‘স্মানডে’
রবিবার দুপুর অবধি ব্যাপারটা রবিবার। কিন্তু দুপুরের খাওয়াদাওয়া, বিশেষ করে তা যদি মাংস-ভাত হয়— সেই খাওয়াদাওয়া সেরে একটা ঘুম দিয়ে যদি ওঠা যায়, যে বিকেলে আমরা উঠব, তা আর রবিবার থাকে না। তা মোটামুটি একটা সোমবারের রং ধরতে শুরু করে। ইংরেজিতে এর জন্য একটা চমৎকার শব্দ আছে— স্মানডে। মানে, ‘দ্যাট পার্ট অফ সানডে, হুইচ ফিলস লাইক মনডে।’ এই অনুভবটা, আমার মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ অনুভূতিগুলোর একটা, যেখানে রবিবারটা চোখের সামনে আস্তে আস্তে সোমবারে পরিণত হয়। আমি দেখেছি, শীতকালে, যখন বেলা ছোট থাকে, তখন এই অনুভবটা তীব্র হয়ে ওঠে। একে দিনের আলো পড়ে আসছে, আশার আলো পড়ে আসছে, রবিবারটাও নিভে আসছে— দুম করে কেমন যেন সোমবার এসে পড়ে।
সোমবারের স্বভাবটাই এমন। সপ্তাহের সাত দিন যদি সাতজন মানুষ হয়, তার মধ্যে সোমবার হচ্ছে সেই মানুষটা, যার জীবনে কোনও আনন্দ নেই, কোনও রোমান্টিকতা নেই, যে প্রচণ্ড কড়া ডিসিপ্লিনে সবসময় থেকে এসেছে। তার গলা থেকে একটা হুইসল ঝোলে, এবং সেই হুইসলে সে বারবার ফুঁ দেয়, এবং বলে, ‘অ্যাটেনশন! চলো, দৌড়ও! লাইফ ইজ আ রেস!’ সারাক্ষণই সে খুব সিরিয়াস, যেন সবসময় তার মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। অনেকটা স্কুলের পিটি স্যরদের মতো, যারা সকলকে রীতিমতো বেত মেরে মার্চ পাস্ট করাতেন, বা প্রচণ্ড চিৎকার-চেঁচামিচি করে আমাদের ঘুম থেকে তুলে জোর করে পিটি করাতেন। এমনই একটা হাবভাব সোমবারের!
আরও পড়ুন : সোমবার মানে সম্ভাবনামুকুলের দিন!
রাকা দাশগুপ্তর কলমে ‘মনডে ব্লুজ’-এর ষষ্ঠ পর্ব…
রবিবার সন্ধেবেলা, সোমবার যখন ক্রমশ এগিয়ে আসছে, ওই সময় একটা অদ্ভুত বেদনাদায়ক অনুভূতি গ্রাস করে আমাকে। স্কুল ছেড়েছি ২০০৬ সালে। এখনও ভুলতে পারি না সেই অনুভূতি। এখনও যখন রোববারের আলো নিভে আসে, মনে হয়, যেন কাল সোমবার বুঝি একটা পরীক্ষা আছে, তার জন্য পড়া হয়নি। কালকেই হয়তো একটা হোমওয়ার্ক জমা করার আছে, এখনও বই খুলে দেখা হয়নি। ঠিক যেন, আগামিকাল স্কুলে গিয়েই আমি একটা বকা খাব। একটা বই আনতে ভুলে যাব, অথবা হয়তো জুতোয় একটু কালি লেগে যাবে। কিছু একটা হবেই। কিছু একটা অঘটন ঘটবেই।
তবে কলেজবেলাটা এক্ষেত্রে আমার জন্য খুবই ইন্টারেস্টিং! কারণ সেসময়, যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়়তাম, সেখানে সোমবার ছুটি থাকত। আমার বন্ধুদের দেখতাম, শুক্রবার পার্টি করছে, অথবা শনিবার টইটই করে এদিকওদিক বেরিয়ে পড়ছে। শনিবার আমি ক্লাস করতাম, কারণ জানতাম, বন্ধুরা যখন দৌড়ে দৌড়ে সোমবার কলেজে যাবে, তখন আমি আয়েস করব।
আমার পেশাগত জীবনে দু’ধরনের সোমবার আসে। এক, যখন আমি রেডিও স্টুডিওতে যাই, যখন রেডিওতে প্রতিদিন সকালবেলা কলকাতা শহরের সঙ্গে কথা বলার একটা সুযোগ হয়, তখন আমার জীবনে সোমবারটা খুবই প্রকটভাবে আসে। রবিবার রাতে পরেরদিনের তাড়াহুড়োটা আগে থেকেই অনুভব করি। একটা বিষয় এক্ষেত্রে আলাদা। যেহেতু আমার কাজকে, রেডিও স্টুডিওকে আমি ভালবাসি, তাই সোমবারটা আমার কাছে খুব কড়া অঙ্কের মাস্টারমশাই নন। সোমবারটাও আদতে একটা উদযাপনের দিন। কারণ, সোমবার আমি আমার কাজের স্রোতে ফিরতে পারছি। যেখানে আমার শ্রেষ্ঠ পারফরমেন্স দিতে পারব, সেখানে ফিরতে পারছি। এখানে একটা জিনিস বোঝার, আমার কাজ যদি আমার ভাললাগার হয়, সেই কাজটাকে যদি ভালবেসে ফেলতে পারি, তাহলে সোমবারটাকে আর সোমবার মনে হবে না, কাজটাকেও আর শুকনো কাজ মনে হবে না, উইকডে আর উইকএন্ডের মধ্যে বিশেষ দূরত্ব থাকবে না।
রবিবার সন্ধেবেলা, সোমবার যখন ক্রমশ এগিয়ে আসছে, ওই সময় একটা অদ্ভুত বেদনাদায়ক অনুভূতি গ্রাস করে আমাকে। স্কুল ছেড়েছি ২০০৬ সালে। এখনও ভুলতে পারি না সেই অনুভূতি। এখনও যখন রোববারের আলো নিভে আসে, মনে হয়, যেন কাল সোমবার বুঝি একটা পরীক্ষা আছে, তার জন্য পড়া হয়নি। কালকেই হয়তো একটা হোমওয়ার্ক জমা করার আছে, এখনও বই খুলে দেখা হয়নি।
এটা বলা হয়তো সোজা। ছাত্রছাত্রীদের অনেককিছুই জোর করে করিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু ছাত্রজীবন পেরিয়ে যারা পেশাগত জীবনে ঢুকছে, তারা যদি একটু ভাবনাচিন্তা করে এমন একটা কাজ খুঁজে নিতে পারে, যা তারা আনন্দের সঙ্গে করতে পারবে, বা কাজে ঢুকে যদি কাজটাকে ভালবেসে ফেলা যায়, যেটা হয়তো অনেক বেশি কঠিন— তাহলে সোমবারটাকে আর সোমবার মনে হয় না।
অন্যদিকে এমন অনেক কাজের ক্ষেত্রও আমার আছে, যেমন শুটিং-জাতীয় যাবতীয় যে কাজ, সেখানে আর কোনও দিন বা বার থাকে না, তারিখ বা ডেটটাই প্রধান হয়ে যায়। সেখানে যা সোমবার, তাই বৃহস্পতিবার, তাই শনিবার। হয়তো এমন হল, শনিবার থেকে কাজ শুরু হয়ে, রবিবারটা প্রচণ্ড কাজ হয়ে সোমবারটা হঠাৎ ছুটি পাওয়া গেল।
মোদ্দায়, সোমবারের একটা মনস্তত্ত্ব আছে। সোমবার যখন আসে, তখন সে একা মোটেই আসে না, সে আসে গোটা সপ্তাহের একটা অগ্রিম ক্লান্তি নিয়ে। সেই ক্লান্তি তখনও হয়তো তৈরিই হয়নি, কিন্তু তা আমাকে ভেতর থেকে ক্লান্ত করে দিচ্ছে। তাই মনে হয়, দৌড়ঝাঁপের এই জীবনে, সোমবার একটা কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী, যে নিজের খেলাটা খুব ভাল করে জানে। আমি আর সোমবার যদি মুখোমুখি দাঁড়াই একটা মাঠে, দু’জনে দু’জনের থেকে বল কাড়ার চেষ্টা করি, তাহলে দেখব, সোমবারের টিমে যারা খেলছে, তারা হল স্ট্রেস, কাজের চাপ, কর্মক্ষেত্রের নানাবিধ প্রত্যাশা, ক্লান্তি, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্সের মতো কঠিন খেলোয়াড়রা। আর আমার টিমে খেলছে কারা? আনন্দ, একটুখানি ঘুরতে যাওয়া, একটু ছুটি, একটু আরাম, নিজের মতো সময় কাটানো। আমাকে আমার টিমের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখতে হবে, যাতে সোমবার কোনওভাবে গোল না দিয়ে দিতে পারে। কাজেই, তাদের সময় দেওয়া প্রয়োজন, শুধু শনি-রবিতে নয়, সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতেও। তাহলেই, যে টিমে আমার ভাললাগার মানুষ, ভাললাগার সময় আছে, সে এগিয়ে থাকবে। ভাবতে হবে না, কাকে বল পাস করব। টিম বন্ডিং আর কেমিস্ট্রিটা ঠিক থাকলেই সোমবারকে ছাপিয়ে শেষমেশ গোলটা আমরাই করব!