ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং : পর্ব ৪৯


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (November 27, 2023)
     

    ধন্যবাদের পার্বণ

    দিকে দিকে জীবনশিক্ষকরা স্ট্রেস-ফ্রি যাপনের উপদেশ ছড়াচ্ছেন: ডাইরিতে লেখো তুমি কী কী কারণে বিধাতার কাছে কৃতজ্ঞ। যাব্বাবা, সারাদিন ভগবানের মাথায় ক্ষোভের ডাঙশ আছড়াচ্ছি: ‘মোরে দিলে কম টাকা, ওরে দিলে জয়পতাকা’, ইদিকে নির্জনে বসে ‘জয় মা আমি ধন্য অস্তিত্বের জন্য’ ভজন গুনগুনাব? এখন পাশ্চাত্যে থ্যাংকসগিভিং চলছে, গোড়ায় নাকি তা শস্যফলনের জন্য ধন্যবাদ-প্রদান অনুষ্ঠান ছিল, ইদানীং নির্দিষ্ট গণ্ডি নেই, সামগ্রিক ধন্যবাদের পরব। টার্কি খাও, আত্মীয়দের সঙ্গে হল্লা মচাও, এবং ঈশ্বর ও পৃথিবীকে কৃতজ্ঞতা জানাও। বহু বড়মানুষও পইপই বলে গেছেন, ক্ষুদ্র অতৃপ্তি ছাড়িয়ে সেরেফ এই আনন্দে জ্বলজল করো: বেঁচে আছ। বলে কী? জীবন যেখানে একটি নিশ্চিত মৃত্যুওলা জগঝম্প অসুখ, টিভি যেখানে অহরহ ইতরতার সংবাদে ঝমঝম, সেখানে এরা শিশু-চিত্ত-থিম সরবরাহ করে ঘোড়াড্ডিম ফলাচ্ছে?

    খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই গ্রহে সজীব নড়াচড়ার চান্স পাওয়াই মিরাকল। কোত্থেকে কীসব জটিল কাণ্ডাকাণ্ড ক্লিক করল এবং আচমকা অ্যামিবা জন্মাল ও তা থেকে ধাপে ধাপে মানুষ, তাপ্পর কোন গুহাবাসীর সঙ্গে কোন গুহাবাসীর আলাপ ঘটল এবং সহস্র বৎসর পরে শতেক যুগল ঘুরে বারুইপুরে তস্য বংশধর, জিন ও ক্রোমোজোমের জাদু-কারিগরিতে অমুক রূপ ও তমুক গুণের অনোখা পুঁটলি— পা দুলিয়ে চায়ের দোকানে বসে ট্র্যাভিস হেডের বাপান্ত করছে— এ-জিনিস ভাবতে বসলে নিশ্চিত ভোম্বল। যুগ যুগ ধরে একটা মাইক্রোস্কোপিক কণারও এদিক-ওদিক ঘটলে আমি আমি না হয়ে অন্য হতাম, ফলে এই যে হয়েছি ও আছি, এজন্যই হাঁটুব্যথা সত্ত্বেও নতজানু হওয়ার প্র্যাকটিস প্রয়োজন। তদুপরি রোদ্দুর উঠছে, উঠছে মানে পার্ক-বস্তি-গলি-গম্বুজ একেবারে ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে, সূর্য যেন এমাথা-ওমাথা পোস্টার টাঙিয়ে বলছে, ‘এই এক্ষুনি জীবন শুরু, জাস্ট লেগে পড়।’ যদি কারও হাত-পা-চোখ-নাক সকলই চলতি অবস্থায় থাকে এবং দিনে দু’বার খাবার জোটে, তাহলে সে অবিশ্বাস্য সৌভাগ্যে নিয়ত স্নানরত। ধর্মবাগীশরা প্রতি ভোরে উঠেই ‘আরও একটি দিন প্রদান’-এর জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেন। আমরা যে সকালে উঠে আড়মোড়া ভেঙেই অক্সিজেনের সঙ্গে হুপ করে চিরতার জল গিলে নিই, তার জন্য নিজেদের দায় স্বীকার না করলে চলবে কেন?

    তবে যখন খবর পাই, অমুক কোটিপতি ও জগিং-অভ্যাসী, কব্জির খুচরো ব্যথায় টেস্ট করিয়ে শোনে আর দু’মাস বাঁচবে, তখন ভেতরটা একটু শিরশির। যখন ফোন করে শুনি কারও বাবার ক্যানসার ফোর্থ স্টেজ, নিজের ডেঙ্গু এবং তৎসহ গল ব্লাডারে স্টোন, তখন যে আত্ম-দুর্দশাগুলো নিয়ে এতক্ষণ ইনিয়েবিনিয়ে নাইট্য পাকাচ্ছিলাম সেগুলোকে শৌখিন ও অবান্তর ঠাওর হয়। চোখ থাকলে দরিদ্রদের দিকে তাকালেই, আর কান থাকলে বিশ্বের সংবাদ শুনলেই, এইমাত্র যুদ্ধে দেশহীন আত্মীয়হীন বা চক্ষুহীন হয়ে পড়া মানুষের একটি ফোটোগ্রাফ বা ভিডিও ক্লিপিং-এর সম্মুখীন হলেই, আমরা ঘোর অনিত্যতার থিওরেমটা সামান্য হলেও বুঝতে পারতাম। অবশ্য কবেই যুধিষ্ঠির বলে গেছেন, মানুষের দ্বারা কোনওদিনই অবসান মনে রেখে জীবনযাপন হয় না। আমরা সারাক্ষণ ভুলে যাই যে এখনও স্ট্রোক হয়নি, এখনও চাকরি আছে, এখনও ভূমিকম্প ঘটছে না— এ-ই আশীর্বাদ। মহাবিশ্বের জটিল জ্যামিতি মেনে পৃথিবী এখনও কক্ষপথে ঘুরছে ও চু-কিতকিত নুড়ির ন্যায় ছিটকে যায়নি— এ-ই ম্যাজিক। দিনটাকে গালে ভরে চুষে-চেটে তার স্বাদ নিংড়ে নিই না, অসামান্য উপহারগুলোকে জঞ্জালে ছুড়ে ফেলি এবং অন্যের বস্তুপ্রাপ্তির দিকে আঙুল দেখিয়ে তেতো ন্যাকার তুলে কাঁদি। শুধু বেঁচে থাকার আনন্দে তরতাজা হয়ে ওঠার প্র্যাকটিস থাকে বাচ্চাদের, কিছুটা সদ্যযুবাযুবিরও, তারপরেই অফিসে ঢুকেই এবং বিয়ে করেই বিভিন্ন চড়-থাবড়া খেয়ে আমরা ক্রমাগত ক্ষতস্থানে আঙুল পয়েন্ট করি। যা পেয়েছি সেগুলোকে ‘ও তো থাকবেই’ ধরে নিই।

    একটা বা দুটো টার্কি-পাখিকে থ্যাংকসগিভিং-এর আগে মার্কিন রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘ক্ষমা’ করেন, মানে হত্যা থেকে নিষ্কৃতি দেন, তাদের কেউ কেটেকুটে খায় না, তারা খামার বা চিড়িয়াখানায় যায়। তারা নির্ঘাত রাষ্ট্র ও তার পতিকে ধন্যবাদ দিয়ে গলা চিরে ফ্যালে, কিন্তু আরও সহস্র টার্কিভাইবোনেরা সেই উল্লাসে গলা মেলাতে পারে না, কারণ তাদের গর্দান কুচিয়ে ততক্ষণে স্বাদু মাংস চাখছে মার্কিন জনতা।

    কিন্তু বাংলাদেশি এক লেখক বলেন, সাপ যখন ব্যাঙকে গিলছে, সাপ নাহয় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছে খাবার জুটল বলে, ব্যাঙ কেন ধন্যবাদ দেবে? হক কথা। এই যে গলার তলা থেকে প্যারালিসিস হওয়া মানুষকে দেখে আমি ভাবলুম উরিব্বাবা আমি যে গোলপার্ক অবধি হনহন হাঁটতে পারছি এ কি কম সৌভাগ্য, তাহলে সেই রোগী শুয়ে শুয়ে আমায় দেখে কী ভাববে? কেন অভিশপ্ত ও কান্নাময় রাতদিনে ধন্যবাদের তোড় অনুভব করবে মস্তিষ্কে? কেন যুদ্ধে সব হারানো মানুষ ‘ওগো ঈশ্বর গো’ বলে নাচবে? যার তিন মাসের বাচ্চা মরে গেল ওষুধ না পেয়ে, যার বারো বছরের কন্যা গণধর্ষিতা হল, যার বোনকে পুড়িয়ে মারল শ্বশুরবাড়ির লোক, যার বাড়ি পাক খেতে খেতে তলিয়ে গেল সুনামিতে, যে গলগণ্ডের ফলে সহসা বাকশক্তি হারাল, যে চোখের সামনে দেখল ভাইকে কুপিয়ে খুন করল দাঙ্গাবাজরা, যাকে রাজনীতির পান্ডা বিনাদোষে ওঠবোস করিয়ে অট্টহাসল— সে কেন ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই ভবে, এমন মানবজনম আর কি হবে’ কেত্তন গাইবে ও এক্সট্রা খঞ্জনি খুঁজবে? তাই ধন্যবাদে আকুল উদ্বেল হওয়া গণপিণ্ডের এধারেই আছে ত্রাণহীন গত্তে পতিত হওয়া জনমণ্ড, যে-পৃথিবীতে সাম্য নেই ন্যায় নেই দরদ নেই তা দেখে ক্রোধ ও বিরাগে পূর্ণ সচেতন কিছু লোকও, যারা বাষ্পাকুল ঢালাও ‘কৃতজ্ঞ হও’ শুনে ‘ইতিবাচক কোর্স’-এর সিলেবাসে শলাকা ফুঁড়ে দিতে চায়। এবার নেদারল্যান্ডসে অবধি নির্বাচনে জিতছেন অতিদক্ষিণপন্থী লোক, যিনি বিদেশিদের আশ্রয় (অ্যাসাইলাম) দেওয়ার বিপক্ষে। চিনে নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে মসজিদ বন্ধ করে দেওয়ার এবং কিছু মসজিদের স্থাপত্য বদলে তাকে আরও ‘চিনা’ করে তোলার। ইজরায়েলের হানায় মারা গেছে প্যালেস্তাইনের পাঁচ হাজার শিশু (ধ্বংসস্তূপের তলায় পড়ে আছে আরও মৃতদেহ) এবং ইউএন সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন এ হল ‘শিশুদের কবরখানা’। কীসের ধন্যবাদ? তোমারই গেহে কে পালিছে স্নেহে? কতকগুলো রাসায়নিক ক্রিয়ায় এই গ্রহে জীবন এসেছে আর শুক্রাণু-ডিম্বাণুর কেরামতিতে আমি জন্মে গেছি বলে যুগ যুগ ধরে মানুষের মার খাওয়া বুঝেও, মানুষের না খেতে পেয়ে মরে যাওয়া বুঝেও, হাড়-গরিবের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সমাধানহীন তড়পানি দেখেও, কেন এই জীবনকে সজল ও ফলবতী বলব? তা কি নেকু ভণ্ডামি নয়? একটা বা দুটো টার্কি-পাখিকে থ্যাংকসগিভিং-এর আগে মার্কিন রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘ক্ষমা’ করেন, মানে হত্যা থেকে নিষ্কৃতি দেন, তাদের কেউ কেটেকুটে খায় না, তারা খামার বা চিড়িয়াখানায় যায়। তারা নির্ঘাত রাষ্ট্র ও তার পতিকে ধন্যবাদ দিয়ে গলা চিরে ফ্যালে, কিন্তু আরও সহস্র টার্কিভাইবোনেরা সেই উল্লাসে গলা মেলাতে পারে না, কারণ তাদের গর্দান কুচিয়ে ততক্ষণে স্বাদু মাংস চাখছে মার্কিন জনতা।

    বরঞ্চ অন্য আরেক ধরনের ধন্যবাদ জ্ঞাপন শ্রেয়, যেখানে খাওয়ার আগে ধন্যবাদ জানানো হয় যে চাষি শস্য ফলিয়েছে, যে সেই শস্য বাজারে এনেছে, যে বাজারে তা বিক্রি করেছে, যে বাজার থেকে তা কিনে এনেছে, এবং যে বাড়িতে তা দিয়ে এই খাবার রান্না করেছে— প্রত্যেককে। ফুটবল খেলতে যাওয়ার সময়ে চামড়ার কারবারি থেকে খেলা-দোকানের মালিক-কর্মচারীকে মনে রাখা, সাবান মাখার সময়ে যে শ্রমিকরা তার তৈরি-প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে তাদের ভূমিকার সমাদর করা, খবরকাগজ পড়ার সময়ে যারা অনামে রিপোর্ট লিখেছে সম্পাদনা করেছে ও ছাপা-মেশিনে ছেপে বের করেছে তাদের অবদান আন্দাজ করে কৃতজ্ঞ হওয়ার চল আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। আমরা সুইগি-র ডেলিভারি-মানুষটিকে থ্যাংক ইউ বলি না, ভাল মাংস রান্না হলে মা’কে (বা রাঁধুনিকে) প্রশংসা না করেই উঠে যাই, যদিও ডিমের ডালনায় নুন কম হলে খ্যাঁকাতে ছাড়ি না। কিন্তু ল্যাপটপে হাত রেখে যেদিন এক মুহূর্তও ভাবতে শিখব, এই অসামান্য বস্তুটি আমার হাতে এসে পৌঁছেছে, আমাকে এত সাহায্য করছে ও আনন্দ দিচ্ছে, তার পিছনে কত মানুষের বুদ্ধি, প্রতিভা, আবিষ্কারক্ষমতা, অধ্যবসায়, ব্যবসা-উদ্যোগ, নাছোড় পরিশ্রম, এবং নিজের কাজ ঠিকমতো করে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টা রয়েছে— সেই কে এর আইডিয়া ভেবে পেয়েছিল থেকে কে এটাকে সুরক্ষিত রাখার প্যাকেট বানিয়েছে অবধি— আমি কাউকে না চিনলেও, এমনকী ২৩জন না ২৩০জন এর গোটা কাণ্ড-অংশী স্পষ্ট না জানলেও, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চেষ্টা করব বিড়বিড়িয়ে, সেদিন হয়তো কত মানুষের প্রতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ধন্যবাদ-জ্ঞাপন করা উচিত, কত মানুষ কত শ্রম-বন্দোবস্তে লেগে রয়েছে আমাদের সারাদিনের কাজ-সম্পাদন ও আনন্দ-ভোগ নিশ্চিত করার জন্য, তার একটা আবছা ধারণা আমাদের হবে। চুপচাপ একাচোরা বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা, যাঁদের নাম অবধি প্রতিবেশী জানেন না, যখন তাঁ(দে)র সারাজীবনের সঞ্চয় শহরতলির উন্নতি বা গ্রামে ইস্কুল গড়ার জন্য দান করে যান, তাঁরা হয়তো এই বিশাল মানবতরঙ্গ, যা সর্বব্যাপী উপযোগিতার চাকা চালাচ্ছে— সে সম্পর্কে আন্দাজ পান। এবং নিজে তার অংশ হওয়ার প্রো-অ্যাক্টিভ প্রয়াস করেন। এই থ্যাংকসগিভিং চমৎকার।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook