ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • মশগুল : পর্ব ৫

    ল্যাডলী মুখোপাধ্যায় (February 15, 2025)
     

    ‘কাগজের বাঘ’-এরা…

    পাঁচ মাথা এক হলেই আমি ভিড়ে যেতাম। তা সেই ছোট থেকেই। গপ্প-আড্ডা শোনা ছিল আমার প্রাথমিক অভিপ্রায়। তারপর দিন গেছে, বছর গেছে, কখন যে নিজেই তার শরিক হয়ে পড়লাম! শুরু হয়েছিল পারিবারিক আড্ডা থেকে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলার আড্ডা, পাড়ার আড্ডা থেকে ক্রমে রাজনৈতিক আড্ডায় ছিল আমার গতায়াত। এরপর সাহিত্য-সংস্কৃতির পাল্লায় পড়ে পুরো দৈনন্দিনতায় চলে আসে নতুন মোড়।

    সেই সদ্য শিল্পের আকাশ দেখতে বা অনুভব করতে ঘুরে বেড়াতে শুরু করি আড্ডায়-আড্ডায়। মূলত শিল্পী-সাহিত্যিকদের বাড়ি ও তৎকালীন কিছু রেস্তোরাঁয়। কিন্তু সত্যি বলতে সেই সব একপেশে আড্ডা আমার কখনও তেমন ভাল লাগেনি। যার বাড়ি, সেই মূল বক্তা অথবা তার ঘনিষ্ঠ ভক্তজনরা দু’চার কথা বলবে। এই পর্যন্তই। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, আড্ডার কোনও প্রতিশব্দ নেই (সম্ভবত)। তো আমি এই পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে, খানিকটা লেখাপড়া করে এখনও বুঝতে পারিনি যে, যথার্থ আড্ডার পরিসরটি কী! সুপ্রাচীন গ্রিক আড্ডা, ফরাসি ক্যাফের আড্ডা, রাশান রান্নাঘরের আড্ডা, শীত-সন্ধ্যার তুরস্কের আড্ডা, শনিবারের রাতের স্পেনের আড্ডা, মুজতবা-খ্যাত মিশরের আড্ডা না নিখাদ বাঙালির আড্ডা! কোনটা যে মহত্তম, তা আজও বুঝিনি।

    আরও পড়ুন : গণেশ পাইনের হাঁটাচলাও নকল করতাম আমরা! পড়ুন অরণি বসুর কলমে ‘মশগুল’-এর চতুর্থ পর্ব…

    এতটা গৌরচন্দ্রিকার পর ঠিক এইখান থেকেই শুরু করব এই লেখার আড্ডাগল্পকথা। আসলে চাইছিলাম এমন এক আড্ডা, যা স্থিতিজাড্যনির্ভর কথার পৃষ্ঠে শুধু কথা নয়। এমন এক আড্ডা, যা ক্রমে সক্রিয় হয়ে উঠবে নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে। তা তো কোনও গাছের ফল নয়, যে টুক করে পড়ে একটা অবকাশ তৈরি করবে। ফলে বুঝে ফেলেছিলাম, এটা তৈরি করতে হবে। গত শতাব্দীর আটের দশকে অবশেষে একটা আড্ডা তৈরি করা গেল কলেজ স্ট্রিটে। পিয়ারীচরণ সরকার স্ট্রিটের ফুটপাতে একটি চায়ের দোকানে আমরা জনাসাতেক এই আড্ডা শুরু করি। ক্রমে সেই আড্ডার সদস্য-সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। চায়ের দোকানের মালিক বুড়ো আমাদের একরকম প্রশ্রয় দিতে থাকে। এরপর এই আড্ডার কথাবার্তা আর আলাপ-আলোচনা থেকেই জন্ম নেয় ‘কাগজের বাঘ’ নামে একটি বিকল্প বইয়ের দোকান। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার একটি বইয়ের দোকান মায় যোগাযোগ কেন্দ্র। নামটা এল মাও সে তুং-এর ‘পেপার টাইগার’ থেকে।

    দোকান বলতে ‘কাগজের বাঘ’ ছিল একটি কিয়স্ক। যেমন, পুরনো বইয়ের দোকানগুলো এখনও আছে। অনেকেই ভুল করে ‘কাগজের বাঘ’-কে পত্রিকা ভাবে। তা কিন্তু নয়। তবে তখন আমরা ওখান থেকেই একাধিক লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতাম। সেই সূত্রে বিভিন্ন লেখক-শিল্পী নিয়মিত আসতে শুরু করে।

    দোকান খোলা থাকত দুপুর বারোটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। জমে যেত শনি-রবিবার। আড্ডা-আলোচনা-তর্কবিতর্কের সঙ্গে থাকত গান। এই আড্ডার পাশাপাশি শুরু হল হাজারও অনুষ্ঠান। এমনই একটা অনুষ্ঠানের কথা দিয়েই ‘কাগজের বাঘ’-এর ধরনধারনের একটা ইঙ্গিত দিই।

    সেবার ঠিক হল, জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন পালন করব আমরা। নিরাভরণ সেই অনুষ্ঠানে কবিতা পড়বেন শঙ্খ ঘোষ। আমার ওপরেই দায়িত্ব পড়ল শঙ্খবাবুকে রাজি করানোর। শঙ্খবাবু বললেন, খুব ভাল, কিন্তু আমি কেন কবিতা পড়ব? অনেকটা বোঝানোর পর উনি সম্মত হলেন। বললেন, তবে আমার কবিতা নয়, জীবনানন্দের কবিতাই পড়তে পারি। মেনে নিলাম।

    শঙ্খ ঘোষ

    সেদিন বিকেল থেকে ‘কাগজের বাঘ’-এ ভিড় উপচে পড়ছে। প্রসিদ্ধ শিল্পী-সাহিত্যিকরা ছাড়াও উপস্থিত প্রচুর ছাত্রছাত্রী। প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর আর স্কটিশের ছেলেমেয়েদের দল। যাদের মধ্যে আজ অনেকেই প্রতিষ্ঠিত। কেউ মন্ত্রী, কেউ আমলা, কেউ অধ্যাপক, কেউ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। শঙ্খবাবু এলেন। আমায় জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় বসে পড়ব? আমি একটু ঠাট্টার সুরে বললাম, কেউ একটা ভাল চেয়ার নিয়ে এসো তো। তখন তো আমরা সকলে আগুনখেকো প্রতিষ্ঠান-বিরোধী! শঙ্খবাবু আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিপাত করে তৎক্ষণাৎ নিজের চটিজোড়া পেতে ফুটপাথেই বসে পড়লেন। শুরু হল জীবনানন্দর কবিতা পাঠ। রাস্তা উপচে পড়েছে। কে একজন তার মধ্যেই কলকাতা পুলিশের একটা নো এন্ট্রি বোর্ড এনে রাস্তার মুখে লাগিয়ে দিল। এটাকে কি ইতিহাস বলব না!

    কবি দীপক মজুমদার আসতেন নিয়মিত। দুপুরের দিকে খানিকটা বই পড়তেন। বিকেলের দিকে সবাই এলে উনি কথা বলতে শুরু করতেন। ম্যারাথন টকার দীপকদা সারা পৃথিবীর সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে উপস্থিত করতেন তাঁর কথায়। এক সময়ের জেলখাটা বামপন্থী দীপক তখন, আটের দশকে, দেশীয় মূলধারার বামপন্থীদের তুমুল সমালোচক ছিলেন। তা নিয়ে চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্কবিতর্ক।

    দীপক মজুমদার

    একবার এই আড্ডায় ‘আকৃতি’ নামে একটি সংস্থা দীপকদাকে আমন্ত্রণ করতে আসে। দীপকদা তাদের প্রচণ্ড ধমকের সুরে আকৃতির শুদ্ধ উচারণ জানিয়ে বললেন, আগে উচারণ শুদ্ধ করো, তারপর কথা হবে। তারা তো মানে মানে ধমক খেয়ে কেটে পড়ল আর দীপকদার গমগমে গলায় হাসি যেন থামতেই চায় না। যেন বলতে চাইলেন, কেমন দিলুম। ‘কাগজের বাঘ’-এর আড্ডায় দীপকদার দরাজ গলার গান ছিল প্রকৃতই অনন্য এক অভিজ্ঞতা।

    ওই যে লিখেছি চলন্ত আড্ডা, সক্রিয় আড্ডা। সেটাই ছিল ‘কাগজের বাঘ’-এর আড্ডার বিশেষত্ব।

    এই আড্ডার পরিকল্পনা-মাফিক একবার জনাকুড়ি ছেলেমেয়ে আমরা পৌঁছে যাই উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার। সেখানে তিনদিন ধরে উৎসব চলল। থিয়েটার দেখাল আমাদের সঙ্গে থাকা ‘শিকড়’ নাট্যগোষ্ঠী। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বাউলরা গান গাইলেন আর বন্ধুশিল্পীরা টাঙিয়ে দিলেন নানা বর্ণের ছবি। নিয়ে গিয়েছিলাম তিন-তিনটি ছবির ক্যান। ঋত্বিকের ‘আমার লেনিন’, বারীন সাহার ‘তেরো নদীর পারে’ আর গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ‘নাগমতী’। প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশটি জাম্বো ক্যান ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! কিন্তু ছবি যে দেখাতেই হবে। ওই যে লিখেছি, এই সবই হল সক্রিয় আড্ডার ফলশ্রুতি।

    এই আড্ডায় নিয়মিত আসতেন হাংরি জেনারেশনের লেখকরা। বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবিমল বসাক। উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় এলে অরুণেশ ঘোষও আসতেন আড্ডা মারতে।

    এরা মূলত নিজেদের আন্দোলনের কথা আর একে-অন্যের বিরোধিতার কথাই বেশি বলতেন। বলতেন, নিজেদের রচনা নিয়ে। ব্যতিক্রম ছিলেন বাসুদেব। বাসুদার আড্ডা-গল্পের বিষয় ছিল বিবিধ। সাহিত্য থেকে সিনেমা, নাটক থেকে চিত্রকলা, সমাজ-বাস্তবতা থেকে রাজনীতি ছিল তার বিষয়-আশয়। ভাল গান করতেন বাসুদা। আড্ডা জমিয়ে দিতেন পুরনো বাংলা গান ও গণনাট্যের গানে।

    পরিকল্পনা-মাফিক একবার জনাকুড়ি ছেলেমেয়ে আমরা পৌঁছে যাই উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার। সেখানে তিনদিন ধরে উৎসব চলল। থিয়েটার দেখাল আমাদের সঙ্গে থাকা ‘শিকড়’ নাট্যগোষ্ঠী। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বাউলরা গান গাইলেন আর বন্ধুশিল্পীরা টাঙিয়ে দিলেন নানা বর্ণের ছবি। নিয়ে গিয়েছিলাম তিন-তিনটি ছবির ক্যান। ঋত্বিকের ‘আমার লেনিন’, বারীন সাহার ‘তেরো নদীর পারে’ আর গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ‘নাগমতী’।

    ‘কাগজের বাঘ’-এর এক আড্ডা থেকেই ঠিক হল, আমরা এই রাস্তায় মেলা করব। যার নাম হবে ‘খোলামেলা’। আয়োজন শুরু হল। হিরণ মিত্র পুরো রাস্তাটা সাজিয়ে দিলেন হোগলার মাদুরের ওপর বর্ণময় তুলির টানে। প্রখ্যাত ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়ের কাজ চলে এল ফুটপাথে। শান্তিনিকেতন থেকে এল আরেক প্রথিতযশা শিল্পী সোমনাথ হোড়ের ভাস্কর্য। এর আগে রাস্তায় বা ফুটপাথে ভাস্কর্যের প্রদর্শনী কলকাতাবাসী দেখেনি। বীরভূম থেকে শিল্পী অলক সোমের ছাত্ররা এল রণপা-র নাচ দেখাতে। নয়া পিংলা থেকে দুখুশ্যাম চিত্রকর এল তার জড়ানো পটের ডালি নিয়ে। নাটক হল রাস্তায়। মধ্যরাত পর্যন্ত প্রতিদিন গান গাইল গৌরক্ষ্যাপা, পবন, সুবলদাস বাউল। সঙ্গে গৌতম চট্টোপাধ্যায় আর দীপকদার গান। এই শুরু হল— খোলামেলা। তিনদিন তিনরাত্রি ধরে চলত সেই মেলা। ‘কাগজের বাঘ’ বন্ধ হওয়ার শেষ তিন বছর এই খোলামেলা বসত প্রতি ডিসেম্বরে।

    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

    এখানে আড্ডা ছিল হরেকপ্রকার। যেমন ধরা যাক রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় বা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতো তাত্ত্বিক বক্তিমেবাজরা এলে একরকম, আবার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এলে ঠাট্টারসে ভরে উঠত বুড়োর চায়ের দোকান। গল্পকার অরূপরতন বসু আসতেন প্রায়শই। তিনি তখন সিনেমার কাজে যুক্ত হয়েছেন। সন্দীপনদার গল্প নিয়ে সিরিয়াল করছেন।একবার ভরা আড্ডায় সন্দীপনদা আমায় অরূপদার সামনেই বললেন, ‘আচ্ছা বলো তো ল্যাডলী, অরূপ তারকোভস্কির মতো গল্প লিখে কীভাবে সুখেন দাসের মতো ছবি বানায়?’ সবাই হেসে উঠল। তবে তারপরও আড্ডা থেমে থাকেনি। কোনও মনোমালিন্যও হয়নি। সুবিমল মিশ্র আসতেন প্রায়ই। অত্যন্ত কম কথা বলতেন, ফলে আড্ডা তেমন জমত না। তবে ছোট ছোট কথায় আমাদের কর্ম-উদ্দীপনাকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন বরাবর।

    সব কিছুর যেমন শুরু থাকে, তেমন শেষও থাকে। দশ-দশটি বছর হইহই করে চলা এই আড্ডা ও ‘কাগজের বাঘ’ বন্ধ হয়ে গেল ১৯৯০ সালের শুরুতে। নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য, বিতর্ক ও না-লিখতে পারা— নানা সমস্যায়। আমিও ছেড়ে দিলাম বা বাধ্য হলাম। তথাপি বলে রাখি, এই কথাগুলিই শেষ নয়। দশ বছরের নানা আড্ডা-গল্প-কথা কি এইটুকু পরিসরে লেখা যায়! তা নিয়ে একটা আস্ত বই-ই হতে পারে। আরও অনেকানেক কথা জমা রইল। তা কখনও সুযোগ পেলে লিখব।

    তবে বলে রাখি, আড্ডাধারী ছাড়া আড্ডা টেকে না।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook