২০০২ সালে গুজরাতে, মুসলিম ও হিন্দু উগ্রপন্থীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেই রক্তক্ষয়ী সহিংসতার মধ্যে এক তরুণ, জায়েদ মাসুদ (পৃথ্বীরাজ সুকুমারণ) ও তার পরিবার নিজেদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও এক বিশিষ্ট রাজপরিবারের প্রধান, সুভদ্রাবেনের কাছে আশ্রয় নেয়। সুভদ্রা (নিখাত খান) তাদের আশ্রয় দেয় এবং তার ভাগ্নে মুন্নার হাতে দেয় তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব। কিন্তু মুন্না (সুকান্ত গোয়েল) মারাত্মক মুসলিমবিদ্বেষী। সে তার দাদা বলরাজ পটেলকে জায়েদের পরিবারের উপস্থিতির কথা জানায়। বলরাজ (অভয় সিং) এক হিংস্র জনতাকে সঙ্গে করে পরিবারটিকে হত্যার জন্য আক্রমণ করে। জায়েদের বাবা তাকে ও তার ছোট ভাই জাহিরকে একটি ছোট কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখেন। বলরাজ ও তার লোকেরা নির্মমভাবে হত্যা করে জায়েদের পিতাকে। সুভদ্রাও ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করার অভিযোগে বলরাজ ও মুন্নার হাতে নিহত হন। জায়েদ পালাতে সক্ষম হয়। কিন্তু পরে সে জানতে পারে যে, ছোটভাই জাহির সেই দাঙ্গায় খুন হয়েছে। আহত, আঘাতপ্রাপ্ত ও একাকী জায়েদকে একটি উগ্রপন্থী সংগঠন আশ্রয় দেয়। এরা শিশুদের সন্ত্রাসবাদে দীক্ষিত করতে ব্রতী। তবে পাকিস্তান পাঠানোর পথে জায়দকে উদ্ধার করে এক শক্তিশালী নেটওয়ার্কের নেতা কুরেশি আব্রাহম (মোহনলাল)। কুরেশি জায়েদকে নিজের ছত্রছায়ায় নিয়ে তার মধ্যে প্রতিশোধের অগ্নি প্রজ্বলিত করে।
সম্প্রতি মালয়ালম চলচ্চিত্র ‘এল২: এমপুরান’ ২০২৫ সালের সবচেয়ে বিতর্কিত ভারতীয় চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠেছে। ছবির শুরুতে ১৭ মিনিটের এক দৃশ্যে হিন্দু জনতা একটি মুসলিম পরিবারকে আক্রমণ করছে। সেখানে একজন গর্ভবতী মহিলার ধর্ষণ ও হত্যা চিত্রিত হয়েছে। দৃশ্যটি নারোদা পাটিয়া গণহত্যা, বিলকিস বানোর গণধর্ষণ এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার কথা দর্শকদের স্মরণ করিয়ে দেয়। একটি জ্বলন্ত ট্রেন (গোধরা ট্রেন হামলার ইঙ্গিত) এবং ‘বাবা বজরঙ্গী’ নামে এক দাঙ্গাবাজ নেতার (দণ্ডপ্রাপ্ত বজরং দল নেতা বাবু বজরঙ্গীর সঙ্গে সাদৃশ্য) উল্লেখ থাকায় ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে।
আরও পড়ুন : অ্যাডোলেসেন্স ভয় পাওয়ায়, কোনদিকে যাচ্ছে জেন-জি কৈশোর? লিখছেন উজান চট্টোপাধ্যায়…
ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলির অভিযোগ ছবিটি দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটানো গোধরা ট্রেন-জ্বালানোর ঘটনা উপেক্ষা করে শুধুমাত্র হিন্দুদের দ্বারা মুসলিমদের ওপর হামলার দিকে মনোযোগ স্থাপন করেছে। আরএসএস এবং বিজেপি-সমর্থিত সংগঠনগুলি ছবিটিকে হিন্দুবিরোধী ও দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছে। যদিও ছবিতে একজন হিন্দু মহিলাকে মুসলিমদের আশ্রয় দিতে দেখা গেছে, কিন্তু দাবি করা হয়েছে ছবির নির্মাণ আসলে হিন্দু সম্প্রদায়কে নিষ্ঠুরতার প্রতিমূর্তি হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। আরএসএস-সমর্থিত একটি পত্রিকা ‘এমপুরান’-কে ‘সিনেমার ছদ্মবেশে বিভাজনমূলক গল্প’ বলে আখ্যা দিয়েছে এই অভিযোগে যে, ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল করার চেষ্টাই নাকি এ-ছবির প্রতিপাদ্য। কিছু বিজেপি নেতা প্রথমে ছবিটিকে সমর্থন করলেও পরে এর ‘ইতিহাস বিকৃতি’ নিয়ে সমালোচনা করেছেন। মালয়ালম সিনেমার মেগাস্টার মোহনলাল প্রকাশ্য ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, চলচ্চিত্রটি কোনও সম্প্রদায়কে আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়নি। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, সেন্সর বোর্ডের সম্পূর্ণ ছাড়পত্র পেয়ে ছবি মুক্তি পাওয়ার পরেও নির্মাতারা পুনরায় ২৭টি দৃশ্য (মোট ১২৮ সেকেন্ড) ছেঁটে বাদ দিতে রাজি হয়েছেন! ‘বাবা বজরঙ্গী’-র নাম বদলে ‘বলদেব’ রাখা, ২০০২-এর উল্লেখ মুছে ফেলা এবং নারীদের ওপর হামলার কিছু দৃশ্য বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিজেপি ও তার মিত্র সংগঠনগুলি এ-ছবির বিরুদ্ধে সরব হলেও, খুব স্বাভাবিকভাবে কেরলের শাসক বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস শৈল্পিক স্বাধীনতার পক্ষে বলেছে। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন ছবিটিকে ‘সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচারমূলক’ বলে দেগে দেওয়ার নিন্দা করেছেন এবং তিনি উল্লেখ করেছেন, এমন ঘটনা প্রকৃতপক্ষে শৈল্পিক স্বাধীনতার ওপর হামলা। জোর করে অযাচিত এই দৃশ্য সম্পাদনার সিদ্ধান্ত আসলে হুমকির মুখে শিল্প পরিবর্তন এবং এটি একটি বিপজ্জনক নজির তৈরি করে। তবে বিজেপি নেতৃত্ব রাজনৈতিক চাপের কথা অস্বীকার করেছেন। তাঁদের মতে, পুনঃসম্পাদনার ব্যাপারটি নির্মাতাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
গুজরাত দাঙ্গা ছাড়াও ‘এমপুরান’-এ একটি কাল্পনিক বাঁধের কাহিনিতে বাস্তবের মুল্লাপেরিয়ার বাঁধ বিরোধের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে। একটি সংলাপে ‘৯৯৯ বছরের লিজ’ (মুল্লাপেরিয়ার চুক্তির সঙ্গে সাদৃশ্য আছে) ব্যাপারটির উল্লেখ থাকায় দুই রাজ্যের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে খানিক। কেউ কেউ বলেছেন, ছবিটি কেরলে তামিল-বিরোধী মনোভাব তৈরি করতে পারে। প্রযোজকদের মতে বাঁধটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
এ-খেলায় যেন সবাই জিতে গেছে! ডানপন্থীরা খুশি যে, তারা নির্মাতাদের অনুশোচনায় ডোবাতে পেরেছে, বামপন্থীরা খুশি যে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আসল মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে, মোহনলালের ভক্তরা খুশি যে, তাদের নায়কের ইমেজ সংশোধিত হয়েছে এবং মালয়ালম চলচ্চিত্রশিল্প খুশি যে. এতদিনে তারা ১৫০ কোটি ক্লাবে প্রবেশ করতে পেরেছে!
কিন্তু যতই নীরবতা থাকুক, ছবি পুনঃসম্পাদনার এই সিদ্ধান্ত আসলে দেশে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার প্রতিফলন। এখন চলচ্চিত্র শিল্পকেও শাসকের মতাদর্শ অনুযায়ী মিলিয়ে নিতে হয়! ‘কেরালা স্টোরি’, ‘ছাওয়া’ কিংবা ‘ডিপ্লোম্যাট’-এর মতো ছবি, যেগুলো শাসকের রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে— সেগুলির পথ ভারতে প্রশস্ত। কিন্তু বিজেপি সরকারের ঐতিহাসিক কুকীর্তির কথা উঠে এলেই সব ‘ইতিহাস বিকৃতি’ হয়ে যায়। শিল্পকে হতে হয় দেশদ্রোহী!
চিত্রনাট্যকার মুরলী গোপী ‘এমপুরান’-কে যতই একটি কাল্পনিক রূপক বলে অভিহিত করুন না কেন, পরিচালক পৃথ্বীরাজ এ-ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব থাকায়, ভেতর ভেতর যে রাজনৈতিক চাপ কাজ করছে— তা নিয়ে সন্দেহ নেই। নানারকম বিতর্ক সত্ত্বেও ‘এমপুরান’ মালয়ালম সিনেমার ইতিহাসে সর্বোচ্চ আয়কারী চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। প্রমাণ হয় যে, বিতর্ক প্রায়শই বাণিজ্যিক সাফল্য নিয়ে আসতে পারে। বিশ্লেষকরা এমনও বলছেন যে, এই বিতর্কের কারণে কৌতূহলবশত দর্শকরা সিনেমা হলে বেশি গিয়েছে। এবং আর-একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা আগে হয়নি। এ-খেলায় যেন সবাই জিতে গেছে! ডানপন্থীরা খুশি যে, তারা নির্মাতাদের অনুশোচনায় ডোবাতে পেরেছে, বামপন্থীরা খুশি যে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আসল মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে, মোহনলালের ভক্তরা খুশি যে, তাদের নায়কের ইমেজ সংশোধিত হয়েছে এবং মালয়ালম চলচ্চিত্রশিল্প খুশি যে. এতদিনে তারা ১৫০ কোটি ক্লাবে প্রবেশ করতে পেরেছে!
কিন্তু এত সবের মধ্যে যা সবার চোখ এড়িয়ে গেছে, তা হল ‘এমপুরান’ ছায়াছবির হিংসাশ্রয়ী আঙ্গিক। এখানে প্রতিটি চরিত্রের একটি হিংস্র অতীত আছে, যা তাদের ফিরে তাড়া করে। প্রিয়দর্শিনীকে (মঞ্জু ওয়ারিয়ার) দুই মৃত স্বামীর (প্রথম স্বামীকে দ্বিতীয় স্বামী হত্যা করেছিল, দ্বিতীয় স্বামীকে তার আদেশে হত্যা করেছিল স্টিফেন) সম্মুখীন হতে হয়। জায়েদ মাসুদ একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী থেকে ভাড়াটে সৈনিকে পরিণত। তার পরিবারকে হত্যা করা বজরঙ্গী গুন্ডাদের সঙ্গে তার হিসেব মেলাতে হবে। স্টিফেন এবং তার বংশের অতীত রহস্যে ঘেরা, যা প্রকাশিত হবে পরবর্তী অধ্যায়ে।
কেরলের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বের ছ’বছর পূর্তিতে যতীন রামদাস (টভিনো টমাস) অর্থ পাচার ও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে কেন্দ্রীয় একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তের মুখে পড়ে। তার শাসনামলে এমন দুর্নীতির কারণে তার নিজের দল ‘ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন ফ্রন্ট’ (আইইউএফ)-র সদস্যরা, যাদের মধ্যে রয়েছে মহেশ ভার্মা ও মুরুগন, কেরলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এই অস্থিরতার মধ্যে উত্তর ভারতের একটি নতুন বিরোধী দল, অখণ্ড শক্তি মোর্চা (এএসএম) জনপ্রিয়তা অর্জন করে কেরলে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। খেলা ঘুরে যায়, যখন যতীন এক সমাবেশে একটি অপ্রত্যাশিত ঘোষণায় আইইউএফ থেকে পদত্যাগ করে তার প্রয়াত পিতা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পি. কে. রামদাসের নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল আইইউএফ (পিকেআর) গঠনের কথা জানান। সে এও ঘোষণা করে যে, তার দল অখণ্ড শক্তি মোর্চার সঙ্গে জোট বেঁধেছে! অখণ্ড শক্তি মোর্চার জাতীয় নেতা হল সেই বলরাজ। সে এখন বাবা বজরঙ্গী নামে পরিচিত। কেরলের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে জনসেবার ছদ্মবেশে নিজের সম্পদ বাড়ানোর পরিকল্পনা করে বলরাজ। এদিকে গোবর্ধন পি. কে. রামদাসের দত্তক পুত্র স্টিফেন নেডুমপল্লির তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। স্টিফেন যতীনের মুখ্যমন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর থেকেই রাজনীতি থেকে দূরে ছিল।
কিন্তু কে এই স্টিফেন? কুরেশিই বা কে? এমন সব প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে পরবর্তী পর্বে।
‘এল-২ এমপুরান’ স্ব-সেন্সরশিপ, শৈল্পিক স্বাধীনতা ও কৌশলী সিনেমা ব্যবসার প্রশ্নে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।