ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • টোকাটুকি


    আবীর কর (March 31, 2023)
     

    সত্তরের দশক নাকি গণটোকাটুকির দশক। এমনকী শোনা যায়, ১৯৭১/’৭২-এ ছাত্ররা বেঞ্চে ছুরি গেঁথে অর্থাৎ সিস্টেমকে ফালা-ফালা করে খোল্লামখোলা পরীক্ষা দিয়েছে। যদিও তারপর সত্তরের উত্তর-দশকেও প্রায় ফি বছর পরীক্ষার সঙ্গে এঁটুলির মতো লেগে থেকেছে এই টোকাটুকি ওরফে টুকলি বা চোতা, বানানের রূপভেদে চোথা। শব্দার্থের সন্ধানে গেলে অভিধানে দেখা যাবে বাজে, তুচ্ছ, নিকৃষ্ট হল চোতা বা চোথার আক্ষরিক অর্থ। আদতে চোথার আক্ষরিক সজ্জা ভিন্ন-ভিন্ন রূপে ও ভাবে অভিনব, চমৎকার সে অক্ষরবিন্যাস। প্রায় চোখের অগোচরে থাকা সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র লেখমালা যেন সাধারণ চোখের পক্ষে পড়ে ফেলার স্কোপ কম, সঠিক ভরসা মাইক্রোস্কোপ। 

    প্রতিলিপি বা ফোটোকপির আধুনিক যন্ত্রের অনেক আগে থেকেই টেক্সট-বুক, মেড-ইজি, পরবর্তীতে ছাত্রবন্ধু থেকে ছোট-ছোট কাগজে দিব্যি রাশি-রাশি নকল হয়েছে পরীক্ষার আগের রাত জেগে। নানান মাপের চিরকুটে খুদে-খুদে লেখাও যে অসামান্য হস্তশিল্পের দৃষ্টান্ত, তা দৃশ্যত মানতেই হয়। এছাড়া টোকার জন্য আরও সহজতম পথ ছিল এবং আছে বই ও খাতার পাতা ছেঁড়া। আর এই বই-খাতা থেকে টোকা বা ঝাড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল অনুমানশক্তি। আসতে পারে এমন প্রশ্নের টুকলি নিয়ে আসতে পারাটাই এই পর্বের মূল। কিন্তু তারপর এই মূলধনকে শরীরের অন্ধিসন্ধিতে, জামার কব্জিবন্ধে, কলারে, ঘড়ির মণিবন্ধে, একদা ধুতির কোমরবন্ধে, এখন প্যান্টের হরকিসিমের পকেটে, বেল্টের তলায় এমনকী জুতোর তলাতে, আর শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও জাঙিয়ার বুক পকেটে পর্যন্ত… চোরাগোপ্তা সে-মাল মজুত করে পরীক্ষার হলে আসতে হয়। অভিজ্ঞজনেরা বলছেন, পোশাকের খাঁজে-ভাঁজে চোথা-সুরক্ষার ক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বরাবর অনেক এগিয়ে। প্রথমত, শাড়ির কুঁচিতে-কুঁচিতে ওই খুদি-খুদি লেখার ছোট-ছোট পুরিয়া তারা যে কীভাবে কোথায় পুরিয়া আনে তার সন্ধান পাওয়া দুঃসাধ্য। সালোয়ার-কামিজের ক্ষেত্রে, সালোয়ারের ঊরু-অঞ্চল গুরু ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের একপ্রকার সুরক্ষিত উত্তর-অঞ্চল হতে পারে। এরপর উত্তর-কালে উতলা উত্তরীয় তো আছেই নজরদারের নজর-ভ্রম ঘটাতে! 

    টুকলি বা চোথা, আবার দস্তুরমতো দাওয়াই অর্থে পুরিয়া যোগে, এমনকী আস্ত বই নিয়ে পরীক্ষা-বৈতরণী পার হওয়ার সময়কাল, সত্তর দশকের বিচারে অর্ধ-শতাব্দীকাল পেরিয়ে গেল। এই পাঁচ দশকে টুকলি-সংস্কৃতির ভিতরে-বাইরে প্রভূত পরিবর্তন ঘটেছে। বিবর্তনের সেই পথ বেয়ে গেলে দেখা যাবে, শুধুমাত্র পরীক্ষার্থীই যে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ও বেশবাসের ভিতরে নকল করে আনছেন বা সাদা কাগজ কেটেকুটে চিরকুটে লিখে আনছেন তা নয়, এক সময় বাইরে থেকে উত্তুরে-বাতাসের মতো বাতাসে উত্তর ভেসে আসা শুরু হল, এছাড়া ছোট্ট ঢিলে জড়ানো টুকলি অসামান্য গুগলি হয়ে জানলা দিয়ে ধেয়ে আসতে লাগল। এবং কী আশ্চর্য সেই ভাসিয়ে দেওয়া উত্তরের হাওয়ায় বন্ধুবান্ধব, উৎসাহী স্বজন ও প্রেমিককুলের পাশাপাশি এক সময় এসে দাঁড়াচ্ছেন প্রাইভেট টিউটররাও। (খবরে প্রকাশিত, মধ্যপ্রদেশের মোরেনা জেলার শিক্ষা দপ্তরের নির্দেশিকা মেনে মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন ১৫০ জন প্রাইভেট টিউটরকে থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছে, উদ্দেশ্য টুকলি আটকানো।) তবে পরীক্ষাকেন্দ্রের দেওয়াল বেয়ে উঠে বা কার্নিশে ঝুলে ‘স্পাইডার-ম্যান’ হয়ে টুকলি সাপ্লাইয়ে অনেক-অনেক এগিয়ে চরম-বন্ধুরা ও কাতর-প্রেমিকরা। প্রয়োজনে ওই বিল্ডিং-লাগোয়া গাছে চড়ে বা বাঁশের কঞ্চির ডগায় টুক করে টুকলি পৌঁছানোর গুরুদায়িত্ব তারা অনায়াসে পালন করে। প্রায় ফি বছর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন ওই স্পাইডারম্যান বা গেছোদাদাদের ছবি আমরা সংবাদমাধ্যমে প্রত্যক্ষ করি। 

    নয়ের দশকে টুকলির ইতিহাসে এক বড় পালাবদল নিয়ে এল জেরক্স মেশিন, এবং পরে-পরে মাইক্রো জেরক্স টুকলিবাজদের অনেক হ্যাপা কমিয়ে দিল, বই-খাতারাও আকছার ছেঁড়াছেঁড়ির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেল। অন্যদিকে পরীক্ষার মরশুমে পাড়ায়-পাড়ায় জেরক্সের দোকান হয়ে উঠল মাইক্রো জেরক্সের মেগা-হাট। এমন পরিস্থিতি হল যে, প্রশাসনিকভাবে ঘোষণা জারি করতে হল, পরীক্ষাকেন্দ্রের পাঁচশো মিটারের মধ্যে থাকা জেরক্সের দোকান পরীক্ষা শুরুর আগের চব্বিশ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হবে। যদিও ঘোষণার গাম্ভীর্য ওই পাঁচশো মিটার আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই বাকিটা সহজেই অনুমেয়… 

    নকলে ইলেকট্রনিক গেজেটকে মাধ্যম করার মধ্যে আছে পাকা মাথার হিসেব, যা অনেক বেশি চতুরালির নিদর্শন। শোনা যায়, বাঘা-বাঘা টুকলিবাজরা টুকলিরও সূচি নিয়ে আসে, যেমন— ‘বঙ্গভঙ্গ বুকের মধ্যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্যান্টের নীচে, ভিক্টোরিয়া বুক-পকেটে, মোঘল সাম্রাজ্যের পতন পায়ের তলায়’।

    টুকলি আটকানোর জন্য বারে বারে নানা পথ ও পন্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই বজ্র আঁটুনিই সার হয়েছে, ফস্কা গেরো খুলে যে যার কাজ সেরে নিয়েছে। এক সময় পরীক্ষার হলে নকল ধরা পড়লে খাতা বাতিলের সম্ভাবনা ছিল, আর সে-সম্ভাবনার একটা পাহাড়-প্রমাণ দুর্ভাবনা টুকলিবাজ পরীক্ষার্থীদের মাথায় থাকত। নকল ধরা পড়লে ইনভিজিলেটররা টুকলি বা চোথা কাগজকে পরীক্ষার খাতার সঙ্গে স্টেপলার দিয়ে আটকে দিতেন। সেটা ছিল চরম অসম্মানজনক বিষয়। পরবর্তীতে সে কঠোর বিধিনিষেধ পরীক্ষার হল থেকে হালকা হতে-হতে এক প্রকার হারিয়ে গেল, যেমন হাওয়ায় হারিয়ে গেল শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় শাসন করার আয়োজনটুকু। এখন, ইদানীং ছাত্রছাত্রীদের প্রায় সব বেয়াদপিই লঘুভাবে দেখতে হয়। পরীক্ষার ধরনধারণও এসেছে অনেক পরিবর্তন। সেই নবম-দশম মিলিয়ে মাধ্যমিক এবং একাদশ-দ্বাদশ যোগে উচ্চমাধ্যমিকের বিপুল সিলেবাস আর নেই। এমসিকিউ আর এসএকিউ টাইপে নম্বর ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। এ-ধরনের প্রশ্নে টুকলি ব্যর্থ, এর জন্য যা জরুরি তার চালু পরিভাষা, ‘হল-ম্যানেজ’। অনেক সময় প্রশ্ন ফাঁস হলে এ-জাতীয় প্রশ্নের উত্তরও ভেসে আসে বাতাসে অভিনব সাঙ্কেতিক সুরে ও সূত্রে— ‘অ্যাপেল অ্যাপেল ডল্, ক্যাট ক্যাট বল্’— অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে প্রশ্নের উত্তর : A A D C C B। এরপর হলজুড়ে ওয়াইফাই টুকলিফাই। 

    প্রযুক্তির হাতে হাত রেখে বা তাকে হাত করে টুকলি বা নকলের মাধ্যম হয়েছে অত্যাধুনিক ক্যালকুলেটর, মোবাইল ফোন, কানে প্রায় অদৃশ্য থাকা ব্লুটুথ, কম্পিউটার চিপ। তবে এ-কথা অনস্বীকার্য, সাবেকি টুকলির মধ্যে যে মৌলিক কায়দাকৌশল আছে, তা কিন্তু প্রযুক্তিগত প্রশ্রয়ে নেই। আষ্টেপৃষ্ঠে ওয়াচ-রিস্টে লুকিয়ে এনে নজরদারের নজর এড়িয়ে কষ্টেসৃষ্টে পৃষ্ঠাদুয়েক লেখার মধ্যেও অসাধুতা আছে কিন্তু এর মধ্যে অল্পবিস্তর আবেগ ও ছেলেমানুষি আছে। নকলে ইলেকট্রনিক গেজেটকে মাধ্যম করার মধ্যে আছে পাকা মাথার হিসেব, যা অনেক বেশি চতুরালির নিদর্শন। শোনা যায়, বাঘা-বাঘা টুকলিবাজরা টুকলিরও সূচি নিয়ে আসে, যেমন— ‘বঙ্গভঙ্গ বুকের মধ্যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্যান্টের নীচে, ভিক্টোরিয়া বুক-পকেটে, মোঘল সাম্রাজ্যের পতন পায়ের তলায়’।

    করোনা-পরবর্তী, মাধ্যমিকে জড়িয়েছিল সহানুভূতির হাওয়া। দু’বছর ধরে ক্লাস না হওয়ার শূন্যতা তথা অসহায়তা পরীক্ষার্থীদের অনুকূলে ছিল। ফলে একপ্রকার অলিখিত নির্দেশ— কড়া নজরদারি নয়, শান্তি বজায় রেখে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে টুকটাক কথা চালাচালিতেও যেন থাকে নরম মনোভাব। এর ফলে পরীক্ষার হলে বেশ ফুরফুরে মুক্ত বাতাস। তারপর হল উচ্চমাধ্যমিক, তাদের জন্য আবার হোম সেন্টার তথা ঘরই কেন্দ্র, সেখানেই তাদের অতিমারীকালের শিক্ষার্জনের ভার ও ভরের পরীক্ষা। পরিচিত পরিবেশ, নজরদারের ভূমিকায় কে কেমন নরম-গরম, সেও তাদের সুপরিচিত। উল্টোভাবে পরীক্ষার্থীদের রকমসকমও শিক্ষকদের চেনাজানা। তাই সেবারের পরীক্ষা ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয় তরফেরই। যথেষ্ট স্পর্শকাতর হয়ে খেয়াল রাখতে হয়েছিল টোকাটুকি রুখতে না ঠোকাঠুকি লেগে যায়। 

    এবার করোনার যাবতীয় আশঙ্কা কাটিয়ে, রীতিমতো পরীক্ষা হল। কিন্তু পরীক্ষার হলে-হলে, খবর নেওয়া হলে দেখা যাবে টোকাটুকির ‘হাত’ থেকে পরীক্ষার মুক্তি মেলেনি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষাই যথেষ্ট টুকলি-বিদ্ধ ভাবেই উত্তীর্ণ হল। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত, কোনও কোনও পরীক্ষাকেন্দ্রে কড়া নজরদার শিক্ষকের ভাগ্যে ‘নকলনবিশ’ পরীক্ষার্থীর পক্ষ থেকে জুটেছে রোয়াব, ‘বাইরে দেখে নেব’ গোছের হুমকি। পূর্ব মেদিনীপুরের এক পরীক্ষার্থী আবার কথার খেলাপ করেনি, বাসে উঠে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে সপাটে চড় কষিয়ে  সেরেছে ‘গুরু’দায়িত্ব। আবার এক টুকলিবাজ ছাত্র দলবদ্ধভাবে, বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে কথামতো স্যারের বাড়ি চড়াও হয়েছে। এই ঘটনাক্রম থেকে এটা স্পষ্ট যে, নকল তার আসলধর্ম প্রকাশে আরও পাকাপোক্ত হচ্ছে। স্কুলে শাস্তি নেই, পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে হার মেনেছে উপস্থিতির হার, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনেও নেই কড়া নির্দেশিকা, বরঞ্চ উল্টে নরম নজরদারির অনুরোধে আরও অনুকূল হচ্ছে টোকাটুকির ক্ষেত্রটি। দিনের দিন এইভাবে চললে পরীক্ষা হয়ে উঠবে দীনহীন এবং একেবারেই অর্থহীন।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook