ঔচিত্যের গজকাঠি
একটা মানুষের মধ্যে অনেকগুলো মানুষ আছে— সেটা ভুলে যাওয়াই হচ্ছে আজকের যুগের সহজ পাঠ। বোদা সিনেমার মতো, তুমি হয় হইহই হিরো অথবা ভয়ংকর ভিলেন। এ-বছর ‘এমিলিয়া পেরেজ’ ছবিটা অস্কারে ১৩টা মনোনয়ন পেয়েছে, শ্রেষ্ঠ নায়িকা হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন এই ছবির নায়িকা কার্লা সোফিয়া গ্যাসকন, যিনি রূপান্তরিতা— পুরুষ ছিলেন, নারী হয়েছেন। অনেকেই বলছিল, এবার তাঁর পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বিরাট, শুধু এই কারণে নয় যে, তিনি দুরন্ত অভিনয় করেছেন, এই কারণেও যে ডোনাল্ড ড্রাম্প রূপান্তরকামীদের বিরুদ্ধে। ট্রাম্পের লিঙ্গধারণা প্রথা-সাপ্টা: শরীর ছেলের হলে সে ছেলে, শরীর মেয়ের হলে সে মেয়ে। এই গোঁয়ার-গোঁড়া জ্যাঠা কল্পনাও করতে পারেন না, শরীরগত ভাবে যে পুরুষ, সে নিজেকে নারী বলে পরিচয় দিয়ে স্বস্তি পেতে পারে, বা উল্টোটা। বা কেউ আদৌ ভাবতে পারে: আমি নিজের লিঙ্গ নির্দিষ্ট করবই না। কিংবা মূল স্রোতে এই ধরনের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করো— দাবি তুলতে পারে সমাজের প্রভাবশালী অংশ।
ফলে, সেই আমেরিকায় দাঁড়িয়ে, প্রগতিশীল শিল্পীরা একজন রূপান্তরকামীকে, রূপান্তরিতাকে, অস্কার দিলে ট্রাম্পের মুখের ওপর মোক্ষম থাবড়া: ভোটে জিতলেও তুমি সজাগ চেতনার রাজ্যে গো-হারা, তোমার সংকীর্ণতায় যাদের করেছ অপমান, দারুণ প্রাইজ দিয়ে প্রমাণিব তারাও মহান। তাই শেষ পাতে পলিটিকাল কারেক্টনেসের জয়।
কিন্তু মুশকিল, গ্যাসকন-এর কয়েক বছর আগে করা কতকগুলো টুইট দুম করে উদ্ধার হল, যেগুলো ভয়ানক পলিটিকালি ইনকারেক্ট— কোথাও তিনি ইসলাম ধর্মকে মানুষ জাতের পক্ষে ক্ষতিকর বলছেন, কোথাও জর্জ ফ্লয়েড-কে (যে কৃষ্ণাঙ্গকে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ পুলিশ গলায় হাঁটু দিয়ে মেরে ফেলল রাস্তায়) বলছেন মাদকাসক্ত জোচ্চোর, কোথাও চিনের ভ্যাকসিনকে বিদ্রুপ করছেন। এমনকী, ২০২১ সালের অস্কার অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলছেন: এই অস্কার তো দেখছি দিন-কে-দিন একটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর প্রতিবাদী ছবির অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কী দেখছি— একটা অ্যাফ্রো-কোরিয়ান উৎসব, না কি কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার রক্ষার সভা, না কি মহিলাদের আন্তর্জাতিক ধর্মঘট! (সোজা কথা না, দুই বাক্যে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি, প্রতিবাদী ছবি, অস্কারদাতা সংস্থা ‘অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস’, আফ্রিকা, কোরিয়া, কৃষ্ণাঙ্গ, মহিলা— সব্বাইকে পাইকারি লাঞ্ছনা)!
দেখেশুনে woke— বা জাগ্রত নীতিশার্দূলগণের— দু’গাল মাছি। নৈতিক ঠিকতার প্যারেডে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে যাকে জয়পতাকা পতপতানোর দায়িত্ব দিলে, সে-ই ঝাড়েবংশে অনৈতিক! তুমি রূপান্তরিতা, আমরা তোমার হয়ে গলা ফাটালাম, আর তুমিই কিনা অন্য গোষ্ঠীদের স্টিরিওটাইপের পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে ঘেন্না উজাড়! আসলে পুরাকালের স্থাণু বা নব্যযুগের ঝানু— সকলেই চটজলদি সমীকরণে বিশ্বাসী। কেউ-ই মনে রাখে না, একটা গোটা গোষ্ঠী অবিমিশ্র ভাল বা বেধড়ক মন্দ হওয়া অসম্ভব (একটা গোটা মানুষের বেলায়ও তা খাটে)। ফলে প্রান্তিক বা নিগৃহীত গোষ্ঠীর মধ্যেও ধুমাধাড় নিচতা বা রগরগে নির্বুদ্ধিতা থাকতে পারে। অথচ এই বোধ খুব স্বাভাবিক। পৃথিবীর প্রতিটি গরিব লোক তো আর সততার জাহাজ নয়। কিংবা সব সমকামী তো ঘুমের মধ্যে খাম্বাজ রাগে নাক ডাকে না। বহু পুরুষ যেমন খেঁকুরে মারকুটে, বহু মেয়েও রগচটা কুচুটে। এই সহজ সত্যি জেনেও, ইচ্ছে করে চেপ্পে চোখ বুজে থাকে— একবগ্গা সমাজকর্মী, কাকাতুয়া পণ্ডিতুয়া। কারণ তাতে কাজের সুবিধে হয়। তারা একঝোঁকা হওয়াকে পবিত্র কর্তব্য মনে করে, নিগৃহীতের গায়ে একমেটে ভালত্বের পোঁচ বোলায়, কারণ তাহলে অত্যাচারিতের পক্ষে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা খোঁচহীন, সিধে পথে ফুলস্পিড। তাদের একটা স্পষ্ট মিশন নিয়ে (এবং বহু লোককে প্রকল্পে শামিল করে) এগিয়ে যেতে হয়, তাই শিল্পের মতো ‘সাদা-কালো বিভাজন ছাড়ো, ধূসরবাজি অধিক গাঢ়’ আবছা-চক্কর পোয়ালে, সন্দেহ ও প্রশ্ন ঢুকে, মনোযোগ ছেতরে ও স্বস্তি পিছলে যেতে পারে। যাদের জন্য লড়ছি, প্রত্যেকে শুচিসুন্দর— ভাবলে প্রতিপক্ষের দিকে দ্বিধাহীন ক্রোধ নিক্ষেপ সহজ হয়, নিজ পক্ষের প্রতি অনর্গল সহমর্মিতা বিচ্ছুরণের সুবিধে ঘটে। গুলি চালানোর সময় সৈনিকের ভাবলে চলে না যে, আমার রাষ্ট্র অন্যায়কারী হতেই পারে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সত্যের গায়ে বুঝ-কম্বল মুড়ে দিলে তো শেষরক্ষা হয় না, সে আচ্ছাদন সরে গিয়ে মানুষের গভীর জটিল বহুরঙা চালচিত্র উঁকি মারবেই। ফলে আসল কথাটা জোর দিয়ে বলতে হবে: গরিবদের মধ্যে খারাপ লোক থাকলেও গরিবদের পক্ষে লড়াই জারি থাকবে। দলিতদের মধ্যে বিদ্বিষ্ট মানুষ থাকলেও তাদের পক্ষে আন্দোলন থেমে যাবে না। কারণ প্রশ্নটা তো অ্যাক্কেবারেই এটা নয়: তারা ভাল লোক না খারাপ লোক। বিক্ষোভটা এই নিয়ে: রাষ্ট্র ও সমাজ তাদের দমন করছে, বঞ্চিত রাখছে। কোনও গোষ্ঠীকেই অত্যাচার বা উপেক্ষা করার অধিকার কারও নেই, প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে নিপীড়নের সম্ভাবনা বেশি, তাই তাদের (এবং তাদের হয়ে) প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়া অধিক জরুরি। সেই গোষ্ঠীভুক্ত কোন আইকন কেমন ব্যবহার করল, তার ওপর আন্দোলনের যাথার্থ্য নির্ভরই করে না।
আসল ঝামেলা হল, পলিটিকাল কারেক্টনেসের হাওয়া এসে বহু সিধে কথাকেই গুলিয়ে দিয়েছে। সেরা অভিনেতার অস্কার দেওয়া হয় অভিনয়ের জন্য। ভাল লোক হওয়ার জন্য নয়। যে লোক কৃষ্ণাঙ্গকে অপমান করেছে, সে নির্ঘাত খারাপ কাজ করেছে, কিন্তু তাকে যদি পুরস্কার-মঞ্চ থেকে বাদ দিই, তাহলে প্রমাণিত হয়, আমি চাই একজন নির্ভেজাল ভাল মানুষ পুরস্কারটা পাক, সেখানে অভিনয়ের উৎকর্ষ ম্লান হয়ে গেলে, যাবে। (মানে, বাড়তি শর্ত জুড়ে, পুরস্কারটা ভালমানুষি+ভাল অভিনয়কে দেওয়া হচ্ছে)। তাহলে কিন্তু কাউকেই পুরস্কার দিতে পারব না, কারণ প্রত্যেকের সারাজীবনের সমস্ত কাজ ও ভাবনার ফিরিস্তি আমার কাছে নেই। কার্লা সোফিয়া গ্যাসকন তাঁর বিরোধী-প্রচারে রেগে বলেছেন এগুলো চক্রান্ত, এবং সেই সূত্রে ব্রাজিলীয় নায়িকা ফার্নান্দা টোরেস-এর নাম করেছেন (ফার্নান্দা ‘আই অ্যাম স্টিল হিয়ার’ ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রীর অস্কার-দৌড়ে)। ফার্নান্দা যদিও কোনও রূঢ় প্রত্যুত্তর দেননি, সেই সংযমের জন্য প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। ক’দিন পর, ২০ বছর আগে করা ফার্নান্দার একটি টিভি-শো স্কিট উদ্ধার হয়েছে, সেখানে তিনি মুখে কালি মেখে কৃষ্ণাঙ্গ সেজেছেন (এবং তা এখন কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে অপমানজনক ধরা হয়)। ফার্নান্দা তক্ষুনি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। একজন সমালোচক চমৎকার বলেছেন, এরপর বোধহয় সেরা ক্ষমা প্রার্থনার জন্য একটা অস্কার চালু করতে হবে।
কিন্তু কথা হল, কে ১৬ বছর কে ২০ বছর কে ৬৬ বছর আগে কী বলেছিল, লিখেছিল, করেছিল— সমস্ত দলিল তন্নতন্ন ছেনে তাবৎ হিসেবের ডান-বাঁ কষে তবে যদি শিল্পের জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়, তাহলে শিল্পকে পুরস্কার দেওয়া হল কি? আমরা যখন কোনও ছবি দেখব, কলাকুশলীর গোটা তালিকার প্রতিটি লোকের (প্রযোজক পরিচালক সম্পাদক অভিনেতা ধ্বনিগ্রাহক ক্যামেরাম্যান ও আরও ৩৪২ জন) ফাইল খুঁটিয়ে পড়ে তবে দেখতে বসব? যারা আজ গ্যাসকন বা টোরেস-এর বিরুদ্ধে হইহই ক্যাম্পেন করছে— ওগো এঁদের পুরস্কার দিও না— তাদের কেউ ১২ বছর আগে একটা কুকুরের ল্যাজ কেটে দিয়েছিল কি না, বা তিনদিন আগে প্রেমিকাকে চড় মেরেছে কি না, বা ১৭ বছর আট মাস আগে বাথরুমে নাৎসি স্যালুট ঠুকেছে কি না, আমরা জানি কি? আর, সবচেয়ে বড় কথা: জানার দরকারটাই বা উদ্ভূত হচ্ছে কোত্থেকে? ফুটবল খেলতে যে নেমেছে, তার খেলাটুকু দেখা ভাল, শোওয়ার ঘরে কেমন ব্যবহার করেছ দেখে তবে টিমে নেব— এই ফতোয়া জারি করলে খেলা চৌপাট হয়ে যাবে। সর্বোপরি, খেলাটার প্রতি ও দল গঠনের প্রতি ন্যায়বিচারও হবে না।
পৃথিবীর প্রতিটি গরিব লোক তো আর সততার জাহাজ নয়। কিংবা সব সমকামী তো ঘুমের মধ্যে খাম্বাজ রাগে নাক ডাকে না। বহু পুরুষ যেমন খেঁকুরে মারকুটে, বহু মেয়েও রগচটা কুচুটে। এই সহজ সত্যি জেনেও, ইচ্ছে করে চেপ্পে চোখ বুজে থাকে— একবগ্গা সমাজকর্মী, কাকাতুয়া পণ্ডিতুয়া। কারণ তাতে কাজের সুবিধে হয়।
গ্যাসকন অস্কার অনুষ্ঠানকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন আফ্রিকান-কোরিয়ান উৎসব— দু’টি দেশকেই অপমান করেছেন। কিন্তু সত্যি যদি এই দেশগুলোর শিল্পীদের পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে তাঁরা ভাল কাজ করেছেন বলে নয়, ওঁদের পুরস্কার দিয়ে অ্যাকাডেমি-র ইনক্লিউসিভ ও দুরন্ত পলিটিকালি কারেক্ট হিসেবে সুনাম ছড়ানোর স্বার্থে— তাহলে শিল্পের পক্ষে ঘাতক এই কাজ করে অ্যাকাডেমি ধর্মচ্যুত হয়েছে। সেক্ষেত্রে গ্যাসকন অন্যায় করেননি, এবং অ্যাকাডেমি আসল ভিলেন। ভিলেন নৈতিক ঠিকতার ঠিকাদারি করা সেই আন্দোলন-বাগীশরা, যাঁরা শিল্পের সর্বত্র ঔচিত্য-গজকাঠি পোঁতার চেষ্টা করছেন। ২০২৩-এ উডি অ্যালেন, রোমান পোলানস্কি, লুক বেসঁ-র (তিনজনের বিরুদ্ধেই যৌন নিগ্রহের অভিযোগ আছে) ছবি দেখানোর জন্য যখন ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালকে দুয়ো দেওয়া হচ্ছিল, এই উৎসবের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর আলবের্তো বারবেরা বলেন, আমার কাজ কারও ব্যবহারের বিচার করা নয়, সিনেমার গুণমানের বিচার করা। এইটা বোঝা দরকার। যদি লোকটা যৌন নিগ্রহ করে থাকে, আইন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, সে শাস্তি পাবে। কিন্তু সে ভাল সিনেমা করলে তাকে ওই অভিযোগের জন্য পুরস্কার-বঞ্চিত করা যাবে না।
অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচার-কে মোশন পিকচার দেখতে হবে, জনতার ইমোশনের গ্রাফ নয়। নিত্যব্যবহারের নীতি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু পুরস্কার প্রদানেরও নিজস্ব একটা নীতি আছে, সেটা বিস্মৃত হলে চলবে না। একটা লোক বদ টুইট করেছিল বলে তার অভিনয়ের অস্কার কেড়ে নেওয়া যায় না, আবার একটা লোককে অস্কার দিলে একটা সু-আন্দোলনের সুবিধে হবে বলে তাকে পুরস্কার দেওয়া যায় না। কোন শর্তটা বিবেচ্য, কোন মানদণ্ডটাকে অগ্রাধিকার দেব, প্রতিটি ক্ষেত্রে তা ওজন করতে হবে, তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ যুগের টিক-মারা জাগরণকে ভয় পেয়ে কেবল ধৌতস্নাত স্ট্যাচুকে আলোকবৃত্ত দিলে, শিল্পের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হবে। অপেক্ষাকৃত প্রতিভাহীন লোক ছবি আঁকা বা উপন্যাস লেখার পুরস্কার নিয়ে বুক ফুলিয়ে বলবে, জানি, তেমন ভালভাবে কাজটা করতে পারি না, কিন্তু গত ৮৭ বছরে একটাও মশা মারিনি, সেই জন্য কি আমি জিনিয়াস নই?