‘সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল প্রোফেসর বোসের গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। এই সার্কাসে নাকি বাঙালী মেয়েরাও খেলা দেখাত, এমনকি বাঘের খেলাও। আর সেই সঙ্গে রাশিয়ান, আমেরিকান, জার্মান আর ফরাসী খেলোয়াড়ও ছিল…’
তোপসের জবানিতে এই কথাগুলো বলেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়, তাঁর ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ উপন্যাসে। কিন্তু কে এই প্রোফেসর বোস! সার্কাস দলের সঙ্গেই বা তাঁর কী সম্পর্ক! জানতে গেলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে, এক মজার ঘটনায়।
উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রিয়নাথ বসু ও তাঁর দাদা মতিলাল বসু ‘বোসের সার্কাস’ নামে একটি সার্কাস দল তৈরি করেন। একবার আলিপুরে বড়লাটের বাসভবনে অনুষ্ঠান করছেন তাঁরা, বড়লাট তখন লর্ড ডাফরিন। দলের শিল্পীদের সঙ্গে প্রিয়নাথ নিজেও খেলা দেখাচ্ছেন মঞ্চের উপর। হঠাৎ ডাফরিন জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘হু ইজ দ্য প্রোফেসর?’ এবং প্রিয়নাথ সামনে এলে, তাঁকে প্রোফেসর বোস বলে সম্বোধন করলেন বড়লাট। আর সেই থেকেই প্রিয়নাথ বসু হয়ে গেলেন প্রোফেসর বোস এবং দলের নাম হল ‘প্রোফেসর বোসেস গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস।’
প্রিয়নাথ বসুর জন্ম ১৮৬৫ সালে উত্তর ২৪ পরগনার ছোট জাগুলিয়ায়। বাবা মনোমোহন বসু ছিলেন হিন্দুমেলার রূপকার নবগোপাল মিত্রের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এবং বিশিষ্ট নাট্যকার। ছেলেবেলা থেকেই প্রিয়নাথ ছিলেন শরীরচর্চা-পাগল, আজকের যুগে যাঁকে ফিটনেস-ফ্যানাটিক বলে আরকি! ছোট জাগুলিয়া থেকে কলকাতায় এসে প্রখ্যাত কুস্তিগীর গৌরহরি মুখোপাধ্যায়ের আখড়ায় নাম লেখান তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে ওঠেন গৌরহরির প্রিয় ছাত্রদের একজন। একদিকে চলতে থাকে শরীর-শিক্ষার পাঠ নেওয়া, অন্যদিকে সতীর্থ ভোলানাথ মিত্রকে নিয়ে উত্তর কলকাতার সিমলায় একটি নতুন জিমন্যাস্টিক ক্লাব গঠন করেন তিনি। কিছুদিন পর ভোলানাথ আলাদা হয়ে গেলে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে তাঁদের পৈত্রিক বাড়িতে আখড়া সরিয়ে আনেন প্রিয়নাথ এবং চর্চা চালিয়ে যেতে থাকেন। পিরামিড অ্যাক্ট, জাগলিং, ঘোড়ায় চড়া বা জিমন্যাস্টিকের মতো বিভিন্ন খেলায় তিনি যত না দক্ষ ছিলেন তার চেয়েও ছিলেন ভালো ব্যায়াম-প্রশিক্ষক। কালক্রমে কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগণার নানা জায়গায় ৫০ টির মতো আখড়া গড়ে তোলেন এবং এই সমস্ত আখড়াতে তিনি নিজেই শিক্ষকতা করতেন। এ-ভাবেই, শহরের গণ্ডি পেরিয়ে কেবল কলকাতা কেন্দ্রিক শিক্ষিত জনসমাজের বাইরে দূরদূরান্ত অবধি ব্যায়ামের চর্চা ছড়িয়ে যায়, যা ‘বোসের সার্কাসে’র ভিত তৈরি করে দিয়েছিল। প্রিয়নাথের সার্কাসের কথা জানার আগে, চোখ রাখা যাক তাঁর পূর্বসূরিদের দিকে।
আরও পড়ুন : কাটা দিয়ে জোড়া লাগাতে পারলেন না! কী ঘটেছিল পিসি সরকারের ম্যাজিকে ? লিখছেন কৌশিক মজুমদার
১৮৬৮ সালে নবগোপাল মিত্র নিজের বাড়িতে একটি জিমন্যাস্টিক স্কুল খোলেন, নাম দেন ‘ন্যাশনাল জিমন্যাসিয়াম’। স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম জীবনে এই জিমন্যাসিয়ামেই যোগ দেন। নবগোপাল এবং তাঁর সতীর্থদের উদ্যোগে এ-ভাবেই কিছুদিন পর গড়ে ওঠে ভারত তথা বাংলার প্রথম সার্কাস দল– ‘ন্যাশনাল সার্কাস’, পরে দু’জন বার-প্লেয়ার তাঁদের একটি টাট্টু ঘোড়া নিয়ে নবগোপাল বাবুর দলে এসে যোগ দেন। বাকিদের মধ্যে বিহারীলাল মিত্র ছিলেন সার্কাসের ম্যানেজার, রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেখাতেন উড়ন্ত ট্রাপিজের খেলা। এই রামচন্দ্রই প্রথম ভারতীয় যিনি বেলুনে চড়ে শূন্যভ্রমণ করেন, একে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও তিনিই প্রথম। নবগোপাল মিত্রের হাত ধরে বাংলায় সার্কাসের সূত্রপাত হলেও তা ছিল নিতান্তই প্রাথমিক পর্যায়ের এবং কালক্রমে ‘ন্যাশনাল সার্কাস’ তার ধারাবাহিকতা ও ধরে রাখতে পারেনি।
এর অন্যতম কারণ, নবগোপাল কখনোই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে সার্কাস শুরু করেননি এবং সার্কাস ছাড়াও তিনি নানা সাংগঠনিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। ফলে সেভাবে দেখতে গেলে বিদেশি সার্কাসের সমকক্ষ সার্কাসদল তৈরির কাজটা প্রথম করেন নবগোপালের ছাত্ররা। রাজেন্দ্রলাল সিংহ, শ্যামাচরণ ঘোষ, দীননাথ ঘোষ, কাঁশারিপাড়ার ব্যায়াম শিক্ষক যোগীন্দ্রনাথ পাল ও আরও কয়েকজন মিলে একটি সার্কাসদল খোলার পরিকল্পনা করেন। তাঁদের বুনিয়াদী ব্যায়াম শিক্ষা এখানে যথেষ্ট সুবিধা করে দেয় এবং সম্পূর্ণ নতুন উদ্যমে শুরু হয় বাঙালির সার্কাস। দলের নাম হয় ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’, সালটা ১৮৮৩। ১৮৮৭ সালে ‘ন্যাশনাল সার্কাস’ বন্ধহয়ে গেলে সার্কাসের যাবতীয় জিনিসপত্র ও ঘোড়া জলের দরে কিনে নেন প্রিয়নাথ, সঙ্গে ছিলেন দাদা মতিলাল। দু’জনের নেতৃত্বে ওই বছরই যাত্রা শুরু করে ‘গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’। ১৮৯৯ সালে প্রথমবার কলকাতায় ‘বোসের সার্কাস’ খেলা দেখাতে এলে প্রিয়নাথ ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস’ও কিনে নেন। দলের অন্যতম অংশীদার যোগীন্দ্রনাথ পাল বোসের সার্কাসে ঘোড়ার ট্রেনার এবং রিং-মাস্টার হিসাবে নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু তিনি এই কাজেই বহাল ছিলেন।
হঠাৎ ডাফরিন জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘হু ইজ দ্য প্রোফেসর?’ এবং প্রিয়নাথ সামনে এলে, তাঁকে প্রোফেসর বোস বলে সম্বোধন করলেন বড়লাট। আর সেই থেকেই প্রিয়নাথ বসু হয়ে গেলেন প্রোফেসর বোস এবং দলের নাম হল ‘প্রোফেসর বোসেস গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস।’
প্রথম দিকে, প্রিয়নাথ ও মতিলালের দল বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে গিয়ে খেলা দেখিয়ে বেড়াতে থাকেন, কয়েকবার বাংলার বাইরেও যান। স্রেফ নিজের দৃঢ় সংকল্পের জেরেই প্রিয়নাথ তাঁর দলকে পৌঁছে দেন উচ্চতার শিখরে। মঞ্চ নেই, তাঁবু নেই, গ্যালারির নামও কেউ শোনেনি তখনও। তাই যাত্রাদলের মতো মাটিতে চাটাই পেতে বসা দর্শকের সামনে মশাল জ্বালিয়ে খেলা দেখাতে থাকে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। একটু-একটু করে টাকা আসায় যা উপার্জন হত, প্রিয়নাথ তার সবটাই ঢালতে লাগলেন দলের জন্য। তাঁবু কিনলেন, ভাল কয়েকজন খেলোয়াড় আনলেন আর রাখলেন রাখালচন্দ্র বসু নামের এক ম্যানেজার। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের। এতদিন হাড়-জিরজিরে টাট্টু ঘোড়া ছাড়া গ্রেটবেঙ্গলে আর কোনও জীবজন্তু ছিল না। ১৮৯৬ সালে রেওয়ার মহারাজা খেলা দেখে খুশি হয়ে প্রিয়নাথের দলকে উপহার দেন একজোড়া বাঘ! তাদের নাম রাখা হয় লক্ষ্মী-নারায়ণ এবং এরাই হয়ে ওঠে গ্রেট বেঙ্গলের তারকা! দেশের নানা জায়গায়, রাজা-রাজড়ার দরবারে, ইংরেজ বড় কর্মচারীদের কাছারিতে খেলা দেখালেও, কলকাতায় ‘বোসের সার্কাস’ প্রথম খেলা দেখাতে আসে ১৮৯৯ সালের নভেম্বরে। তারপর থেকে প্রতিবছর নিয়ম করে শীতকালে কলকাতা ময়দানে তাঁবু ফেলত বোসের সার্কাস।
ততদিনে দলে যোগ দিয়েছেন একঝাঁক নতুন খেলোয়াড়, যাঁদের মধ্যে ছিলেন বীরবাদল চাঁদ, ভবেন্দ্রমোহন সাহা, পান্নালাল বর্দ্ধন, বীরেন্দ্রনাথ-হীরেন্দ্রনাথ, প্রমুখরা। এখানেই শেষ নয়! প্রিয়নাথ সার্কাসের দলে নিয়ে আসেন মেয়েদেরও। সুশীলাসুন্দরী নামে বাঙালিনী খালি হাতে বাঘের খেলা দেখিয়ে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসকে খ্যাতির চুড়োয় নিয়ে যান, তাঁর বোন কুমুদিনী পিরামিড অ্যাক্ট, ট্রাপিজের খেলা দেখাতেন, তিনি ছিলেন অসাধারণ ঘোড়সওয়ারও। এদিকে দলে তখন ঢুকেছে হাতি। মৃন্ময়ী নামে আরেক বাঙালিনী শুরু করেন হাতির পিঠে বাঘের খেলা দেখানো। পাশাপাশি বুকের ওপর তক্তা পেতে তারউপর দিয়ে হাতি হাঁটানোর খেলা শুরু করেন ভবেন্দ্রমোহন ওরফে ভীমভবানী। বিখ্যাত ঘোড়সওয়ার মন্মথনাথ দে দেখাতেন চোখ বেঁধে ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠের উপর দাঁড়ানোর খেলা। আর ছিলেন ভারতীয় জাদুর প্রবাদপ্রতীম পুরুষ গণপতি চক্রবর্তী, তাঁর ইলিউশন বক্স, ইলিউশনট্রি-র মতো অভাবনীয় বন্ধন মুক্তির খেলা তখন হয়ে উঠেছিল সার্কাসের প্রধান আকর্ষণ।
প্রিয়নাথ নিজের দলকে ব্যবহার করতেন স্বদেশি চেতনার প্রসারের কাজেও। প্রতিদিন অনুষ্ঠান শেষে ইংরেজদের অত্যাচারে ধুঁকতে থাকা দেশবাসীকে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখতেন তিনি, তাঁবু ফুঁড়ে ধ্বনি উঠত ‘বন্দেমাতরম’। ফলে স্বদেশি কাগজগুলো প্রিয়নাথ আর তার সার্কাসের দলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠতে লাগল। সার্কাস নিয়ে বাংলার বাইরে ভাবনগর, জুনাগড়, কচ্ছ, সুরাট, বরোদা, ইন্দোর, মুম্বাই, পুণে, ঝাঁসি, চিতোর, উদয়পুর, করাচি, পেশোয়ার, রাওয়ালপিন্ডি থেকে দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা, জাভা, মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়াতে পৌঁছে গেলেন প্রোফেসর বোস। ১৯০২ সালে সেইসব ঘোরার অভিজ্ঞতা একত্রিত করে স্মৃতিকথার ঢঙে তিনি বই আকারে প্রকাশ করলেন, নাম ছিল- ‘প্রোফেসর বোসের অপূর্ব্ব ভ্রমণ-বৃত্তান্ত’। প্রায় ১৯১২ সাল পর্যন্ত পুরোদস্তুর চলেছিল এই সার্কাস।
প্রিয়নাথ ও তাঁর সার্কাসদলের একটি স্বতন্ত্র ইতিহাস আছে, স্বাভাবিক ভাবেই তার সমস্তটা এখানে আলোচনা করা সম্ভব হল না। প্রিয়নাথের মেজো ছেলে অবনীন্দ্রকৃষ্ণ বসু ‘বাঙ্গালীর সার্কাস’ নামে যে প্রামাণ্য বইখানা লিখে গিয়েছেন তার থেকে এই বিষয়ে অনেকটাই জানা যায়। ১৯১০এ মতিলাল বসু মারা যান, তারপর থেকেই ক্রমে সুদিন ফুরিয়ে আসতে থাকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও দলের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন গড়ের মাঠে তাঁবু ফেলা নিষিদ্ধ হলে বিদেশি দলগুলি আসা বন্ধ করে দেয়। যুদ্ধপরবর্তী অভাব-অনটনের বাজারে আয় যেমন কমে আসছিল তেমনই সার্কাস দেখতে যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থাও কারোর ছিল না। ১৯২০ সালে সিঙ্গাপুরে আজকের দিনেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রোফেসর বোস আর এভাবেই সমাপ্তি ঘটে বাঙালির সার্কাস সংস্কৃতির সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়ের।
তথ্যসূত্র:
প্রোফেসর বোসের অপূর্ব্ব ভ্রমণ-বৃত্তান্ত– প্রিয়নাথ বসু
বাঙ্গালীর সার্কাস– অবনীন্দ্রকৃষ্ণ বসু
দ্য ট্রপিক ট্রাপিজ : সার্কাস ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া– অনির্বাণ ঘোষ