এবারের একুশে অন্য রকম হওয়ার কথা ছিল। ২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। একুশ মানেই বাংলার গান, একুশ মানেই কবিতা উৎসব, একুশ মানেই বইমেলা; বিশ্ববাঙালির মিলনবেলা।
কিন্তু এর মধ্যে অনাহূত অতিথি করোনা। এলোমেলো করে দিল সব। গত বছর এমন সময়ে বাংলাদেশে চলছিল একুশের মেলা উদ্বোধনের তোড়জোড়, আর একই সঙ্গে কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলায় এক ঝলক ঘুরে আসার চিন্তা; এক বছর না যেতে সে-সময়ে পৃথিবীটাই পালটে গেল। কলকাতা পুস্তকমেলা স্থগিত, ঢাকায় কবিতা উৎসব স্থগিত, একুশের বইমেলা ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে মার্চের আঠারোতে গিয়ে ঠাঁই পেল। তাও ভাল। কয়েক দফা বন্ধ বা স্থগিত অথবা ভার্চুয়ালি আয়োজনের সিদ্ধান্ত অবশেষে বদল হল।
ফেব্রুয়ারির ক’মাস আগে থেকেই বহির্বিশ্বে অবস্থানকারী বাঙালিরা আসতে শুরু করত দেশে, বই বের করার প্রাণান্ত প্রয়াস চলত। ঢাকার বাংলাবাজার থেকে শাহবাগ— বইপাড়াগুলো সরগরম থাকত নতুন কাগজের গন্ধে, নতুন বইয়ের জন্মসনদে।
এবার অবশ্য চিত্রটা ভিন্ন। মেলার আগেই অনেকেই বই করছেন। বইমেলায় বিকিকিনির অনিশ্চয়তা ঘোচাতে চাইছেন অনলাইন বই বিক্রির সংস্থাগুলোর সহায়তায়। তবু তা আর কত! বইয়ের মতোই ঝক্কির মুখে পড়েছে তরুণ কবি, লেখকদের লিটল ম্যাগ উদ্যোগ। করোনার করুণ বাস্তবতা বিজ্ঞাপনের নেহায়েত সংকট সৃষ্টি করেছে, যা অভাবিতপূর্ব।
ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলাভিত্তিক বইমেলাগুলোও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কবি-লেখক-প্রকাশকদের কাছে এখন বই বিক্রির একটা বড় অনলাইন-নিশ্চয়তা ‘প্রি-অর্ডার’।
অবশ্য একুশ মানে তো শুধু একুশের বইমেলা নয়; একুশের অঙ্গীকারও। এ বছর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর, আর আগামী বছর একুশের ৭০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে এখন থেকেই সুবর্ণ জয়ন্তী ও সাত দশকের নানা উদ্যোগ-আয়োজন চোখে পড়ছে। এই তো সেদিন, কুমিল্লা থেকে নিমন্ত্রণ পেলাম— স্থানীয় ‘তিন নদী পরিষদ’-এর প্রায় চার দশকের একুশের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার। একুশের সংকলন প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছে অনেকেই। অবশ্য ১৯৫২ সালের অমর একুশের স্মৃতিবিজড়িত শহিদ মিনারের প্রতিবেশী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় করোনা-কালে বন্ধ থাকায়, এ-অঞ্চলকেন্দ্রিক একুশের আবহ কিছুটা হলেও ম্লান। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই তো একুশের প্রাণ; একদা তাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থীরাই তো মায়ের ভাষা বাংলার বদলে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার পাকিস্তানি অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল।
ফেব্রুয়ারির ১ ও ২ এই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই জমে ওঠে ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’। এক সময়ে এই উৎসব আলো করে থাকতেন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, বেলাল চৌধুরী। তাঁরা আজ নেই। তবু তাঁদের স্মরণে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার কবিতা-সক্রিয় প্রবীণ-নবীনেরা এখানে সমবেত হন, উচ্চারণে শপথ নেন সমুখে যাওয়ার, উজান বাওয়ার। এ বছর সে উৎসব স্তব্ধপ্রায়। সীমিত আকারে কিছু আয়োজন থাকবে, এটা অবশ্য জানা গেছে।
২০২১-এর শুরুটা স্বস্তির কিছুটা। কারণ ভারতের পর এবার বাংলাদেশে করোনার টীকা এসেছে। টীকা সংক্রান্ত ভীতি মানুষের কেটে গেছে। অনেকটা উৎসবের মতো, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ টীকা নিচ্ছেন। অবশ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে বইমেলা সফলতা পাবে কি না, সে-প্রশ্নও ওঠেছে, কারণ শিক্ষার্থীরা বইমেলার নান্দনিক অংশ।
তবে, আসন্ন বইমেলার পাশাপাশি ২০২১ মনে করিয়ে দেয়— এ বছর সত্যজিৎ রায়, শিবনারায়ণ রায়, বিমল কর, সৈয়দ আলী আহসান, আহমদ শরীফের জন্মশতবার্ষিকীও বটে। তর্পণ ও মোহমুক্ত মূল্যায়নের শুরু হোক ধারা— এটা জোর প্রত্যাশা।
২০২১-এর বইমেলার দুর্ভাগ্য নিয়েও বলতে হয়। ফি বছর বইমেলায় পাওয়া যায় পয়লা বসন্তের উত্তাপ, ভালবাসা দিবসের ঢাক। এবার মার্চে স্থানান্তরিত হওয়ায় নিষ্ঠুর নিয়তি সইতে হবে বইমেলাকে; এ-দুটি পর্বের কোনওটাই পাওয়া যাবে না বইমেলা চলাকালে। তবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস আর মেলার শেষদিন ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষও তো বইমেলার কালসীমাকে ধারণ করবে। মেলা খেলা সারাবেলা…
প্রবল শীত কমে আসবে। বসন্তের ভেঁপু বাজবে। আবার পুরোদমে চলবে ঢাকা-কলকাতা বইমেলা, কবিতা উৎসব আর একুশের আবহ! মিলেমিশে আমরা সব গাইব গান— অবিকল্প ভালবাসার।