ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • একটা জ্যান্ত লোক


    তরুণ পাইন (January 4, 2025)
     

    আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল পারিবারিক ও ব্যক্তিগত। ওর লেখা আমাদের কাছে খুব নতুন ছিল বলেই হয়তো আমরা প্রথমে খুব মন দিয়ে পড়িনি, কিন্তু একই সঙ্গে বুঝেছিলাম ইলিয়াস বিস্ময়করও বটে। একটা গল্পের সঙ্গে আরেকটা গল্পের সময়ের তফাত দেখলেই বোঝা যায়, কতটা সময় নিয়ে লিখত। যেমন ‘দোজখের ওম’ অনেকটা সময় নিয়ে লেখা। এর কারণ কিন্তু আলস্য নয়, আদতে এই লেখাগুলোর জন্য যে-ভাবনার চর্চা, তাতেই এই সময়টা লাগত। দুটো উপন্যাস, ‘খোয়াবনামা’ আর ‘চিলেকোঠার সেপাই’-ও অনেকটা সময় নিয়ে লেখা। ‘খোয়াবনামা’ যেমন প্রায় ন’বছর সময় নিয়ে লেখা। নিরন্তর ক্ষেত্রসমীক্ষা, লাইব্রেরি ঘাঁটা— সব কিছু করে লেখাটা তৈরি।

    আমরা পাঠক হিসেবে তো অতটা সময় বা শ্রম দিই না। ‘খোয়াবনামা’-কে আমরা, এপারের বাঙালিরা হয়তো কিছুটা দেশভাগের নিরিখে পড়তে চাই। কিন্তু ‘খোয়াবনামা’-র শুরু যেভাবে হয়— ‘পায়ের পাতা কাদায় একটুখানি গেঁথে যেখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলার রগ টানটান করে যতটা পারে উঁচুতে তাকিয়ে গাঢ় ছাই রঙের মেঘ তাড়াতে তমিজের বাপ কালো কুচকুচে হাত দুটো নাড়ছিলো, ঐ জায়গাটা ভালো করে খেয়াল করা দরকার।’ এমন একটা বাক্য কিন্তু বাংলা উপন্যাসে চট করে পাওয়া মুশকিল। ওই লাইনটাই কিন্তু উপন্যাসটাকে ধরে রাখে। একে কি একমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা আদৌ সম্ভব? তমিজের বাপের কোনও নাম নেই, তমিজের বাপ নামেই তার পরিচিতি। ধরা যাক, এই উপন্যাসে বৈকুণ্ঠ নামে যে-চরিত্রটা, সে মুসলমানদের সঙ্গে ওঠে-বসে, খায়, কেবল জল পান করে না। এমন চরিত্র আমরা দেখেছিই বা কতটুকু, পড়েছিই বা কতটুকু?

    ও লিখত টাইপে, সেই টাইপ করা কপি আমি দেখেছি। ‘খোয়াবনামা’ লেখার সময়ে, মনে আছে, পান্ডুলিপির প্রথম দশ পাতা, তারপরের কিছুটা অংশ— এভাবে পাঠাতে থাকত। পরে যখন একটি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এই উপন্যাস প্রকাশিত হতে শুরু করে, সেই পত্রিকার কপিও পাঠাত ওর এক ছাত্রী মীরার হাত দিয়ে। মীরার বাড়ি ছিল ফার্ন রোডে, কিন্তু ও ঢাকা-কলকাতা যাতায়াত করত। এখান থেকে আবার আমিও কিছু বইপত্র পাঠাতাম। সেসব মনে পড়ে।

    আরও পড়ুন : অটোমেটিক রাইটিং বলে কিছু হয় না, বিশ্বাস করতেন মতি নন্দী…

    ওইভাবেই আমার কিন্তু ‘খোয়াবনামা’ পড়া। আরও হয়তো কেউ-কেউ পড়েছিলেন আগে, কিন্তু খাস পান্ডুলিপিটাই আমি পড়েছিলাম। মনে আছে, শুরুতেই মাছ ধরার যে-ঘটনাটা ছিল, সেখানে একটা শব্দ নিয়ে ওর সংশয় ছিল। আমি বললাম, কথাটা ‘হ্যাঁচকা টানে’ হতে পারে। বললেন, ‘তাহলে ওটা করে রাখো তো!’ ফলে, কলকাতা এডিশনে ওই ‘হ্যাঁচকা টানে’ কথাটা হয়তো থাকবে, ঢাকা এডিশনে ওটা আবার পাওয়া যাবে না। তবে হ্যাঁ, খুব সাংঘাতিক পার্থক্য দুটো এডিশনের মধ্যে ঘটেনি।

    আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এখনও আমাদের বিস্ময় জাগান

    ব্যক্তিগত আদানপ্রদান যে কতরকমভাবে ঘটেছে ওর সঙ্গে! আমার সঙ্গে কিন্তু লেখালিখি নিয়ে আলাপ-আলোচনা কমই হত। বেশি কথা হত বরং কাবাব ইত্যাদি নিয়ে! একবার চাকমাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। সেখান থেকে একটি হাতের কাজের খরগোশ এনেছিল। বউদির ডাকনাম তুতুল, আমার মেয়ের নামও তুতুল। আমাকে বলেছিল, জুনিয়র তুতুলকে এটা দিয়ে দিয়ো। এতটাই আন্তরিক ছিল আমাদের পরিবারের সঙ্গে। আমার মেয়েকে যেমন বলত, ‘পটল একদম খাবি না। জানবি ওটা ওয়ার্স্ট অফ দ্য লট! খেলে কাবাব খাবি, পটল কেন খাবি!’

    একবার আমার অফিসে খুবই গোলযোগ চলছিল। তখন আমাকে মানসিক শক্তি কিন্তু আখতারুজ্জামান ইলিয়াসই জুগিয়েছিল। বলেছিল, ‘তোমার এই চেহারায় দাপটটা দেখাতে পারো না আসলে। থাকত হাতে একটা কাটা দাগ, মারপিটের চিহ্ন, একটা মস্তান-মস্তান ব্যাপার থাকত! দেখতে, কেউ ঘাঁটাতে সাহস পেত না!’

    ‘খোয়াবনামা’-র প্রচ্ছদ

    আমার দিদি একবার ওকে, ওর জন্মদিনে রানী চন্দর ‘আমার মা’র বাপের বাড়ি’ উপহার দিয়েছিল। রানী চন্দর লেখা ও আগে পড়েছিল বটে, কিন্তু এইটা পড়েনি। পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। তারপর হঠাৎই একদিন বলল, ‘আমাকে আরও কয়েক কপি আনিয়ে দাও তো!’ আমি বললাম, ‘তোমাকে তো দিদি দিয়েছে!’ বলল, ‘এদেশে এসব তো কেউ পড়েই না। আমি আরও কয়েকজনকে পড়াব।’

    তখন সংস্কৃত কলেজের মুখে একটা চায়ের দোকান ছিল। ‘নানির চায়ের দোকান’ বলতাম আমরা। সেখানে গিয়েই বলত, ‘নানি, আমার জন্য লাল চা, বাকিরা কে কী চা খাবে দেখে নিও।’ বলে থালায় করে সেই চা-টা নিজেই নিয়ে আসত। কলকাতায় এসে কোনও বিখ্যাত লোককে এমনটা আমি করতে দেখিনি।

    কলকাতায় বাসে উঠে নিজে চিনে-চিনে প্রেসিডেন্সি এসেছিল। আমি তার আগে ওকে রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছিলাম। ও খুব ভাল রাস্তা চিনতে পারত। বাস থেকে নেমে দেখি প্রায় লাফাতে-লাফাতে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত ফুর্তি কীসের!’ বলল, ‘কন্ডাক্টরের কাছ থেকে গাল খেয়েছি।’ আমি তো শুনে বিস্মিত! তখন বলল, ‘আসলে বালিগঞ্জ থেকে বাসটা আসছে, যাবে বাগবাজার। কন্ডাক্টর একা বসে ছিল। খুবই দুঃখী লাগল ওকে। ভাবলাম, একটু কথা বলি। তাই বার বার বলতে লাগলাম, প্রেসিডেন্সির সামনে নামতে পারব তো? কন্ডাক্টর বার বার আশ্বাস দিচ্ছিল। তারপর বললাম, আচ্ছা, ধর্মতলা থেকে এখানে মোটে পনেরো পয়সা ভাড়া? এবার একটু রাগতভাবে তাকাল। তারপর কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, আসলে আমি মুসলমান তো, আমার বুদ্ধি কম! তাই এত প্রশ্ন করছি। অবশেষে নামার সময়ে কন্ডাক্টর বলল, কোথা থেকে যে সব (চার অক্ষর) এদেশে ঢুকে পড়ে! এতে বুঝলাম, আমার মিশন সাকসেসফুল! ঢাকার রিকশাওলা থেকে কলকাতার কন্ডাক্টর, দেখলাম, কোথাও কোনও বিভাজন নেই।’

    তখন সংস্কৃত কলেজের মুখে একটা চায়ের দোকান ছিল। ‘নানির চায়ের দোকান’ বলতাম আমরা। সেখানে গিয়েই বলত, ‘নানি, আমার জন্য লাল চা, বাকিরা কে কী চা খাবে দেখে নিয়ো।’ বলে থালায় করে সেই চা-টা নিজেই নিয়ে আসত। কলকাতায় এসে কোনও বিখ্যাত লোককে এমনটা আমি করতে দেখিনি।

    এমন লোকই লিখছে, ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’, সেটাকে বরং দেশভাগের গল্প বলা চলে। সেই গল্পে ভাইপো গিয়েছে পিসিমার কাছে, পিসিমা গাইছে অতুলপ্রসাদী। এই যে লেখার মাঝে মাঝে গানের লাইন ঢুকে পড়া, তা ওর বিভিন্ন গল্পে পাওয়া যাবে। কখনও হয়তো যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখা, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর’-এর প্রসঙ্গ চলে এসেছে। ‘মিলির হাতে স্টেনগান’-এ আবার মিলিকে পাগল হয়ে যেতে দেখি, যে পাগল সে সুস্থ হয়ে ওঠে। আবার ‘অপঘাতে’ গল্পে দুটো দু-রকম মৃত্যু এক জায়গায় এসে মেলে। এই গল্পগুলো প্রথম পড়ে, এই লোকটার টানে, আমি একবারই ঢাকায় গিয়েছিলাম। গিয়ে অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। মনে হয়েছিল, কতদিনের চেনা! আর কী আশ্চর্য সুদর্শন ছিল!

    ‘খোঁয়ারি’-র প্রচ্ছদ

    পরে বউদির থেকে জেনেছি, ওই গল্পগুলোর যাত্রাপথ। মনে হত, ঘরের মধ্যেই লোকটা যেন চলেফিরে বেড়াচ্ছে। আসলে তো লোকটা জীবন্তই। কিন্তু পরে ওর গল্পগুলো আর পড়িনি। খুব কষ্ট হয় আসলে।

    আনিসুজ্জামানের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। ও ছিল আনিসুজ্জামানের প্রিয় ছাত্র। আনিসুজ্জামান বলতেন আমাকে, ‘ওকে দিয়ে পিএইচডি করানো যে কী কষ্টসাধ্য ঘটনা ছিল! ভাবো তখন আমার কত গ্ল্যামার, সেই আমাকে কিনা আমার ছাত্রের পিছনে দৌড়ে বেড়াতে হত!’

    অনেকেই আজ আর নেই। যেমন ‘খোয়াবনামা’ যাঁকে উৎসর্গ করা, সে আজ নেই। ‘খোঁয়ারি’ ছিল রণজিৎ পালচৌধুরীকে উৎসর্গ করা। সেও আজ জীবিত নেই। ফলে, এখন ঢাকা গিয়ে আর কাউকেই পাব না। পুরান ঢাকার রোয়াকে বসা গল্প করারও আর কেউ নেই। মনে আছে, ইলিয়াসের পুরনো বাড়ির কাছেই ছিল শওকত আলীর বাড়ি, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ যাঁর লেখা। তাঁর বাড়ি গেলে আমাকে বলত, ‘আগে ওর (ইলিয়াসের) বাড়ি যাও। নইলে তোমাকে কিলোবে।’ এমনই অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল!

    একটা আশ্চর্য গল্প আছে ইলিয়াসের, সেটা বলেই শেষ করি। ওদের আদি বাড়ি বগুড়ায়। সেখানে ও একবার গিয়েছে, ওর মা তখনও জীবিত। ও তখন পড়ায় ঢাকা কলেজে। ওর অসম্ভব ভূতের ভয় ছিল। বলত, ‘ভদ্দরলোকেরা ভূতে বিশ্বাস করে।’ গাঁয়ের মোড়লের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, কথা বলতে-বলতে রাত হয়ে গেছে। ওকে ঢাকার একটা দূরপাল্লার বাস ধরতে হবে। তখন সেই বৃদ্ধ মোড়ল হ্যারিকেনের আলোয় পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছিলেন ওকে। হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, ‘মনে হল আমাদের কর্তা উড়ে গেল। তুমি দেখলে?’ সেই শীতের রাতে, ইলিয়াস বলেছিল, ওর ভয়ে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল। তারপর হঠাৎই দেখা গেল, সেই মোড়ল গ্রামের বাকিদের ডেকে আনলেন। সেখানে দুটো পাকুড় গাছ আশ্চর্যভাবে একে-অপরকে জড়িয়ে ছিল। তার তলায় জড়ো হল গ্রামের সব মানুষ, হ্যারিকেন হাতে। এবং শুরু করল বিলাপ, আর প্রার্থনা— ‘ও কর্তা, আমাদের ছেড়ে কোথায় গেলে! এখানে তো খরা হবে! আমাদের কোনও ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিয়ো।’ ইলিয়াসের ভূতের ভয় চলে গেল, ও সারারাত ওই প্রার্থনা দেখল দাঁড়িয়ে। এখান থেকেই ‘খোয়াবনামা’-র অনুপ্রেরণা এসেছিল কি না, কে বলতে পারে!

    আমাকে বার বার বলত, প্যাঁচপয়জার কষে লিখতে বোসো না। শেষটা ভেবে নিয়ে এমনকী, চিঠিও লিখতে বোসো না। সেই কথাগুলো মনে পড়ে এখনও। পরে যখন খুব একা লেগেছে, চারপাশে তাকিয়ে বুঝেছি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ওই একজনই হয়। লোকটা এখনও আমার কাছে নিয়ত জ্যান্ত!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook