মানুষ কেন খাবার খায়— এই সহজ প্রশ্নটির একটি বিজ্ঞানসম্মত উত্তর সবারই আশা করি জানা আছে। এবং তা হল, বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু সত্যিই কি তাই? শুধু কি বেঁচে থাকতে হবে ভেবেই আমরা খাওয়াদাওয়া করি?
একজন মানুষের জীবনের সব ধরনের আনন্দময় এবং দুঃখবিজড়িত পরিস্থিতির সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে খাবার। মধ্যবিত্ত জীবনে মুখেভাত, বিয়ে, পরীক্ষায় পাশ-করা, চাকরিপাওয়া– এমন নানা সুসংবাদের সঙ্গে সবসময়ই তো খাওয়াদাওয়ার অনুষঙ্গ জুড়ে আছে। জড়িয়ে আছে, মৃত্যুকে ভুলে আবার প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসার মতো নিয়মভঙ্গের মুহূর্তেও। মানুষ প্রেমে পড়লে ভাল ভাল খাবার খায়। আবার প্রেম ভেঙে গেলে সেই দুঃখ ভুলতেও তার ভাল-মন্দ খাবার লাগে। খুব নিম্নবিত্ত যারা, যাদের ইচ্ছেমতো খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ নেই, তারাও কিন্তু হাতে দুটো বাড়তি টাকা পেলে, ফুচকা, আলুকাবলি বা আইসক্রিম কিনে আনন্দ করে খায়! প্রবীণ অর্থনীতিবিদরা অবশ্য বলতে পারেন, তাদের সেই বাড়তি টাকা দিয়ে রুটি বা মুড়ি কিনে খাওয়াই উচিত ছিল, যা তাদের পেট ভরাবে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তো সমস্ত অঙ্ক মেলে না।
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লেখা বেশ কিছু ধর্ম-বিষয়ক গ্রন্থে নানা আঙ্গিকে বলা আছে, মানুষ তৈরি হয় প্রধানত দু’টি জিনিস দিয়ে। এক হল, তার শরীর এবং দুই হল, তার আত্মা। শরীর হল বাইরের এক আবরণ বা পোশাক, যা আমাদের ভেতরের সূক্ষ্ম অণু-পরিমাণ আত্মাটিকে ঘিরে থাকে। এবং মানুষের যা-কিছু ইচ্ছে-অনিচ্ছে— সব কিছুই নির্ধারিত হয় আত্মার মেজাজ-মর্জি অনুসারে।
এই বিষয়টি বুঝতে যদি কারও অসুবিধে হয় বা কেউ যদি এই তত্ত্বে বিশ্বাসী না-হন, তবে তাঁকে অনুরোধ করব, একবার নিজের এলাকার কোনও বনেদি মিষ্টির দোকানে গিয়ে, সেখানকার সবচেয়ে বড় রাজভোগটি কিনে, একটু একটু করে ভেঙে খেতে। তাহলে তিনি সেই রাজভোগের শরীরের ভেতরে, মানে প্রায় কেন্দ্রস্থলে থাকা খোয়া ক্ষীরের ছোট্ট মায়াময় গুলিটিকে দেখে, আমাদের শরীরের ভেতরে থাকা অদৃশ্য আত্মার উপস্থিতি কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারবেন।
জন্মের ঠিক পরে পরে মানুষ যে দু’টি কাজ না-শিখেও করে ফেলতে পারে— তা হল খাবার খাওয়া এবং শরীর থেকে বর্জ্যপদার্থ বের করে দেওয়া। শিশু বয়সে তাকে যা খেতে দেওয়া হয়, কোনওরকম দ্বিরুক্তি না-করে সে তা খেয়ে ফেলে। আরেকটু বড় হলে সেই খেতে দেওয়া খাবারের মধ্যে কোনও কোনও খাবার তার ভাল লাগতে শুরু করে, আর কিছু খাবার চলে যায় অপছন্দের তালিকায়। আসলে মানুষের খাদ্যরুচির সিংহভাগটাই তৈরি হয় তার ছোটবেলায়, তার মা কিংবা মাতৃস্থানীয়া কোনও মহিলার কাছ থেকে, যাঁর হাতের রান্না খেয়ে সে বড় হয়েছে। খাবারের একটি পদের বিশেষ একটি স্বাদকে আমরা সারা জীবন প্রিয়তম বলে মনে রাখি, কারণ পদটি ওই স্বাদেই আমাদের মুখে প্রথমবার উঠেছিল।
তারপর যত দিন যায়, নানা জনের হাতে সেই স্বাদ, রান্নার নানারকম উপাদানের সঙ্গে মিশে, আরও মাখোমাখো, আরও গরগরে হয়ে, এক বিশেষ ধরনের আকর্ষণ তৈরি করে আমাদের জিভে এবং মনে। আর মানুষ সেই আকর্ষণের আশ্চর্য মায়া কিছুতেই যেন কাটিয়ে উঠতে পারে না। তখন শয়নে, স্বপনে, জাগরণে শুধু সেই খাবারটিকেই যেন দেখতে পায় সে। কখনও সেই পদটি তার সামনে এসে পড়লে, সেটা খাওয়ার জন্যে তার প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। আর ঠিক সেই সময় যদি তাকে বলা হয়, ‘বাপু , তুমি একটির বেশি মেনি মাছ যেন কখনো খেয়ো না!’— তখন তার কেমন লাগে? আর ঠিক এই কাজটাই করে থাকে তার ডায়েট। মানে, বেঁচে থাকার জন্য যে পৌনে একখানা মেনিমাছ তার শরীরের দরকার, সে তাকে শুধু সেইটুকু খাবার অনুমতি দেয়, তার বেশি নয়। অথচ সেই সময়, তার আত্মা হয়তো চাইছে গুনে গুনে সাতখানা মেনিমাছ পাতে নিয়ে, তার গায়ে থকথকে হয়ে লেগে থাকা সরষে-ঝাল দিয়ে, দু’থালা চামরমণি চালের গরম ভাত মেখে গরাস গরাস খেতে। আর যা না-খেলে তার আত্মা সত্যিই খুব কষ্ট পাবে। শরীর নামক সেলুলার জেলের বন্ধ কপাটের ওপারে হাঁটু গেড়ে বসে তার আত্মা ঠক্ ঠক্ করে নিজের মাথা ঠুকে যাবে সারারাত। আর এর জন্য দায়ী হবে একজনই— যার নাম ডায়েট।
এই প্রসঙ্গে অতি-আধুনিক আর অতি-শিক্ষিত লোকজন, যারা পরজন্মে বিশ্বাস করে না, তাদের চট করে দু’-একটা গোপন কথা বলে নিই। এই যে, ‘ডায়েট’ নামক অত্যাচারের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনের যাবতীয় খাদ্য-সংক্রান্ত কামনা-বাসনাকে প্রতিদিন নৃসংশভাবে হত্যা করা হচ্ছে, এর ফল কিন্তু মোটেই খুব ভাল হচ্ছে না। এমনও দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ তার জীবনের যাবতীয় সুখাদ্যের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে একদিন নিঃশব্দে সরে যাচ্ছে এই পৃথিবী থেকে। অর্থাৎ, তার শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শরীরের খোলসে বন্দি হয়ে থাকা আত্মাটি মুক্তি পেয়েও নিজের অতৃপ্ত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে আবার যখন নতুন করে জন্ম নিচ্ছে এই পৃথিবীতে, তখন সে কিছুতেই আর মানুষ হয়ে জন্ম নিতে চাইছে না। মানে, যে-মানুষ কাতলা মাছের পেটির কালিয়া খেতে ভালবাসত, কিন্তু ডায়েটের চাপে মন খুলে তা খেতে পারেনি কোনওদিন, সে জন্মাচ্ছে একটা ছাইরঙা হুলো হয়ে। কুচো মৌরলার ঝরঝরে ভাজা শুকনো ভাতের সঙ্গে খেতে যে তুমুল পছন্দ করত, সে জন্মাচ্ছে ধবধবে খুন্তে বক হয়ে। যার প্রিয় ছিল বোরলি মাছের পেঁয়াজ-টমেটো-ঝাল, সে এবার চেহারা নিয়েছে নীল-সবুজ মাছরাঙার। যে এক আসনে বসে গোটা কাঁঠাল খাওয়ার স্বপ্ন দেখত, কিন্তু মুখপোড়া ক্যালোরির হিসেব তাকে সেই স্বপ্ন কোনওদিন পূরণ করতে দেয়নি, এজন্মে সে হয়েছে বাগানের এক জাঁদরেল হনুমান। আইবুড়ো বেলায় সাতখানা কাঁচালঙ্কা ছাড়া যে খেতে বসতে চাইত না কোনওদিন, অথচ স্বামীর পারিবারিক অর্শ এবং ডায়েটেশিয়ান বন্ধুর চাপে পড়ে যে মরিচগুঁড়োর কাঁটাতার টপকাতে পারেনি কোনওদিন, এ-জন্মে সে হয়েছে এক পাহাড়ি টিয়াপাখি। ছোলা দিয়ে পাকা কুমড়োর মিষ্টি মিষ্টি ছক্কা ফেভারিট ছিল যে ছাপোষা লোকটার, হঠাৎ মরে গিয়ে সে নতুন করে জন্ম নিচ্ছে দত্তপুকুর বাজারে রাউন্ড দেওয়া বিশাল ষাঁড় ভোলেবাবা হয়ে। থালার পর থালা ভাত খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বুকে চেপে দুপুরবেলা চোখের জল ফেলতে ফেলতে যে লোকটা ওটস গিলত গুচ্ছের টকদই দিয়ে, নতুন শরীরে সে এবার ধানক্ষেতের মেঠো ইঁদুর। আর প্রতিদিন তিন পেগ চাইলেও, এক পেগের বেশি মদ দেওয়া হত না যে লোকটাকে, পরজন্মে সে এবার বিলাসপুরের ঘন জঙ্গলে মহুয়াখোর লোমশ ভাল্লুক। এবং এইসব পরজন্মের পিছনে লজিক শুধু একটাই। হুলো, হনুমান, টিয়াপাখি বা ভাল্লুকের জীবনে ডায়েট বলে কোনও শব্দ নেই। তাই আবার মানুষ হয়ে জন্মানোর ক্যাঁতায় আগুন!
বেশিরভাগ মানুষ ডায়েট করে তার শরীরের অতিরিক্ত ওজন ঝরিয়ে ফেলার জন্য। কেউ আবার ডায়েট করে ওজন বাড়ানোর জন্য। কারও হয়তো মেটেচচ্চড়ি দিয়ে রোজ রাতে ঘি-মাখানো দেড় ডজন রুটি খেয়েও ওজন বাড়ে না। আবার কেউ হয়তো একবাটি ক্লিয়ার স্যুপ আর মাখন ছাড়া একখানা কড়া বাদামি টোস্ট খেলেও তা হু হু করে বেড়ে যায়।
আসলে কোন খাবারটা কে কীরকম মাপে খাবে, সেটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। কোনও খাবার যদি মুখে নিয়ে গিলে ফেলার পর, পাকস্থলীতে পৌঁছনোর আগেই ভ্যানিশ হয়ে যায়, তবে খাবার খাওয়ার সুখের অনুভূতিটাই তো অকালে মারা গেল। আর এত কম খাওয়ার চেয়ে না-খাওয়াই তো অনেক ভাল! এর চেয়ে থালা-ভর্তি খাবারের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেও তো অনেক বেশি আনন্দ পাওয়া যাবে।
বেশিরভাগ মানুষ ডায়েট করে তার শরীরের অতিরিক্ত ওজন ঝরিয়ে ফেলার জন্য। কেউ আবার ডায়েট করে ওজন বাড়ানোর জন্য। কারও হয়তো মেটেচচ্চড়ি দিয়ে রোজ রাতে ঘি-মাখানো দেড় ডজন রুটি খেয়েও ওজন বাড়ে না। আবার কেউ হয়তো একবাটি ক্লিয়ার স্যুপ আর মাখন ছাড়া একখানা কড়া বাদামি টোস্ট খেলেও তা হু হু করে বেড়ে যায়। কারণ এসবই তো মানুষের ঘুম ও জাগরণের মধ্যে সেতু হয়ে শুয়ে থাকা মেটাবলিক রেটের খেলা। আসল কথা হল, হজম-ক্ষমতা যার ভাল, সে প্রচুর খেলেও সেই খাবার ঠিক হজম করে ফেলবে এবং তা চর্বি হিসেবে কখনওই তার গায়ে লেগে যাবে না। কিন্তু হজমশক্তি কম হলে অল্প খাবারও হজম না-হয়ে ইটের ওপর জমা বালি-সিমেন্টের প্লাস্টারের মতো মেদের পরত হয়ে জমা হতে থাকবে আমাদের শরীরে।
দেখা যায়, সৃষ্টিশীল মানুষের খাওয়াদাওয়ার ওপর কিছু-না-কিছু দুর্বলতা থাকে। রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, ভাষাচার্য সুনীতিকুমার, শিবরাম চক্রবর্তী, দেবব্রত বিশ্বাস, উত্তমকুমার, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, চার্লি চ্যাপলিন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে– এঁদের প্রত্যেকেরই সেই দুর্বলতা ছিল। মনোলোভা খাবার পেট ভরে খেয়ে, প্রফুল্ল মনে, একটি চমৎকার কবিতা কিংবা একটি আনকোরা ছোটগল্প যে এক সিটিং-এ লেখা সম্ভব– এ তো এঁদের মধ্যে অনেকেই প্রমাণ করে দিয়েছেন। কাজেই খাবারের প্রতি সংযম রেখে এবং ডায়েট করে করে যাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁদের হাসিমুখে বেঁচে থাকার জন্য ফি-বছর, ৬ মে তারিখে সারা বিশ্বে পালিত হওয়া ‘নো ডায়েট ডে’-র মূল্য অপরিসীম। ১৯৯২ সালের এই দিনটিতে ব্রিটেনে প্রথম ‘নো ডায়েট ডে’ পালিত হয়। এরপর তা ছ়ড়িয়ে প়়ড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল এবং ভারতে। মানুষের বাড়াবাড়ি ডায়েট, নিজের শরীরের আকার এবং গড়ন নিয়ে হীনমন্যতা এবং মন থেকে ফ্যাট ফোবিয়া অর্থাৎ ‘এই রে, আমার চর্বি বেড়ে যাচ্ছে গো!’– গোছের চিন্তাভাবনা দূর করার মধ্য দিয়ে, সারা বিশ্বের মানুষের মনে নিজের শরীরের প্রতি ভালবাসা গড়ে তোলাই ছিল এর আসল লক্ষ্য।
‘নো ডায়েট ডে’-তে আমরা কোনও ডায়েট মানব না। যা খুশি, যেমন খুশি, যতটা খুশি খাব– এটাই ছিল এদিনের আসল স্লোগান। আর বাজারপ্রিয় বাঙালি, রন্ধনপটু বাঙালি, ভোজনরসিক বাঙালি এবং দৃষ্টিখিদেকে সযত্নে মনের মন্দিরে লালন করা বাঙালি, যে প্রাণপণ চেষ্টা করেও মাঝে মাঝে তার ডায়েটের কঠোর নিয়মের গণ্ডি থেকে একটুখানি পিছলে বেরিয়ে যায়– তাকে নিয়ে বহুযুগ আগে একটি অনবদ্য সরস কবিতা লিখেছিলেন প্রিয়তম জিনিয়াস সুকুমার রায়। তিনি যখন এই কবিতাটি লিখেছিলেন তখন এই মহাবিশ্বে ডায়েট নিয়ে কোনও চিন্তাভাবনা কারও মাথাই সেভাবে তোলপাড় করেনি। এই কবিতাটির নাম ছিল ‘নিরুপায়’ এবং এটি তাঁর ‘খাই খাই’ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে সংকলিত হয়েছিল।
কবিতাটি ছিল এই রকম—
বসি বছরের পয়লা তারিখে
মনের খাতায় রাখিলাম লিখে–
‘সহজ উদরে ধরিবে যেটুক,
সেইটুকু খাব হব না পেটুক।’
মাস দুই যেতে খাতা খুলে দেখি
এরি মাঝে মন লিখিয়াছে একি!
লিখিয়াছে, ‘যদি নেমন্তন্নে
কেঁদে ওঠে প্রাণ লুচির জন্যে,
উচিত হবে কি কাঁদানো তাহারে ?
কিম্বা যখন বিপুল আহারে,
তেড়ে দেয় পাতে পোলাও কালিয়া
পায়েস অথবা রাবড়ি ঢালিয়া–
তখন কি করি, আমি নিরুপায়!
তাড়াতে না পারি, বলি আয় আয়,
ঢুকে আয় মুখে দুয়ার ঠেলিয়া,
উদার রয়েছি উদর মেলিয়া!’