কিছু গান ফিরে-ফিরে আমাদের কাছে আসে। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলের পরে একটা গানের কথা পাক খেয়ে চলেছে বুকের ভেতর। আমি কাঠ বাঙাল। কারণে-অকারণে বাংলাদেশের বন্ধু-আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করা আর আড্ডা দেওয়া আমার জীবনের এক পরম ব্যসন। সেই রাস্তা এখন বন্ধ। আমার জন্ম এই বঙ্গে, বাংলাদেশ আমার বাপ-মায়ের জন্মভূমি। কিন্তু ওই দেশটা আমাকে কেন টেনেছে তার কোনও ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। সেই দেশের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ হলে আমার যদি খারাপ লাগে, তাহলে যে-মানুষ কতখানি দীর্ণতা আক্রান্ত হয়ে এই গান লিখেছিলেন, তাঁর ক্ষত কতখানি সেটা কিছুটা আন্দাজ করা গেলেও আমাদের পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন।
শিয়ালদহ গোয়ালন্দ আজও আছে ভাই
আমি যাব আমার বাড়ি সোজা রাস্তা নাই
১৯৪৭-এ দেশভাগের দগদগে স্মৃতি এই গানের মধ্যে জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্টে। পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৯১৮ সালের ৫ মে জন্মানো মানুষ গিরিন (গিরীন) চক্রবর্তী। চলে গিয়েছিলেন ১৯৬৫-র ২২ ডিসেম্বর। মাত্র সাড়ে সাতচল্লিশ বছরের জীবন— তার মধ্যে বাংলার সংগীত জগতে তাঁর সক্রিয় চংক্রমণ অন্তত ৩২ বছর। তাঁর প্রথম ৭৮-আরপিএম রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে। অসংখ্য অবিস্মরণীয় গানের জনয়িতা— কথা আর সুরের আশ্চর্য সব বিবাহের পুরোহিত তিনি। বাংলা এবং হিন্দি— দুই ভাষাতেই লিখেছেন অসংখ্য গান, সুরও করেছেন। আধুনিক বাংলা গানের প্রথম পর্বকে যাঁরা তাঁদের মেধা এবং শ্রমে ঋদ্ধ করেছেন, গিরিন বা গিরীন্দ্র তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্যদের অন্যতম। এ-কথা অতিশয়োক্তি নয়— ‘শিয়ালদহ গোয়ালন্দ আজও আছে ভাই’, ‘কিশোরগঞ্জে মাসির বাড়ি’, ‘বাড়ি ছিল পদ্মা নদীর পাড়ে’ শুধুমাত্র এই তিনটে গানই তাঁকে বাঙালির স্মৃতিমেদুরতায় জায়গা করে দিতে পারত।
কিন্তু বাঙালির স্মৃতিশক্তি যে অত স্থিতিমান, সেরকম অপবাদ না দেওয়াই ভাল। ২০২৪-এ যে-মানুষটির বয়স মাত্র ১০৬ পূর্ণ হয়েছে, যে-মানুষটি বাঙালির সংস্কৃতিকে ভরিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন তাঁর অজস্র গানের ফসলে, তাঁর সম্পর্কে জানার বা চর্চা করার পরিশ্রম আমরা বাঁচিয়ে চলেছি। এই তো গত বছরই ‘পিপ্পা’ ছবির ‘কারার ওই লৌহকবাট’ গানটা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বাঙালির অস্মিতা জেগে উঠে গণস্বাক্ষর জোগাড় করেছে, রাস্তায় মিছিল করেছে, সভা করেছে, চোখের জলে-নাকের জলে একাকার হয়েছে। সে-সময়ে নজরুলের কথায় সুর বসিয়ে গাওয়া গিরিনের এই গানের রেকর্ডের (১৯৪৯-এ প্রকাশিত) কথা আমাদের স্মৃতির দোসর হয়েছিল কিছুদিনের জন্য। কিন্তু নজরুলের মতো গিরীন্দ্র কাকতালীয়ভাবে কোনও দেশের জাতীয় কবি না হওয়ার কারণে গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা হিসাবে কলকে পেলেও, তাঁর ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। অথচ প্রতিভা তাঁর তো কিছু কম ছিল না। একের পর এক ‘হিট’ গানের সুর আর কথা তিনি উপহার দিয়েছেন— ‘তোমার আকাশে ঝিলমিল করে চাঁদের আলো’ (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রথম রেকর্ডও বটে), ‘ওরে ও গাঁয়ের আকাশ’ (সত্য চৌধুরী), ‘নয়না নদীর তীরে দেখা’ (রাধারাণী), ‘দুটিপাখি দুটি তীরে’ (তালাত মাহমুদ)।
আব্বাসউদ্দিনের সেই ইতিহাস হয়ে যাওয়া গান ‘আল্লা ম্যাঘ দে পানি দে’ তো প্রাণ পেয়েছিল গিরিনের সুরেই। তাঁর কথা-সুরে গান গেয়েছেন চিত্ত রায়, ভবানীচরণ দাস, চিন্ময় লাহিড়ী, আঙুরবালা, ইন্দুমতী, কমলা ঝরিয়া, শৈল দেবী, হরিমতি, রাধারাণী, যূথিকা রায়, শচীন দেববর্মণ, তালাত মাহমুদ, অসিতবরণ, সত্য চৌধুরী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, বাঁশরী লাহিড়ী, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অমর পাল, বিষ্ণুপদ দাস, লাবণ্যলেখা রায়… তালিকা দীর্ঘ!
কাজী নজরুল ইসলামের প্রায় তিরিশটি গানের সুরকার গিরিন। আলাউদ্দিন খান আর আফতাবউদ্দিনের কাছে সংগীতের তালিম নিয়েছেন। নজরুল-কমল-বিমল দাশগুপ্তের সহচর তিনি। গায়ক আর সুরকার পরিচয় প্রধান হয়ে উঠলেও, গিরীন্দ্র আসলে বাংলার একজন সাংস্কৃতিক দূত— অজস্র পল্লি আর লোকগানের সংগ্রাহক গিরিন উদ্যোগ নিয়ে কলকাতা রেডিয়োতে পল্লিগীতির আসর চালু করাতে পেরেছিলেন। দেশভাগের আগে ঢাকা রেডিয়ো আর তার পরে কলকাতা বেতারে পল্লিগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, দেশাত্মবোধক গান, নজরুলগীতি, শ্যামাসংগীত, বাংলা আধুনিক গান, ভজন, গীত, গজল সবেতেই গিরিন সব্যসাচী। গান লিখেছেন-গেয়েছেন ‘সুজন মাঝি’, ‘রতন মাঝি’, ‘দ্বিজ মহেন্দ্র’, ‘সোনা মিঞা’ নামে। হিন্দিতে ‘পণ্ডিত গিরীন্দ্র’ নামে হিন্দি গীত-ভজন রেকর্ডে গেয়েছেন, ‘পণ্ডিত মধুর’ নামে হিন্দিতে গীত-গজল-ভজন লিখেছেন।
বেঙ্গল মিউজ়িক কলেজ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়), বাসন্তী বিদ্যাবীথিতে সংগীতের অধ্যাপনা করেছেন, সংগীতের পাঠক্রম তৈরি করেছেন, ১৯৫২ সাল থেকে দিল্লির ‘জাতীয় সংগীত সম্মেলন’-এ তিনি নিয়মিতভাবে আমন্ত্রিত হতেন, প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ‘সংগীত নাটক অকাদেমি’র সদস্য ছিলেন। ‘বৈকুণ্ঠের উইল’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘স্বামী’, ‘ঠিকাদার’ ইত্যাদি ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন, গীতিকার এবং সংগীত পরিচালক ছিলেন ‘মায়ামৃগ’ (১৯৪১), ‘বন্দী’ (১৯৪২), ‘অভিনয় নয়’ (১৯৪৫), ‘রক্তের টান’ (১৯৫০), ‘সম্পদ’ (১৯৫১), ‘এ যুগের মেয়ে’ (১৯৫২), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৯৫২), ‘মাকড়সার জাল’ (১৯৫৩), ‘প্রতীক্ষা’ (১৯৫৫), ‘সতী অহল্যা’ (১৯৫৬) ইত্যাদি ছায়াছবির। কবিকে যেমন তার জীবনচরিতে পাওয়া যায় না, শিল্পীকেও যায় না হয়তো। কিন্তু জীবনচরিত আমাদের সাহায্য করে একজন শিল্পীর জীবনের ব্যপ্তিটাকে বুঝতে। গিরিন চক্রবর্তীর জীবনের এইসব তথ্য সাক্ষ্য দেয় যে, আজকের দিনে প্রায় বিস্মৃত এই মানুষটি শুধুমাত্র শিল্পী হয়েই থাকতে চাননি— গিরীন্দ্র চক্রবর্তী একটি এমন জীবন যাপন করেছেন, যা বাঙালির সাংস্কৃতিক যাপনের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকা উচিত।