ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সিঁড়ি


    রোদ্দুর মিত্র (September 23, 2023)
     

    ১.

    যোগ, বিয়োগ অথবা গুণ নয়— বাড়ি ভাগ হয়েছে।
    আপনারা মন দিয়ে দেখুন! টেবিলে শায়িত দেশটিকে আড়াআড়ি কেটে দিলে সে কেমন দুই দেশে পরিণত হবে! রক্ত নেই। যন্ত্রণা নেই। কিচ্ছু নেই। একটা টুপির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে একগাদা মানুষ শুধু। যেন ভাতের দানা। তারপর ছড়িয়ে গেল। গোটা স্টেজে।

    হাততালি! হাততালি!

    ওই যে, কালো কাপড়ে ঢাকা বাক্সটি দেখতে পাচ্ছেন, এইবার, এইবারই, জ্যান্ত একটা মানুষ পুরে, দিলাম দুই দিয়ে ভাগ করে! দেখুন, দেখুন একবার! এদিকে পাঁচ আর ওদিকে পাঁচ— কেমন দশটা পায়রা ডানা ঝাপটে উড়ে গেল! সাদা পায়রা! শ্রাদ্ধবাড়ির কাপড়চোপড়ের মতো সাদা।

    হাততালি! হাততালি!

    চোখ ঝলসে দিচ্ছিল। বারেবারে। একটা ভাগচিহ্নের আলো। স্টেজের দু-পাশে বিরাট বিরাট সাউন্ড বক্স। মরবিড অ্যাঞ্জেলের গান বাজছে। ডেথ মেটাল! শ্রাবণ বুঝতে পারছিল, ওরা কেউ মানুষ নয়! আলোর একেকটা বডি। এলইডি স্ক্রিন থেকে বেরিয়ে আসছে। আর ভূতগ্রস্তের মতো চেঁচাচ্ছে, আরও ভাগ দেখতে চাই! আরও, আরও—

    —‘আরও?’

    দর্শকাসন থেকে একলাফে স্টেজে উঠল শ্রাবণ। আচমকা। ম্যাজিশিয়ান যখন আবার একটা ভাগের খেলা দেখাতে প্রস্তুত! একহাতে গ্লোব! অন্যহাতে জাদুদণ্ড! ঠিক তখনই ঠাঁটিয়ে এক থাপ্পড়।

    —‘ক্লান্ত লাগছে আমার! বুঝতে পারছেন না কেন?’

    পাবলিক হেবি মজা পেয়েছে। ভেবেছিল আরও তামাশা হবে। কিন্তু ম্যাজিশিয়ানের শরীর ততক্ষণে ভাগ হচ্ছে। রক্ত পড়ছে— যে গালে থাপ্পড় মেরেছিল শ্রাবণ— কান, মাথা, মুখ— উপচে পড়ছে রক্ত— ভাগচিহ্ন— ভাগ হতে হতে হতে পালিয়ে যাচ্ছে। হাত ফসকে। শ্রাবণ দৌড়তে পারছে না। গ্লোবটা ম্যাজিশিয়ানের হাত থেকে পড়ে গেল। মাঝবরাবর চিড় খেয়েছে। অডিটোরিয়ামে পচা রজনীগন্ধা আর সাইকেল পিওর আগরবাতি আর গঙ্গাজলের গন্ধ। গায়ে লেগে থাকে আঁশের মতো। ফাটা গ্লোব গড়িয়ে গড়িয়ে স্টেজের পিছনে। কোন জাদুতে পৃথিবীর আকার নিল— দরজা খুলে গেল বিকট শব্দে— ভেতরে রাষ্ট্রনায়কের মতো দেখতে— একচোখ কানা অসংখ্য জোকার— মেয়েদের কাটামুন্ডু নিয়ে জাগলিং করছিল— একটা বুলডোজার— টিপে টিপে দেখছিল কোন বাড়িটার নরম বুক— ম্যাজিশিয়ান জাদুদণ্ড ঘোরাতে ঘোরাতে ঢুকে যাচ্ছে সেই গ্লোবে— শ্রাবণের খুব চেনা— পড়ার টেবিলে ছিল। শ্রাবণের পা কাঁপছে অসহ্য। শ্রাবণের বুকে মরবিড অ্যাঞ্জেলের ড্রাম। গুলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। ঘাম হচ্ছে, অথবা বৃষ্টি, অথবা কিছুই হচ্ছে না। চোখ দুটো খোলার পরে মনে হল, ভোর হচ্ছে।

    জীবনানন্দের কবিতায় যেমন দুটো করে ভোর হয় প্রতিদিন! শ্রাবণও ইদানীং টের পায়— প্রথম যে ভোর তার অবচেতনের আকাশে জন্মেছিল, হাঁটতে শিখেছিল, কাদামাঠে ফুটবল খেলেছিল ঘোর বর্ষায়— সে এখন স্থাণু, বনসাইয়ের মতো— প্রাণ আছে, হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদে না। দ্বিতীয় যে ভোরে শ্রাবণের ঘুম ভাঙে এখন, এই একটু আগেই ভেঙেছে— সে বিস্তর ভাঙাচোরা, অসুন্দর, এবং সত্য!

    কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রাবণের বাবা, পাড়াজাগানো রেডিও চালিয়ে লাউগাছের আগায় দড়ি বাঁধবেন। শিউলিগাছের গোড়াটা খুঁচিয়ে দেবেন অল্প। ছাদময় শুকনো পাতাগুলো কুড়িয়ে নেবেন কী আশ্চর্য যত্নে! কলে জল আসবে। স্থানীয় সংবাদ শেষ হতে না হতেই বাসিউঠোন ঝাঁট দিতে দিতে ছিপছিপে ফুলওয়ালির মুখে ওই পোড়া দাগটা কীসের— জেনে নেবেন শ্রাবণের মা।

    সকালবেলার আলোয় আরও কিছু থাকার কথা ছিল কি? ঘেঁটে দেখল শ্রাবণ। স্বপ্নের ইমেজ পুরোপুরি মুছে যায়নি। ফিরে ফিরে আসছে। শ্রাবণকে জিজ্ঞেস করছে, ‘একটা ভাগচিহ্ন দেখতে কেমন?’

    —‘ওপরতলায় একজন সুন্দর। নীচতলায় আরেকজন। মাঝখানে একটা হাড়।’

    ঘরে টিকটিকি ডাকল না। ঘড়ির কাঁটার যে সম্মতিসূচক শব্দ শুনতে চেয়েছিল শ্রাবণ, সেটা ছাপিয়ে ভেসে এল, ‘সমবেত কণ্ঠে শুনলেন দেশাত্মবোধক গান, এবারে চলে আসব প্রাত্যহিকীর চিঠির পর্বে।’

    ২.
    শ্রাবণ কে?

    উত্তর নেই।

    শ্রাবণের বয়স কত?

    উত্তর নেই।

    শ্রাবণ কোথায় থাকে?

    —‘খেলনাবাড়িতে!’, শ্রাবণের মা প্রায়শই বলেন। মলিন হাসি হেসে চলে যান। শ্রাবণ যে হাসির থই পায় না— থই পেলেও কাউকে জানাতে চায় না— হয়তো জানাতে চায়— কেউ শুনতে চায় না— কেউ কেউ শুনতে চায়— শ্রাবণের বলতে ভয় করে। ভয় কোনওদিন শ্রাবণকে অন্ধকার উপহার দেয়নি। করেছে মৌলিক। সে টের পায়। টের পায়, মৌলিক হওয়া মানে একা হয়ে যাওয়া। একা একাই ক্ষতবিক্ষত। একা একাই শূন্য। একা একাই অ্যাবসলিউট।

    শ্রাবণ কি ভিতু?

    না।

    তাহলে সাহসী?

    না।

    শ্রাবণ তবে একজন নারী।

    কেন?

    একজন পুরুষ?

    হতেই হবে?

    শ্রাবণ কি যৌনতাকে অস্বীকার করে?

    না।

    সে নিজেকে আর কী ভাবে?

    একটা সাইকেল। ক্রিং ক্রিং-এর বদলে বেজে ওঠে দুঃখ।

    শ্রাবণ জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়েছে?           

    ‘…কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে’

    প্রিয় কবি?

    ভাস্কর চক্রবর্তী।

    অন্য যে-কোনও কবিকে শ্রাবণ ঘেন্না করে নিশ্চয়ই?

    ভালবাসে।

    তা কী করে হয়?

    সাইকেল নিয়ে যেমন খুশি বেরিয়ে পড়লেই হয়। পৃথিবীর দুরন্ত সব গতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ‘আরও ধীরে’ বলে প্যাডেলে চাপ, পৃথিবীর তাবড় তাবড় হিংসার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ‘আরও ধৈর্য’ বলে প্যাডেলে চাপ…গতিকে সম্পূর্ণ বর্জন করে যে-কোনও গলির ভেতরে সাইকেল থামিয়ে শ্রাবণ বহুক্ষণ জিরিয়ে নিতে পারে। রোয়াকের ওপরে যে হুলো বেড়াল রোদ পোহাচ্ছে, তার মধ্যে সে খুঁজে নিতে পারে ঈশ্বর।   

    শ্রাবণ তাহলে আস্তিক?

    না।

    নাস্তিক?

    তাও না।

    শ্রাবণ কি হিন্দু?

    না।

    মুসলিম?

    না।

    শ্রাবণের পরিচয় কী?

    সে চেতেশ্বর পূজারাকে ভালবাসে।

    হঠাৎ?

    আজকের পৃথিবীতে বড় বেমানান, না?

    বটেই তো!

    অথচ কী নিরালা একজন! দীর্ঘস্থায়ী— তারপরই বালি, একেবারে ঝুরঝুরে, শূন্য রান করে প্যাভিলিয়ানে ফিরে আসছেন— নশ্বরের মতো— চোখ দুটো গভীর, মাথাটা নিচু— সামান্যই। গ্যালারি এবং গ্যালারি ছাড়িয়ে সমবেত একটা দীর্ঘশ্বাস— এবারেও কোনওরকম চিরাচরিত চতুর্ভুজে তাঁকে ভরে দেওয়া গেল না।

    শ্রাবণ কি স্বর্গের সন্ধান করছে?

    না।

    শ্রাবণ নির্ঘাৎ নরকে যাবে!

    কে জানে!

    শ্রাবণ গান শুনতে ভালোবাসে?

    হ্যাঁ।

    কেমন গান?

    জন ডেনভার। ‘ইউ ফিল আপ মাই সেন্সেস…’

    ৩.
    বিকেল মরেছে। টিউশনমুখী কতগুলো মেয়ে। মোড়ের মাথায় বাড়িমুখো ব্যাট-উইকেট-ক্যাম্বিস বল। শনিমন্দিরের চাতালে একগামলা শিন্নি। চারিদিকে শালপাতার বাটি। অগুনতি হাত। কালো। সাদা। খয়েরি। শ্যামলা। রক্তিম। অল্প বাঁকা। চুড়ি আছে। চুড়ি নেই। লাল সুতো। নীল তাবিজ। জন্মদাগ। স্মার্ট ওয়াচ। দূর থেকে এটুকুই দেখা যায়। শ্রাবণের মনে হয়, একখন্ড ভারতবর্ষ।

    একটা গান হাওয়ায় ভাসে। ভাসতে ভাসতে আসে।

    —‘হে দয়াময়, হে দয়াময়ী! হে ভগবান, হে ভগবতী! পৃথিবীর মাঝে আমি বাঁচতে চাই…’,

    তারপর খেই হারিয়ে গেল। কেউ ছিল না। কোত্থাও না। সামান্য একটা সুর শ্রাবণকে তছনছ করে দিল। এই সন্ধের মুখে। একবার। দুবার। তিনবার। আবার। ‘হে দয়াময়, হে দয়াময়ী! হে ভগবান, হে ভগবতী! পৃথিবীর মাঝে আমি বাঁচতে চাই…’ কে গায় এমন! কোন মানুষ?

    —‘ভিক্ষে চাইতে এসেছে?’

    —‘না।’

    —‘কেউ গান গাইছে মনে হল!’

    —‘ওই লোকটা।’

    —‘কোথায়?’

    —‘ভাঙাবাড়ির দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে।’         

    —‘লোকটার দু-কাঁধে ওগুলো কী? ঝোলা?’

    —‘হ্যাঁ।’

    —‘আবার টুপিও পরেছে দেখ এমন, মুখই দেখা যাচ্ছে না। প্যাণ্টখানা জিন্‌সের নাকি?’

    —‘মা, আমি বেরোচ্ছি একটু।’

    —‘কোথায় যাচ্ছিস এখন?’

    শ্রাবণকে টানছিল। বৃষ্টির দিনে অঞ্জন দত্তের গান যেভাবে টানে! যেভাবে কলেজস্ট্রিটের ফুটপাথসর্বস্ব পুরনো বইগুলো টানে! বিড়িতে যেভাবে সুখটান দেয়! ভাঙাবাড়ির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। লোকটা। শ্রাবণকে টানছিল! কোথায় গেল? একটা ভূতুড়ে সুর। অনর্গল ঢিল দিচ্ছে। নেশায় পড়ে সুতো ছাড়ছে শ্রাবণ। ভাঙাবাড়ির মাঠ ছাড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ। লোকটার দেখা নেই। সুর মিশতে চাইছে শ্রাবণের জল-হাওয়ায়। অপাপবিদ্ধ সুর। অনেকটা যেন স্বর্গের গান!

    শ্রাবণ নিশ্চিত। লোকটা আসবে। উতলা করবে আবার। তখন ধরে-বেঁধে জিজ্ঞেস করবে। বাঁচতে চেয়ে এমন গান কেন গায় লোকটা! শুনলে মনে হয় পালিয়ে যেতে! আর কোনওদিন বাড়ি ফিরবে না।

    সে বাড়ি ফেরে। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ।  

    —‘সিঁড়িটা তো ভাঙতে হবে।’

    —‘নইলে আর ভাগ হল কীভাবে তুই বল?’

    —‘বাগানের ধার ঘেঁষে নতুন একটা সিঁড়ি তুললেই তো মিটে যায়!’

    —‘কিন্তু এক সিঁড়ি, দুটো সংসার— হয় কখনও?’

    —‘ভাগে গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে না দাদা?’

    —‘সিঁড়িটা আমি ভাঙবই!’

    শ্রাবণ দেখতে পাচ্ছে, একসঙ্গে অনেক কিছু বলতে গিয়ে বোবা হয়ে যাচ্ছে মা। বাবার মুখে কথা নেই। এই প্রথম! শোনার মানুষ কমে গেছে। নিঃসন্দেহে।

    অথচ কী নিরালা একজন! দীর্ঘস্থায়ী— তারপরই বালি, একেবারে ঝুরঝুরে, শূন্য রান করে প্যাভিলিয়ানে ফিরে আসছেন— নশ্বরের মতো— চোখ দুটো গভীর, মাথাটা নিচু— সামান্যই। গ্যালারি এবং গ্যালারি ছাড়িয়ে সমবেত একটা দীর্ঘশ্বাস— এবারেও কোনওরকম চিরাচরিত চতুর্ভুজে তাঁকে ভরে দেওয়া গেল না।

    ৪.
    শ্রাবণ কি ফেরেশতাকে খুঁজছিল?

    না।

    শ্রাবণ শয়তানের উপাসক?

    না।

    শ্রাবণের অন্তর্গত কোনও শয়তান নেই?

    ছিল। বিক্রি করে দিয়েছে।

    কার কাছে?

    একজন লেখকের কাছে।

    শ্রাবণ কি লেখক?

    উত্তর নেই।

    শ্রাবণ একজন শ্রমিক?

    পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষই একজন শ্রমিক।

    শ্রাবণ কি শিল্পী?

    না।

    শ্রাবণ কি কমিউনিস্ট?

    উত্তর নেই।

    ফ্যাসিস্ট?

    থুঃ

    শ্রাবণ কি আদৌ মানুষ?

    হ্যাঁ। শ্রাবণ একটি অসাড় দুনিয়ার নাগরিক। যে দুনিয়া আমাদের সবরকম দুইপক্ষের বাইরে। যেখানে সে এবং পূজারা— অনন্ত নো-ম্যান্‌স ল্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে সংযোগের ভাষা নির্মাণ করছে নিজেদের মতো করে। জীবন কখনও উঠছে। কখনও নামছে। জীবন কখনও লোপ্পা বল করছে। তারা লোপ্পা বলে বেমালুম ক্যাচ তুলে দিচ্ছে!

    এত ঘোরপ্যাঁচ কষে শ্রাবণ তাহলে তৃতীয় কোনও পক্ষ নির্মাণ করছে।

    কক্ষনো না।

    শ্রাবণ একজন এসকেপিস্ট!

    না।

    একশোবার এসকেপিস্ট! সে বুঁদ হয়ে আছে ইউটোপিয়ায়।

    বুঁদ হয়ে নেই। শ্রাবণ মেনে নিয়েছে কোনও মন্ত্রীর ছেলে ইচ্ছে করলেই তিনজন কৃষককে এসইউভির তলায় পিষে দিতে পারে। সে কি পালিয়ে গেছে কোথাও?

    শ্রাবণ তাহলে বাস্তবকে অস্বীকার করতে চাইছে!

    আপনি হঠাৎ এত রেগে গেলেন কেন?

    আশ্চর্য!  

    আসলে শ্রাবণ নিজের ছোটবেলা ফেরত চাইছে। যেখানে দ্বন্দ্ব ছিল। প্রতিপক্ষ ছিল। বিরুদ্ধাচরণ ছিল। মানুষ ছিল। আর মানুষ ছিল গাছের মতো। এখন এত তাড়া! তাড়া আছে, তাই দৌড়। দৌড়ের সঙ্গে ধাক্কা। ধাক্কার পরে একদলা ঘেন্না। দরাজ গলায়। কী বিপুল গর্ব সে ঘেন্নায়! পারিপার্শ্বিকের নিরিখে শ্রাবণ বেমানান।

    কেন মানাবে না? আর পাঁচজনকে তো মানিয়ে গেছে দিব্যি!

    শ্রাবণ তো শীতবিকেলের মতো! যেসব বিকেলে হয়তো চেতেশ্বর পূজারা শ্যাডো প্র্যাকটিস করেন— ধ্যানীর মতো, আত্মমগ্নতার প্রদীপ জ্বেলে…

    শ্রাবণ তবে ঠাট্টা করছে নিজের জীবন নিয়ে!

    এ কী! ফের উত্তেজিত হচ্ছেন আপনি?

    হওয়াটাই স্বাভাবিক। এমন মিসফিট একটা মানুষ, সমাজের জন্য তো ক্ষতিকারক!

    সে জন্যেই হয়তো শ্রাবণ প্রতিরাতে শূন্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করে। তাকে ভাঙে। কুচি কুচি করে কাটে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে। ভাবে কোনও দিন জাগিবে না আর। পরদিন ঘুম ভাঙে। এজবাস্টনে পূজারা ব্যাটিং করেন। মনে হয় রাহুল দ্রাবিড়। নির্মাণ। বিনির্মাণ। একই ছায়ায়। একই মনে।  

    শ্রাবণ কবিতা লেখে।

    না।

    কার কাছে শয়তানকে বিক্রি করেছে?

    ভাগ হতে হতে যে কোনও দিন কবিতা লিখেই উঠতে পারবে না!

    শ্রাবণ কি ভাগচিহ্ন দেখেছে?

    হ্যাঁ।

    কোথায়?

    বাড়িতে।

    শ্রাবণ বিয়োগচিহ্ন দেখেছে?

    হ্যাঁ।  

    কোথায়?

    ভাস্কর চক্রবর্তীর ডায়রিতে।

    ৫.
    সকাল থেকে শ্রাবণের বাড়ি। শ্রাবণের শৈশব। আম্মার ছবি। টলে যাচ্ছে ছেনি আর হাতুড়ির আঘাতে। আপনারা মন দিয়ে দেখুন! কালো কাপড়ের ভেতর থেকে এরপরই বেরিয়ে আসবে— নতুন একটা ঘর। রক্ত নেই। যন্ত্রণা নেই। কিচ্ছু নেই।

    হাততালি! হাততালি!

    শ্রাবণের সঙ্গে লোকটার বোধহয় দেখা হবে না। তবু সে এখনও ভুলতে পারল না। বিছানায় শুয়ে, অদেখা একটা মুখের ওপর জুম-ইন আর জুম-আউট করতে থাকে! দীর্ঘক্ষণ। জানলা খুলে দেয় হাওয়া। বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। শীতকাল। কিছুতেই স্পষ্ট হয় না— দয়াময় কি মানুষ— লোকটা অমন আকুল হয়ে ডাকল কেন— সেদিন তার গান শুনে কেউ হাততালি দিয়েছিল— বলেছিল, আরও গান শুনতে চাই—আরও, আরও!

    —‘হে দয়াময়, হে দয়াময়ী! হে ভগবান, হে ভগবতী! পৃথিবীর মাঝে আমি বাঁচতে চাই…’

    শ্রাবণ কি ঠিক শুনেছে! তার সবগুলো ইন্দ্রিয় যেন কক্ষপথ চ্যুত একেকটি ইলেকট্রন! ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে। শ্রাবণ বুঝতে পারছে, অনেক কিছু ভাঙছে আজ। একসঙ্গে। বিছানা থেকে নেমে সে স্পর্শ পেল আগুনের। মেঝেতে থরে থরে মরা জলপিপি। কুলগাছের কাঠ। মাংসপোড়া ছাই। এই তো ভোর! এমন ভোরে শ্রাবণ নবজন্মপ্রাপ্ত। এ দেহ রাতভোর খুব পুড়েছে। এখন মিহি মিহি ছাই। কালো কালো কুয়াশা। ঘরদোরে ভেসে বেড়াচ্ছে: গতজন্ম। মনে হচ্ছে, যা কিছু ভাল, সব ঘটে গেল। গতজন্মে। গতভোরে। এই ভোরে শ্রাবণ একা। নিঃসঙ্গ। ঘরছাড়া। অশরীরী। ওজনহীন। একটা অবয়বমাত্র! কী তার পরিচয় সে জানে না। এটুকু জানে, তার আমিটাই আদতে দয়াময়, দয়াময়ী, যেটা ইচ্ছে সেটাই!

    ঘর পেরোলেই বারান্দা। রেলিং-এ বুক ঠেকিয়ে শরীরটাকে হালকা ঠেলতে হবে। এনার্জি ওয়েস্ট হবে না একটুও! লোকটা ডাকছে। বলছে পালিয়ে যেতে। তারপর কোনও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ। রূপকথার ঘর। আশ্চর্য মেঘ। চেরিফলের বাগান। সূর্যমুখী ফুলের আলো। মৃত্যুর মতো শান্তি। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেহালা। আবার সেই ভূতুড়ে সুর। লাফ মারতে গিয়ে শ্রাবণ থ মেরে যায়। কে যেন বলল, সেঞ্চুরিয়নে দ্বিতীয় ইনিংসে পূজারা হাফ সেঞ্চুরি করবে!

    পূজারা ব্যাট করছে! টিভি চালানোমাত্র স্ক্রিন হেজি। এক মিনিট। দু’মিনিট। তিন মিনিট। তারপর এলইডি স্ক্রিনে বিজ্ঞাপন শুরু হয়। কত কত উগ্রতার পোশাক! ব্র্যান্ডেড। গায়ে দিলেই পাওয়ার! চ্যানেল বদলায় শ্রাবণ। বিজ্ঞাপন। একটি বেসরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ক্যাচলাইন: আপনার সন্তান কি ভাগ করতে পারছে না? ফের চ্যানেল বদলায়। বদলায়। বদলাতেই থাকে। পূজারাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রত্যেক চ্যানেলে কাতারে কাতারে মানুষ। চিৎকার করছে। শ্রাবণের নাম ধরে। ওরা ভাগ দেখতে চায়! আজ কোনও ম্যাজিশিয়ান নেই। আজ শ্রাবণ নিজে ভাগ করবে। একমানুষকে পরিণত করবে দুইমানুষে! শ্রাবণ সিঁড়ির দিকে তাকায়।

    আগামীকাল, যখন রেডিওয় স্থানীয় সংবাদ চলবে, এই সিঁড়িটার আয়ু ঠিক ততক্ষণ। সেই সিঁড়ি বেয়ে শ্রাবণ নীচে নামছে। চিৎকার বাড়ছে ততই। গেটের বাইরে থেকে সেই লোকটা এখনও বলছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের কথা। কিন্তু শ্রাবণ নীচে নামছে। নীচে। নীচে। নীচে। এই প্রথম। পৃথিবীর ঢাকনা খুলে গেছে। কালো কাপড়ে ঢাকা অগুনতি মুখ। ইতিউতি ধুনি জ্বলছে। দেওয়ালে চারপেয়ে দাঁড়কাক। হিংস্র শামুক। শুয়োরের মতো মানুষের বাচ্চা কেটে ঝোলান। পাশে দাঁড়িপাল্লা। দূরে ঝিনচ্যাক আলোয় দুটো মেয়ে আর একটা ল্যাংটা ছেলে। পাছা দোলাচ্ছে। যারা মাতাল, এক খাবলা করে মাংস তুলে নিচ্ছে। জিভ লকলকে চাট। ওদের গ্লাসে ঠাণ্ডা পারদ। শ্রাবণ একবার পা রাখলেই, ওদের আমোদ আকাশ ছোঁবে। ভাগচিহ্নের খেলা শুরু হবে।

    শ্রাবণের বমি পাচ্ছে। সে ভাগ করতে পারবে না। সে বেমানান। সে নিষ্ক্রিয়। সে সকলকে বিস্মিত করে অর্ধেক সিঁড়িতে বসে পড়ল। এরপর কেউ তাকিয়ে দেখল না। ঝিনচ্যাক আলোয় মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে খেয়ে ফেলল নিজেকে। তবু যদি তাকাত, দেখতে পেত একজন অনুদ্বিগ্ন সিঁড়ির ধাপে দুমড়ে-মুচড়ে-কুঁকড়ে শুয়ে আছে। নবজন্মপ্রাপ্তি ঘটেছে তার। প্রথম ঘুম নেমে আসছে এবার। নক্ষত্রময় চোখে। এরপর বিকেল হবে। বিকেলের নরম আবরণ ভেঙে, থপ করে মাটিতে পড়ে যাবে। শালিখছানার মতো। তাকিয়ে দেখবে, শ্যাডো প্র্যাকটিস করছেন চেতেশ্বর পূজারা।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook