কোন লেখার কাছে ফিরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, এ-প্রশ্ন তেমন কঠিন নয়। কত কবিতাই তো আছে, আছে কত গানের কথা, যাদের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে মাঝেমধ্যেই। যাইও। বরং কঠিন হলো এই প্রশ্ন যে, কোন লেখার কাছে ফিরে যেতে হয় বারেবারে। যেতে চাওয়া আর যেতে হওয়ার মধ্যে একটা তফাত তো আছেই। প্রথমটা ইচ্ছে, দ্বিতীয়টা বাধ্যবাধকতা। ইচ্ছে বেশ স্বাধীন একটা বিষয়, খুশি হলো, ঘুরে এলাম পছন্দের কাছ থেকে। যখন ইচ্ছে নেই, তখন আর তার কাছে ফেরার তাগিদও নেই। তাই এক্ষেত্রে ব্যাপারটা দ্বিমুখী। লেখার যেমন গুণ আছে, পাঠকেরও টান আছে তার প্রতি। তাই মাঝেমধ্যে কোথাও দেখা করে নেওয়া। কিন্তু পরের ব্যাপারটা একমুখী, যেখানে লেখার কাছে বারবার ফিরে যেতে হয়, না গিয়ে উপায় থাকে না কোনও। সেখানে, মেনে নিতেই হবে, লেখার জোর হচ্ছে আসল কথা। সে তবে এমনই লেখা, তাকে ছাড়া আমার জীবনের নানা মোড়, নানা মুহূর্ত, নানা অভিঘাত বা নানা অনুভূতি অচল। সে না থাকলে তবে আমার দিশেহারা বোধ হয় খানিক, আনন্দে বা অসুবিধেয় তবে বন্ধুর মতো তাকেই আমি জড়িয়ে ধরতে চাই। সে-লেখা তবে অনিবার্য, অনপনেয়, অনন্য।
এমন লেখার প্রসঙ্গ উঠলে কেবল কে একটি কবিতাই মনে পড়ে, তা হয়তো নয়। আছে বেশ কিছু কবিতা, যাদের কাছে আমাকে বাধ্য হয়ে, ঘোর লাগা নেশার মাতালের মতো ফিরে ফিরে যেতে হয়, জীবনের নানা সময়ে। আগামী দিনেও হবে, জানি। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি কোনও লেখাকে বেছে নিতে বললে, আমি বাছব এই লেখাটিকে। আগে কবিতাটি উদ্ধৃত করি এখানে, তারপর না হয় বাকি কথা হবে।
স্পর্ধা
তার কোনো খ্যাতি নেই তার জন্মপরিচয় নেই
তার কোনো মুক্তি নেই লোকে যাকে মুক্তি বলে থাকে
যতদূর দেখা যায় সারি সারি কম্বল, পশম
আর কোনো ঢেউ নেই ঢেউয়ের সংঘর্ষে দ্যুতি নেই।
জীবন এত যে-ভালো, সে-জীবনে অধিকার নেই
লজ্জাহীন সুন্দরের মুখে কোনো লাল আভা নেই
সারি সারি উট আর উটের চোখের নীচে জল
দু-হাত বাড়িয়ে দেখে আর কোনো জলচিহ্ন নেই –
তবু সে এমনভাবে কোন স্পর্ধা করে বলে যায় –
‘আমার দুঃখের কাছে তোমাদের নত হতে হবে!’
বাংলা কবিতার পাঠকমাত্র জানেন, এ-লেখা শঙ্খ ঘোষের। প্রথম যখন এই কবিতা আমি পড়ি, তখন আমার ক্লাস ইলেভন। কিছু বছর হলো কবিতার পাঠক হয়েছি, অন্তত নিজেকে ভাবছি তেমনটা। আর যেখানে কবিতা নামের যা পাচ্ছি, পড়ে ফেলছি। কোনও বাছবিচার বা অগ্রাধিকারের তালিকা আমার নেই, পুরনো বইয়ের দোকান, বন্ধুদের ঝোলা, গড়িয়াহাটের ফুটপাথ, এরা আমার জোগানদার তখন। আর কদাচিৎ নতুন কোনও বই ঠিক দামে কিনে আনা, কিন্তু সে ছিল বিরল ব্যাপার। সেই সময়ে আমার হাতে আসে শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা। তার আগে যে পড়িনি তাঁর লেখা, এমন নয়, কিন্তু জোট বেঁধে একসঙ্গে অনেক লেখা তাঁর আমি পাইনি হাতে তখনও। সেই প্রথম পেলাম এবং প্রথম পাতা থেকে পড়তে শুরু করলাম। মনে রাখতে হবে, এমনকী এই পড়াও শঙ্খ ঘোষের কবিতার ধারাবাহিক পাঠ নয় (যা আমি করতে পেরেছি বেশ কিছু বছর পরে), কেননা এখানে কেবলমাত্র তাঁর বাছাই কবিতাই স্থান পেয়েছে, যেমন হয়ে থাকে। কিন্তু, সেই বাছাইয়ের মধ্যেও তো এক ধরনের বহমানতা, এক ধরনের ক্রমান্বয়তা থাকে, সেইটেই আমাকে পেয়ে বসল। বা বলা ভাল, গ্রাস করল আমাকে। দিনরাত ভুলে, স্নান খাওয়া প্রায় বিস্মৃত হয়ে আমি পড়ে চললাম শঙ্খ ঘোষের কবিতা। পঙক্তি থেকে পংক্তিতে, পাতা থেকে পাতায়, বই থেকে বইয়ের উত্তরণে সেসব কবিতারা ভাসিয়ে নিয়ে চলল আমায়।
অতশত তো বুঝিনি তখন, এখনো যে বিশেষ বুঝি তা নয়, কিন্তু একটা বিষয় টের পেয়েছিলাম, হ্যাঁ, টেরই পেয়েছিলাম, এই কবির লেখায়, কোনও লেখায়, তিনটি দিকের অভাব নেই। দর্শন, অবস্থান এবং ব্রত। সে-কবিতা প্রেমের হতে পারে, হতে পারে রাজনীতির, সে-লেখা হতে পারে বিরহের বা হতে পারে যুদ্ধবিরোধী, কিন্তু এই তিন বিন্দুকে তিন দিক থেকে ছুঁয়ে থাকার অভ্যাস তিনি ত্যাগ করেননি কোথাও। তাঁর বাকভঙ্গিমা, তাঁর সংযম, তাঁর ধ্যান এবং এমনকী তাঁর কৌতুকও এই তিনের বাইরে নয়। তখন বুঝলাম, এই তবে হলো শঙ্খ ঘোষের কাব্যজগৎ। বা, অন্তত ভাবতে পারলাম এমনটা। তাঁর জগৎ বোঝবার জন্যও পাঠককে যে-দীক্ষা পেরোতে হয়, তা আমার সেদিনও ছিল না, আজও নেই। কিন্তু, অবুঝের মতোই, চারপাশে তাঁর কবিতার সুনির্দিষ্ট বাতাবরণ আমি টের পেলাম।
আর টের পেলাম এই কবিতাটি। প্রথম যখন পড়ি, বলতে লজ্জা নেই, বুঝতে পারিনি বিশেষ। তার গভীরতা, তার ব্যাপ্তি, তার আয়তন বা তার বিস্তার, এসব যে আছে, সেটুকু বেশ বুঝেছি। কিন্তু যেভাবে তিনি কথা বলে উঠছেন কবিতায়, শুরু থেকে যেভাবে পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছেন, সেই বলন বা সেই চলন আমার কাছে ধরা দেয়নি পুরোপুরি। আজও কি দিয়েছে? জানি না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছিলাম, এই কবিতা আমাকে জোর দিচ্ছে, ভিতর থেকে। কেন দিচ্ছে, কীভাবে দিচ্ছে, সেটা পরের কথা। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছি, কবিতার ভিড় থেকে এগিয়ে এসে এই একটি কবিতা আমার হাত ধরে দাঁড়াতে চাইছে, আমার পাশে। এই অনুভূতির বিস্ময় যে ঠিক কীরকম, তা বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রথমবার পড়েই কবিতাটিকে আমি আমার বন্ধু বলে আবিষ্কার করেছিলাম, যা আজও মিথ্যে হয়নি।
কারণ হয়তো এই যে, এই কবিতার যে-সর্বনাম, সেই ‘সে’ হয়ে উঠি আমি, সেই ‘তার হয়ে ওঠে আসলে আমার। আমি নিজের অজান্তেই সেই কবিতার কেন্দ্রে গিয়ে দাঁড়াই, আর নিজের চারপাশে দৃশ্যকল্পের মতো বিছিয়ে যেতে দেখি সেই কবিতাকে, নিজের সারা শরীর জুড়ে চারাগাছের মতো লতিয়ে উঠতে দেখি সেই কবিতাকে। যেন-বা আমারই কথা ভেবে রচিত হয়েছে সে, যেন-বা আমিই সেই কবিতার প্রাণ। এই এক আশ্চর্য জোরালো বোধ আমাকে আর কবিতাটি থেকে আলাদা হতে দিল না, আজও দেয়নি। খুব সংক্ষেপেই যদি বলি, তাহলে এ কবিতা গোড়ায় তার চরিত্রকে নির্মাণ করে দুটি মাত্র পঙক্তিতে। এমন একজন, যার খ্যাতি নেই, জন্মপরিচয় নেই, তথাকথিত মুক্তি নেই। আর এমনভাবে বলা হয় এই দু’লাইন যে, প্রথমেই তার সঙ্গে আত্মীয়তা বোধ তৈরি হয় পাঠকের, অন্তত আমার হয়েছিল। এত ভাল যে-জীবন, সেই জীবনেও তার কোনও অধিকার নেই। এইখানে এসে এই কবিতার ‘সে’ বড় নিঃস্ব হয়ে ওঠে। নিজের সমস্ত নিঃস্বতা ও লুকনো হাহাকারের সঙ্গে তাকে এক করে দেখতে আমার আর অসুবিধে হয় না কোনও। এরই পাশাপাশি গড়ে উঠতে থাকে দূরবর্তী কিছু দৃশ্যকল্পের অব্যর্থ আভাস, যা ‘তাকে, এবং স্পষ্টতই আমাকেও আরও একা করে তোলে। এই অবধি এসে আমি যখন অসহায়, পরাজিত বোধ করতে শুরু করছি, ঠিক তখনই কবিতাটিতে ঘুরিয়ে দাঁড় করান শঙ্খ ঘোষ। আর লেখেন –
তবু সে এমনভাবে কোন স্পর্ধা করে বলে যায় –
‘আমার দুঃখের কাছে তোমাদের নত হতে হবে!’
এইখানে, ঠিক এইখানে এসে এই দুটোমাত্র লাইন আমার জীবনের দর্শন বদলে দিয়ে যায়, চিরকালের মতো। নিঃস্বতার মধ্যে, একাকীত্বের মধ্যে, পরাজয়ের মধ্যে, অসহায়তার মধ্যে যে স্পর্ধা লুকিয়ে থাকতে পারে, এবং সে যে নিজের দুঃখের কাছে নত হবার একরকম অভিশাপই দিয়ে যেতে পারে পৃথিবীকে, সে-ধারণা আমার ছিল না। হলো। এই একটি কবিতা পড়ে হলো। আর তারপর থেকে, কে জানে কত-না বার আমি এই কবিতার কাছে ফিরে ফিরে গেছি, আজও যাই। বয়স যত বেড়েছে, তত জীবন বদলেছে আমার, সকলেরই মতো। কিন্তু এই কবিতার হাত-ধরা কখনও বদলে যায়নি, বদলে যায়নি তার উপহার দেওয়া পরাজয়ের জোর। তাই আজ, এই কবিতার সামনে, আমার ঋণের খানিকটা নামিয়ে রাখলাম…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র