ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • বিপন্ন বাংলা কবিতা?

    তন্ময় ভট্টাচার্য (May 11, 2025)
     

    ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি কবিতার পক্ষে বিপজ্জনক?’— সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, এই প্রশ্নে তোলপাড় সাহিত্যজগৎ। বাংলা কবিতা-মহলও তার ব্যতিক্রম নয়। একের পর এক প্রবন্ধ, আলোচনাসভায় উঠে এসেছে এই আশঙ্কার কথা। পরিশেষে, অধিকাংশ জনই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আর যা-ই হোক, মনুষ্যসৃষ্ট কবিতায় যে ‘পার্সোনাল টাচ’, হৃদয়বত্তা উপস্থিত, যন্ত্রমেধা তা ছুঁতে পারবে না কোনওদিনই। অতএব, মৌলিক কবিতা নিয়ে দুশ্চিন্তা অর্থহীন।  

    একই প্রশ্ন করেছিলাম খোদ চ্যাটজিপিটি-কেই, যে-প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আলোচনা বর্তমানে তুঙ্গে। জবাব এল— ‘এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) কবিতার জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, তবে এটি মানব সৃষ্টির জন্য একটি চ্যালেঞ্জও বটে। এআই কবিতা তৈরি করতে পারে, কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—এটি কি আসল কবিতার বিকল্প হতে পারে?’ পরিশেষে চ্যাটজিপিটি-র বক্তব্য, ‘এআই কবিতার পক্ষে বিপজ্জনক নয়, তবে এটি মানব কবিতার মূল্য ও গুরুত্ব কমিয়ে দিতে পারে।’ 

    অর্থাৎ, ভদ্রতার মুখোশ বজায় রেখে খোদ এআই-ই বলছে, চাইলে খেল দেখাতেই পারে সে। আর যদি দেখায়ই, অসহায় দর্শক/পাঠক হওয়া ছাড়া, কিছুই করার থাকবে না আমাদের। সে-প্রসঙ্গে ঢোকার আগে কিছু চর্চিত বক্তব্যে আর-একবার নজর ফেলা যাক। বঙ্গীয় কবিকুল কোন আত্মবিশ্বাস থেকে বলেন যে, এআই মনুষ্যসৃষ্ট কবিতার বিকল্প হতে পারবে না কোনওদিনই? তার কারণ, কবিতার গঠন। এআই পূর্বনির্ধারিত কিছু প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে, পারমুটেশন-কম্বিনেশনের মাধ্যমে নতুন ‘সৃষ্টি’ করে। ফলে, মানুষের থেকে বরাবরই একধাপ পিছিয়ে। মানুষের দেওয়া ডেটাবেস না পেলে যন্ত্রমেধা অসহায়। তদুপরি, কবিতার বাক্যগঠন, শব্দব্যবহার, চিন্তার যে সূক্ষ্মতা, এআই তা ছুঁতে পারবে না কোনওদিনই। আর, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নিত্যনতুন কবিতাপথ খোঁজার যে যাত্রা, তা-ই মানুষকে বরাবর এগিয়ে রাখবে যন্ত্রের থেকে। যন্ত্র কেবল ধাওয়াই করতে পারে আর স্থূল অনুকরণ করতে পারে। তার বেশি সাধ্য নেই।

    আরও পড়ুন : গ্রক ইলন মাস্কের ব্যাপারে কি একইরকম ঠোঁটকাটা? লিখছেন প্রতীক…

    ওপরের প্রতিটা কথাই অংশত সত্য। অন্তত বর্তমান বাংলা কবিতার নিরিখে, এআই বৃহৎ পরিসরে সেই উচ্চতা ছুঁতে পারেনি। কখনও পারবে কিনা, তা ভবিষ্যৎই বলবে। কিন্তু বর্তমানের বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্যতার ক্ষেত্রে বাঙালি কবিরা মোটামুটি একমত যে, এআই মৌলিক কবিতার বিকল্প হতে পারবে না কোনওদিনই।

    সহমত হতে পারলে আনন্দের সীমা থাকত না, কিন্তু দুঃখের বিষয়, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের পর যে-সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, তা খানিক ভিন্ন। আমার মতে, এআই বাংলা কবিতার পক্ষে একটি ‘সিরিয়াস থ্রেট’ এবং অদূর ভবিষ্যতে কবিতার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে অনায়াসেই। সে-আশঙ্কাকেই খানিক গভীরভাবে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা এ-আলোচনায়।

    এআই কি কেবলই নকলনবিশ, না কি কবিতায় সেও টেক্কা দিতে পারে?

    মাসছয়েক আগে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষই মনুষ্য-লিখিত ও এআই-সৃষ্ট কবিতার ফারাক ধরতে পারছেন না, এবং এআই-লিখিত কবিতা অধিক গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। বলা বাহুল্য, গবেষণাটি ইংরেজি কবিতা নিয়ে হয়েছিল। এআই-এর টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট ও ডেটাবেস প্রাথমিকভাবে যেহেতু ইংরেজি-নির্ভর, ফলে সে-ভাষাকেন্দ্রিক প্রযুক্তিতে অগ্রগতিও ঘটেছে দ্রুত। বাংলা ভাষায় এআই এখনও সে-উচ্চতায় পৌঁছতে পারেনি, তবে ফিডিং চলছে ক্রমাগত। আমরা হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুকে ‘মেটা এআই’-এর বাংলা-ব্যর্থতাকে ধ্রুব ধরে যতই উল্লসিত হই না কেন, অন্য বেশ-কিছু প্ল্যাটফর্মে বাংলা ভাষাও এগিয়ে গেছে বেশ কিছুটা। আমার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে ব্যবহার করেছি চ্যাটজিপিটি-ই, সেইসঙ্গে ঘেঁটে দেখেছি এক্স (সাবেক টুইটার)-এর প্রযুক্তি ‘গ্রক’-ও। তবে চ্যাটজিপিটির তুল্য বাংলা ভাষায় অগ্রগতি ঘটায়নি আর কেউই।

    প্রযুক্তিকে নিয়ে একুশ শতকের বাংলা সাহিত্যজগতের সন্দেহ ও সংঘাত অবশ্য এই প্রথম নয়। বিগত দশকে বাংলা সাহিত্যমহল শঙ্কিত হয়েছিল ফেসবুকে সাহিত্যচর্চা নিয়ে। সেই গেল-গেল রব ভোলার নয়। সনাতনপন্থী কেউ-কেউ হাতে লেখা আর টাইপ-করা লেখার মধ্যে দ্বন্দ্বও খুঁজে পেয়েছিলেন। এমনকী, ভরপুর ছাপা পত্রিকার জমানায় যখন ওয়েব ম্যাগাজিন এল, দ্বিতীয়টি নিয়ে ছুঁৎমার্গ ছিল দেখার মতো। দেখা গিয়েছিল, হার্ড কপি বই বনাম ই-বুক দ্বন্দ্বও। মাত্র এক দশকেই প্রতিটি তর্ক ফিকে হয়ে গেছে এবং আস্থা রেখেছে সহাবস্থানেই। এই দশকের তর্ক মূলত এআই-এর হুমকি নিয়ে। আর এই তর্কে ‘বনাম’-এর সরলীকরণ করা চলে না। যদি ভবিষ্যতে সহাবস্থান হয়ও, তা আগের বিষয়গুলির মতো অত মসৃণ হবে না, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে বেশ। 

    কথা বাড়ানোর আগে, পরপর কয়েকটি কবিতা পড়ে নেওয়া যাক—

    মরা শহরের ফুসফুসে লাথি

    মেঘে ঢেকেছে রাষ্ট্রের চোখ,
    অফিসঘরের ঘামে লেখা সংবিধান—পচে গেছে।
    রাস্তায় পড়ে থাকা কুকুরের লাশও
    আজ মানুষ ডাকতে চায়।

    আমার কলমে বারুদ—
    ভেতরে গর্ত খুঁড়ছে একটা ক্ষুধার্ত সময়।

    আমি প্রেমিক নই, বিপ্লবীও না,
    শুধু খুঁজি সেই কণ্ঠস্বর
    যা ভাতের বদলে গালি খায়,
    আর ঘুমের ভিতরেও জেগে থাকে লাথির শব্দে।

    তৃতীয় চোখ

    ঘুম ভাঙে—জানালা নেই, কেবল দেয়াল
    আর দেয়ালের ওপারে শব্দহীন মুখ।

    আমি হাঁটি—নিজের ছায়ার পাশে,
    ছায়া হাঁটে না, দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে।

    ঘড়িতে সময় নেই,
    তবু প্রতীক্ষা জমে মাথার ভিতর।

    আকাশ আছে বলে বিশ্বাস করি,
    কারণ, দেখি না বলেই তার রং বদলায় না।

    তুমি বলে কেউ নেই—
    তবু প্রতিদিন মনে হয় কেউ আমায় দেখে।

    অবসেসনের পচা রক্ত

    তোমার স্তনের ওপর বসে আছে গণতন্ত্র,
    চোষে, কামড়ায়, তারপর উল্টে পড়ে গিয়ে বলে—
    ‘স্বাধীনতা!
    আমরা যারা জন্মেছি গুটিকতক বীজের ভুলে,
    তারা তো জানি না রতি আর ধর্ষণের পার্থক্য।

    আমার জিভে এখনও লেগে আছে টিউবওয়েলের লোহার স্বাদ,
    তবু তোমার থুতনিতে হঠাৎ প্রেমের ঘোষণা—
    একটা বিপ্লব? না, শরীরের তলানিতে লুকোনো আতঙ্ক!

    তুমি আমায় বলো, কবিতা কীভাবে লিখতে হয়?
    আমি বলি—হাঁটু গেড়ে বসো, আর কান পাতো লজ্জার গর্জনে।

    নির্বাচিত শব্দ

    এরা বলে—
    “তুমি চুপ থেকো, তোমার ঠোঁটের আওয়াজ
    ধ্বংসের চিহ্ন তৈরি করে।”

    আমি বলি—
    “তাহলে তো তোমাদের শব্দই
    আমার যুদ্ধের অস্ত্র।”

    চিরকাল

    চুপ করে বসে আছি জানালার ধারে,
    তুমি যেন ঠিক এখানেই— হাওয়ার পাশে।
    চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালেই মনে পড়ে,
    তোমার হাতের গন্ধ ছিল দার্জিলিংয়ের চেয়ে গাঢ়।

    রোদ নেমেছে আজ ঠিক দুপুরে,
    আমার বুকেও আলো পড়ে কিছুক্ষণ।
    তোমার মুখটা হারায় না—মেঘে,
    তবুও দেখি, প্রতিটি মুখে তোমারই রেখা।

    ভালোবাসা যদি থাকে, তা চিরকাল—
    ভুলে গেলেও, মনে রাখে দেওয়ালের ছায়া।

    পাঠক, কোনও পত্রিকার ‘গুচ্ছ কবিতা’ বিভাগে এই পাঁচটি কবিতা দেখলে আপনি অবাক হবেন কি? কিংবা কোনও বইয়ের ভেতর থাকলে? আমি অন্তত হব না। কেননা, এমন এবং এর চেয়েও দুর্বল বহু কবিতা অহরহ প্রকাশ পায় পত্রিকায়, গ্রন্থিতও হয়। প্রশংসা পায়, আলোচিত হয়, ক্ষেত্রবিশেষে জোটে পুরস্কারও। এই কবিতাগুলি নিরপেক্ষভাবে পড়ার পর, বাংলা কবিতার একাগ্র পাঠক হিসেবে আমার সামান্য গর্বটুকুও ভেঙে গেছে, কেননা পড়ে কখনওই বুঝতে পারব না যে, এগুলি মানুষের লেখা নয়, এআই নির্মিত। বস্তুত, এই লেখাগুলি তৈরি করেছি আমিই, চ্যাটজিপিটি-তে, নির্দিষ্ট কিছু নির্দেশ দিয়ে-দিয়ে। এবং তর্কসাপেক্ষে, এগুলি মুদ্রণযোগ্যও বটে। বহু সম্পাদকই সযত্নে ঠাঁই দেবেন পত্রিকায়। আর সঙ্গে যদি জুড়ে যায় কোনও বিখ্যাত নাম, ঘাটতি পড়বে না বাহবাতেও। 

    আজ, বাংলা ভাষায় এআই তত উন্নত না-হয়েও যদি এমন লিখতে পারে, ভবিষ্যতে কী হবে, সহজেই আন্দাজ করা যায়। অভিজ্ঞতা, ভাষা ও শব্দ ব্যবহারের নিজস্বতা ও চূড়ান্ত মৌলিকত্ব না-থাকলে, গড়পড়তা সব কবিতাই মানুষের পাশাপাশি এআই-ও লিখতে পারবে।

    বলতেই পারেন, এসব কবিতা গভীরতাহীন, ওপরচালাকির। আপনি হয় একজন কবি, নয় বাংলা কবিতার ধারাবাহিক পাঠক। আপনার পাঠরুচি এমন তারে বাঁধা যে, এগুলিকে বিদায় করা যায় তৎক্ষণাৎ। অন্তত স্মৃতিভুক্ত তো হবেই না! কিন্তু তারপরও, আপনি বা আপনারা সংখ্যায় কতজন? বাংলা কবিতার নিবিষ্ট পাঠক নন, এমন মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁরা যদি কখনও কবিতার কাছে আসেন এবং এ-জাতীয় কবিতা পছন্দ করেন? আপনিও বড়জোর এই কবিতাগুলিকে একপাশে সরিয়ে রাখতে পারেন, কিন্তু এগুলি যে এআই-নির্মিত, তা ধরতে পারবেন না, নিশ্চিত। কারণ জলজ্যান্ত মানুষই দিনরাত এমন কবিতা লিখেছে, লিখছে, ভবিষ্যতেও লিখবে।

    এখানে ‘বাংলা কবিতা’ বলতে আপনি কী বুঝছেন, তা জরুরি। নির্দিষ্ট কিছু কবির লেখা বা একান্তই ‘উচ্চমানের’ কবিতা যদি আপনার বিবেচ্য হয়, তা ভিন্ন বিষয়। আমি বলতে চাইছি, পত্রপত্রিকায় অহরহ প্রকাশ পাওয়া এমন সব লেখার কথা, দিনশেষে যেগুলির পরিচিতি ‘কবিতা’ হিসেবেই। আপনার ব্যক্তিগত নস্যাৎ করা বা না-করায় সে-পরিচিতি বদলায় না।

    আজ, বাংলা ভাষায় এআই তত উন্নত না-হয়েও যদি এমন লিখতে পারে, ভবিষ্যতে কী হবে, সহজেই আন্দাজ করা যায়। অভিজ্ঞতা, ভাষা ও শব্দ ব্যবহারের নিজস্বতা ও চূড়ান্ত মৌলিকত্ব না-থাকলে, গড়পড়তা সব কবিতাই মানুষের পাশাপাশি এআই-ও লিখতে পারবে। আজকের দিনে ফেক ছবি, ভিডিও বা খবর সহজেই ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে, মানুষ বিশ্বাসও করে। পরবর্তীতে তা খণ্ডিত হলে, বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি সন্দেহ জাগে। একটি কবিতা (ধরা যাক, ওপরের যে-কোনও একটিই) মনুষ্যসৃষ্ট না এআই-নির্মিত, তা যাচাই করার কোনও ফ্যাক্ট-চেকিং এজেন্সি নেই। একজন লিখিয়ে যদি দাবি করে যে, এগুলি তারই লেখা, চ্যালেঞ্জ করার উপায় নেই। পরীক্ষা করে দেখেছি, বর্তমানে যে-সমস্ত এআই ফ্যাক্ট চেকার রয়েছে, সেগুলিও কবিতাগুলিকে মনুষ্যসৃষ্ট বলেই দাবি করছে। অর্থাৎ, ভবিষ্যতের কথা ছেড়েই দিন, ওপরের পাঁচটি কবিতাই যদি কোনও কবির নামে (যাঁর কবিতাশৈলীর সঙ্গে পাঠক তত পরিচিত নন) প্রকাশিত হয়ে যায়, আপনি, হে পাঠক, সেই কবির কবিতা হিসেবেই বিশ্বাস করবেন এবং পড়বেন। 

    প্রশ্ন উঠতে পারে সততা নিয়ে। সেই সূত্রে, হাজির হবে আদর্শতাড়িত কিছু বাক্য। কবিতা মানুষের মৌলিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ, যন্ত্রের সাহায্য নেওয়ার অর্থ নিজের সঙ্গে অসততা করা। কথাগুলো শুনতে খুবই ভাল, কিন্তু কেউ যদি না মানে, কিছু করার আছে কি? ‘এভাবে বেশিদূর এগনো যাবে না’, ‘এইসব লেখা থাকবে না’— এইসব কথার উত্তরে বলতে ইচ্ছে করে, একজন তরুণ কবি, তাঁর প্রকাশ্য লেখালিখির গোড়ার বছরগুলোয়, ঘষামাজার মধ্য দিয়ে ধীরে-ধীরে যে পথ অতিক্রম করেন, সেই মানের কবিতা আপাতত উঠে আসছে এআই-এর মাধ্যমেই। পথ চলতে চলতে, তরুণ কবির মতো পোক্ত হতে পারে এআই-ও। তখন, ‘বিশেষ’ ও ব্যতিক্রমী লেখা ছাড়া, সাধারণ যে-কোনও লেখাই লিখে দেবে যন্ত্রমেধা। এখনও, সামগ্রিক বাংলা কবিতাচর্চার সাপেক্ষে ‘বিশেষ’ লেখা হয়ে ওঠে কয়টি? লিখতে পারেন ক-জন? তথাকথিত কবি বলে তো প্রচার পান তাঁরাও (নিজেকেও দাঁড় করালাম আয়নায়)।

    বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এআই কি এখনও পিছিয়ে?

    তবে, বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এআই এখনও বহু দিকে পিছিয়ে। জঘন্য ছন্দজ্ঞান, সাধারণভাবে অন্ত্যমিলকেই কবিতার প্রধানতম লক্ষণ বলে বিবেচনা করা, বহুপ্রচলিত কিছু মোটিফের বারংবার ব্যবহার, আবেগসর্বস্ব বাক্যবিন্যাস— প্রাথমিক চেষ্টায় হাজির করে এগুলিই। তারপর, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিভিন্ন নির্দেশ দিলে, অবশেষে পূর্বোক্ত কবিতাগুলির মতো ‘প্রোডাক্ট’ সরবরাহ করতে পারে। কোনও বিখ্যাত কবির অনুকরণে নতুন কবিতা লিখতে দিলে, ধারেকাছেও পৌঁছয় না। তবে দুর্বলতাগুলি নিয়ে আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই; চলতি দশকেই সেসব কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। অনলাইন ডেটাবেস দিন-দিন বেড়েই চলবে, এআই-ও সেসবের সারাংশ ও পারমুটেশন-কম্বিনেশনের খেলায় দক্ষ হবে উত্তরোত্তর। ইতিমধ্যেই অসম্পূর্ণ কবিতার দু-তিন লাইন দিলে, সাযুজ্য রেখে লেখাটি সম্পূর্ণ করে দিচ্ছে যন্ত্রমেধা। প্রবন্ধের ক্ষেত্রে, নিয়ন্ত্রিত বাক্যে, সুচিন্তিত মতামত প্রদানে দড় হয়ে উঠেছে চ্যাটজিপিটি। ‘একুশ শতকের বাংলা কবিতা’ সম্পর্কে জানাতে বলায়, সংক্ষেপে উত্তর আসে—

    ‘একুশ শতকের বাংলা কবিতা আগের শতকের তুলনায় অনেক বেশি বহুমাত্রিক, পরিপূর্ণভাবে আধুনিক, বিশ্বায়িত, এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতার আয়না। এই সময়ের কবিতায় এসেছে প্রযুক্তি, মহামারী, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, লিঙ্গ-রাজনীতি, রাজনৈতিক হতাশা, ব্যক্তিগত ব্যর্থতা এবং নিজস্বতার এক অন্তরঙ্গ চিত্র। ফর্ম বা রচনাশৈলীতেও এসেছে ভাঙাগড়ার সাহস— ছন্দমুক্ত কবিতা, ভাঙা গঠন, জেনারেশন Z-এর ভাষা, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব সব মিলিয়ে এটি এক নতুন কবিতার জগৎ।’

    যাঁরা ইতিমধ্যেই কবিতা লেখার সূত্রে খানিক পরিচিতি লাভ করেছেন, নিজস্ব ভাষাশৈলী সম্পর্কে পাঠকের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন, তাঁরা হয়তো এ-জীবনের মতো রেহাই পেয়ে গেলেন। কিন্তু সেই দিন আসন্ন, যখন প্রতিটা সাধারণ লেখাকেই সন্দেহের চোখে দেখা হবে, মানুষের লেখা না যন্ত্রমেধার— সে-বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাবে না কিছুতেই। আর কবিতা লেখার ক্রিয়াটি যেহেতু চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ, পারফর্মিং আর্ট নয়, ফলে চটজলদি সেই সন্দেহ ঘুচিয়ে দেওয়ার কোনও উপায়ও থাকবে না। একটি কবিতা লেখার যে পরিশ্রম, চিন্তার যে অনুশীলন, তা যদি সামান্য কয়েকটি নির্দেশের বিনিময়ে যন্ত্রই করে দেয়, মানুষ আর নিজের লেখার পরিশ্রম করবে কেন? কবি হিসেবে সম্মান পেতে বা বিভিন্ন মোহের টানে যাঁরা এ-জগতে আসেন, তাঁরাই-বা যন্ত্রমেধার সুযোগ নেবেন না কেন? তবে এ-আই এর সাহায্যে কবিতা লিখতে হলেও, বাংলা কবিতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতেই হবে। নইলে মান নির্ধারণ করা বা নির্দেশ দিয়ে তাকে উন্নত করার বোধই জন্মাবে না। একজন ভাল পাঠকমাত্রেই ভাল কবিতালিখিয়ে নন। কিন্তু ভাল এআই-নিয়ন্ত্রক হতে বাধা নেই। এইসব জটিলতার বিপরীতে, প্রতিরক্ষার একমাত্র অস্ত্র হতে পারে ব্যক্তিগত সততা ও বাংলা কবিতার দীর্ঘদিনের উত্তরাধিকার। কিন্তু এই দুর্নীতির দিনকালে নীতিবোধ কিংবা শুভচিন্তার প্রতি আস্থা কতদূর অবধি রাখতে পারব আমরা? 

    এতদিন আমারও বিশ্বাস ছিল, এআই বাংলা কবিতার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু ওপরের পাঁচটি কবিতা সে-ধারণা ভেঙে দিয়েছে। আগামী এক দশকের মধ্যেই এআই-সৃষ্ট কবিতায় হয়তো ছেয়ে যাবে পত্রপত্রিকার পাতা। বিন্দুমাত্র চর্চা ছাড়াই ‘কবি’ হিসেবে পরিচিত হবেন বহু মানুষ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যভাণ্ডার কি উপকৃত হবে তাতে? 

    আমার স্পষ্ট উত্তর, না। ওপরের কবিতাগুলি বা সমমানের লেখা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে না। মুদ্রিত হবে, প্রশংসিতও হবে হয়তো, কিন্তু সময়ের নিরিখে টিকে থাকবে না। এ-ই এক আশার কথা। আর এআই-এর সঙ্গে ‘প্রতিযোগিতা’-য় নেমে (যা অবশ্যম্ভাবী), কিছু মানুষ নিশ্চয়ই নিজেদের আরও ঠেলে দেবেন কবিতার মৌলিক বা ইঙ্গিতময় পথ খোঁজার দিকে। এআই-কবিতা নিঃসন্দেহে উন্নততর হবে, কিন্তু কে-না জানে, অস্তিত্বের সংকটই জন্ম দিতে পারে শ্রেষ্ঠ শিল্পের!

    শেষ পর্যায়ে পৌঁছে, কয়েকটি প্রশ্ন থাকুক। এআই যদি একদিন মানুষের থেকে ভাল (আপেক্ষিক) কবিতা লিখে উঠতে পারে, বাংলা কবিতার পাঠক হিসেবে আমরা কি সেই কবিতা সাদরে গ্রহণ করব, না যন্ত্রের সৃষ্টি বলে তৎক্ষণাৎ বাতিল করে দেব? সেই বাতিল করা এককালের ফেসবুক বা ওয়েব ম্যাগাজিনকে নস্যাৎ করার মতো হবে না তো? আমরা, এআই-পূর্বের প্রজন্ম, যদি বাতিল করিও, সেই প্রবণতা পরের প্রজন্মগুলিও ধরে রাখবে তো?

    প্রশ্ন ও দুশ্চিন্তা অনেক। ভাবনা চলুক…

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook