তরঙ্গনাথ – পাঁচ
দিন দশেকের ছুটিতে এলেও তরঙ্গনাথকে একরকম জোর করেই শিবনিবাস পাঠালেন তার বাবা। মায়েরও সেই একই কথা, যাতে সে নিজে গিয়ে পাত্রীটিকে একবার দেখে আসে; অগত্যা রাজি হতেই হল। তরঙ্গনাথের কাছে এ এক বেজায় বিড়ম্বনা; এ তো আর সেরকম যাওয়া নয় যে পাত্রী দেখার ছুতোয় সে আর হরু বেশ ফুরফুর করে বেড়িয়ে এসে গম্ভীর হয়ে জানাল যে, পাত্রী তাদের মোটেই পছন্দ হয়নি! একবার তো বড় তরফের সেজো দাদার জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে হরুর সঙ্গে জুটে, হবু কাকিমার বাড়ির পুকুরে দাপিয়ে সাঁতার কেটে, গাছে উঠে, তাদের বাগানের ডাঁশা পেয়ারা আর পাকা পাকা বিলিতি আমড়া সাঁটিয়ে, দুপুরে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে বিকেলের গাড়িতে উঠেছিল! সেজদা যখন জানতে চেয়েছিল যে মেয়েটাকে কেমন বুঝল তারা, তনুর তো মাথায় হাত! হরু বুদ্ধি করে চটজলদি ভাগ্যিস বলে দিয়েছিল যে, বড় হলে মনে হয় স্বাস্থ্যবতীই হবে! তনু এদিকে বিশেষ কোনও একজন বালিকার মুখও আলাদা করে পাত্রী বলে মনে করতে পারেনি সেদিন; কারণ ওই ঘরে ঢোকার আগেই তো তারা কেটে পড়েছিল আশপাশটা একটু ঘুরে দেখবে বলে। সে বিয়ে অবশ্য হয়েছিল; উঠতে-বসতে সেজোবউদি খোঁচা দেয় এখনও, তাদের নজরে রাখা ডাঁশা পেয়ারাগুলো সাবাড় করে খেয়ে ফেলার জন্য। ফলে অন্যের জন্য পাত্রী দেখা আর নিজের জন্য দেখে রাখা পাত্রীর ওপর একবার চোখ বু্লিয়ে আসায় বিস্তর ফারাক দেখতে পাচ্ছে তনু। অন্তত জনা-চারেকের দল জুটিয়ে যাওয়া, চব্যচুষ্য খাওয়া, পাত্রপক্ষের ট্যাঁকশ-ট্যাঁকশ কথা এবং অহঙ্কারী হাবভাবের সামনে পাত্রীপক্ষের সিঁটিয়ে থাকা— এ সব ভেবেই ভারী ব্যাজার লাগছে তনুর। তার ওপর এই দলে হরু যে তার সঙ্গে যাবে এমন আশাও দুরস্থান। শেষে এই স্থির হল যে হরুর ভাই নিশি আর সেজদাকে নিয়ে তনুরা বেরিয়ে পড়বে সকাল সকাল। নিশি যাচ্ছে শুনেই তার ছোটভাই বদুও বায়না ধরল যাবে বলে। রাণী জানে যে বায়না করলেও সে যেতে পারবে না, তাই সে নানা ছুতোয় উঠে পড়ে লাগল বদুর যাওয়াটা যাতে আটকানো যায়!
সকাল হতেই নিশি এবং সেজদা এ বাড়িতে এসে হাজির; সকলেরই পরনে রোজকার মতোই পিছন দিকে কাছা এবং সামনে কোঁচা ঝুলিয়ে মিলের ধুতি; আর গায়ে মোটা কাপড়ের গলা বন্ধ পাঞ্জাবি এবং পায়ে তালতলার চটি; বদু অবশ্য চেষ্টায় ছিল তার দাদার পুলিশের ড্রেসটা টুপি সমেত গায়ে চাপাবার। যদিও গরম পড়ে গেছে তবু বেরোবার সময় একটা হালকা চাদর এনে, তনুর হাতে দিয়ে মা বললেন, ‘আলগা করে কাঁধে ফেলে রাখ।’ সেজদা মিচকে হেসে বলল, ‘কাঁধে চাপাও বাবাজীবন; নইলে নিশিকেই না পাত্র বলে ভুল করে সকলে!’ বদুর দিকে তাকিয়ে নিশি বলল, ‘চলো নিতবর মশাই; তুমিই পথ দেখাও!’
বাবা-মাকে প্রণাম করে ওরা চারজনে বেরিয়ে এল। প্রায় হাঁটা পথেই রেল স্টেশন; ঘণ্টা চারেক পরে শিবনিবাস পৌঁছল; বেজায় গরম এবং মাথার ওপর ছনছন করছে জ্বলন্ত সূর্যের তেজ; চাঁদি প্রায় ফেটে যাবার জোগাড়। ওদের নিতে নিজেই স্টেশনে এসেছেন তনুর হবু শ্বশুরমশাই; কালীপদ ভট্চায পেশায় হোমিওপ্যাথি ডাক্তার; তাঁর তিন মেয়ে এবং এক ছেলের মধ্যে তরঙ্গনাথের হবু স্ত্রী তরুলতাই সকলের বড়; নিজের ছাতা ছাড়াও আরও তিনখানি লম্বা বাঁটের কালো ছাতা নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছেন কালীপদ। তনু, নিশি এবং তনুর সেজদা— এই তিনজনের হাতে তিনখানি ছাতা ধরিয়ে দিয়ে, বদুর হাত ধরে কাছে টেনে বললেন, ‘তুমি বাবা তাহলে এই ছাতার তলায় না হয় আমার সঙ্গেই চলো!’
২
মেয়ে দেখার জন্য আসা অথচ পাত্রী ছাড়া আর সকলেই হাজির; দফায় দফায় কেবল খাওয়া। মেয়ের কাকিমা নিয়ে এলেন চিনির পানা, বউদির হাতে কচি ডাব, মায়ের হাতে প্লেট সাজানো মিষ্টি। তার সঙ্গে এদিক-সেদিক থেকে বাচ্চা-বুড়ো-জোয়ান, সব বয়সের মেয়েদের উঁকিঝুঁকি। ডাব-পর্বের পরই কোথায় যেন কেটে পড়েছে নিশি আর বদু; সেজদার তো খাওয়ায় না নেই; ভালোই জমিয়েছে মেয়েমহলে। এদিকে তনু শুধু বিব্রতই নয় বিরক্তও বোধ করছে। যদিও উশখুশ করে অন্যকে সেটা বুঝিয়ে ছাড়া এটা ওর ধাতে নেই। দুরন্ত বদুর জন্য চিন্তাও যে হচ্ছে না তার, তা-ও তো নয়। বদুকে সামলানো কি নিশির কম্মো! হাত-মুখ ধুয়ে এবার দুপুরের ভোজ। ধূলি ধূসরিত অবস্থায় বদু এবং এক কণাও ধুলো না মেখে নিশি, দুজনেই হাত ধুয়ে এসে পিঁড়িতে বসল; সেজদার জন্য পাতা খালি পিঁড়িটার দিকে তনু একবার তাকাতেই শ্বশুরমশাই বললেন, ‘উনি একটু বাহ্যে গেছেন তো, তাই নদীতে ডুব দিয়ে এসে খাবেন বলে গেছেন।’
একবার বসে পড়লে পাত ছেড়ে ওঠার রীতি নেই। তরঙ্গনাথ তাই একপাশে বদু এবং অন্য পাশে শ্বশুরমশাইয়ের মাঝখানে বসে, কাঁসার গ্লাস থেকে জল নিয়ে আচমন সেরে ভাতে হাত দিল। শুক্ত পাতে পড়তে না পড়তেই সেজদা এসে হাজির। কার একটা ধুতি চেয়ে দু-ভাঁজে ফেরতা দিয়ে পরে, খালি গায়ে এমন করে খেতে বসে গেল, যেন এটা ওর নিজের বাড়ি! তনুর মাথা তখন রাগে দপদপ করছে। কোথায় সেই বুদ্ধিদীপ্ত হরু আর কোথায় এই ভোজন-সর্বস্ব সেজদা! এই সেজদাকে নিয়ে খেয়ে উঠবে বলে তনু একটু ধীরে ধীরেই খাচ্ছিল। ফলে সেজদার হাবড়হাটি খাওয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে অসুবিধে হল না তার। অত পদ খাইয়ে শাশুড়ি যখন এক থালা আম ধরে দিলেন, তনু-নিশি-বদু সকলেই হাঁ-হাঁ করে না বলাতে, সেজদা কিন্তু সকলের জন্য বরাদ্দ সমস্ত আম একাই খেয়ে নিল। সেজদার পেট ভরেনি ভেবে শ্বশুরের নির্দেশে একটা গোটা কাঁঠাল এল। মা, কাকিমা, বউদি তিনজনে হাত লাগিয়ে ছাড়াচ্ছেন আর সেজদা সেগুলো এক গরাসেই খেয়ে ফেলছে ভাতের মতো; কাঁঠাল ভক্ষণ প্রায় শেষ পর্যায়ে দেখে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে কঠোর স্বরে তনু বলতে বাধ্য হল, ‘এবার তাহলে ওঠো; আসল কাজটাই তো এখনও বাকি, তাই না!’
সামান্য নিচু হয়ে, সেজদার বগলের নীচে হাত গলিয়ে পিঁড়ি থেকে একটানে তুলে, তাকে একেবারে সোজা দাঁড় করিয়ে দিল তনু। তনুর গতিক সুবিধার নয় বুঝে থতমত সেজদা ঘটি হাতে সোজা চলে গেল উঠোনের দিকে, আঁচাতে। ফেরার পথে সেজদা আর কোনও কথা না বলে, সমস্ত পথটাই নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে শেষ পাতের কাঁঠালটা হজম করার পথ ধরল।
৩
জানলার ধারের সিটে বসে এবার উলটো দিকের বেঞ্চিটাতে পা তুলে একটু আরাম করে বসল তনু; তার সামনে বসা লোকটি ব্যারাকপুর স্টেশনে এইমাত্র নেমে গেল; সারাটা দিন খুব সতর্ক হয়েই থাকতে হয়েছে তনুকে; হবু শ্বশুরবাড়ির আপ্যায়নে বেশ মজাই লাগছিল। কিন্তু বিকেলবেলা মেয়েটিকে নিয়ে তার বড় জেঠিমা ঘরে এসে ঢোকার সময় হঠাৎই তনুর চোখ গেল খোলা জানলাটার দিকে; সকালবেলাতেই তনু লক্ষ করেছে যে, এঁদের এই পাঁচিলবিহীন ন্যাড়া বাড়িটার ওদিকটায় আর কোনও ঘর-বসত নেই; বড় বড় গাছ আর বন বাদাড়ের মধ্যে শুধু একটা বড়সড় পানা পুকুর; কাঠকুটো কুড়োতে যাওয়া ছাড়া, সাপ-বিছের কামড় খেতে কে আর কোন দরকারে ওই বিছুটির বনে ঢুকতে যাবে! ফলে, জানলার ফাঁকে ঝাঁপালো কালচে পাতাগুলোর আড়ালে একজোড়া সতর্ক চোখ দেখেই তনুর শিরদাঁড়া সিধে হয়ে গেল; নিজের কোমরের কাছে হাত বুলিয়ে রিভলবারটা জামার ওপর দিয়েই ছুঁয়ে নিল একবার; ভাবলেশহীন মুখে, লাজুক চোখে দেখতে লাগল সেই এক ফোঁটা বালিকাকে। বালিকাকে দেখার ছুতোয় চোখাচোখি হল সেই সতর্ক চাহনির সঙ্গেই। তনুর অনুমান যে, প্রকাশ্যে এক জোড়া চোখ ভেসে উঠলেও, আশেপাশে আরও কয়েক জোড়া এমন চোখের দৃষ্টি অবশ্যই আছে। এও তনু জানে যে, তরুলতার ভাবী বরকে দেখতে তারা আসেনি; এসেছে তরুণ পুলিশ অফিসারকে জরিপ করতে বা এক গুলিতে খতম করে দিতে।
তনু জানে না যে, এ গ্রামে সশস্ত্র-স্বদেশিরা কতটা সক্রিয় বা কী পরিমাণ অস্ত্র এবং তা চালাবার কতটা অনুশীলন তাদের আছে! একটু খোঁজখবর না নিয়ে, মায়ের কথায় এমন হুট করে চলে আসাটা যে ভীষণ এক ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহই নেই তনুর। হয় তরুলতার পরিবারের গুড উইল, না হয়তো তাদের প্রস্তুতির অভাবই আজ বাঁচিয়ে দিল তনুকে। এবার তনু বুঝেছে যে, পাত্রী দেখতে হরু কেন কিছুতেই তার সঙ্গে আসতে চায়নি। সেটাই তো এক মস্ত সংকেত ছিল। এমনও হতে পারে যে, হরুর স্বদেশি নেটওয়ার্কের ফলেই তার খুলি লক্ষ্য করে বন্দুক চালায়নি তারা! ছুটিতে তনুর বাড়ি ফেরার কদিন আগেই তো মি. অগাস্ট কথা প্রসঙ্গে তাকে বলেছিলেন যে, সাহেবদের প্রস্তাব অনুযায়ী শিবনিবাস নাকি আর বাংলায় থাকবে না। নবদ্বীপের সাব-ডিভিশন কিষাণগঞ্জের এই গ্রাম শিবনিবাস তো কলকাতা থেকেও অনেকটাই দূরে; এমনকী বেশ কয়েক ঘণ্টার পথ ডিসট্রিক্ট হেডকোয়ার্টার কৃষ্ণনগর থেকেও। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে তার মধ্যে শিবনিবাসকে পূর্ব পাকিস্থানে ঠেলে দেওয়াও এক চরম সিদ্ধান্ত; খেপে আছে এখানকার লোকজন; কয়েক শতক ধরে শিবের মাহাত্ম্যে যে অঞ্চলের গরিমা, তাকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মোল্লাদের দিকে! যদিও এখানে ব্রাহ্মণদের সংখ্যাধিক্য নেই কিন্তু প্রাধান্য তো তাঁদেরই! ফলে রাষ্ট্রনীতি যতই ঘোরালো হচ্ছে, ততই সংগঠিত হচ্ছে স্বদেশি আন্দোলন; স্থানীয় মানুষদের সম্মতি বলে যাকে তুলে ধরা হচ্ছে, তা তো আসলে সাহেবদের পেটোয়া কয়েকজন মুষ্টিমেয় নেটিভদের মতামত। ভূমিজরা তাই মাটি কামড়ে লড়ছে। বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মতোই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত এই শিবনিবাস গ্রামেও আগুন লাগল বলে! তনু ভাবতে লাগল, এখানে বর সেজে বিয়ে করতে আসার আগে এ বিষয়টা নিয়ে মি. অগাস্টের সঙ্গে তার একবার বিশদ আলোচনায় বসা উচিত কি? নাকি সবটাই চেপে যাবে সে! তার আগে অবশ্য সেজো মেসোমশাই শরৎচন্দ্রের সঙ্গে কথা তো তাকে বলতেই হবে একবার।
সন্ধে নাগাদ বাড়ি ফিরে, বাইরের কাপড় ছেড়ে, হাত-মুখ ধুয়ে, একখানা মাদুর বিছিয়ে ছাদে গা এলিয়ে দিতেই, প্রথমেই যে গা ঘেঁষে হেলান দিল সে হল আহ্লাদি রাণী; তারপর একে একে কাছে এসে বসলেন মা, এসে বসল বদু এবং কিছু পরে বাবাও।
রাণীর যেন আর তর সইছে না…‘বউদিকে কেমন দেখলি রে দাদা?’
‘তোর থেকে বড় কিন্তু মাথায় আমার থেকে খাটো’, উত্তর দিল বদু।
‘তাতে তো অপছন্দ হওয়ার মতো কিছু নেই! আছে কি?’ বাবা প্রশ্ন রাখলেন।
‘কথাবার্তা কেমন?’ মা জানতে চাইলেন।
‘আমার সঙ্গে কথা বলেছে, খেলেছে, পুতুল দেখিয়েছে; কিন্তু দাদার সামনে কথাই তো বলেনি’, এ কথাও জানিয়ে দিল বদু।
বদুর এই কথায় সকলে হেসে উঠলে, আশকারা পেয়ে বদু এবার সবিস্তারে বলতে বসল সেজদার কাণ্ডকারখানা; সেই সঙ্গে এও বলল যে, দাদার বউ সাঁতার কাটতে পারে; পুকুর এবং তাদের ওখানকার চূর্ণী নদী-দুটোতেই। বদু তাকে স্লেটের ওপর নিজের নাম লিখতে বলায় সে নাকি নিজের নাম ‘তরুলতা’ লিখে দিয়েছে; বদু তাই এও দেখেছে যে, তার নিজের থেকেও ওই তরুলতার হাতের লেখা আরও সুন্দর; বড়দের লেখার মতোই টানা টানা। তনু নিজে কিছু বলছে না দেখে, বাবা-মা দুজনেই উঠে পড়লেন। একটু বাদে উঠে চলে গেল বদু আর রাণীও। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল কতদিন পরে, ছাদের ওপর মাদুর পেতে শুয়ে কালপুরুষ দেখছে তনু।
শব্দহীন পায়ে দোতলায় নিজের ঘরে গিয়ে বড় এসরাজটা নিয়ে আবার ছাদে উঠে এল তনু; এসরাজে ছড় টানতেই তার ইচ্ছে হল ছোটমাসির কাছে শেখা সেই গানটাই গাইতে,
‘কত বার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া/ তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া…’
আমি তরঙ্গনাথ বা তনু; শিবনিবাসে মেয়ে দেখতে গিয়ে যে দুটি অভিজ্ঞতা হল তা প্রায় সারা জীবন ধরে ডিভিডেন্ড পাওয়ার মতোই। প্রথম হল পাত্রী দেখার আগেই এক গুপ্ত স্বদেশির সঙ্গে চোখাচোখি; যার ফলে শিবনিবাসকে কেন্দ্র করে একদিকে র্যাডক্লিফ প্ল্যান এবং অন্যদিকে উত্তাল স্বদেশি আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা গড়ে তুলতে আর একটুও কালক্ষয় করিনি আমি; যে ধারণা না থাকলে পুলিশের এই চাকরিতে নিজের মর্যাদা বাঁচিয়ে টিকে থাকতেই পারতাম না। পারতাম না সংসারের হাল ধরে মায়ের চোখের জল মোছাতে। পারতাম না গুপ্তহত্যার থেকে নিজেকেও বাঁচাতে।
আর দুই, এই তরুলতা; যে হল আমার আমৃত্যু সঙ্গী এবং বড় আদরের বউ!
মনে পড়ল, ছোট্ট এক বালিকাকে; কিশোরী হলেও সে কিন্তু চপল বা বাচাল নয়; আমার মায়ের মতো ধপধপে না হলেও গায়ের রংটা যেন চাঁপা ফুলের মতোই নরম এবং উজ্জ্বল; একপিঠ খোলা চুল; চোখ এড়াতে পারল কই একটা টুলটুলে সোনার নোলক পরা বাঁশির মতো তার সেই নাকখানি। কী জানি আমাকে মনে ধরল কি না তার! আখাম্বা লম্বা, কদমছাঁট চুল, ইয়া গোঁপজোড়া আর ঘন ভ্রূর নীচে কুতকুতে চোখের এই মুখখানি! আড়চোখে চেয়ে অন্তত একবারও কি আমাকে দেখল তরুলতা?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র