ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • পোষা ভাইরাস


    কৌশিক গুড়িয়া (November 3, 2023)
     

    .

    এমনটা কোনও দিন দেখিনি! দোকানের দুয়ারে তিনটে লেবু আর তিনটে কাঁচালঙ্কা সুতো দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ঝুলিয়ে দেওয়াই তো দস্তুর, কিন্তু তিনটে ধুতরো ফল আর তিনটে গোটা বিড়ি একই স্টাইলে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে? দু’দিকের দুটো লম্বা কঞ্চি কাতাদড়ি দিয়ে টানটান করে বাঁধা, দরজার আদল, আর সেখান থেকে লকেটের মতো ঝুলছে এমন শিল্প!

    ‘এটা কী বস্তু বস?’
    ‘আরে কাকা, পাতিলেবু পনেরো টাকা জোড়া, তাকে ভাতে চিপব নাকি দোকানে ঝুলাব, বলো দিকি? তবে বলতে পারো এটা আমার নতুন আবিষ্কার। বিজ্ঞানী বলে তুমরাই শুধু আবিষ্কার করবে তা হবে নাকো।’
    ‘মানে?’
    ‘শুনো, লেবু ঝুলায় দোষ কাটাতে, মানে ওই নজর-টজর না পড়ে যায় তাই। এখন উসব নাই। এখন শুধু করোনা, শুধুই করোনার দোষ। ধুতরো ফল দেকছো? পুরো করোনার জ্যারক্স। আর ওই যে বিড়ি, তা কিন্তু বিড়ি না। ইদিকে আসো কানে কানে বলি, ওতে পুরিয়া ঠুসেছি। মানে গাঁজা। শুনোনি? ছানাপোনারা হোস্টেলের টবেও নাকি চাষ কত্তিছে!’

    আমার বিশ্বাস ধুতরো ফলের বিষ আর গাঁজার মন-ভাসানো ধোঁয়াই পারবে করোনা তাড়াতে।

    ‘কী খাও বলো তো? এমন সরেস মাথা তোমার! একটু চরণ-ডাস্ট হবে?’
    সে হাসে…
    ‘হলে রেখে দিও বাপু, ফেরার পথে বাড়ি নিয়ে যাব।’

    শনি-মঙ্গলবার গ্রহের দোষ কাটাতে জিতেনের দোকানে ভিড় লেগেই থাকে। বিজ্ঞানভবন পেরিয়ে মন্থরপুর থানার দিকে পাঁচ কি ছয়-পা এগোলেই ওই যে তাদের তিন পুরুষের দোকান। দোকান ঠিক নয়, পুরাকালে পাতলা কাঠ দিয়ে যেমন ফলের বাক্স তৈরি হত, তেমন চারটে বাক্সর ওপর কালো ত্রিপল চড়িয়ে, ছাউনির মাথায় থরেথরে  সাজানো জংলি গাছের জ্যান্ত ডাল আর কিছু শিকড়বাকড়। কালো সুতোয় বাঁধা দু’গাঁট কিংবা লাল সুতোয় তিন টুকরো জড়িয়ে রাহু-কেতু-ধাতু-কাম-যশ কত কী-ই না ভ্যানিশ করে দেয় জিতেন, আবার ফিরিয়েও আনে অনেক কিছু! কিন্তু কী জানি, কেন সে ভ্যানিশ করতে পারে না ওই অলুক্ষুণে ভাইরাস-টাকে!

    বাপের কাছে শেখা বিদ্যে ফলিয়ে বন বাদাড় ঘেঁটে তুলে আনা ধুতরো, শ্বেতবেড়ালা, বামনহাটি, অনন্তমূল কিংবা অশ্বগন্ধার ডালপালা ও শিকড়বাকড় নিয়ে বিহঙ্গলতা স্টেশনে বসে থাকে সে। যেন টিয়াপাখির গায়ের রঙে আঁকা দাস্য একটা গ্রাম। সত্যিকারের হরিয়ালি ক্যানভাস। যেন কচুপাতা থেকে টুপটাপ জল পড়ার শব্দের মতো ঝুপঝুপ করে ট্রেন চলে আসবে এই তো এখনই! তাকে নিয়ে যাবে কালো একটা মস্ত শহরে। আরও কালো মানুষজন থাকে যেখানে!

    .

    ‘কী হল? কেটলিটা কিন্তু বাইরে থেকে আনা। সারা ক্যান্টিন তো আর অটোক্লেভ করা নয়! সুতরাং এটুকু খেয়াল তো তোমাদের রাখতেই হবে।’
    ‘দেখো বাপু, থ্রি-লেয়ার দুটো মাস্ক মাস্ট। হেড-শিল্ড কই?’
    ‘ঠিক আছে, জানি তোমরা সবাই বুস্টার ডোজ পেয়েছ। তবুও একটু দূরে দূরে বসলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?’
    ‘শোনো, আমরা যখন জীবাণু নিয়েই কাজ করছি, তখন সব থেকে সাবধান হতে হবে আমাদেরকেই। টয়লেট ইউজ করার পর, নিজেরাই হাইপো-স্প্রে করে আসবে। কোর জোনের বাইরেও এসব জরুরি, মনে রেখো।’— অধ্যাপক কালামের এমন সব কড়া নির্দেশ অমান্য করাও যায় না, আবার অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলাও যেন দিন  কে দিন বোঝা হয়ে যাচ্ছে আমাদের। সুতরাং ভাইরাসকে আপাতত ভয় না পেয়ে উপায় নেই। মাধ্যামিকের জীবনবিজ্ঞানে যাকে আমরা জীব ও জড়ের মাঝামাঝি একটা বস্তু বলে জেনেছিলাম, সে যে এমন ভেলকি দেখাতে পারে, অতিমারি ত্রাসের জনক-জননী হয়ে উঠতে পারে, তা কি আর আগে জানতাম?

    তাকে বাঁচিয়ে রাখতেই টোয়েন্টি-ফোর সেভেন নিস্পলক আদর-যত্ন জারি থাকে আমাদের। তার যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, তাই ইনকিউবেটারের তাপমান ঠিকঠাক বজায় রাখতে হয়, কী খেতে তিনি ভালোবাসেন তা জানতে হয়। কৃত্রিম পরিবেশে তার মন জুগিয়ে চলাই কাজ আমাদের। তাকে তো আর প্লেট কিংবা টেস্ট টিউবে শুতে দিলে চলে না, তাকে দিতে হয় আস্ত একটি জীবদেহ। মাঝে মাঝে আমরা ওই যে দেখতে পাই, কেমন সরু সরু রক্তের জাল লেগে থাকে বাজার থেকে আনা ডিমের কুসুমে, সেদ্ধ করার পর। সেটা আসলে মুরগির একটি অপরিণত ভ্রূণ। আমরা দু-তিন দিনের ওই রকম ভ্রূণকে এই ভাইরাসের হোস্ট হিসেবে ব্যবহার করি।

    আমাদের প্রজেক্টের পরবর্তী হোস্ট হল সাদা ইঁদুরের বিশেষ একটি প্রজাতি। এমন আদুরে অ্যালবিনো র‍্যাট অলরেডি মায়ানমার থেকে আনানো হয়েছে। তিথি আপাতত নরম গাজর দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করছে দিনরাত। আসলে ইঁদুর তো মানুষের খুব কাছাকাছি জাতের একটি প্রাণী, তাই ভাইরাসকে ইঁদুরের শরীরে বাঁচতে না দেওয়ার ইমিউনোসুপিরিয়র পথ খুঁজে পাওয়াই আমাদের গবেষণার মোক্ষ।

    এ মোক্ষ রোদবাবুর ভিডিয়োর মতো প্রকাশিত নয়, এ মোক্ষ কালাম সাহেবের জীবন-বাজি-রাখা এক গুপ্ত রিসার্চ। সারা পৃথিবীর এত মৃত্যু, এত শোকের শেষ দেখতে চান তিনি। আমরা বারোজন তাঁর রিসার্চ স্কলার। সিক্স প্লাস সিক্স— ছেলে ও মেয়ে। ড. কালামকে নিয়ে তেরোজনের টিম। আমরা জানি না এই তেরো শেষ পর্যন্ত লাকি নাকি আনলাকি হয়ে দাঁড়াবে সমাজের কাছে। তবে এটুকু এতদিনে জেনে ফেলেছি, যে এই গবেষণাই ‘জন্নত’ স্যারের কাছে। যে দিন তিনি আঙ্গুরতলা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের মর্গে শেষ বার অঝোরে কাঁদছিলেন, সেদিন তাঁর ছাত্রছাত্রীরা জানতে পেরেছিলাম মানুষটার লৌহকঠিন অবয়বের আড়ালে তুলোর চেয়েও নরম একটি শিশু বসবাস করে। সেদিন চেনা গেছিল ভদ্রলোককে!

    ‘প্লিজ, শান্ত হোন স্যার!’ নূরজেল অনুনয় বিনয় করছিল বারবার।
    ‘আমার যে সব শেষ…। কী নিয়ে বেঁচে থাকব আমি? বাড়ি ফিরে এত দিনের সাধনা কার কাছে বলে এবার  শান্তি পাব বলো তোমরা?’ স্যার ভেঙে পড়েছিলেন একেবারে।

    সেদিনের পর থেকে নিজের বাড়িতে আর ওঠেননি তিনি। আমানতপুর ফ্লাইওভারের পাশে ত্রিনয়ন রিজেন্সি তাঁর নতুন ঠিকানা হয়েছে এখন। দত্তক কন্যা নিজের মতো তাঁকে অনেকটা সামলে নিয়েছে এই ক’দিনে। আমরা অবশ্য বলাবলি করি, স্ত্রীর মৃত্যুই যেন স্যারের তিন নম্বর চোখ খুলে দিল। এক দিকে দত্তক মেয়ে তাঁকে আগলে রেখেছে আর অপর দিকে তিনি পুষে রেখেছেন ভাইরাসের গোপন এক সাম্রাজ্য! এগুলোই জীবনের আমানত তাঁর।

    ৩.

    আমি একটু লেট-রাইজার, ফলে ল্যাবে ঢুকতে ঢুকতে বারোটা আমার বাজবেই। কালচার মিডিয়া ঠিকঠাক রান করছে কি না তার ডেটা শিট স্যারকে স্নেল মেল করি বারোটা চৌত্রিশ মিনিটে। এটাই এখন নিত্য দিনের রুটিন আমার। এদিকে ভোরে যারা ল্যাব থেকে বেরোয়, তারা আবার জয়েন করে বিকেল চারটে নাগাদ। ফলে জীবাণু, জীবন ও যন্ত্রের অদ্ভুত এক সাইক্লিক সহমর্মিতা আয়ত্ত করে ফেলেছি আমরা। হ্যাঁ, তার মধ্যেও কি আর চুলোচুলি নেই? আছে তো অবশ্যই। আর অবশ্যই আছে মানব-মানবীর অন্তরে পোষ মানানো মহাপ্রাকৃতিক সেই প্রেম।

    সত্যি কথা বলতে কী, তিথির সঙ্গে যে নূরজেলের কোনও দিন সম্পর্ক হতে পারে আমরা ভাবতেই পারিনি। এই দুজনের কোনও কিছুই যে মেলে না। তবুও… সম্পর্ক আসলে এক মায়াসুতো— না আছে তার গঠন না আছে আকার; না আছে তার ধর্ম, না আছে তার বর্ণ। কিন্তু ইচ্ছের গায়েও কি কামনার রোঁয়া লেগে থাকে না! নাকি ইমিউনোসুপিরিয়র কোনও রসায়ন তাদের নাকে  দড়ি দিয়ে অ্যাড্রেনালিন রেসে চরকির মতো ঘোরায়?

    ‘এক্ষুনি কোর-গ্রুপে একটা নোটিস এল। উথুম্বা থেকে ভাইটেক টেকনিশিয়ান পাঠিয়েছে, ওরা পিপিসির অ্যাডভান্সমেন্টনিয়ে একটা প্রেজেন্টেশনদেবে। মাইতি, তুই আরও দুজনকে নিয়ে মিটিং জয়েন করিস। স্যার বলেছেন। আজ ইভনিংয়ে, আটটা থেকে দশটা’— আয়ুষ ছুটতে ছুটতে এসে এক নিঃশ্বাসে বলে গেল।

    ‘যাহ্‌ বাবা! পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ক্লোদিং-এর আবার কী এমন অ্যাডভান্সমেন্ট হল?’
    ‘ওকে চল, তোর সঙ্গে আমি আর ক্ষেত্রী আসছি।’

    ভোরে যারা ল্যাব থেকে বেরোয়, তারা আবার জয়েন করে বিকেল চারটে নাগাদ। ফলে জীবাণু, জীবন ও যন্ত্রের অদ্ভুত এক সাইক্লিক সহমর্মিতা আয়ত্ত করে ফেলেছি আমরা। হ্যাঁ, তার মধ্যেও কি আর চুলোচুলি নেই? আছে তো অবশ্যই।

    হাসপাতালে নীল ফিতে লাগানো, পাতলা ফিনফিনে সাদা যে পোশাকটি আমরা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি এই ক’বছরে, তা আসলে অতি নিম্নমানের একটি উইন্ডচিটার অথবা প্যারাসুট কাপড়ের জামা! ভাইটেক আমাদের দেখাল পিপিসির ‘অ্যাকচুয়াল ওয়াটার রিপিলেন্সি’ কত ডিগ্রি হওয়া দরকার, কত মিলিবার পেনিট্রেশন প্রেসার অতিক্রম করলে তবেই জীবাণু আমাদের চামড়া ছুঁয়ে ফেলতে পারে, ওনারা দেখালেন কোন পিপিসির মিন ইউজেবিলিটি স্কোর আমাদের জন্যে সব থেকে নিরাপদ। এত সব তত্ত্বগত আলোচনা শুনে মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছিল আমাদের। যাকে সেভাবে চোখেই দেখিনি কোনও দিন, যাকে নিয়ে আকাশকুসুম ভয় জমিয়ে রেখেছি কেবল, সে আদপে সত্যিই আছে তো? নাকি সর্বঘটে বিশ্ব-উষ্ণায়নের মতো সেও এক কষ্টকল্পনা!

    ‘ঠিক বলেছিস।’ মাইতি সায় দেয় আমার কথায়। বলে, ‘দেখ, আমরা রিয়েল টাইম পিসিআর-এ কী পাই বল তো? ভাইরাস দেখতে পাই কি? না! শুধু সিটি ভ্যালু পাই।’
    ‘তাই তো!’
    ‘নাক বা মুখ থেকে নেওয়া সর্দি জাতীয় তরলে আরএন-এর চিহ্ন খোঁজা হয়। বহুবার ছেঁকে ছেঁকে এমন জেনেটিক বস্তুর অস্তিত্ব দেখি আমরা, যা নাকি ওই জীবাণুর পেটে আছে। ঠিক যেমন চা-ছেঁকে নেওয়ার পরে ছাঁকনিতে যে পাতা পড়ে থাকে, তার উপর সাদা জল ঢাললেও দেখবি জলে সামান্যতম চায়ের গন্ধ থেকে যাবেই। আরটিপিসিআর–ও তাই।’
    ‘বাহ্‌! দারুণ বলেছিস। আমার একবার স্যারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল এই নিয়ে। বলেছিলাম, যে জীবাণু আমরা কালচার করছি সে কি সত্যিই আছে? উনি বললেন, হ্যাঁ আছে। তবে উনি বিশ্বাস করেন জীবাণুরা নাকি খুব গোঁড়া হয়।’
    ‘গোঁড়া মানে?’
    ‘মানে উনি বলতে চাইলেন, কোনও ভাইরাস সমজাতের আর কোনও ভাইরাসের সঙ্গে কখনোই ভাব-ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে না। তাই মিউটেশানের কোনও প্রশ্নই নেই। ফলে তাদের বংশ যত বাড়ে, ততই দুর্বল হতে থাকে তারা। তাই তিনি তেজি, তাজা ও একদম প্রথম প্রজন্মের জীবাণুকেও টিকিয়ে রাখতে চান ল্যাবে, গোপনে।’

    ঠিক যে ভাবে আমাদের প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের মাথা খেয়ে রেখেছে চিন! যেমন ভাবে গেম ঢুকিয়ে দিয়েছে জিনে।      

    ৪. 

    সেদিন দোল ছিল। যে ক’জন ছিলাম মেসে, লিটর‍্যালি ভালুকের বন্যা বয়ে গেছে। তেমন পানীয়র এটাই ছিল আমাদের কাছে কোড নেম। ফলে দুপুরে ল্যাদ খেয়েছি একপ্রস্থ। ল্যাবে যেতে পারিনি, স্যার নিজে ল্যাবে ছিলেন। দূরের জেলার বাকিরা যে যার বাড়ি চলে গেছে।

    সাড়ে আটটা নাগাদ ল্যাবে ঢুকে দেখি বাফার কম্পার্টমেন্ট আনলকড! সেকী? আমার তখন হার্টবিট চারগুন বেড়ে গেছে। ছুটে গিয়ে দেখি কোর দরজার পাসওয়ার্ড হ্যাকড! মানে? ওরা দুজন তো থাকার কথা ছিল, কোথায় গেল? স্যারকে ফার্স্ট-কী দিয়ে রিং করলাম। পি… পিঁক… পিঁক… ফোন ঢুকছে না। আরে! জ্যামার কে অ্যাক্টিভেট করল?     তখন আমি পাগলের মতো গোটা ল্যাবে দৌড়চ্ছি, যেন পাগলা গারদে বন্দি!

    পরে বুঝতে পেরেছিলাম, সবই ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত। দিনক্ষণ মেপে, সময় ও সুযোগ কাজে লাগিয়েই এমনটা ঘটানো হয়েছিল।

    শেষমেশ, স্যারের কেবিনের ঘষা কাচের ভেতর থেকে আমি তাদের প্রতিসরণ দেখতে পাই। দেখি, ওষ্ঠ-আগ্রহে মেতে উঠেছে তারা। দেখি পারদের মতো ওঠানামা করছে তাদের শরীর। তাদের হাত পা যেন হয়ে উঠেছে হিলহিলে সাপের মতো নমনীয়! যেন ঠাণ্ডা আগুন জ্বেলেছে ওরা। যে আগুন মনের বাগানে দাবানল চারিয়ে দিতে পারে। আমাজন অরণ্যের মতো…

    এমন অভাবিত দৃশ্যায়ন আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। না, দরজা ঠেলে ভেতরে যাইনি। তাদের সময় দিয়েছিলাম। আদর ও অনুনয় আড়াল থেকে শুনেছিলাম। তাদের আক্ষেপ ও সামাজিক অনুশোচনা উপলব্ধি করছিলাম। বিশ্বাস করুন, তাদের উপর রাগ সেই মুহূর্তে ন্যাতানো টিস্যু পেপারের মতো হয়ে গিয়েছিল আমার।

    তিনদিন পর নূর বলেছিল, ‘নেট পাস করে রিসার্চে ঢুকেছি ঠিকই কিন্তু স্যারের এই হাইপোথিসিস আমি মানি না। বিশ্বাস কর শুধু ভ্যাকসিন তৈরির জন্যে এত দিনের এই গোপন গবেষণার কোনও মানে নেই। আমি আর তিথি সেটাই প্রমাণ করতে চাই। তুই যা দেখেছিস, তা ছিল কেবল মাত্র হোস্ট সৃষ্টি করার একটি প্রোটোকল। আমরা মানি, সমাজ মানে না!’

    তিথি সারা দিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে কেবল। একটা বিস্কুট পর্যন্ত মুখে তোলেনি। সোডিয়াম-পটাশিয়াম নেমে গেছিল। বিটা ব্লকার দিতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত।

    তবে নূর খুব কনফিডেন্ট ছিল। বলে কিনা, ‘তুই চাপ নিস না ভাই। তিথিকে আমি দেখে নিচ্ছি। আসলে আমাদের একটি হিউম্যান হোস্ট দরকার ছিল খুব। সেদিন আমরা তারই ইনিসিয়েশন করেছি।’

    চোদ্দ সালে যে পোলিও ভারত থেকে হারিয়ে গেছে বলে বলা হয়, তা নাকি রেগুলার পালস্‌ পোলিও ভ্যাকসিনের জন্যেই সম্ভব হয়েছে। না, আসলে তা নয়! আমাদের সৃষ্টি করা হিউম্যান হোস্টকে, পোলিও ইনফেক্ট করিয়ে আমরা দেখাতে চাই  ভ্যাকসিন ছাড়াই আমার হোস্ট, আমার আত্মজ জীবাণুকে হারাতে পারে। কিংবা বংশ বিস্তার করতে করতে জীবাণু নিজেই হয়তো হেরে বসে আছে।

    ‘এও এক পরিবেশগত অভিযোজন। তুই শুধু আমাদের মানসিক অভিযোজনে সাথ দে বস।’
    ‘প্রমাণ করতে দে একবার। তারপর দেখবি, কোভিডেও হাত দেব আমরা…’

    ৫.

    আজ ২৭শে মার্চ, ২০২৫। আবহাওয়া অতীব মধুময়। আমি ল্যাবে, আটতলার এই কোণের ঘরটি আজ আমার কাছে কল্পিত-স্বর্গের থেকে কোনও অংশে কম নয়! আমি আকাশ গাঙ্গুলি, আজ যেন পৃথিবীর সুখীতম একজন। তবে বিশ্বাস করুন, কেবল ব্যক্তিগত কারণেই যে আমার মন ফুরফুরে হয়ে আছে এমনটা নয়। তার ব্যাপক দু-দুটো কারণ আছে। বলি শুনুন,

    প্রথমত, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী আফিফালতা কিস্কুডেভিড রাত বারোটার পর, জাতির উদ্দেশে ঘোষণা করেছেন, আমাদের দেশ আজ থেকে কোভিড-মুক্ত। ওয়ার্ল্ড ফিজিশিয়ানস অর্গানাইজেশন (ডবলুপিও) আমাদের এই স্বীকৃতি দিয়েছেন।
     
    আর দ্বিতীয়ত, গ্রেটার সায়েন্স আজ কভার-পেজ করেছে একটাই খবর নিয়ে। ট্রু অ্যান্ড অথেনটিক সায়েন্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (টাসা) তাঁদের রিসার্চে নাকি জানিয়েছেন বিশ্ব-উষ্ণায়ন আসলে একটি ফেক স্টোরি। তা নিয়ে আর নতুন কোনও গবেষণা এখন অর্থহীন।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

               

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook