ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আবার এসেছি ফিরে


    সুস্নাত চৌধুরী (July 14, 2023)
     

    ফাস্ট’ না হলে নাকি ‘ফার্স্ট’ হওয়া যায় না। দ্রুততার সঙ্গে যে দক্ষতার একটা মাখো-মাখো সম্পর্ক আছে, এমনটাই মানুষ চিরাচরিত কাল থেকে জেনে এসেছে। একটি করে নির্দিষ্ট কর্ম সে যত দ্রুত সমাপনে দক্ষ হয়েছে, সভ্য হওয়ার দিকে যেন তত এগিয়েছে। চাকার ব্যবহার থেকে চ্যাট জিপিটি— এতদিন যে-কাজ দীর্ঘ সময় নিত, তা মুহূর্তে সালটে দিতে পারার ‘ঈশ্বরসম’ ক্ষমতা অর্জন করে সে যুগে-যুগে বিস্মিত হয়েছে, নিজের পিঠ নিজে চাপড়ে নিয়েছে। এই প্রবণতা তাকে বুঝিয়েছে, কোনো কাজ তাড়াতাড়ি করতে শেখাই আধুনিকতার প্রধান পাঠ— অপরের থেকে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম শর্ত। এই কথা ভাবতে ভাবতে আর তাড়াতাড়ি করা শিখতে-শিখতে সে যে কখন ‘তাড়াহুড়ো’ করে ফেলেছে, ধরতে পারেনি!

    ‘তাড়াতাড়ি’ আর ‘তাড়াহুড়ো’ এক জিনিস নয়। মানুষকে অবহিত করতে চাওয়ার দায়বোধ আর নিজে এগিয়ে গিয়ে ফুটেজ খাওয়ার অদম্য বাসনাও যে ভিন্ন বস্তু, তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটে চলা বিবিধ কর্মকাণ্ডে বেশ মালুম হয়। এই অতিতৎপরতার প্রধান ক্ষেত্রটি হল প্রয়াণবার্তা। অন্তিম শ্বাস বেরোনো তো দূরস্থান, দিব্যি সুস্থ মানুষকে স্রেফ গুজবে ভর করে সটান চালান করে দেওয়া যায় জান্নাত কিংবা জাহান্নমে। কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে থেকে শিল্পী নারায়ণ দেবনাথ— জীবৎকালে অনেকেই এই ঘটনার শিকার হয়েছেন। রোয়ান অ্যাটকিনসন, অমিতাভ বচ্চন কি ভিক্টর ব্যানার্জি— প্রথম হওয়ার তাড়নায় এমন সব প্রবীণ সেলেবের ক্ষেত্রে ‘রিপ’ থেকে ‘রিপান্তরে’ যেতে বেশি সময় নেয়নি ফেবু-জনতা। সম্প্রতি একই রকম দুঃখজনক ব্যাপার ঘটেছে অভিনেতা জয়জিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মৃত্যুর ভুয়ো খবর রটায় বলিউডের মার্কামারা ভিলেন প্রেম চোপড়াও খেদের সঙ্গে যা বলেন, তার সারমর্ম হল— মানুষ এখন দুঃখের খবর ছড়িয়েই সুখ খুঁজে পায়। আমাদের সংবেদনশীলতার অভাব কি আমাদেরই স্তম্ভিত করে দেয় না?

    ততটা দায়িত্বজ্ঞানহীন নয় বটে, কিন্তু দ্রুতির প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়ে অনলাইন পোর্টাল কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলও কখনো-সখনো এমন ভুল করে বসে। পাকেচক্রে পা দিয়ে ফেলে ফেক নিউজের ফাঁদে। নিজের কর্মজীবনের সামান্য অভিজ্ঞতাতেও দেখেছি, অবিবেচকের তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তে সুচিত্রা সেন কিংবা নিমাই ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বের ভুয়ো মৃত্যুসংবাদ সম্প্রচারিত হতে। হাতের তির আর মুখের কথা বেরিয়ে গেলে ফেরানো যায় না বটে, ভুল ব্রেকিং নিউজ বেরিয়ে গেলে অবশ্য মানুষের বিস্মৃতির উপরে ভরসা রাখাই রীতি।

    এ-ধরনের ভুল খবর কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির মাধ্যমে ফেসবুক কিংবা টুইটারে এলে তা বিভ্রান্তির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। সংবাদ মাধ্যমের লাইভ প্রতিবেদনেও তা উঠে আসার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। বছর পাঁচেক আগে কিছুটা তেমনই ঘটেছিল প্রাক্তন তৃণমূল নেতা পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র অসুস্থতার সময়ে। সেক্ষেত্রে অবশ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই প্রথমে তাঁকে প্রয়াত ঘোষণা করে, খবর ছড়িয়ে পড়ে, আসতে থাকে শোকবার্তা, টুইট পর্যন্ত করে ফেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়; কিন্তু পরে সাময়িকভাবে ফের তাঁর হৃদস্পন্দন দেখতে পাওয়া যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার অস্তিত্ব না থাকলেও, ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ব্যর্থতায় কতকটা এমন ভাবেই দেশজুড়ে রটে যায় রাজনীতিক জয়প্রকাশ নারায়ণের মৃত্যুসংবাদ। বিবৃতি দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই স্বয়ং। সংসদ স্থগিত করে দেওয়া হয়। পরে জানা যায় যে খবরটি আগাগোড়া ভুয়ো; কিন্তু জল তখন অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছে। আসলে সেকালের তুলনায় আজকের বৈদ্যুতিন মাধ্যমের একটা সুবিধে হল, খবরটি যে ভুল তা বোঝামাত্রই সরিয়ে ফেলা এবং তৎক্ষণাৎ সংশোধনী প্রকাশ করা খুব সহজেই সম্ভব। ছাপা খবরের কাগজের বেলায় ঘটনাচক্রে তেমন হলে সমস্যা বিস্তর। মুদ্রণ চলাকালীন ধরা পড়লে ‘লেট’ এডিশনে সংশোধন করে যদি-বা কিছুটা সামাল দেওয়া যেতে পারে, তার বেশি দেরি হলেই সাড়ে সর্বনাশ! তখন চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষার পর ভুলস্বীকার করা ছাড়া উপায় থাকে না। তাই সচরাচর সংবাদপত্রে সতর্কতার মাত্রাও হয় কয়েক গুণ বেশি।

    কিন্তু তা বলে কি মৃত্যুর ভুল খবর কখনো ছাপার অক্ষরে বেরোয়নি? মুদ্রিত পত্রপত্রিকার ইতিহাসের দিকে তাকালে এমন বহু নমুনাই চোখে পড়ে— বিশ্বের তাবড় লোকজনের নাম উঠে আসতে দেখা যায় ভুয়ো মৃত্যুসংবাদের শিরোনামে, হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়া ভ্রান্ত অবিচুয়ারির কেন্দ্রে। এসবের নেপথ্যে অবশ্য দ্রুততা নয়— বরং ভুল তথ্য সরবরাহ, গুজবে ভরসা, সাংবাদিকের মাছিমারা কেরানিসুলভ মানসিকতা, প্রযুক্তিগত ত্রুটি ইত্যাদি বিবিধ বিষয় অবস্থাভেদে কাজ করেছে। যার জেরে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর মতো সংবাদ মাধ্যমকেও বার বার এমন ভুলের চক্করে জড়িয়ে পড়তে হয়।

    ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত কার্ল মার্কসের ভ্রান্ত অবিচুয়ারি

    ‘I’ve just read that I am dead. Don’t forget to delete me from your list of subscribers.’ একটি পত্রিকায় নিজের মৃত্যুসংবাদ চাক্ষুষ করে এমন চিঠিই নাকি লিখে পাঠিয়েছিলেন রুডইয়ার্ড কিপলিং। আর ১৮৯৭ সালের ২ জুন ‘নিউ ইয়র্ক জার্নাল’-এ প্রকাশিত হয়েছিল মার্ক টোয়েনের বক্তব্য, ‘The report of my death is an exaggeration.’ তার আগের ঘটনা কী হয়ে থাকতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়! তবে এটিই শেষ নয়, টোয়েন সাহেবের জীবনে এমন ব্যাপার ঘটেছে আরও এক বার। ১৯০৭ সালের ৪ মে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ একটি প্রতিবেদনে জানায়, মার্ক টোয়েন নিখোঁজ এবং গভীর সমুদ্রে তিনি তলিয়ে গিয়ে থাকতে পারেন। খবরটি পড়ার পর স্বকীয় মেজাজেই পাল্টা প্রতিবেদন লেখেন তিনি। পরদিন ওই কাগজেই প্রকাশিত হয় সে-লেখা— ‘MARK TWAIN INVESTIGATING, And If the Report That He’s Lost at Sea Is So, He’ll Let the Public Knew.’

    ভুয়ো মৃত্যুসংবাদ প্রকাশের ঘটনা সর্বদা যে হাস্যরসেরই উদ্রেক করেছে তা নয়— কখনো জন্ম দিয়েছে গভীর বেদনাবহ পরিস্থিতির, কখনো তা ওই ব্যক্তির জীবনের মোড় ঘুরিয়েছে। ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার মারা যাওয়ার এক বছর আগে প্যারিসের একাধিক সংবাদপত্রে ছাপা হয়ে যায় তাঁর মৃত্যুর খবর। সেটা ১৮৬৬ সালের এপ্রিল। সেইসব ভুল খবর যখন বেরোচ্ছে, বোদলেয়ার তখন বেলজিয়ামে। শারীরিক অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি হয়েছে, বসে গিয়েছে শরীরের ডান পাশ, আর তিনি হয়ে পড়েছেন প্রায় বাক্‌শক্তিরহিত। আলফ্রেড নোবেলের যে-জীবনকাহিনি প্রচলিত আছে, তা আবার অন্যরকম। তাঁর মৃত্যুর আট বছর আগে, ১৮৮৮ সালের ১২ এপ্রিল মারা যান আলফ্রেডের ভাই লুডভিগ নোবেল। দুই ভাইকে গুলিয়ে ফেলায় একাধিক সংবাদপত্র লুডভিগের বদলে ছেপে দেয় আলফ্রেড নোবেলের ‘অবিট’। তার মধ্যে একটি ফরাসি কাগজের শিরোনাম হয়, ‘Le marchand de la mort est mort’— মৃত্যুর ব্যবসায়ী মৃত! ভুল খবরটি দেখে নাকি গভীর আঘাত পান নোবেল। মানুষ কি তাহলে তাঁকে বিধ্বংসী ডিনামাইটের আবিষ্কর্তা হিসাবেই মনে রাখবে? এই ভ্রান্তিবিলাস তাঁর চোখ খুলে দেয়। ভবিষ্যৎকালের কাছে নিজের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি চিরস্থায়ী করতে নোবেল পুরস্কার চালুর পরিকল্পনা পাকা করেন তিনি।

    ১৮৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত হয় কার্ল মার্কসের মৃত্যুজনিত শোকসংবাদ। খবরটি ছিল আদ্যন্ত ভুল, অথচ সে-ব্যাপারে কোনো সংশোধনী পরে প্রকাশ করা হয়নি। পাঠকেরা জানতে পারেন প্রায় এক বছর পর, ১৮৭২-এর ২ সেপ্টেম্বর যখন ওই পত্রিকাতেই বেরোয় নেদারল্যান্ডসে তাঁর বক্তৃতা করার খবর। মার্কস মারা যান এরও এগারো বছর পর। তখন অবশ্য ঢের সতর্কতার সঙ্গে রিপোর্ট করে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’, শিরোনামেও যে-সতর্কতার ছাপ ছিল স্পষ্ট—  ‘Reported Death of Karl Marx.’ বিশ্বখ্যাত এই কাগজেই সুভাষচন্দ্র বসুর বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ভুয়ো খবর প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালের ২৯ মার্চ। খবরের সূত্র ছিল খাস রয়টার। কথায় বলে, কারও মারা যাওয়ার খবর রটলে নাকি তাঁর আয়ু বাড়ে! নেতাজির ক্ষেত্রেও কি তেমন কাকতালীয় কিছু ঘটেনি?

    সময় যত গিয়েছে, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মান্য মুদ্রিত পত্রে এমন ভুলচুকের হার কমেছে। ক্রমে আরও সতর্ক হয়ে উঠেছেন সংবাদকর্মীরা। এই কলকাতাও তার বাইরে থাকেনি। ১৯৮৮ সালের এক সকালে প্র্যাট মেমোরিয়াল স্কুলের তৎকালীন প্রিন্সিপাল ভেরোনিকা বীথি ঘোষ ঘুম থেকে উঠে দেখেছিলেন, শহরের প্রথম সারির একটি ইংরেজি দৈনিক বলছে, তিনি গত হয়েছেন! সে-সময়ে খানিক শোরগোল তোলে এই ঘটনা, যার পাকাপোক্ত প্রভাবও পড়ে এ-রাজ্যের প্রিন্ট মিডিয়ায়। ষোলো আনার উপরে আঠারো আনা নিশ্চিত হওয়া গেলে তবেই এখন কোনো মৃত্যুসংবাদ পাতায় বসে। তবে কি না মানুষ যেহেতু মরণশীল, তাই বিখ্যাত ব্যক্তিদের অবিচুয়ারি আগাম লিখে ফোল্ডারে সুরক্ষিত রেখে দেওয়ার চল কোনও-কোনও কাগজে রয়েছে। জীবিত মানুষজনের উপরে লেখা হলেও সাংবাদিকতার চালু বুলিতে সেই গোপন ভাঁড়ারটির ডাকনাম—  ‘মর্গ’!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook