একটা মাঠ একটা মঠ
১৯৯৮ সাল, বিশ্বকাপ ফুটবল হচ্ছে। তিব্বতি সন্ন্যাসীদের একটা মঠ থেকে একজন খুদে সন্ন্যাসী, ১২-১৩ বছর বয়স, নাম অর্গিয়েন, প্রায় রোজ রাত্তিরেই পালিয়ে পালিয়ে টিভিতে খেলা দেখতে যাচ্ছে। তার ঘরের দেওয়ালে মারাদোনা, রোনাল্ডো (ব্রাজিলের), আরও বহু ফুটবলারের ছবি সাঁটা। প্রার্থনার সময় সে অন্য এক সন্ন্যাসীকে চিরকুট পাস করে জানতে চায়, ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচ দেখতে সেও তার সঙ্গে আজ পালাবে কি না। ডাইনিং হল-এ বাজি ধরে, অমুক যদি না জেতে, তাহলে তোর রান্নাঘরের ডিউটিটা আমি করে দেব। দারুণ মিষ্টি এবং মেদহীন একটা তিব্বতি ভাষার ছবি ‘দ্য কাপ’ (১৯৯৯, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: খিয়েনৎসে নোরবু) ফুটবল-পাগলামি নিয়েই গড়ে উঠেছে, কিন্তু অন্য অন্য কথাও বলেছে, আর কোনও কথাকেই উপদেশ বা বিলাপের পর্যায়ে নিয়ে যায়নি। মঠের লামাদের জীবন নিয়ে ছবি যে ধর্মব্যাকুল বা নীতিবাক্যময় না-করে স্রেফ তকতকে রাখা যায়, তা এই ছবির চমক।
দেখানো হচ্ছে ভারতে তিব্বতি সন্ন্যাসীদের একটা মঠ, সেখানে নানাবয়সি সন্ন্যাসী। ছোটরা কোকাকোলার ফাঁকা টিন নিয়ে ফুটবল খ্যালে, আবার মেজো-শ্রমণ আসছেন দেখে ভয়ে পালায়। দেওয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে রাক্ষস বা পাখির ছবি আঁকে, ফের ভয়ে পালায়। প্রার্থনার সময় কেউ রোজই ঘুমিয়ে পড়ে, কেউ কাগজ দিয়ে ফুল বা পাখি বানায়। কেউ ঘরে লুকিয়ে ম্যাগাজিন আনে, তাতে কখনও-সখনও সন্ন্যাসীদের দেখা উচিত নয় এমন ছবি থাকে। একদম বড়-সন্ন্যাসী যিনি, এখনও রোজ গাদা গাদা তোরঙ্গে গোছগাছ করে রাখেন জিনিসপত্তর, যাতে টক করে তিব্বতে ফিরে যেতে পারেন, যদিও এই দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতে আজ এত বৃদ্ধ হয়েছেন, কখনও আর পারবেন বলে মনে হয় না। তিব্বত থেকে লুকিয়ে, চিনাদের নজর এড়িয়ে, বর্ডার পেরিয়ে এখানে শ্রমণ হতে আসে অনেকে, তারা কেউ বড্ড ছোট, মায়ের জন্য কাঁদে, পোষা খরগোশের জন্যও। যারা তাদের পাচার করে নিয়ে এসেছে, তারা চিনাদের অত্যাচারের কথা জানায়। মেজো-শ্রমণ অনেকটাই খবর রাখেন, তিনি বলেনও ধরা পড়লে চিনারা খুব কড়া শাস্তি দেয়, কখনও মেয়েদের ধর্ষণ করে। ছোট বাচ্চার সঙ্গে তার মামাও আসে, একটু বড়, সেও শ্রমণ হবে। তাকে ন্যাড়া করতে করতে একজন বলে, কেন আমাদের চুল কামিয়ে দেওয়া হয় বলো তো? যাতে মেয়েরা আকৃষ্ট না হয়। কিন্তু মেয়েদের ন্যাড়া করে দিলে ওদের আকর্ষণ একটুও কমে না! অর্গিয়েন জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, তিব্বতে তো তোমরা জীবনে একবার মাত্তর চান করো, তাই না? উত্তর আসে, না, প্রতি নববর্ষে করি। অর্গিয়েন বলে, এটা ভারত, রোজ চান করতে হয়। সে স্নানের জন্য সন্ন্যাসীর পোশাক খুলে ফেলতে দেখা যায় ভেতরে ব্রাজিলের গেঞ্জি, তাতে আবার সে ‘রোনাল্ডো’ লিখে রেখেছে, অবশ্য গেঞ্জি পরেই গায়ে জল ঢেলে দিতে, সেই লেখা কিছুটা ধেবড়ে যায়।
একটা হোস্টেল লাইফ নিয়ে ছবিতে যেমন হয়, এখানেও দেখানো হয়: প্রার্থনা, পড়াশোনা, নানারকমের ছাত্র, খুনসুটি। অর্গিয়েন অন্য দুজনকে ফুসলে ফুটবল দেখতে গিয়ে, সেখানে এত বকবক করে যে তাদের বের করে দেওয়া হয়। অবশ্য অর্গিয়েনের খুব দোষ নেই, মামাটি একেবারে নতুন, ফুটবলের কিছুই বোঝে না, বারবার জিজ্ঞেস করছিল, হাতে করে বল ছুড়ছে কেন, ওই গোলটা বাতিল হল কিসে? আরও বড় বিপদ, আশ্রমে ফিরে তারা দ্যাখে, অতি-কড়া মেজো-শ্রমণ জেগে আছেন, তাঁর হাতে ধরা পড়ে যায়। বকুনি খায়, তাদের রান্নাঘরে ডিউটি পড়ে, কিন্তু অর্গিয়েন কিছুতে দমবার পাত্র নয়, সে মতলব ভাঁজে, ফাইনালটা দেখতেই হবে, ব্রাজিল আর ফ্রান্স খেলবে, ছাড়া যাবে না। তার পরামর্শ: সরাসরি মেজো-শ্রমণকে গিয়ে বলি না। ওঁদের আপত্তি তো খেলা দেখা নিয়ে নয়, রাত্তিরে মঠ থেকে বেরনো নিয়ে। তা, মঠের ভেতরেই যদি খেলা দেখি? একটা টিভি ভাড়া করে এনে, সব্বাই মিলে দেখলে, কোনও নিয়ম তো ভাঙবে না। এই বৈপ্লবিক তর্কের পর আর কথা হয়? আরেজন তার সঙ্গে গুটিগুটি যায় প্রস্তাব পেশ করতে।
মেজো-শ্রমণ এর আগে, যখন রাতে পালানোর জন্য শাস্তি দিয়েছিলেন, বড়র সঙ্গে কথা বলতে গেছিলেন। বলেছিলেন, এখন ছেলেগুলোকে সামলানো একটু শক্ত, কারণ বিশ্বকাপ চলছে। বড়: ‘সেটা কী?’ মেজো: ‘দুই সভ্য রাষ্ট্র একটা বল নিয়ে মারামারি করে।’ বড়: ‘ধুর, তুমি রসিকতা করছ।… আচ্ছা, এই ব্যাপারটার মধ্যে কি হিংসা আছে?’ মেজো: ‘কখনও-সখনও আছে।’ বড়: ‘আর সেক্স?’ মেজো: ’না, তা নেই, নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’ বড়: ‘তুমি এতসব জানলে কী করে?’ মেজো হেসে ফ্যালেন। পরে আমরা তাঁকে দেখি ফুটবলের ম্যাগাজিন পড়তে (যার পিছনের প্রচ্ছদে লেখা আছে, ‘Just get out there and enjoy yourself’)। যখন অর্গিয়েনের প্রস্তাব শুনে, মেজো বড়র কাছে অনুমতি নিতে যান, বলেন, ওরা শুধু এই একটা ম্যাচ দেখতে চাইছে, বলছে তাহলে খুবসে পড়াশোনা করবে আর বাধ্য হয়ে থাকবে, তখন বড় জিজ্ঞেস করেন, ’মারামারিটা কখন হবে?’ ‘মাঝরাত্রে।’ ‘বাবা, মারামারির পক্ষে খুবই উদ্ভট সময়। তা, এত লড়ে এরা কী পাবে?’ ‘একটা কাপ।’ ‘একটা কাপ!’ বড় হেসে ফ্যালেন। ওই নির্মল হাসিতেই অনুমতি লেখা থাকে। এবার তো তাহলে টিভি ভাড়া করতে যেতে হয়। তার টাকা কই? সব সন্ন্যাসীর কাছে চাঁদা চাওয়া হয়। প্রথম রাউন্ডে খুব একটা টাকা ওঠে না, দ্বিতীয় রাউন্ডে তবু কিছুটা। অর্গিয়েন নিজের জমানো টাকা সবটা বের করে দেয়। আশ্রমে এক বয়স্ক সন্ন্যাসী থাকেন, তিনি একটু পাগলাটে, গায়ে দুর্গন্ধ, খুচখাচ ভবিষ্যদ্বাণী করে অনেকের কাছ থেকে টাকা পান। তাঁকে অর্গিয়েন প্রায়ই খ্যাপায়, ঘুমোলে নাকে ঘাসের সুড়সুড়ি দেয়, বলে, পরের খেলায় রেজাল্ট কী হবে, একটু ভবিষ্যদ্বাণী করে দাও না! এবার অর্গিয়েন টাকার জন্যে তাঁকে গিয়ে ধরে, তখন তিনি বাসন মাজার গুঁড়ো সাবান দিয়ে শ্যাম্পু করছিলেন (তাঁর সাফ কথা, যে সাবান দিয়ে গেলাস ধোওয়া যায়, তা দিয়ে মাথা বা পাছাও ধোওয়া যায়)। তিনি বিশ্বকাপ ব্যাপারটা জানেন না, চাঁদাও দেবেন না। অর্গিয়েন তাঁকে বাথরুমে বন্ধ করে দেয়, বলে ১০০ টাকা না দিলে খুলব না। কাজ হয়। তারপরও টিভির দোকানি বলে, এখন তো বিশ্বকাপ বলে টিভির ভাড়া বেড়ে গেছে বাপু, আরও ৫০ টাকা লাগবে। সবার মাথায় হাত। কী হবে? অর্গিয়েনের মাথায় আসে, যে ছোট্ট ছেলে তিব্বত থেকে সবে এসেছে, তাকে মা সঙ্গে করে একটা ঘড়ি দিয়েছেন, সেই সাধের ঘড়িটা বন্ধক রাখলে হয় না? তার মামাকে ভজিয়ে-ভাজিয়ে রাজি করাতে পাঠানো হয়। দোকানি বলে, কাল দুপুর বারোটার মধ্যে টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে না নিয়ে গেলে, এ ঘড়ি কিন্তু অন্যকে বেচে দেব।
ট্র্যাক্টরে করে ডিশ অ্যান্টেনা আর টিভি চড়িয়ে আনা হয়। আশ্রমে শোরগোল পড়ে যায়, বিশাল উৎসব। ডিশ অ্যান্টেনা নিজেদেরই লাগাতে হবে (দোকানি লাগালে আরও ৫০ টাকা লাগত), তার চেষ্টাচরিত্র চলে, এদিকে ঘোরাও সেদিকে ঘোরাও, কোনটা পূর্ব কোনটা উত্তর কিছুই ভাল ঠাহর হয় না। প্রথমে টিভিতে শুধুই ঝিরঝির, শেষে ছবি আসে। কিন্তু ছোট্ট ছেলে ঘড়ির শোকে তার মামার কাছে দুঃখু জানায়, সবাই বেঞ্চি পেতে বা মাটিতে থেবড়ে মহানন্দে বিশ্বকাপ দেখলেও, সে মাথা নিচু করে থাকে, তার ক্রমাগত কান্না পায়। অর্গিয়েনের চোখ বারবার সেদিকে চলে যায়। এতবড় ম্যাচ হচ্ছে, জিদান গোল দিচ্ছেন, রোনাল্ডো গোল মিস করছেন, কিন্তু অর্গিয়েনকে তেমন উত্তেজিত দেখা যায় না। কেউ তাকে ঠেলতে থাকে, কী হল রে, তোর কী হল? মাঝখানে আবার লোডশেডিং হয়ে যায়। অনেকে রেগে ওঠে, একজন গিয়ে খবর আনে, গোটা গ্রামেরই আলো চলে গেছে। সবাই আশ্বস্ত হয়, তার মানে বেশিক্ষণ লাগবে না, আলো চলে আসবে। আলো আসে, একটু পরে বড়-শ্রমণ মেজো-শ্রমণও এসে বসেন। অর্গিয়েন কিন্তু খেলা ছেড়ে উঠে চলে যায়। যার উৎসাহে ও পরিকল্পনায় এই প্রবল কাণ্ড, পবিত্র আশ্রমে টিভির প্রবেশ, নিরবচ্ছিন্ন উপাসনার মধ্যে ফুটবলের পাত পেড়ে বসে যাওয়া— সে-ই চলে গেল? বড়র আদেশে মেজো দেখতে আসেন, কী হল। গিয়ে দেখেন, অর্গিয়েন তার তোরঙ্গ খুলে একজোড়া জুতো বের করেছে, আরও কীসব খুঁজছে। মেজো জিজ্ঞেস করেন, ব্যাপার কী? অর্গিয়েন বলে, কাল টাকা না দিলে, ছোট্ট ছেলেটা ঘড়ি পাবে না। এই জুতোটা দিয়ে ঘড়ি ছাড়িয়ে আনা যাবে না? মেজো অর্গিয়েনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ঘড়ির বদলে জুতো? তোর ব্যবসাবুদ্ধি যখন এত কম, তুই ভাল শ্রমণ হবি। চিন্তা করিস না, ওই টাকা আমরা দিয়ে দেব। অর্গিয়েন একগাল হাসে। এরপরও সিনেমাটা একটু চলে, বড় সন্ন্যাসীর একটা উপদেশ-বার্তা শোনা যায়, যার অর্থ হল, নিজের চেয়ে অন্যকে ভালবাসো। কিন্তু তা দেখানোর দরকার ছিল না, ফুটবলের নেশার চেয়ে অর্গিয়েনের কাছে যখন ছোট্ট ছেলেটার প্রতি মায়া বড় হয়ে উঠেছিল, রোনাল্ডো গোল শোধ করতে পারবেন কি না তার চেয়ে বেশি যখন দুর্ভাবনা হচ্ছিল মায়ের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন ছেলেটা ফেরত পাবে কি না, তখনই সেই টলটলে দরদ ছবিটার নায়ক হয়ে গেছিল।
অনেকটা রসবোধ এবং প্রচুর খুঁটিনাটি মোড়া এই ছবিতে বহু কথা ইতিউতি ঠিকরোয়। আধুনিক জীবন কীভাবে একেবারে নিভৃত সাধনার এলাকাতেও গুঁতোগুঁতি করে ঢুকে পড়েছে, বহির্বিশ্বকে অস্বীকার করে এখন ধর্মাচরণ আর যুক্তিযুক্ত কি না, শৈশব ও কৈশোরের উচ্ছল প্রাণকে প্রশ্রয় দেওয়া যে কোনও মানবিক চর্চারই আবশ্যিক শর্ত কি না, সেসব প্রশ্ন আছে। একটা সহিংস পৃথিবীকে এড়িয়ে পেরিয়ে এক হিংসাহীন দ্বীপে ধ্যান করার আরাম, এবং স্বজাতিকে বিপদে রেখে সেই আরাম উপভোগের বেদনাও আছে। সঙ্গে আছে দুরন্ত বাস্তব। অর্গিয়েন জানে, সব চিনা খারাপ, সব তিব্বতিই নোংরা, সব ভারতীয়ই ঘুষ খায়, এবং আমেরিকার সব লোকেরই মুখ ও বুক রবারের তৈরি (সে ম্যাগাজিনে দেখেছে)। বাড়ি ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে আসার তীব্র মনখারাপও আছে, আবার দেওয়ালে টর্চের ছায়ায় জন্তুজানোয়ার বানিয়ে গল্প বলার শোনার স্ফূর্তিও আছে। এবং সবই আছে হাল্কা আঁচড়ে। এবং কোনও ভিলেন নেই। মঠের জীবনকে বাড়তি মহিমান্বিত করার দায় নেই, প্যাঁচঘোঁচ খোঁজারও আতশ কাচ নেই। একটা সরল ছবি, কিন্তু সঙ্গে আছে ঝকঝকে বুদ্ধি, কৌতুক ও বিশ্বাস, আর অবশ্যই মধিখানে আছে বিশ্বকাপ, যা তাকে এ মরশুমে একটু বেশি উল্লেখ্য করেছে।