বসন্তে দেদার রিহার্সাল
আমাদের ছোটবেলার পাড়ায়, এই বসন্তকালে একখানা অনুষ্ঠান হতো। সেকালে পাড়ার অনুষ্ঠানে আজকের মতো এত চাকচিক্য, এত জৌলুস ছিল না, সেই সামর্থ্যও ছিল না মধ্যবিত্ত পাড়াগুলোর। কিন্তু এমন একরকমের নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা ছিল, আজ যার জুড়ি মেলা ভার। হয়তো অনেক বেশি সম্বল ছিল না বলেই, মনের সবটুকু জুড়ে জুড়ে সেসব অনুষ্ঠান সাজানো হতো। আর তাই আজও তার সমস্তটুকু মনের মধ্যে থেকে গেছে, ছবির মতো।
কতই বা বয়স হবে আমার তখন, ক্লাস সিক্স বা সেভেন। পাড়াভর্তি সমবয়সী সব বন্ধু বান্ধবী, তাদের বিচ্ছুমি সামাল দিতে বাবা মায়েরা নাকাল যাকে বলে। কিন্তু এই বসন্তকাল এলে বাইরের হাবেভাবে আমরা কেমন যেন শান্ত, ঠান্ডা, সুভদ্র হয়ে উঠতাম। কেননা নইলে পাড়ার অনুষ্ঠানে চান্স পাওয়া যাবে না। বড়রাও সেখানে অনেক কিছু করবেন, জানি। বা বলা ভাল বড়রাই সবটা করবেন। গানবাজনা হবে, ম্যাজিক হবে, আলোচনা হবে, নাটকও হবে। সেসবের মধ্যে মধ্যে ছোটদেরও অংশ নিতে দেওয়া হবে, এ ছিল জানা। কিন্তু অতি দুষ্টুমি করলে সেই জলসা থেকে নাম কাটা যেতে পারে, এই ভয় ছিল সকলেরই। তাই সন্ধে সন্ধে বাড়ি ফিরে হাত পা ধুয়ে পড়তে বসা, বা দশটার মধ্যে আলো নিভিয়ে শুতে যাওয়া, এসব অভিনয় আমরা সকলেই করে থাকতাম। তাতে যেটা হতো, অনুষ্ঠানের এক মাস আগে আমাদের সক্কলের ডাক পড়তো পাড়ার ক্লাবঘরে বা লাইব্রেরিতে। বুঝতাম, অভিনয় নেহাত মন্দ করিনি কেউ।
এখন মনে পড়ছে, অনুষ্ঠানটা হতে হতে একটু গরমই পড়ে যেত, কলকাতায় যেমন হয়। বসন্ত আর কদিনেরই বা বাসিন্দা এখানে। কিন্তু ভরা বসন্তে চলত আমাদের দেদার রিহার্সাল। আর সেই রিহার্সালের আনন্দ, মজা বা রোমাঞ্চ খোদ অনুষ্ঠানের চেয়ে ছিল ঢের বেশি। ছোটের নাটক যে প্রতিবার হতো, এমনটা নয়। কিন্তু এক কি দু’খানা সমবেত সংগীত থাকতই। সেও কি কম আনন্দ? ভাল পাট করা জামাকাপড় পরে স্টেজে উঠে সার বেঁধে দাঁড়াব, বেঞ্চে রাখা হারমোনিয়াম তবলার সঙ্গে মাইকে গলা মিলিয়ে গাইব সকলে, এই ভাবনার শিহরণেই তো বসন্ত কেটে যেত আমাদের।
রবীন্দ্রনাথের গানই উঠে আসত আমাদের গলায়। আদব কায়দা করে তো রবীন্দ্রসংগীত শিখি না কেউ, কিন্তু তখনও বাড়ি বাড়ি সন্ধের পর গীতবিতান খুলে হারমোনিয়াম টেনে বসার একটা চল ছিল। আমাদের পাড়াও তেমনই। সকলের বাড়িতে আর কিছু না হোক, ওই একটি বই থাকতই। আর যেমনই হোক, একখানা হারমোনিয়াম। কিন্তু আমার ছিল সবচাইতে বেশি মজা। কেননা ছোটদের গানের রিহার্সাল সব সময়ে আমাদের বাড়িতেই হতো। যদিও মা রবীন্দ্রনাথের গান শেখাতেন না, তাঁর নিজেরও রবীন্দ্রনাথের গানের তালিম নেই। কিন্তু মা যেহেতু গানের মানুষ এবং গান শেখানোর একমাত্র মানুষ, তাই তাঁর কাঁধেই এসে পড়ত এই দায়িত্ব।
গান শেখানো ব্যাপারটা মায়ের রোজকার রুটিন, তাই আলাদা করে এ নিয়ে ঝামেলা হতো না। বরং রাগরাগিণীর ভিড় সরিয়ে দু’তিনখানা রবীন্দ্রসংগীত তোলাতে মায়েরও ভাল লাগত খুব। কারা কারা শিখব? এই তালিকায় সকলের নাম উঠে আসত। মা আবার আলাদা করে ধরে ধরে একেক জনের গান শুনত। কাউকে তো বাদ দেওয়া যাবে না তালিকা থেকে, কিন্তু সুরের মার্কিং অনুযায়ী স্টেজে তার দাঁড়ানোর মার্কিং টাও বুঝে নিতে হবে, তাই এই ব্যবস্থা। তারপর গান বাছা, তারপর মহড়া শুরু।
মনে আছে, সে-বছর বাছা হয়েছিল একখানাই গান মোটে। খুব কঠিন, কিন্তু শুনতে কী যে আরাম! ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে’। ওরকম গান ওর আগে কখনও শুনিনি। ওরকম আশ্চর্য গানের কথা, আর তার সঙ্গে ওইরকম সুর। এমন কীভাবে পারে মানুষ? তখনও জানি না, রবীন্দ্রনাথ কী কী পেরে গেছেন। সেই গান তুলতে আমাদের অনেক দিন লেগেছিল। প্রথমে মা গেয়ে গেয়ে শোনাত সকলকে। কেউই পারতাম না বিশেষ। গানের কথা যতটা সম্ভব বুঝিয়ে বলত, তাও তেমন পারতাম না। কত উঁচুতে তুলে নিয়ে যেতে হয় গলা, তুবড়ির মতো? তারপর ঘুরে ঘুরে নামা। ওই ‘বিকশিত প্রীতিকুসুম হে’ আর ‘হরষগীত উচ্ছ্বসিত হে’ বলে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে আবার সটান সিঁড়ি ধরে উঠে যাওয়া। অত সহজ নাকি?
তা যাই হোক, সে কোনও রকমে গান বসল আমাদের গলায়। রোজ সন্ধের পর রিহার্সাল, বার সাতেক গানটা গেয়ে ঝালিয়ে নেওয়া, পাড়ার জলসার আর বেশি দেরি নেই তখন। এই সময়ে একদিন আবিষ্কার করলাম, আমার মধ্যে এক অদ্ভুত অসুবিধে জন্ম নিচ্ছে। প্রথমটায় টের পাইনি, কিন্তু এবার পেতে শুরু করেছি। আর রবি ঠাকুরের এই গানই বয়ে এনেছে সেই অসুবিধে। জীবনলতা অবনতা তব চরণে’। কীরকম? গানের প্রথম লাইনে যখন ‘প্রাণেশ হে’ উচ্চারণ করছি, শুদ্ধ রেখাব আর শুদ্ধ গান্ধার হয়ে টানটান রোদের মতো শুদ্ধ মধ্যমে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে গানের সুর, তখন কী আশ্চর্য আনন্দে মনপ্রাণ ভরে উঠছে যেন। সুরেরই জাদু হবে নির্ঘাত! তার সঙ্গে কথার ওইরকম লেনদেন। আনন্দ বসন্ত সমাগমের কথাই তো বলছেন। সেখানে আনন্দ হবে না? এইটুকু বুঝতাম তখন। এত সুরের কারিকুরি, কথার মারপ্যাঁচ বোঝার মতো জটিল মন তো গড়ে ওঠেনি তখনও।
কিন্তু আবার যখন সঞ্চারীতে গাইছি ‘জীবনলতা অবনতা তব চরণে’, তখন অকারণ মনখারাপ ঘিরে আসছে চারপাশ থেকে। কেন হবে এরকম? সেই একই শুদ্ধ মধ্যমে গিয়ে তো দাঁড়াচ্ছি এখানেও, যে-সুর আমাকে একটু আগেও আনন্দের রোশনাইতে ভরিয়ে দিয়েছে। তবে কেন কিছুক্ষণ বাদে সেই একই সুরের কাছে পৌঁছে অজানা ব্যথায় কান্না ঠেলে উঠে আসবে? কেন লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করবে চোখ? কেন ভারী হয়ে উঠতে চাইবে বুক? কিছুতেই বুঝতাম না। কিন্তু এই রহস্য আমাকে তাড়িয়ে মারত। মুখচোরা ছেলে, তাই এমনকী মাকেও জিগ্যেস করতে পারিনি এর উত্তর। তাছাড়া এই অবাক কষ্ট বুঝিয়ে বলবার মতো ক্ষমতাও তো ছিল না তখন। কেবল ছিল কান্না টের পাবার মতো মন। সেই মনই অনেক অনেক বছর ঘুরে মরল, এই প্রশ্নটা বুকে চেপে।
আজ বুঝি, কোথায় সূক্ষ্ম কারসাজিটা লুকনো আছে। কথাতেও আছে, সুরেও আছে, কিন্তু বুঝে নিতেই এতগুলো বছর লেগে গেল আমার। প্রথমবার যখন শুদ্ধ মধ্যমে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে গানটা, ‘প্রাণেশ হে’ উচ্চারণ ক’রে, তখন সে আসলে বসন্তকে স্বাগত জানাচ্ছে, উদযাপন করছে তার সমাগমকে। তাই সেখানে আনন্দের বোধ ঝলমল করে উঠছে, গাইতে গিয়ে। কিন্তু সঞ্চারীতে যখন সেই একই মধ্যমের কাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন বলছে ‘জীবনলতা অবনতা তব চরণে’। অর্থাৎ, তখন সে কেবল সমর্পণের কথা বলছে, সবটুকু দিয়ে দেবার কথা বলতে চাইছে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেবার মধ্যে যে ভাললাগার ব্যথা মেশানো আছে, সেই তখন বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমার সামনে। আর তাই, অজান্তে, চোখ ছাপিয়ে আসছে কান্না। তখনও আসতো, কিচ্ছু না বুঝে। কিন্তু ওই অত ছোট বয়সেও যে ভার হয়ে যেত মন, সে তো এত কথার কারিকুরি বুঝত না। তাহলে? সেইখানেই রবীন্দ্রনাথ সাজিয়ে রেখেছেন সুরের কারসাজি। খেয়াল করলে দেখব, প্রথমবার মধ্যমে পৌঁছনো সময় শুদ্ধ গান্ধার হয়ে যাচ্ছেন তিনি। যা আসলে রোদের প্রতিরূপ, আলোর উপমান। আর দ্বিতীয়বার সেই শুদ্ধ মধ্যমেই পৌঁছচ্ছেন, কিন্তু কোমল গান্ধার হয়ে। যা আসলে ব্যথার চিহ্ন, দুঃখের নিশান। আর ওইখানেই আমাদের অবচেতনকে এক লহমায় ঘুরিয়ে দিচ্ছেন তিনি, ডেকে আনছেন এক আন্তরিক বিপর্যয়। গন্তব্য একই রাখছেন, কেবল পথকে বাঁকিয়ে নিচ্ছেন রোদ থেকে মেঘের দিকে, যাতে ব্যথা টের পেতে পারে মন।
আজ যখন ‘এবারের মতো বসন্ত গত জীবনে’… এই কথাটিকেই সার মনে হয় বসন্ত এলে, তখন তাঁর ওই আশ্চর্য কারসাজি আমাকে আরও একবার নতুন করে কাঁদায়, ভাবায়। সবটুকু দিতে পারার বেদনা, নাকি কিছুই দিতে না-পারার আক্ষেপ, তা আর বুঝি না…