে কাজ করার পর ওরা নিজেরাও কাজ করা শুরু করল। রাজা তথ্যচিত্রর পথই বেছে নিয়েছিল। সেসময় রাজা অনেক তথ্যচিত্র করেছে, শর্ট ফিল্ম করেছে।
রাজা ওর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যর কাহিনিচিত্র বানিয়েছিল ১৯৮৮ সালে। যেটা খুব ইন্টারেস্টিং, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর এই উপন্যাস ‘একটি জীবন’ আসলে করার কথা ছিল সত্যজিৎ রায়ের। আমি যথন মানিকদাকে নিয়ে তথ্যচিত্রটা বানিয়েছিলাম, তখন মানিকদার ঘরটা বউদি খুলে দিয়েছিলেন আমার জন্য। সেখানে দেখেছিলাম মানিকদার খাতায় নোট নেওয়া, অভিধানটা কীভাবে কীভাবে তৈরি হচ্ছে, তার সঙ্গে সমান্তরালে দেশের ও পৃথিবীর অবস্থা কীভাবে বদলাচ্ছে, তার একটা রূপরেখা করা ছিল। সেটা যদিও আমি অনেক পরে আবিষ্কার করেছি। মানিকদা সেই ছবিটা করেননি, তখন বুদ্ধদেব বসুর পরিবারের থেকে রাইটটা রাজা পায়। চমৎকার ছবি করেছিল ও। সৌমিত্রদা অসাধারণ অভিনয় করেছিল, জাতীয় পুরস্কারও পায় ওই ছবি।
ফিচার ছবির পাশাপাশি তথ্যচিত্রও প্রচুর করেছে রাজা। কবিতা লিখত, ছবিও আঁকত। একজন চিত্রশিল্পীর দৃষ্টি থেকেই ও বীরভূমের পটচিত্র নিয়ে ছবি করেছে, কাজ করেছে কালীঘাট পটচিত্র নিয়েও। শিল্প সংক্রান্ত বিষয়ে ওর উৎসাহ ছিল প্রবল। এই কাজগুলোও সেজন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এখনকার মতো তখন ফিল্মমেকারদের হাতে এত কাজ ছিল না। ফলে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য অন্য কাজ করতে হত। আমিও করেছি, রাজাও করেছে। ভাবলে অদ্ভুত লাগে, আমার লগে লগে এসে, রাজা এবং সনৎ সিনেমাকেই প্রাথমিক পেশা হিসেবে বেছে নিল। শিল্পসম্মত কাজ করার প্রতিই আগ্রহ ছিল রাজার। একটা উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে আমাদের যৌবন কেটেছে। নকশালবাড়ি আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- সব মিলিয়ে একটা উন্মাদনা তখন। সেই সময়টা আমাদের সবাইকেই খুব উদ্বুদ্ধ করেছিল। রাজাও সেই স্রোতেই ছবি করতে এল। আমাদের মধ্যে এমন ছবি বানানোর তাগিদ ছিল, যার মধ্যে একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। সেসময় ফিল্ম সোসাইটির সূত্রে আমরা দেশবিদেশের নানা ছবি দেখছি। মৃণালদা, মৃণাল সেন আমাদের লাতিন আমেরিকান ছবি দেখাচ্ছেন তখন, বলেছিলেন, ‘দেখো, কীভাবে সাধারণ মানুষের কথা উঠে আসছে এই ছবিগুলোতে।‘ রাজা সেই মতাদর্শ থেকেই ছবিগুলো বানিয়েছে।
আরও অনেক কাজ করার কথা ছিল ওর। কিন্তু অকস্মাৎ মারণরোগ বাসা বাঁধল শরীরে। এটা এতটাই দুর্ভাগ্যজনক, যে কিচ্ছু বলার নেই। আমরা অনেক চেষ্টাও করেছিলাম। খুব মনে পড়ে সেই প্রথমদিকের দিনগুলোর কথা। তখন রাজা কবিতা লিখত, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতা লিখত, আর যেহেতু আমি একটু পড়াশোনা করতাম, আমাকে ওরা জাজ হিসেবে রাখত, কার কবিতা ভাল সেটা দেখার জন্য। সেসব কতকাল আগের কথা।
এখন চিন্তা একটাই, রাজার কাজগুলো পরবর্তী প্রজন্ম দেখতে পাবে কি না। সংরক্ষণের অবস্থা তো খুবই খারাপ। রাজার নেগেটিভগুলো কোথায় আছে, দেখতে হবে। ‘একটি জীবন’-এরও ভাল প্রিন্ট সংরক্ষণ জরুরি। এটা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ বলে মনে হয়। সংরক্ষণ তো আমাদের জাতীয় চরিত্রেই নেই। বিদেশে এমনটা হয় না।যদিও বম্বের তাবড় পরিচালকরা তাঁদের ছবির নেগেটিভ সংরক্ষণ করে রেখেছেন। বাংলায় সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই কাজ আগামীর জন্য করে যেতেই হবে।