সুপ্রভা – দুই
বাপের বাড়ি থেকে সেই যে খোকা কোলে সোদপুরের বাড়িতে এসে ঢুকল সুপ্রভা, সে অবধি ভূতেশ আর আসতেই পারেনি। মা-বাবাকে লেখা ভূতেশের চিঠি থেকেই সুপ্রভা জানতে পারে যে, তার কর্তা ভালই আছে; কাজের খুব চাপ, ছুটি নেই। তিন ছেলেমেয়েকে সামলে সুপ্রভারও আর দেহ সরে না চিঠি লিখতে বসতে। তার হয়ে যেটুকু যা জানাবার, তা ওই বড়খুকিই লিখে দেয়। বাবার ইচ্ছে নয়, ভূতেশের বড় দুই মেয়ে বা ছোটখুকির দুই মেয়ে কেউই বাড়ির বাইরে গিয়ে ইশকুলে যাক; বাড়ির তিন কিশোর অবশ্য পাড়ার ইশকুলে যায়।আর সুপ্রভার ছেলেটার বয়স তো সবে বছর দুয়েক। দাদা-দিদিদের সঙ্গে খেলা করে বাড়ি মাতিয়ে রাখে সে। সুপ্রভার শরীরটা মাঝে মাঝেই বেঁকে বসে। নিধিকাকিমা থাকলেও সে পেরে উঠছে না; মস্ত শিলে রাশি-রাশি বাটনা আর রান্নার জোগাড় দিতে-দিতেই তার পিঠ যেন বেঁকে যায়; ছেলেকে দুধ খাওয়ানোর সময়ে, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসেই, লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সুপ্রভা। সুপ্রভার এই স্বাস্থ্যহানির কথা বড়খুকির চিঠিতে জেনে, কর্তা নিদান দিয়েছে ভাল করে ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করতে; কিন্তু সে-সময়টুকু কোথায় যে, সংসার থেকে ছুটি নিয়ে নিজের জন্য সময় বার করবে সুপ্রভা!
তবে ডাক্তার ডাকতেই হল। নিধিকাকা নিজে গিয়ে নিয়ে এল, পাড়ার সেই নাড়ি-টেপা ভূধর ডাক্তারকে। দাগ-দেওয়া বোতলে লাল-মিক্সচার দিয়ে ডাক্তার বলে গেলেন, রক্তপরীক্ষা করাতে; তাতেই ধরা পড়ল যে, টাইফয়েড হয়েছে সুপ্রভার। এবার সে কিছুতেই জানাতে দিল না তার বাবাকে। অনভিজ্ঞতার কারণে সুপ্রভা নিজেও ঠিক বুঝতে পারল না যে, এই জ্বরের প্রকোপে, রোগীর পরিণতি কতখানি মারাত্মক হতে পারে। কিন্তু বিপর্যয় নেমে এল, খোকারও টাইফয়েড ধরা পড়ায়। ধীরে-ধীরে সুপ্রভা সেরে উঠলেও, খোকাকে বাঁচানো গেল না কিছুতেই। জ্বরে নেতিয়ে পড়া ছেলের শ্বাস থেমে গেলে, সুপ্রভার কোল থেকে নামিয়ে, তাকে শুইয়ে দেওয়া হল, বাড়ির উঠোনেই তুলসীমঞ্চের নীচে। ওই দুর্বল শরীরেও পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগল সুপ্রভা। মায়ের ওই অবস্থা দেখে, ভীষণ ভয় পেয়ে গেল সুপ্রভার দুই মেয়ে। শাশুড়িমা অজ্ঞান হয়ে কোমায় চলে গেলেন। একটা নতুন মার্কিন কাপড়ে খোকাকে আপাদমস্তক মুড়ে, বড়খুকি তুলে দিল নিধিকাকার হাতে। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে নিধিকাকা চলে গেল তাকে মাটি দিতে।
একদিকে অচৈতন্য মা এবং অন্যদিকে আধা-উন্মাদ সুপ্রভাকে নিয়ে এক ভয়ংকর বিপাকে পড়ে গেল বড়খুকি। তার ভরসা বলতে তো ওই নিধিকাকা আর কাকিমা।সেদিনই ‘তার’ করা হয়েছিল ভূতেশের কাছে; উত্তর এসেছিল, ‘coming soon’।তবে ‘আসছি’ বলে আর বেশি কাল কাটাবার সুযোগ পেল না ভূতেশ। কারণ নাতির শোকে, কোমায় চলে যাবার দু’দিন পরেই দেহ রাখলেন ভূতেশের মা। তার কাছে আবার একটা ‘তার’ যেতেই, একেবারে তড়িঘড়ি করেই বাড়ি এসে হাজির হল ভূতেশ। বলতে গেলে, একইসঙ্গে দরজায় পা দিলেন, সুপ্রভার বাবা এবং ভূতেশ। মায়ের মৃত্যুতে লঘু হয়ে গেল ভুতেশের পুত্রশোক এবং অসুস্থ সুপ্রভার জন্য উদ্বেগ। কাছা পরে, মাথা কামিয়ে, শ্রাদ্ধশান্তি মিটিয়ে একটু থিতু হয়ে বসে, এইবার ভূতেশ সময় পেল সুপ্রভাকে নিয়ে ভাববার।
সুপ্রভার বাবা অনেকবার বলা সত্ত্বেও কিছুতেই সে রাজি হল না আবার বাপের বাড়ি যেতে।আট-দশ বছরের দুই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েও তার মনে হল না যে, শোক কাটিয়ে বুক বেঁধে উঠে দাঁড়াবার। পুকুরে সাঁতার, গাছের যত্ন, নিজের চুল বাঁধা, রান্নার জোগাড়— সবই প্রায় ছেড়ে দিল সুপ্রভা। না আছে তার খিদে-তেষ্টার বোধ, না চোখের জল।কৃপানাথকেও বোধহয় ভুলে গেল সুপ্রভা। নিজের আঁচলখানা মেঝেতে বিছিয়ে সারাদিনটাই প্রায় শুয়ে থাকে ঝিম মেরে; দুধে ভেসে যায় তার বুক। মাথার বালিশটাকেই খোকা ভেবে, সেটা আঁকড়েই সমস্ত রাত জেগে বসে থাকে ঘুম-ছুটে-যাওয়া সুপ্রভা। মাঝে মাঝে নিধিকাকাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, ‘খোকা! কোথায় রেখে এলে তাকে! এত বড় বাগানে কি একটুও মাটি জুটত না খোকার!’
শাশুড়ি-মায়ের অশৌচান্তে, নিধিকাকিমাই জোর করে স্নান করিয়ে, কাচা কাপড় পরিয়ে, কপালে সিঁদুর ছুঁইয়ে দিল সুপ্রভার। পাথরমূর্তি সুপ্রভা শুধু বলল, ‘খোকার অশৌচ শেষ হবে না; আমি তাকে গায়ে মেখে থাকব।’ সারাদিন উপোসে থাকলেও, সন্ধের সময়ে জোর করে একটু দুধ-বাতাসা খাইয়ে, বড়খুকি ধরে-ধরে নিয়ে গিয়ে সুপ্রভাকে পৌঁছে দিল ভূতেশের ঘরে। ভূতেশের বিছানার একপাশে বসেই, ধুপ করে এলিয়ে পড়ল সে; বিছানাটা নড়ে উঠতেই ঘুম ভেঙে গেল ভূতেশের। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে, সেই ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল বড়খুকি। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে বাড়ির বাগানটা। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, পুকুরের ওপরে ভেসে থাকা ছাইরঙা আকাশে রাশি-রাশি তারা; সুপ্রভার লাগানো হাসনুহানা, স্বর্ণচাঁপা আর লেবুফুলের গন্ধে ভরে আছে তাদের ঘরখানাও। দেওয়ালে ভেসে আছে, বাতাসে-দোল-খাওয়া বড়-বড় কলাপাতার সিল্যুয়েট। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, সত্যি-সত্যি ওখানেই বুঝি সেই মস্ত কলাবাগানটাও। এমন পরিবেশ! বহু বছর হল এসব থেকে দূরে সরে গেছে ভূতেশ; তবু সে বুঝতে পারল, কেন পরি এখানে থাকতেই এত আরাম পায়; বাপের বাড়ির মতোই আসলে সে শ্বাস নেয় এই আগান-বাগানের মধ্যে বাস করে।পরি ওরকম নেতিয়ে পড়ায় বেশ খানিক আড়ষ্ট হয়ে গেল ভূতেশ; আদর করে, তাকে যে জাগিয়ে তুলবে, সে-আচরণ তো তার ধাতেই নেই। কথাও এত কম বলে যে, খেই পেল না কী ভাবে কোন কথা দিয়ে পরির ঘুম ভাঙাবে সে। জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে সে শুনতে পেল, জড়ানো গলায় পরি বলছে, ‘শুয়ে পড়ো, আমি ভাল আছি।’
‘ভাল তো দেখছি না; ওইরকম জড়সড় হয়ে কেউ ঘুমোয়?’
‘খোকা আর ফিরবে না, কোথায় যে রেখে এল ওকে!’
‘মরা ছেলেকে তো মাটিই দিতে হবে।’
‘ও আছে। বুকের দুধ খেতে না-পেয়ে খুব কাঁদছে।’
একটা বেড়াল কেঁদে উঠল, জানলার নীচে। ঘরের মধ্যেই ফড়ফড় করে উড়তে লাগল দুটো চামচিকে। হঠাৎ করে মেঘে ঢেকে গেল চাঁদের আলো। জোনাকির আলোয় বাগানটা ডুবে গেল আরও অন্ধকারে। সুপ্রভাকে সোজা করে শুইয়ে, তার ওপর নিজেকে ভাসিয়ে দিল ভূতেশ; বাধা দিল না সুপ্রভা। সঙ্গম শেষে, বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরল ভূতেশ। নারীসঙ্গ এত বিস্বাদও হয়! যে এক মাস সে থাকল, প্রায় প্রতিরাতেই ভূতেশ মিলিত হল সুপ্রভার সঙ্গে; কিন্তু এই সুপ্রভা যেন তার খোকার মতোই এক মরা মেয়েমানুষ; না আছে উৎসাহ, না আছে বাধা দেওয়া, না তার চোখে কোনও জল। ভূতেশ মনে-মনে ঠিকই বুঝল যে, এক গভীর অবসাদে ডুবে আছে পরি।
২
ভূতেশ থাকতে-থাকতেই বোঝা গেল যে, সুপ্রভার গর্ভে আবার সন্তান এসেছে। বিপিনের আসা-যাওয়াতে ছোটখুকিও আগেই পোয়াতি। অভাব-অনটনের সংসারেও কিন্তু বছর-বছর বাচ্চা হওয়া নিয়ে সধবা বউরা কেউ কাউকে বড় একটা কথা শোনায় না। এয়োস্ত্রীর পাতে আঁষ না থাকা যেমন অশুভ, তেমনি সধবাও যে বছর-বিয়নি হবে এটাই যেন দস্তুর।বড়বউ, মেজবউ আর বড়খুকি ভাগ্যিস বিধবা! না হলে তো এ-সংসারে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত! এসব মেয়েলি ব্যাপারে ভূতেশেরও যে খুব একটা মাথাব্যথা আছে তা নয়। ডাক্তারের দেওয়া সেই মিক্সচারের পর আর কোনও ওষুধও পড়েনি সুপ্রভার স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায়।নিধিকাকিমাই শুধু ঘি-মরিচে সাঁতলে এক বাটি সেদ্ধ গেঁড়ি নিয়ম করে সুপ্রভাকে খাওয়ায়।বিধবা মেজবউ ফোড়ন কেটে বলে, ‘ওইরকম কাঁড়ি-কাঁড়ি গেঁড়ি খেলে, শামুকের মতোই ওর পেটে থাকা ছড়া-ছড়া ডিম তো আরও বাড়বে গো!’ বিরক্ত নিধিকাকিমা থাকতে না পেরে একদিন উত্তর দেয়, ‘খাওয়াবার মালিক তো টাকা পাঠাতে দেরি করে না; শামুক কি গেঁড়ি তাকেই না হয় বুঝতে দাও!’
ভূতেশ মেতে আছে নানা পরিকল্পনায়। নিজের বাবা এবং নিশির সঙ্গে সেসব আলোচনাও কানে আসে সুপ্রভার। যুদ্ধ থেমে গেলেও অশান্তি নাকি লেগেই আছে; কিন্তু যুদ্ধের বাজার বুঝে দিল্লি থেকে ভূতেশ নাকি ট্রান্সফার নিয়েছে সিমলাতে। সেখানেই সে একটা দোকান করবে ভাবছে; সুপ্রভাকে সুস্থ হতেই হবে; কারণ সেই দোকানটা হবে সুপ্রভার নামে।সরকারি চাকরি করে নিজের নামে দোকান করার অনুমতি পাইনি ভূতেশ। নিজের তিন মাসতুতো ভাই এবং বড়দার ছেলেটাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে, কর্মচারী হিসেবে কাজে লাগিয়ে দেবে। অন্যদিকে পাত্র দেখাও শুরু করে দিয়েছে সে নিজের এবং বড়খুকির দুই মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য। এ-ব্যাপারে সহমত তার বাবাও। সুপ্রভা তো মতামত দেবার জায়গাতেই নেই। বড়খুকির গুনগুনেরই বা কে তোয়াক্কা করে!
৩
আসন্ন সন্তানসম্ভবা সুপ্রভা এবং দুই মেয়েকে নিয়ে ভূতেশ রওনা দেবে মালদায়। সেখানে তাদের রেখে, একাই সে ট্রেন ধরবে দিল্লির। সময়-সুযোগ বুঝে, পরে এসে সে দিল্লি নিয়ে যাবে তাদের। মালদা যাবার আগের দিন অঝোরে কাঁদতে লাগল সুপ্রভা। তার মনে হল যে, খোকাকে একা ফেলে সবাই মিলে যেন চলে যাচ্ছে তারা। খোকার খাবারের থালা-বাটি-গেলাস আর তার সেই কাঠের টিয়াপখি খেলনাটাকে একটা মাটির কলসিতে ভরে রেখে দিল সুপ্রভা। রাতের খাওয়া সেরে সকলে শুতে চলে গেলে, সেই মাটির কলসিখানা নিজের আঁচলের তলায় লুকিয়ে, উন্মাদের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে এল পরি। একটা নিড়ানি দিয়ে উঠোনের মধ্যেই মাটি খুঁড়ে হাতখানেক গর্ত করে সেগুলো পুঁতে, তার ওপর বসিয়ে দিল একটা শিউলিচারা। এমন করে পুঁতে দিল যে, ঘাসপাতার আড়ালে তা যে কারোর নজরে পড়বে এমন উপায় রইল না। আঁজলায় করে জল দিতে-দিতে খুব খানিক কাঁদল সুপ্রভা।উঠে আসবার সময়ে দেখল যে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে বড়খুকি সব দেখছে। বড়খুকির বুকের ওপর আছড়ে পড়ল শীর্ণ অসহায় পরি; বারে বারে শুধু বলতে লাগল, ‘তুমি ওকে একটু দেখে রেখো গো ঠাকুরঝি! গাছটা যেন মরে না যায়, ওরই গোড়ায় যে খোকা আছে।’
সুপ্রভা আর বড়খুকি দুজনে দুজনকে জড়িয়ে থরথর করে এমন কাঁপতে লাগল, যেন মাঘের শীতে ঝড়ে পড়েছে তারা।
আমি সুপ্রভা। পরি নামটা ধীরে-ধীরে হারিয়েই গেছে। তার জায়গায় এখন গাদাগুচ্ছের বউদি, কাকিমা, মামিমা। খোকার পরে মেয়ে হল আমার। কোলজুড়ে নরম একটা পুঁটলি পেয়ে মন যেন কিছুটা শান্ত হল। কিন্তু সেই খুকির পরে আবার যে-মেয়ে কোলে এল, সেও বাঁচল না; মানে মরা অবস্থাতেই প্রসব করেছিলাম তাকে। সে-শোকে আর কাতর হলাম কই! বছর-বছর বাচ্চা হবে এবং তাদের মধ্যে একটা-দুটো যে মরবেই, এমনটাই তো বোঝানো হয়েছে আমাকে। তবে আমার বাচ্চার সংখ্যা ছোটখুকিকে ছাড়িয়ে গেল, একদিনের জ্বরে, ঠাকুরজামাই হঠাৎ করে গত হওয়ায়। কিন্তু আমার করিৎকর্মা কর্তার কল্যাণে কোলপোঁচা ছোট ছেলেটা তো, বড়মেয়ে এবং মেজমেয়ের ছেলের থেকেও বয়সে ছোট। সে জন্মাল যখন, আমার বয়েস প্রায় বিয়াল্লিশ।
দিল্লির সংসার, সাহেবি পসরার দোকান, অঢেল পয়সা এবং আমার কর্তার চাকরিজীবনে উন্নতি— সবই চলতে লাগল জোরকদমে। জীবনটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়াই যে আসল ব্যবসা, এটা বেশ ভালভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিল আমার কর্তা। পরিবার-পরিজনের দেখভালে তার কোনও আপত্তি নেই; কিন্তু ভয়ংকর অসুবিধে তার কাউকে বিশেষভাবে ভালবাসতে।
সিমলে-দিল্লি— এই দু’জায়গা মিলিয়ে থাকাতে অনেক সাহেবদেরও দেখতে পেলাম।দেখলাম যে ব্রিটিশ সাহেবদের থেকে আমেরিকান সাহেবরা একটু যেন বেশি হাসিখুশি।দোকানে যাতায়াত করতে-করতে চিনে ফেললাম কতরকম জিনিসের কৌটো। খুব ভাল লাগত টিনে রাখা মাছ আর নানারকম চকোলেট খেতে। শিখলাম, হ্যাম, পর্ক, বেকন এসব দিয়ে স্যান্ডুইচ বানানো। ছেলেমেয়েরা সাহেবি কেতায় বড় হতে শুরু করলেও, আমি কখনও শাড়ি ছেড়ে গাউন বা শাল ফেলে কার্ডিগান ধরিনি। তবে কর্তার এনে দেওয়া চামড়ার বাহারি জুতোগুলো পরে পা-দুটো যেন পালকের মতো হালকা হয়ে যেত। আর ভাল লাগত, কর্তার নির্দেশে, প্রসবের পর অ্যাংলো আয়াবিবি যখন সপ্তাহখানেক ধরে নিয়ম করে আমাকে ব্র্যান্ডি খাওয়াত।
মাঝে মাঝে মনে পড়ে আমার শাশুড়িমায়ের মারা যাওয়ার দিনটা। অতীব সুন্দরী ছিলেন বলে, শ্বশুরমশাই তাঁকে কারোর সামনেই বার হতে দিতেন না। এ-নিয়ে বিস্তর অনুযোগ ছিল তাঁর বন্ধুদের মধ্যে। মারা যাওয়ার পর সধবার সাজে তাঁকে সাজিয়ে, বন্ধুদের ডেকে পাঠালেন, তাঁর ‘পরিবার’-এর মুখখানি দেখবার অনুমতি দিয়ে। এইরকম অদ্ভুত আচরণ এর আগে আমি কোথাও দেখিনি। আমার কর্তা ছাড়া শাশুড়ির রূপ আর কোনও ছেলেমেয়েই পাইনি।
ইতিমধ্যে মালদার বাড়িও ফাঁকা হতে শুরু করেছে। বাবা-মা দুজনেই চলে গেছে। বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা ইশকুলে মাস্টারনির কাজ জুটিয়ে নিয়েছে, বোন; ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে সংসারে থিতুও করেছে তাকে। কর্তার সঙ্গে দিল্লি চলে যাবার পর বাপের বাড়ি গিয়ে-গিয়ে থাকবার পাট একেবারেই উঠে গেছে। সোদপুরের বাড়িতেও কমই যাওয়া হয়ে ওঠে।শ্বশুরমশাই দেহ রাখার পর বড়খুকি খুবই একা হয়ে গেছে। পাশের বাড়িতে থেকে যেটুকু যা দেখাশনা নিধিকাকারাই করে; তাদের ছেলে ওখানেই কোন এক বেসরকারি কারখানায় কাজ পেয়েছে। কৃপানাথের সেবাও করে সেই-ই।
একঘর ছেলেপুলে, নাতি-নাতনি নিয়ে সংসার একেবারে জমজমাট। কিন্তু আমি যেন দুনিয়ার বার হয়ে যাওয়া একটা মানুষ। চাকরি শেষে দিল্লিতে না থিতু হয়ে পরিবার নিয়ে সোদপুরেই ফিরে এলেন কর্তা। দুই মাসতুতো দেওর এবং ভাসুরপো অবশ্য সরকারি কাজ পেয়ে থেকে গেল দিল্লিতেই। বাড়ির কাছেই ঘর দেখে দিয়ে, ছেলেপুলে নিয়ে ছোটখুকিকে ভাড়াঘরে পাঠিয়ে দিলেন কর্তা; মাসের ভাড়া তিনিই দিতেন; বাড়িটাকে নিজের কব্জায় এনে নিতে কোথাও একটুও বাধল না কর্তার। বাপের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েও কোনওই দাবি জানাতে সাহস পেল না ভাসুরপোও। আমিই যেন মরমে মরে থাকলাম, কর্তার এমন বিষয়বুদ্ধি দেখে। শুধু কি ভাসুরপো!
সব ক’টি জামাই এবং ছেলের বউ— সকলেই তোয়াজ করে তাঁকে; সকলের মনেই এক চাপা অসন্তোষ যে, আমি কেন তেমন করে হাল ধরি না এ-সংসারের! মা উদাসীন বলে অসন্তোষ আমার ছেলেমেয়েদের মধ্যেও।
এমন দিন যায় না, যেদিন খোকার কথা ভেবে চোখের জল পড়ে না। আগে ‘বছর-বিয়োনি’ বলে আমাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করত; আর এখন হাসে, খোকার কথা ভেবে লুকিয়ে কাঁদি বলে। কত কী না শুনতে হয়েছে! ‘পাগল’, ‘জন্তু’, ‘গরু-গরু চোখ’— কিছুই গায়ে মাখিনি আমি; আবার এমন বলাবলিও শুনেছি, ‘ওরে, ছোটগিন্নি যদি তার কর্তার ট্যাঁকের জোরে একটুও হুঁশিয়ারি ফলাত, তবে আমাদের আর এখানে এমন দাপটের সঙ্গে সংসার করতে হত না।’ কোনওদিন তো ইচ্ছেই করল না, ব্যবসাবুদ্ধি নিয়ে নিরেট ভাগ-বাঁটোয়ারায় যেতে। গরিব-দুঃখীদের মতোই নিজেকে নিঃস্বই মনে হল চিরকাল।
আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এই ফুল জাগানো বাগানটা। গাছ লাগাই, মাটি খুঁড়ি আর ফুল ফোটাই। পুকুরে এক ডুব দিয়ে এসে, ঘরে ঘরে সাজিয়ে রাখি কামিনীপাতার ডাল।হাঁড়িকুঁড়ি যা পাই তাতেই লাগিয়ে দিই বেলফুলের চারা। কর্তার ঘর-বাড়ি সংস্কার লেগেই থাকে। উঠোনের চারপাশে বাঁধানো রকের ওপর সার দিয়ে বেলফুল ফোটে। উঠোনটাকে সিমেন্ট বাঁধাতে দিইনি। কারণ ছাদে ওঠার চওড়া সিঁড়ির গায়ে হেলান দিয়ে বেড়ে উঠেছে সেই শিউলি গাছটা। ওই মাটিতেই তো খোকা মিশে আছে।
শিউলিতলাটা বিকেলেই নিকিয়ে রাখি, যাতে সেই নিকানো উঠোনে রোজ ফুল ঝরে থাকে।রাতের বেলায় ওই ঝাঁকড়া গাছটাকে দেখলে অবাকই লাগে। কেমন এক ঘন সবুজ অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ে তার ডালপালা। শুধু দেখা যায় তারার মতো ফুটে থাকা, থোকায়-থোকায় শুধু ওই শিউলিগুলো; ওরই সুবাসে যেন মিশে থাকে খোকার গায়ের দুধ-দুধ গন্ধ আর খিলখিল করে হেসে ওঠা জ্বলজ্বলে চোখ দুটো। ভোরবেলা দেখি, সব ফুল মাটিতে ঝরে পড়ে যেন এক নরম চাদর; খোকা শুয়ে আছে, সেই ফুলের বিছানায়।
নিজেকেও চিনতে পারি না আর। সংসারে থাকি যেন কোন ভূত। ওই শিউলি গাছের কোটরেই লুকিয়ে রেখেছি পরিকে, ভীষণ গোপনে। কেউ কিচ্ছু টেরই পায় না আর। বাইরে থেকে পাহারা দেয় চাক-চাক দলা-দলা কিছু শুঁয়োপোকা।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র