ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • সংবাদ মূলত কাব‍্য : পর্ব ২

    মৃদুল দাশগুপ্ত (January 26, 2025)
     

    নৃত্যরত সময়ের কবিতা

    কবি বিষ্ণু দে-র কবিতার অমোঘ পঙ্‌ক্তি ‘সংবাদ মূলত কাব‍্য’ আমার জীবনে জড়িয়ে যাওয়ার আগে থেকেই, বলতে গেলে বালক বয়স থেকেই সংবাদ, মানে খবরের কাগজ এবং আকাশবাণীর খবরে ছিল আমার খুব আকর্ষণ। আর ছিল আমার মানচিত্র বইটির প্রতি টান। এছাড়া আমি ডাকটিকিট জমাতাম। জাপান, তৎকালের পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান, চিলি, পোল‍্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল আমার কয়েকজন পত্রবন্ধু। টিভি, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট না থাকলেও, ওই সব কিছুতে মনে-মনে কল্পিত বিশ্বভ্রমণ করতাম আমি, সেই বালক বয়সে। বাড়িতে আসা ‘সোভিয়েত দেশ’ পত্রিকায় উঁচু-উঁচু পাইন-সিডার গাছের তলায় বসে অনেকে বাদ‍্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গাইছে, এমন রঙিন ছবিটি দেখে, তা থেকেই ভেসে উঠেছিল আমার ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ কবিতাটি। চিলির সান্তিয়াগো শহর থেকে আমার পত্রবন্ধু পেদ্রো গঞ্জালেস আমাকে পাঠিয়েছিল কবি পাবলো নেরুদার ‘পোয়েমা ইমমরালিস’, নেরুদার কবিতার পেঙ্গুইনের স্প্যানিশ সংকলন। কিচ্ছু বুঝিনি, আমি কি আর স্প্যানিশ ভাষা জানি! কিন্তু পেদ্রোর ধারণা ছিল, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মানুষ, ভারতেরও সবাই স্প‍্যানিশ জানে। তা নেরুদার ওই বইয়েই স্প‍্যানিশে একটি কবিতা আছে ‘এল পার্টিডো কমিউনিস্তা’, কবিতাটি পড়তে পারিনি, কিন্তু কবিতার নামটি ব‍্যবহার করেছি আমার একটি কবিতায়, সেই কবিতাটি ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ বইটিতে আছে।

    আরও পড়ুন : ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন, নুরুল ইসলামের মৃত্যু একদিনে আমাদের বড় করে দিয়েছিল…

    তা, সংবাদপত্র পাঠে ওই বালকবয়সে আমার ছিল প্রবল আসক্তি। ভোরবেলা খবর কাগজ এলে বাবার সঙ্গে আমার মাঝে মাঝেই হত টানাটানি। তবে বাবা অফিস যাবে ভেবে আমি ছেড়ে দিতাম। শীতের রোদে বারান্দায় পিঠ পেতে মা আমাকে বলত, ‘দে না এবার আমাকে কাগজখানা, একটু পড়ি।’ তখন, ওই বালক বয়সে, যখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, ১৯৬৫ সাল, বেধে গেল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। একদিন বাবা অফিস যাবে বলে কলতলায় চান করছে, হঠাৎ বেজে উঠল সাইরেন। আমিও স্কুলে যাব বলে কলতলার দিকে যাচ্ছি সাইরেনের মধ‍্যে আমাদের কলা গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশে দেখি গোঁ-গোঁ শব্দের একটি বিমান, তার গাঢ় সবুজ রঙের লেজে চাঁদ-তারা আঁকা। সাদা ধোঁয়ার রেখা উঠছে ওই আকাশে মাঝে মাঝেই। ঘুরতে-ঘুরতে ওই বিমানটি হঠাৎ আগুনে দাউ দাউ করে দূরে নীচে পড়তে লাগল। এরপর আমি যখন খেয়েদেয়ে স্কুলে যাচ্ছি, দেখলাম দলে-দলে লোক দৌড়োচ্ছে গঙ্গার দিকে। শুনলাম ওই পাকিস্তানি প্লেন বারাকপুর থেকে আমাদের জওয়ানদের ছোড়া বিমানধ্বংসী গোলায় গঙ্গায় পড়ে গিয়েছে। আমাদের স্কুলও গঙ্গাতীরে। যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে ঘাসের ভেতর লোহার টুকরোর মতো কী যেন পড়ে, ধোঁয়া বের হচ্ছে তা থেকে, আমাদের স্কুলের একটি ছেলে তা দেখে জলের বোতল খুলে জল ঢেলে আর আমাদের স্মৃতিময়বাবু স‍্যার সাইকেল থেকে নেমে ওই লোহার খণ্ডটকে রুমালে জড়িয়ে থানায় জমা দিতে চললেন। কাছেই থানা। আমরা ছাত্ররা সদলবলে গেলাম থানায়। থানার টেবিলে ওই লোহার টুকরোয় দেখলাম চীনা ভাষায় কী যেন লেখা। ওই গোলাটি ছোড়া হয়েছিল পাকিস্তানি বিমানটি থেকে। অদূরে গঙ্গায় তখন ভাসছিল পাকিস্তানি বিমানটির ছিন্ন একটি ডানা, অন‍্যান‍্য যন্ত্রাংশ, আর ভাসছিল গ‍্যাস সিলিন্ডারের মতো লাল কী একটা যেন, মোটরচালিত নৌকোয় এসে বারাকপুরের আমাদের সেনারা, আর গঙ্গার দু’পাড়ে মুহুর্মুহু করতালি দিচ্ছিলেন অগণন মানুষ।

    অদূরে গঙ্গায় তখন ভাসছিল পাকিস্তানি বিমানটির ছিন্ন একটি ডানা, অন‍্যান‍্য যন্ত্রাংশ, আর ভাসছিল গ‍্যাস সিলিন্ডারের মতো লাল কী একটা যেন, মোটরচালিত নৌকোয় এসে বারাকপুরের আমাদের সেনারা, আর গঙ্গার দু’পাড়ে মুহুর্মুহু করতালি দিচ্ছিলেন অগণন মানুষ।

    এর আগে ১৯৬২ সালে ভারত-চীনের যুদ্ধ আমার মনে আছে, তখন আমি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, আমার মাসিরা খাকি উলের সোয়েটার বুনে জওয়ানদের জন‍্য পাঠাত। মনে আছে অনেক কিছুই। আমার বাল‍্যস্মৃতি চলচ্চিত্রের মতো চলমান। দেশভাগ, স্বাধীনতা আমার জন্মের আগেই, আমি দেখিনি। তবে ছয়ের দশকের খাদ‍্য আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন, ‘আমার নিঃশ্বাস লেগে ভেঙে গেল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ ফাল্গুনী রায় লিখেছিলেন, এসব দেখেছি। যুক্তফ্রন্ট সরকার ফেলে দেওয়ায় প্রতিবাদে সুভাষ মুখোপাধ্যায় গ্রেপ্তার বরণ করে পুলিশের জিপে উঠছেন, সিংহের কেশরের মতো তাঁর চুল উড়ছে, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় সে-ছবি আমি দেখেছি। আমি দেখেছি সশস্ত্র বিপ্লববাসনার নকশালবাড়ি আন্দোলন, জেলে-জেলে বন্দিহত‍্যা, কাশীপুর-বরানগর গণহত‍্যা, কোন্নগর নবগ্রাম গণহত‍্যা, বারাসত গণহত‍্যা, দেখেছি রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ‍্যুদয়। ‘সংবাদ মূলত কাব‍্য’ তখনও অনাগত অমোঘ এই কাব‍্যপংক্তি কি ওই কৈশোরেই জড়িয়ে গিয়েছিল আমার জীবনে? আমার প্রথম কাব‍্যগ্রন্থ ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ বইটিতে আছে ওই নৃত‍্যরত সময় থেকে আহরিত কয়েকটি কবিতা। আর আমি তখন পড়ছি সুভাষ মুখোপাধ‍্যায়ের কবিতায় ‘ছেলে গেছে বনে’, আলোক সরকারের কবিতায় ‘পথ হারানো ছেলে বলল, বাড়ি যাব/ঠিকানা তার মনে পড়ছে না…’

    একটি ডায়েরিতে ওই সিক্স-সেভেনে পড়ার সময়ে আমি লিখতে শুরু করি আমার ঝুন্টুমাসির কথায় যা ‘আধুনিক কবিতা’, যা আমি সর্বত্র বহন করতাম, স্কুলে যাওয়ার সময়ে বইখাতার ভেতরও। কবিতার সঙ্গে ছড়াও। আমার বাবার কলকাতার সেন্ট্রাল এভিনিউর জীবনবিমা অফিসের কাছেই ছিল ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র অফিস, ‘যুগান্তর’-এরও সিটি অফিস। আনন্দবাজারের সোমবার শেষপাতায় ছোটদের জন‍্য, ‘আনন্দমেলা’ আর ‘যুগান্তর’-এ মঙ্গলবার শেষ পাতায় ছোটদের ‘পাততাড়ি’ বের হত। বাবা আমার ছড়া সেজন‍্য আনন্দবাজারে আর ‘যুগান্তর’-এর ডাকবক্সে জমা দিত। তখন আমার ছড়া ‘আনন্দমেলা’ আর ‘পাততাড়ি’তে বেরিয়ে যেত। তখন আমি সিক্স-সেভেনে, কিন্তু আমার ছড়া বড়দের সঙ্গেই বেরিয়ে যেত। ছোটদের ‘পাততাড়ি’তে ‘ছবি দেখে ছড়া’ নামে সপ্তাহে-সপ্তাহে প্রতিযোগিতা হত। আমি কয়েকবার প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় হয়েছি আরও দুজনের সঙ্গে। তাঁদের নাম মনে আছে। অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শুনেছি থাকতেন উত্তরপাড়ায়, আর আশানন্দন চট্টরাজ বীরভূমের।

    সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র যখন, স্কুল ম‍্যাগাজিনের জন‍্য একটা কবিতা দিলাম, নাম মনে আছে, ‘মোমবাতি’। দু’দিন পর আমাকে বাংলার স‍্যার মনসাবাবু আমাকে ছাত্রদের দঙ্গল থেকে চেচিয়ে ডেকে টিচার্স রুমে এনে শুধোলেন, ‘অ্যাই, তুমি এই কবিতা কোথা থেকে টুকেছ?’ আমি থমথমে মুখে বললাম, ‘আমার লেখা স‍্যার। একটু দাঁড়ান, দেখাচ্ছি।’ বলেই এক ছুটে আমি উলটোদিকে আমাদের ক্লাসরুমে আমার বইখাতার ভেতর থেকে আমার কবিতা লেখার ডায়েরিটি স‍্যারের হাতে দিলাম। পাতা ওলটাতে-ওলটাতে বড়-বড় চোখ করে মনসাবাবু ঝুন্টুমাসির মতোই বললেন, ‘আরে, এসব তো আধুনিক কবিতা!’ দু’তিনটি কবিতা মনসাবাবু উচ্চস্বরে পড়ে অন‍্যান‍্য স‍্যারেদের শোনাতে লাগলেন। স্নেহভরা মুখগুলির সামনে চোখ ছলছল, লাজুক আমি নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইলাম।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook