শীতের সেই রাতগুলো
শীত এলে মনে পড়ে কলকাতার গানবাজনার আসরগুলোর কথা। আরও বেশি করে মনে পড়ে, কেননা বেশিরভাগ গানবাজনার আসরই হত রাতজাগা, সারারাত্রি ব্যাপী। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরের কথাই বলছি। সে-সময়ে সে-ব্যতীত অন্যান্য রকমের গানবাজনার জলসা সারারাত হত, এমনটা মনে পড়ছে না। আমি যে খুব অনেকদিন আগেকার কথা বলছি, তাও কিন্তু নয়। বছর পঁচিশ কি তিরিশ বড়জোর। অবিশ্যি শেষ তিন দশকে পৃথিবী যতখানি বদলেছে, শেষ তিন শতকেও ততখানি বদলেছে কিনা সন্দেহ। তাই তিরিশ বছর আগেকার কথা এখন কিঞ্চিৎ জীবাশ্মই বটে।
গানবাজনার বাড়িতে বড় হওয়ার সুবাদে এই ধরনের আসরে রাতজাগা প্রায় নিয়মের মধ্যেই ছিল। মামা গাইতে গেলে সঙ্গে যেতাম, মা গাইতে গেলে তো যেতামই। আর দেখতাম, আমার বয়সি ছেলেমেয়ে সংখ্যায় বেশি নেই। কিন্তু ততদিনে এটুকু বোঝার ক্ষমতা হয়েছে যে, কানে কী-পরিমাণ অমৃত বর্ষিত হচ্ছে। ফলে শীত এলেই মুখিয়ে থাকতাম আসরে যাওয়ার জন্য। তাবড় সব শিল্পীদের ছোটবেলা থেকেই শুনছি, বাড়ির লং-প্লেয়িং রেকর্ডগুলোর মধ্য দিয়ে। তাঁদের কেউ কেউ সামনের মঞ্চে বসে গাইবেন বা বাজাবেন আর সে-সুযোগ ছেড়ে দেব, এটা হতেই পারে না।
একটা বয়স পর্যন্ত কেবল মামা আর মায়ের সঙ্গে আসরে যাবারই অনুমতি ছিল। হুট করে একা কোথাও চলে যাব, এমনটা সম্ভব ছিল না। হ্যাঁ, বাবা মাঝেমধ্যে সারারাতের আসরে নিয়ে গিয়ে গানবাজনা শোনাতেন, এও ঠিক। নিয়মটা উঠে গেল মাধ্যমিকের পর। যেন বা একখানা পরিখা চারপাশ থেকে তুলে নিল কেউ। এইবার একা-একা আসরগুলোয় যাওয়া যেতে পারে। ততদিনে অবশ্য শাস্ত্রীয় গানবাজনার মহলে খুব ঘনিষ্ঠ দু’একজন বন্ধুও হয়েছে আমার, ফলে কলকাতা বা তার আশেপাশে জমজমাটি কোনও রাতের খবর থাকলে ওই দু’তিনজন মিলেই যাওয়া শুরু হল। কেননা, সেই ছোট থেকেই একটা বিষয় বুঝতাম, গানবাজনা ঠিক একা শুনে উপভোগ করা যায় না। আজ বুঝি, কোনও শিল্পই একা পুরোপুরি উপভোগ করা কঠিন। পাশে আরেকজন সমঝদার কেউ থাকলে তার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার যে একখানা আলাদা মজা, সেটা থেকে বঞ্চিত হলে যেন শিল্পেরও কিছুটা অধরাই থেকে যায়।
তা সেই তখন, মানে আমাদের ছোটবেলায়, কলকাতায় শীত পড়ত বেশ জাঁকিয়ে। এই ‘শীতকাল কবে আসবে’ কথাটা বারবার সুপর্ণাকে জিগ্যেস করার মতো অবস্থা ছিল না। সে ঠিক সময়েই আসত এবং ট্রাঙ্ক বা আলমারি থেকে শাল, চাদর, সোয়েটার, মাফলার, কানঢাকা-টুপি, সব-ই বার করতে হত। আর এই সবকিছু একসঙ্গে কাজে লাগত রাতের সেইসব আসরগুলোয়। কেননা, সে-সময়ে এ-ধরনের আসরের বেশিরভাগই হত খোলা মাঠ বা চত্বরে শামিয়ানা বা প্যান্ডেল খাটিয়ে। হল-এর মধ্যে অনুষ্ঠান একেবারে হত না বলছি না; মহাজাতি সদন, কলামন্দির বা রবীন্দ্রসদন উপচে পড়ত শ্রোতায়। সেখানেও হাজির থেকেছি এক কোনে। কিন্তু বেশিরভাগ অনুষ্ঠান হত মাঠে। কার্জন পার্ক, বিবেকানন্দ পার্ক, পার্ক সার্কাস ময়দান, এরকম আরও কত জায়গায় যে শামিয়ানার নীচে জবুথবু হয়ে গানবাজনা শুনেছি, তার লেখাজোকা নেই।
মনে আছে, চেয়ারে বা সোফায় বসবার জায়গা থাকতই না প্রায়। থাকলেও সেসব নামীদামি লোকজনের জন্য। আমরা মাটিতে সাদা ধবধবে ফরাসের উপর বসতাম। একটু পরেই টের পেতাম, সেই ফরাসের তলা থেকে বেশ ভাল রকমের ঠান্ডা উঠে আসছে। আর ওদিকে শামিয়ানার ফাঁক দিয়ে উত্তুরে হাওয়া। এই এতরকম প্রতিরোধ পেরিয়ে যখন শুনতাম অদূরেই পণ্ডিত ভীমসেন জোশী দরবারি ধরছেন আর তারপরেই আসর মাতাতে আসবেন উস্তাদ বিলায়েত খান, তখন শীতের বোধ কোথায় যে চলে যেত, কে জানে।
সবচাইতে মুশকিল হত প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারটা। সারারাত জেগে থাকলে সে-ডাক আসবেই, আর এলে তাকে ফেরানোও অসম্ভব। এদিকে মুশকিল হচ্ছে, এমনকী ফরাসে বসবার জন্যও প্রচুর লোক মুখিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা দু’জন শিল্পীকে ওইভাবে দাঁড়িয়েই শুনে ফেলেছে। এবার আমি কড়ে আঙুল তুলে বাইরে বেরোলে নির্ঘাত জায়গা চলে যাবে। রুমাল রেখে যাওয়ার প্রশ্নই নেই, কেননা উস্তাদ বিলায়েত খানের ভাটিয়ার বা পণ্ডিত যশরাজের আহির ভৈরবের মুখে একটা ফিনফিনে রুমাল কোনদিকে উড়ে চলে যাবে তা কেউ হলপ করে বলতে পারে না।
অবশ্য বন্ধুবান্ধব থাকলে পালা করে একজন-একজন ছোট বাইরে ঘুরে আসা যায়। সেটাই করতাম দু’তিনজন দল বেঁধে গেলে। যদিও তাতেও অনেকবার ফিরে এসে দেখেছি জায়গা হাতছাড়া হয়ে গেছে। ঝগড়ুটে শ্রোতার কাছে মুখচোরা বন্ধুটি হেরে বসে আছে দিব্যি। আরেকটা মজা ছিল ভোররাতে বাইরের স্টলে ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দেওয়া। এ-জিনিস ওই গানবাজনার আসর ছাড়া ঠিক মৌতাতে খোলে না। হয়তো সবে পণ্ডিত রাজন ও সাজন মিশ্র আভোগী গেয়ে উঠেছেন, সকলে আড়মোড়া ভেঙে বাইরে এসেছি। কফির স্টলের সামনে দেদার ভিড়। শেষমেশ যখন দোকানদারের হাত থেকে ছোট ভাঁড় বা কাগুজে কাপটা নিয়ে গরম সুগন্ধি কফিতে প্রথম আয়েশের চুমুকটা দিচ্ছি, তখন বাইরের অ্যামপ্লিফায়ার বলে দিচ্ছে, মঞ্চে উঠে পড়েছেন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা ও উস্তাদ জাকির হুসেন।
তবলায় আলতো টোকা পড়ছে, সঙ্গে হাতুড়ির ঠুকঠুক। তারই পাশে একের পর এক বাঁধা হচ্ছে সন্তুরের তার। কাকভোরের সেই রিমঝিম শুনে আমরা বুঝতে পারছি, বিলাসখানি তোড়ি দিয়ে শেষ হবে আজকের আসর। যে-কফি একটু আগেও ঠোঁটে ছ্যাঁকা দিচ্ছিল, তার উত্তাপকে থোড়াই-কেয়ার করে দ্রুত দু’চুমুকের পর দে-ছুট। গোটা শামিয়ানা তখন সন্তুরের সুর আর শ্রোতাদের নীরবতায় ভরে উঠেছে। আজ যখন মনে পড়ে, এক-এক রাতে পরপর কোন সব শিল্পীদের গানবাজনা সামনে থেকে শুনেছি, তখন নিজের ছোটবেলাকেই ঈর্ষা করতে ইচ্ছে করে। কেননা হাজার চাইলেও সেসব রাত আর ফিরে আসবে না।
একটা ঘটনার কথা বলে শেষ করি, সেবার ডোভার লেন-এ কিশোরী আমোনকর গাইছেন। আমি আর আমার দুই বন্ধু শুভাশিস এবং রুচিরা, কারও কাছেই কোনও টিকিট বা কার্ড নেই। অথচ মিস করা যাবে না, শুনতে হবেই। তখন সদ্য ডোভার লেন বিবেকানন্দ পার্ক থেকে নজরুল মঞ্চে উঠে এসেছে। কথা হল, যাই হোক, চেষ্টা একটা করতেই হবে। সেইমতো রাত দশটা নাগাদ কনকনে শীতে নজরুল মঞ্চের সামনে গেট-এ তিনজন দেখা করলাম। যা বোঝা গেল, একে-তাকে ধরে দুটো টিকিটের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু শুনলে তিনজনই শুনব, নইলে নয়। আমার অভিনয় ক্ষমতার উপর আমার বরাবরই ভরসা ছিল, আমি ওদের ঢুকে যেতে বললাম। এ-ও বললাম, ঢুকে জায়গা রাখতে, একটু পরেই আমি ঢুকব। যেমন কথা তেমনি কাজ। আমি বাইরে এক কাপ লেবু-চা শেষ করে, শাল জড়িয়ে খুব গম্ভীর মুখ নিয়ে একেবারে প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতে গেলাম। স্বাভাবিক ভাবেই প্রহরীদ্বয় আমাকে আটকালেন এবং সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। ‘কার্ড কই?’ আমি আরও গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘কার্ড লাগবে কেন? আমি না-ঢুকলে তো শেষ আইটেমটা হবেই না’। ওঁরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে জিগ্যেস করলেন, ‘মানে? আপনি কে?’ আমি নির্ভেজাল নির্দ্বিধায় জবাব দিলাম, ‘আমি কিশোরীজি’র সঙ্গে তানপুরায় বসব। আমি না-থাকলে তো উনিও স্টেজে উঠবেন না!’ এটা শোনার পর তাঁরা সসম্মানে আমাকে দরজা ছেড়ে দিলেন, আমিও চেপে রাখা দম ছেড়ে বন্ধুদের পাশে গিয়ে বসলাম। সেই ভোরবেলা ললিত পঞ্চম গেয়েছিলেন কিশোরী আমোনকর, আজও কানে লেগে আছে। আমরা তিনজন অনুষ্ঠানের পর গ্রিনরুমে গিয়ে প্রণাম করেছিলাম। ওঁর নরম হাতের পাতার আশীর্বাদে আমার রাতের মিথ্যে ভোরবেলা ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল। সেসব রাতজাগা-ভোর আর নেই, কলকাতাও কুয়াশার চাদর সরিয়ে রেখে বয়স কমানোর চেষ্টায় শামিল। শুধু এক কিশোরী, যার ডাকনাম ‘সময়’, সে যে কোন ভিড়ে হারিয়ে গেছে কে জানে…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র