ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সুলভ শৌচালয়


    অমিতাভ মালাকার (February 11, 2023)
     

    নেপালগঞ্জে কাজ থাকলে সোজা হাবিবপুর বাইপাস না ধরে কামারহাটি ফেলে সেই অনেকখানি উজিয়ে লক্ষ্মীর মোড়, নতুন পল্লি, কেশবপুর ছাড়িয়ে চালতাবাজার পেরিয়েই যেত বাপি। এমনকী বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা রোদে, পিচ-গলা গরমের দুপুরেও।  হরিতলার মোড়ে বাইক থেকে নেমে নতুন সুলভ শৌচালয়টায় একবার না ঢুকলে মনে হত সারাটা দিন বৃথা গেল। সবসময় যে ‘পেয়েছে’ বলেই ‘ঢুকেছে’ তা নয়। এমনও হয়েছে, সন্ধ্যার ফুরফুরে হাওয়ায় বাইকের সিটে বসে এক পাঁইট রাম আর কোকের বোতল খালি করা সত্ত্বেও প্যান্টের জিপার খুলে সামনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে বহুক্ষণ – আর তারপরও হিসি না করেই ফের চেন লাগিয়ে বেরিয়ে এসেছে। যে ছেলেটা পয়সা গোনে, সে বেশ সরল। বাঁহাতে কুঁচকি চুলকোতে চুলকোতে বলেছে ‘বিশ্বাসদাও সেদিন আধ ঘন্টা দাঁড়িয়েছিল, একফোঁটা হল না। ভগবানের মার। ঘুসের পয়সায় দোতালা তিনতালা হয়, কিন্তু ইসে? উঁহু! তা সে আপনি যে-ই হোন, হলে হবে, না হলে হবে না। বিশ্বাসদার কষ্ট দেখলে আপনার ইসে ফেটে …।’

    ‘কী করে জানলে বিশ্বাসদার ইসে হয়নি?’ মাথায় হেলমেট গলিয়ে বাপি আলগোছে জিজ্ঞেস করল।

    ‘হলে নল দিয়ে জল যাওয়ার কলকল আওয়াজ পাই। ভাবছেন চুপ করে বসে থাকি, কোনও কাজ নেই, আরামের চাকরি?!’ ভুরু কুঁচকে বাপিকে সরাসরি দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানায় ছেলেটা। ‘উঁহু। আপনারা শিক্ষিত লোক, অপরাধ নেবেন না, সবাই করে বেরিয়ে যাবে, দায়িত্ব নিতে হয় আমাকে… চোখ কান খোলা না রাখলেই বিলা। সেদিন একটা শুড্ডা মাল মাগি নিয়ে সোজা লেডিসে ঢুকছিল… খপ করে ধরলাম…’

    খপ করে কী ধরল ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়ে বাপি, বাকিটা শোনবার চেষ্টাও করে না। বাইরে চোখ ঝলসে যাওয়া রোদের পানে তাকিয়ে ইম্পোর্টেড সানগ্লাসটা ঠিক করে বসিয়ে নেয় নাকের ওপর – মেজদা বছর তিনেক আগে এনে দিয়েছিল দুবাই থেকে। তারপর কী যেন ভেবে ছেলেটির দিকে না তাকিয়েই তার উদ্যাম বাক্যস্রোত মাঝপথে কেটে ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে, ‘এই জায়গাটার এগজ্যাক্ট নামটা কী বল তো?’

    বাপির গলায় কী একটা আছে, যে কারণে ও কথা শুরু করলে চারপাশে সকলে চুপ করে যায়। এটা ও খেয়াল করেছে। বাপি এমনিতে শান্তিপ্রিয়। টেকো বস, মিসেস মণ্ডলের পাছায় হাত বোলাচ্ছিল দুপুরে লাঞ্চ-আওয়ারের বদলে বেটাইমে, একেবারে সকাল-সকাল। বাপি দরজায় নক না করে ঘরে ঢুকে পড়ায় ‘তোমরা মিনিমাম ভদ্রতাটুকুও শেখো না’ থেকে  ‘বিদেশ হলে তোমাকে সাসপেন্ড…’ অবধি পৌঁছোতে মিনিট দেড়েক সময় নিল। ততক্ষণে মিসেস মণ্ডল শাড়ি সামলে খুব ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে ভাব দেখিয়ে হাওয়া। দরজা বন্ধ হতে টেকো ফের ‘তোমাদের জেনারেশন’ বলে লেকচার শুরু করতেই বাপি খুব শান্ত গলায় বললে, ‘আগামী হপ্তায় তিনদিন ছুটি নেব স্যার।’ বস সেই যে চুপ করেছে, দেড়মাস একটাও কথা বলেনি। পাড়ার ক্লাবের বাৎসরিক ঝামেলায় দু’দল মারমুখী ক্ষিপ্ত পাবলিকও সাময়িক ভাবে হাতাহাতি খিস্তি থামিয়েছে ও কথা বলতে শুরু করলে। চেঁচাতে হয় না, হাত পা নাড়তে হয় না – ধমকে গালিগালাজের দিকই মাড়ায় না কনভেন্টে পড়া সরকারি কর্মচারীর একমাত্র সন্তানটি। বাকি লোকগুলো ‘জাস্ট নেই’ ধরে নিয়ে, যা বলার বলে চলে বেশিরভাগ সময় মাথা নিচু করে। তাতেই কাজ হয়। কতবার সকালে স্নান সেরে আয়নায় চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে প্রায় ফিসফিস করে নিজের প্রচ্ছায়ার চোখে চোখ রেখে বলেছে ‘ভাত বেড়ে যা বলার শর্টে বলো, এত আলোচনার সময় নেই।’ নিমেষে শিখার কথা বন্ধ হয়ে গেছে। অবাক হয়ে বাপির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিরেছে রান্নাঘরে, আর তারপর একতলায় সুবলদার সঙ্গে দিনের দ্বিতীয় সিগারেট ফুঁকে বাইক স্টার্ট দেওয়া অবধি কেবল বাসনপত্রের টুংটাং। বাপিদের পাড়াটা শান্ত, দুপুরের দিকে কয়েকটা ফেরিওলার হাঁক ছাড়া কোথাও কোনও আওয়াজ শোনা যায়না। ফ্ল্যাটগুলোতে বাচ্চাও নেই যে ছুটির দিনে ক্রিকেট ফুটবল খেলবে। 

    সুলভের ছেলেটিও কথার তোড় থামিয়ে হঠাৎই ভয়ানক অবাক হয়ে তেলচিটে চট বিছানো বেঞ্চি থেকে ওপরে তাকিয়ে বাপির সানগ্লাসাচ্ছাদিত চোখ খুঁজে ওই প্রশ্নের অর্থ বোঝার চেষ্টা করে। ইম্পোর্টেড কাঁচ থেকে নিজের দুখানা ঈষৎ বিকৃত, হাঁ-করা ঘোলাটে ছায়া তার দিকে তাকিয়ে এদিক ওদিক ঘাড় নাড়ে। বিশ্বাসদা নামক এক বিপন্ন বৃদ্ধের ‘পোস্টারের’ সমস্যা থেকে হিসু না হওয়ার যন্ত্রণা, এবং মেহনতি মানুষের জীবনযুদ্ধে জয়লাভের গোটা আখ্যানটিই তার আগাগোড়া মুখস্থ ছিল। দশ সেকেন্ড আগেও ছিল, এ বিষয়ে সে এখনও নিশ্চিত। ব্লিচিং পাউডার এবং অ্যাসিডের জমাট গন্ধে থম মেরে থাকা এই গ্লেজড টাইলসের জগতে ‘পোস্টার থেকে হাইড্ডোসিল’ অবধি সবটাই ‘বিচি-ফোলা কেস’, যৌনসুখ থেকে সন্তানধারণ ‘মাগিবাজির পোবলেম’ এবং ‘গাঁজা, মদ, পাতা থেকে পুলিশ’ অবধি সব, সব, সবটাই ‘চুতিয়া মার্কা জীবনের ফালতু বখেড়া।’ বাপির পিন-পয়েন্ট প্রশ্নে আজ হঠাৎ সে আখ্যানের মাঝপথে বেখাপ্পা রকম ছেদ পড়ায় ছেলেটার ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান জুড়ে পূর্বনিয়ন্ত্রিত গতিতে বয়ে চলা সরলরৈখিক চিন্তাস্রোতটি পূর্বনির্দিষ্ট লক্ষ হারিয়ে মহাশূন্যে ডিগবাজি খেয়ে বেড়াতে লাগল। সে অনন্ত বিস্তৃতির অনেকখানিই বাসি কচুরি এবং ছোলার ডালের মিহি গন্ধযুক্ত গাঁজার ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ ছিল, ফলে পরিষ্কার পথ চিনে পূর্ববৎ শক্ত জমিতে ফেরা বেশ মুশকিল শুধু নয়, নার্ভাসনেসের কারণে একাদিক্রমে তিন চারটে চোঁয়া ঢেকুর ওঠায় অসম্ভব প্রমাণিত হল। অতএব সে থতমত খেয়ে তোতলাতে থাকে। এই সুযোগে বাপি চট করে একটা দু’টাকার কয়েন টেবিলে ছুড়ে দিয়ে প্রায় একই অ্যাকশনে একটি একটাকার কয়েন তুলে দু’আঙুলে অসম্ভব দক্ষতায় বারংবার ভ্যানিশ করার খেলা দেখাতে দেখাতে বলে, ‘চড়মুড়ির খোলা, তাই না? খালের ওপারটাকে চড়মুড়ি বলো না তোমরা? খুব অ্যাকশন হয়। সেদিনও দুটো লাশ পড়ল। পুরোটাই কলোনি।’

    লোকটা মনে হয় সামনের ছেলেটার কাছে কমপ্লেন করছিল। বাপি পাত্তা দেয়নি। কিছুদিনের মধ্যে ছেলেটাও পাত্তা দেওয়া বন্ধ করল। কেবল কাস্টমার ঢুকলে বলে দিত, ‘ওপাশে একটা পাগলা দাঁড়িয়ে আছে, যা বলে বলুক, মাইন্ড করবেন না।’ অনেকে এ কথা শুনে অ্যাবাউট টার্ন মেরে রাস্তার অন্য ফুটে পানের দোকানের পিছনে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দাঁড়িয়ে পড়েছে – ‘ফালতু রিস্ক নিয়ে লাভ নেই, কামড়ে দিলে আর দেখতে হবে না মশাই!’

    বাপি খালের ওপারটা জানলা দিয়ে বেশ করে খুঁটিয়ে দেখেছে। পর্যবেক্ষণ করেছেই বরং বলা যাক। শৌচালয়টি যে-ই বানিয়ে থাকুক, হিসু করতে দাঁড়ালে সামনের দেওয়ালে বুক থেকে মাথা ছাড়িয়ে হাতখানেক শিক দেওয়া জানলার পরিকল্পনাটা জব্বর। বাপি প্রথম দিনই ‘বাঃ’ বলে উঠেছে আপনমনে। তারপর বাইরে থেকে হঠাৎ ঝোড়ো বাতাস ঢুকে তার চুল এলোমেলো করে দিয়ে গেলে বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে চিরুনি বের করার বদলে দেওয়ালে ভর দিয়ে, ধীরেসুস্থে বাক্সের গায়ে দেশলাই-কাঠি আলতো ঠুকে, ওষ্ঠাধরের মাঝে আলগোছে ধরে রাখা প্রথম চুমুর মতো আধঝোলা সিগারেটটা ধরিয়ে, লম্বা শ্বাসে বুক ভরে ধোঁয়া টেনে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে সব কাজের শেষে নদীর পারে এসে পৌঁছনো মানুষের মতো।  মন্থর গতিতে বয়ে চলা কালো জলের ওপারটায় সরু ইটের রাস্তা নাগরিক সভ্যতার প্রাথমিক প্রমাণ। তারপর টালির চাল আর দরমার নিস্তরঙ্গ বাংলাদেশ। দু’একটা লাথখোর বেড়ার গায়ে মেলা পুরনো ছেঁড়া তোশক পাহারা দেয় সারাদিন উবু হয়ে বসে। ‘বালের তোশক’, আপনমনে বেশ জোরেই হেঁকে ওঠে বাপি। 

    ‘কিছু বললেন?’ পাশের লোকটা ভুরু কুঁচকে খিঁচিয়ে উঠল। 

    ‘বললাম বালের তোশক।’ বাপি লোকটার দিক না তাকিয়েই জবাব দিল।

    লোকটা মনে হয় সামনের ছেলেটার কাছে কমপ্লেন করছিল। বাপি পাত্তা দেয়নি। কিছুদিনের মধ্যে ছেলেটাও পাত্তা দেওয়া বন্ধ করল। কেবল কাস্টমার ঢুকলে বলে দিত, ‘ওপাশে একটা পাগলা দাঁড়িয়ে আছে, যা বলে বলুক, মাইন্ড করবেন না।’ অনেকে এ কথা শুনে অ্যাবাউট টার্ন মেরে রাস্তার অন্য ফুটে পানের দোকানের পিছনে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দাঁড়িয়ে পড়েছে – ‘ফালতু রিস্ক নিয়ে লাভ নেই, কামড়ে দিলে আর দেখতে হবে না মশাই!’ কেউ কেউ আবার সাহস সঞ্চয় করে খানিকটা এগিয়েও চেন খোলার বদলে সেফ ডিস্ট্যান্স থেকে বাপিকে আপাদমস্তক মেপে নিত আগে। বাপি ব্যপারটা বুঝতে পেরে প্রথম প্রথম তাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে সাহস জোগানো স্বরে বলত ‘আসুন, ভয় কী?’ তাতেও লোকে অ্যাবাউট টার্ন মেরেছে – ‘কী জানি বাবা কেন ডাকছে!’  

    কিছুদিনের মধ্যে অবশ্য বাপি এদিক-ওদিক তাকানো বন্ধ করে দিল। এই সব সস্তা, ফালতু, পচা জীবনের হাসি, কান্না, ভয়, ভালবাসার আকর্ষণ তার কাছে মিথ্যে বলে মনে হতে থাকে। এদের ঝগড়া, ভাব, বৈচিত্রহীন মারামারি, অযথা উল্লাসে ফেটে পড়া থেকে ক্লান্ত শরীরটাকে এই জানলার সামনে একবার হিঁচড়ে এনে ফেলতে পারলেই সে মুক্ত। খালের ওপারে শান্ত একটা জীবন শুরু হয় প্রতিদিন সকালে – না কি সে এসে দাঁড়ানো অবধি সবটা চুপ মেরে অপেক্ষা করে থাকে, কে জানে। জানলার গরাদ ধরে দাঁড়ালে যেন বা সাড়া পড়ে যায় ওপারের আলো, হাওয়া, ছাদের ওপর লাফিয়ে বেড়ানো শালিক, চড়াই, কাঠবেড়ালিদের মধ্যে। বাঁক কাঁধে ডান দিক থেকে বাঁদিকে একটা লম্বা-মতো লোক যেতে না যেতেই মই ঘাড়ে দুটো লোক গল্প করতে করতে হাজির। রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েই সিলভারের কৌটো থেকে পান বের করে মুখে দেয় তারা। সাইকেল ঠেলে প্লাস্টিকের হরেক মাল বেচা একটা ফেরিওলা চেঁচিয়ে পসরা বিক্রির প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যায়– গরিব, ঘর থেকে বেরতে ভয় খাওয়া মহিলাদের সবকিছুতেই আশ্চর্য হওয়ার অকল্পনীয় ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে।  এপার থেকে বুড়োটার হাত-পা নাড়া, কপাল চাপড়ে অদৃষ্টের ফের সম্বন্ধীয় গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণের কালে অদ্ভুত রকম মুখব্যাদান ইত্যাদি সবটাই দেখা যায়, কথা শোনা যায় না কেবল। বাপি ওকে ভেঙিয়ে হাত-পা নাড়ে, নিজের ক্লায়েন্টদের ইনশিওরেন্স বিক্রির সময় অমন ভঙ্গিতে কথা বললে কেমন হয় ভেবে হেসে ওঠে হো-হো করে। তারপর পাশের খোপ থেকে ভয়ে, বিষ্ময়ে প্রায় নিথর, চোখ গোল-গোল করে চেয়ে থাকা এক গরিব মুটেকে আশ্বস্ত করার জন্যই বলে, ‘ও কিছু নয়।’ লোকটি এই আশ্বাসবাণীর ওপর খুব একটা ভরসা করতে পারেনি সেটা ওর একপাশে রাখা ঝাঁকাটি তুলে প্রায় দৌড়ে বেড়িয়ে যাওয়া থেকেই বোঝা যায়। বাপি আরও প্রায় দশ মিনিট হেসেই চলে কাউকে পাত্তা না দিয়ে। ছেলেটা বার দুয়েক ‘অ্যালাউ নেই স্যার’ বলে চুপ করে গেছে। বাপি আরও একটা সিগারেট ধরায়। তারপর মনে মনে হিসেব কষে রাখে, এখানে এলে যথেষ্ট সিগারেট থাকতে হবে। দেশলাইও।  

    বাপি ভিতরে থাকলে বেঞ্চি থেকে ঝুঁকে পড়ে ছেলেটা বার কয়েক এমনি এমনিই ‘অ্যালাউ নেই স্যার’ বলে নেয়। এটা যেন ওর ডিউটি। সেদিন বেরোনোর সময় বাপির মনে হল ছেলেটা ঘুমোচ্ছে। অনেকটা নামাজ পড়ার ভঙ্গিতে অদ্ভুত রকম ঝুঁকে পড়েছে শরীরটা সামনের দিকে, হাতদুটো কোলের ওপর জড়ো করা, ঠিক যেরকম রাখাটা নিয়ম ছিল স্কুলে যাওয়ার আগে মা খাইয়ে দেওয়ার সময়।

    ওপারে মাঝে মাঝে এক-আধটা ঘোমটা-টানা বউ বেরোয় ঝুপড়ির সামনে অপ্রশস্ত উঠোনে। ওই সব দিনে বাপি হাতের বাকি কাজ ক্যানসেল করে দেয়। মন দিয়ে দ্যাখে মেয়েদের শাড়ি পরার ধরন, তারা কেমন মুখের ঘাম আঁচলে মুছে খালিপায়ে জলের বালতি হাতে হেঁটেচলে বেড়ায়, দানা দেয় ছুটে বেড়ানো মুরগিদের। মাদুরে শুকোতে দেওয়া গম, ডেলা পাকানো চাল ঝেড়েঝুড়ে তোলে বড় অ্যালুমিনিয়ামের কৌটোয়, তারপর যেন বা কোনও অমঙ্গলের ইশারায় চমকে উঠে ত্রস্ত পায়ে দ্রুত ঢুকে যায় ঘরে। দোর এঁটে নীরন্ধ্র, প্রবেশাধিকারহীন এক দেওয়াল খাড়া করে, অমোঘ, অপরিবর্তনীয় অদৃষ্টের মতো। বাপি জানে সামনের ওই কুৎসিত হুড়কো, ছিটকিনি, তালা ঝোলানো কড়ার প্রতিবন্ধকতা পেরোলেই একটা বড় নিকোনো উঠোন, তারপর…তারপর আর ভাবতে পারে না। মাথার ভিতর অনেকগুলো ছবি মিলেমিশে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যায়। দাওয়া থেকে দু’ধাপ সিঁড়ি নেমে গোবর লেপা উঠোনের নির্দিষ্ট  আয়তক্ষেত্র, বাঁশের খুঁটি, লাউমাচা, অস্পষ্ট আলপনা সমেত মাথার ভিতর ধরে রাখতেই সে জেরবার হয়ে পড়ে। বেঞ্চির ওপর চট পেতে কয়েনের সাম্রাজ্য সাজিয়ে বসা ছেলেটা ভুল বকা থামিয়ে থানা, মৌজা, জেলা, পোস্টঅফিস মিলিয়ে এলাকার নামটা বলতে পারলে কি ছবিগুলো পরিষ্কার হবে? বাপি ফিরে গিয়ে দাঁড়ায় ইউরিনালের সামনে। তারপর জানলা দিয়ে ওপারে তাকিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে – ওপারে কি কেউ রেডিওয় গান চালিয়েছে? কেউ কি আমিন সায়ানির গলায় কিছু বলল? 

    বাপি ভিতরে থাকলে বেঞ্চি থেকে ঝুঁকে পড়ে ছেলেটা বার কয়েক এমনি এমনিই ‘অ্যালাউ নেই স্যার’ বলে নেয়। এটা যেন ওর ডিউটি। সেদিন বেরোনোর সময় বাপির মনে হল ছেলেটা ঘুমোচ্ছে। অনেকটা নামাজ পড়ার ভঙ্গিতে অদ্ভুত রকম ঝুঁকে পড়েছে শরীরটা সামনের দিকে, হাতদুটো কোলের ওপর জড়ো করা, ঠিক যেরকম রাখাটা নিয়ম ছিল স্কুলে যাওয়ার আগে মা খাইয়ে দেওয়ার সময়। বাইকে বসে ভিতর থেকে কিছু একটা দড়াম করে পড়ার আওয়াজ কানে এল। একটু দাঁড়িয়ে গেলে ছেলেটার ডিগবাজি খেয়ে পড়ার অসম্ভব কমিকাল দৃশ্যটি দেখার সুযোগ হাতছাড়া হত না মনে করে একটু দুঃখিতই হল বাপি। তারপর মনে পড়ল, বাবা বলেছিল, ‘কখনও কিছু নিয়ে রিগ্রেট করবে না। গতস্য শোচনা নাস্তি।’ তাই হয়তো বাইকটা আলগোছে স্ট্যান্ড করে, হেলমেট খুলে, ধীরেসুস্থে স্টার্ট বন্ধ করল আবার। 

    এরকম স্টার্ট বন্ধ আগেও করেছে। দুপুরের প্রচণ্ড গরমে কখনও কাঁপুনি ধরছে সারা গায়ে। বারবার স্টার্ট বন্ধ করে ফিরে গেছে জানলাটার সামনে। কেউ আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকলে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে, জল ঢালতে বলেছে বেখেয়ালে ফ্লাশ না করেই ছিটকে বেরিয়ে যেতে উৎসুক লোকজনকে। একটাকার কয়েন টেবিলে ছুড়ে দিয়ে আগে অপ্রস্তুতরকম মুচকি হাসত ছেলেটার দিকে তাকিয়ে, আজকাল আর তার দরকার পড়ে না। শীতের ফাঁকা সন্ধ্যাগুলোয় সামনের চত্বরটা হলুদ আলোয় ভেসে থাকে। জলের বোতল ঝাঁকিয়ে কোক আর রাম বাইকের সিটে বসে চুকচুক করে মারো, আর সামনে দিয়ে ছুটে চলা গাড়ি দ্যাখো। একটা পুলিশের জিপ এসে দাঁড়ায় হপ্তায় তিন চারদিন সাতটা নাগাদ। বন্দুক কাঁধে রোগা সেপাইটা সেদিন বলছিল, ‘বড়বাবু এলে লুকিয়ে খাবেন।’ 

    বাপির মনে হয় এরকম কোথাও প্রতি সন্ধ্যায় চলে যেতে পারলে বেশ হয়। খাটিয়া কাঁধে হেঁটে হেঁটে যাবে, তারপর বেঞ্চিতে বসা ছেলেটার থেকে ঝাঁটা নিয়ে জল ছিটিয়ে সাফ করবে অনেকখানি জায়গা। প্রয়োজনের থেকে অনেকটা বেশিই সাফ করবে সে। তারপর অসম্ভব বড় দড়ি বের করে টাঙাবে একটা সরু মশারি। থলি থেকে অ্যলুমিনিয়ামের কানাউঁচু থালা বের করে সেও ওরকম ভাত মেখে খাবে খাটিয়ার পাশে বসে, হাত মুখ ধুতে যাবে দূরের কলে, ফিরে এসে গামছা মেলে দেবে মশারির দড়িতে।

    বাপি হাতের বোতল রোগাটার দিকে এগিয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘কবে আসবে বাঞ্চোদটা?’ 

    রোগাটা গলায় একবারে পোয়াটাক ঢেলে বললে, ‘ঠিক নেই। খানকির ছেলের বিয়ের জুবিলি সামনে, চার-পাঁচটা থানার সবকটা শুয়োরের বাচ্চাকে নেমন্তন্ন করেছে। মালদা থেকে দুটো মেয়ে আনছে, ডিজে নাচবে। দশ লাখ টাকা খরচা। চানাচুর নেই…?’ 

    বাপি ওর হাতে একটা বাদামের প্যাকেট আর লবণের পুরিয়া ধরিয়ে বলে, ‘আপনাদের নেমন্তন্ন করেনি?’

    ‘না দাদা, আমাদের চা সিঙারা সন্দেশ খাইয়ে ছেড়ে দিয়েছে। দুটো মালের বোতলও দিয়েছিল, নিজেরা চিকেন পকোড়া আনিয়ে নিয়েছিলাম। তবে আমরাও আমাদের কর্তব্য করেছি। একটা পাঁচ লিটারের প্রেশার কুকার গিফ্ট দিয়েছি সবাই চাঁদা তুলে। ফুলের মালা। আপনি কি রামই খান? হুইস্কি টুইস্কি চলে না?’

    রাত বাড়ে। হাইওয়ের একদম শেষপ্রান্ত থেকে একটা দাড়িওলা লোক রোজ খাটিয়া কাঁধে আলোর তলায় দেওয়াল ঘেঁষে শুতে আসে। বহু দূর থেকে দেখতে পায় ওকে বাপি। ঠিক জানে কোথায় খাটিয়া নামিয়ে বাজারের থলি থেকে প্লাস্টিকের বোতল বের করে জল ভরবে, ঘাড় মাথা মুখ ধোবে, গামছায় মুছবে ভেজা গা, তারপর ফের হাঁটা ধরবে এই হলুদ আলোর বৃত্তের পানে। বাপির মনে হয় এরকম কোথাও প্রতি সন্ধ্যায় চলে যেতে পারলে বেশ হয়। খাটিয়া কাঁধে হেঁটে হেঁটে যাবে, তারপর বেঞ্চিতে বসা ছেলেটার থেকে ঝাঁটা নিয়ে জল ছিটিয়ে সাফ করবে অনেকখানি জায়গা। প্রয়োজনের থেকে অনেকটা বেশিই সাফ করবে সে। তারপর অসম্ভব বড় দড়ি বের করে টাঙাবে একটা সরু মশারি। থলি থেকে অ্যলুমিনিয়ামের কানাউঁচু থালা বের করে সেও ওরকম ভাত মেখে খাবে খাটিয়ার পাশে বসে, হাত মুখ ধুতে যাবে দূরের কলে, ফিরে এসে গামছা মেলে দেবে মশারির দড়িতে। দড়িগুলো এতটাই দূরের খুঁটি, দেওয়ালের পেরেক, আর লাইটপোস্টে বাঁধা যে, সবটা শেষ পর্যন্ত দেখা যায় না, মনে হয় আলোর ভিতর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া সোনালি সুতোয় ঝুলে আছে মশারিটা। ছেলেটা বলছিল সারারাত রাতজাগা পাখিরা এসে বসে দড়িতে। গা পরিষ্কার করে, তারপর ভোরবেলায় ঝগড়া করে দাড়িওলার ঘুম ভাঙায়।

    সেসব দেখেনি বাপি কোনওদিন। দাড়িওলার মশারি টাঙানো শেষ হলেই সে উঠে পড়ে। আর বসতে চায় না, কেমন যেন অন্যের শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে বোধ হয়। বরং ফিরে আসে জানলাটার সামনে। ওপারে মিটমিট করে কুপির আলো। দুলে ওঠা আগুনের শিখা তুখোড় বক্সারের মতো এপাশ ওপাশ মাথা হেলিয়ে অন্ধকার থেকে নিক্ষিপ্ত অদৃশ্য প্রতিপক্ষের ঘুসি এড়িয়ে চলে ক্রমাগত, একটানা, অক্লান্ত। ল্যাম্পপোস্ট আর বিজলির তার থেকে কারা যেন প্রতি সন্ধ্যায় মাটি অবধি লম্বা সাদা কাপড় মেলে দেয়। হালকা বাতাসে সেগুলো দোলে, কখনও ফুলে ওঠে জাহাজের পালের মতো, খালের কালো জল ছুঁয়ে চাঁদের আলোয় উড়ে চলা কাফন জড়ানো রাজহাঁসের মতো দেখায় তাদের। বাপি অবাক হয়ে দ্যাখে, রাত বাড়লে তারা একে-একে মানোয়ারি জাহাজের মতো ভেসে পড়ে ঢেউ খেলানো টালির চাল পেরিয়ে, নিকোনো উঠোনের ওপর দিয়ে চোখ ঝলসে যাওয়া চাঁদের আলোয় ঝলমলে এক ভূখণ্ডের দিকে … তারপর আর ভাবতে পারে না বাপি। অত বেশি চাঁদের আলো তার পছন্দ নয়। ওপারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আলো কমানোর ব্যবস্থা করা যায় কি না, সে বিষয়টি ভেবে দেখেছে সে। একটাই সমস্যা। সারাক্ষণ মাথা নিচু করে একাগ্রচিত্তে পয়সা গুনে তুলতে ব্যস্ত ছেলেটা ওকে দেখলে হেঁড়ে গলায় বিরক্তি প্রকাশ করে আজকাল। কথায় কথায় ‘অ্যালাউ নেই’ বলাটাও অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। 

    মিসেসটি পাশের ঘরে শিখাকে বলছিল পুরী, ধৌলগিরি, কোনারক ট্রিপে ওরা কেমন জীবনে প্রথমবার সঙ্গে ফিনাইলের বোতল নিয়ে ঘুরেছিল – ‘তোমার দাদা বাস থেকে নেমে প্রথমেই যে সুলভটা পেত, সেটাকেই নিজের হাতে ফিনাইল দিয়ে পরিষ্কার করত। আমাদের তো ঝাঁটা ক্যারি করার আলাদা ব্যাগ আছে। ওয়াটারপ্রুফ।

    সেইজন্যই বাপি শৌচালয়ের চারপাশ ঘুরে খালের ওপারটা নিরীক্ষণ করার একটা সুবিধেমতো জায়গা খুঁজছিল। দিনের বেলায় কাগজকুড়ানিদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে দেখল, লাভ নেই। তাই এলাকার মানচিত্রটা ভাল করে মগজে গেঁথে ফিরে এল সন্ধের পর, জায়গাটা শুনশান হলে। শিয়ালকাঁটা, কন্টিকারি, ভ্যারেন্ডার ঝোপ ঠেলে, ভাঙা ইট, পুরোনো জমাট সিমেন্টের চাঙড় পেরিয়ে, বাতিল আসবাব, ছেঁড়া প্লাস্টিক আর দোমড়ানো টিনের স্তূপের ওপর উঠে, অন্ধকার ফুঁড়ে ওপারে তাকালেই জানলা দিয়ে দেখা পরিচিত দৃশ্য চোখে পড়বে, এ বিষয়ে বাপি একপ্রকার নিশ্চিত ছিল। অতঃপর, ধোঁয়া আর কুয়াশা ভেদ করে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে যখন ও আবিষ্কার করল যে ওপারে কিছু নেই, একেবারে কিছুই নেই, তখন ও নিজের অজান্তেই আদাড়-বাদাড় ভেঙে পাগলের মতো ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। খাল দিয়ে বয়ে চলা জলের আওয়াজকে সামনে রেখে কখনও ডানদিকে, তো কখনও বাঁদিকে ছুটে, বুকে হেঁটে, গুঁড়ি মেরে, হামলাবাজ সৈন্যের মতো নিশানার খোঁজে উঁকিঝুঁকি চালায়, ঢাল বেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ওঠে, গড়িয়ে নামে এবং মাথায় আঘাত পেয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে থাকে একা, অস্থির এক স্বপ্নের ভিতর। 

    শিখা বলেছিল ‘খেয়ে ড্রেনে পড়ে থাকার চাইতে বাড়িতে খাও। মেজদাও তো খান। আমি নাহয় পকোড়া ভেজে দেব।’ দরজা বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার আগে বাপি চাপা গলায় বলেছিল, ‘দিও।’ ভয় ছিল, বাইক স্টার্ট দিলে সুবলদা বেরিয়ে ফের হ্যাজাতে শুরু করবে আগের দিনের কেসটা নিয়ে – ‘সুলভ শৌচালয়গুলো প্রস্টিটিউশনের ডেন। সবকটা পিক-আপ পয়েন্ট। হোমোদের বৃন্দাবন। আমি কলকাতার সবকটা সুলভে গেছি, শুধু হিসি নয়, হাগুও করেছি, ইয়েস, হাগুও, এভরিডে, আস্ক মাই কোলিগস, আস্ক মাই মিসেস।’ বাপিকে দেখতে এসে খাটের পাশে মোড়া টেনে রামের গ্লাস হাতে হাগুর গল্প করতে গিয়ে উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপে ওঠে সুবলদা। মিসেসটি পাশের ঘরে শিখাকে বলছিল পুরী, ধৌলগিরি, কোনারক ট্রিপে ওরা কেমন জীবনে প্রথমবার সঙ্গে ফিনাইলের বোতল নিয়ে ঘুরেছিল – ‘তোমার দাদা বাস থেকে নেমে প্রথমেই যে সুলভটা পেত, সেটাকেই নিজের হাতে ফিনাইল দিয়ে পরিষ্কার করত। আমাদের তো ঝাঁটা ক্যারি করার আলাদা ব্যাগ আছে। ওয়াটারপ্রুফ। আজকাল তোমার দাদা যেখানে যায়, সেখানেই আগে হাগু করে ফ্রেশ হয়ে নেয়, তারপর আমরা মন্দিরে যাই। পকোড়ার ব্যাটারে শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো দিলে? গুড। আমি চিলি ফ্লেক্সও দিই। তবে তোমার দাদার আবার…।’ সুবলদা এঘর থেকে বউদির কথার মাঝখানে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘সেই আমাদের অজন্তা ইলোরা ট্রিপের গল্পটা বলো। সেই যে, আমি একটা গুহার ভিতরে অন্ধকার দেখে দুবার হাগু করলাম! জল ছিল না, তুমি মিনারেল ওয়াটার কিনে আনলে! মনে নেই? রসম আমার একদম সহ্য হয় না… একটা নতুন ডায়াপার বেরিয়েছে দেখেছ?’ কী জিনিস মাইরি! ভেতরের লাইনিংটা ইম্পোর্টেড। আমি তো আজকাল ওটা না পরে অফিস যাই না। চেয়ারে পেছন ঠেকালে মনে হয় জিনাত আমনের কোলে বসে আছি!’ সুবলদার কষ বেয়ে রাম আর চিংড়ির পকোড়ার ঈষৎ লালচে বাদামি রস গড়িয়ে নামে। বাপি চোখ বন্ধ করে প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যায় শৌচালয়ের জানালা থেকে দেখা দৃশ্যগুলোকে ফিরিয়ে আনার। মাথার ভিতরটা অদ্ভুত যন্ত্রণায় দপদপ করে। প্রায় সাতদিন পাড়ার সকলে ওকে এই একই বিষয়ে নানারকম জ্ঞান দিয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, মাথার পেল্লায় ব্যান্ডেজ, একগাদা লোক মিলে যে বেশ যাচ্ছেতাই ব্যাপার ঘটেছিল, তা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই। দোষটাও তারই। আটঘাট না বেঁধে রাতের অন্ধকারে ওভাবে আননোন টেরেনে ঝাঁপিয়ে পড়া তার একদমই উচিত হয়নি। বাপি মনে মনে একগাছি মোটা দড়ি, পাঁচ ব্যাটারির টর্চ, গামবুট, একটা পেনসিল কাটার ভাল ফোল্ডিং ছুরি আর দু’বোতল রামের হিসেব কষে রাখে মাথায়। দরকার নেই বাইরের ঝোপঝাড়ে ছুটে বেড়ানোর। রাস্তাটা সে আগে দেখতে পায়নি কেন, ভেবে অবাকই হল। ওপারের সবটা যে কেবল ওই জানলা দিয়েই দেখতে পাওয়া সম্ভব, এবং সেটা যে একেবারেই অস্বাভাবিক নয়, তাও এখন একেবারেই পরিষ্কার।  ওই জানলা দিয়েই বেরোতে হবে। প্ল্যানটা বাড়িতে খাটে শুয়ে ছকেছে গত কয়েকদিন ধরে। শিখার একটি নির্দেশেরও নড়চড় হতে দেয়নি, ছোট্ট ব্যালকনিতে বসে মাল খেয়েছে পকোড়া দিয়ে মেজদার মতো, মাথার ব্যান্ডেজ পাল্টে এসেছে মোড়ের ডিসপেনসারি থেকে একদিন অন্তর নিয়ম করে। অতঃপর…

    চোদ্দোশো সামথিং বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন বাইকারোহী পুরুষ মোকাম কলিকাতা হইতে নেপালগঞ্জের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন। পাঠকরা বুঝতেই পারছেন কার কথা বলছি। বাপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে পড়ার আগে একবারও দাঁড়ায়নি। আজ সে প্রস্তুত, মাথা পরিষ্কার। চারদিক খোলা একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে শুকনো লাড্ডু আর পাঁউরুটি দিয়ে লাঞ্চ সেরেছে, বিকেলে খাবার জন্য বাদামের প্যাকেট আছে দুটো, চার প্যাকেট সিগারেট। বেঞ্চিতে বসা ছেলেটার হাতে প্রথমেই একশোটা টাকা গুঁজে দিল। ‘রাখ। সেদিন তুই না দেখলে ঝোপের ভিতরেই মরে পড়ে থাকতাম।’ ওকে আবার ফিরে আসতে দেখে হতচকিত ছেলেটির পাশে বসে পড়ে বাপি। ‘রাম খাবি? রোজ একা খাই। ভাল্লাগে না।’ ছেলেটি উত্তর দেওয়ার আগেই দ্রুত শৌচালয়ের একদম ভিতরে ঢুকে দেখে আসে জানলাটা আগের জায়গায় আছে কি না। দেরি করে না। ছেলেটা যেন ওর অভিযানের ব্যাপারটা বুঝতে না পারে আগে থেকে। তারপর নিজের এবং ছেলেটির জন্য একের পর এক রাম ঢেলে চলে। 

    সেদিন কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে শৌচালয়ের নিস্তেজ টিউবলাইট আর হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলা গাড়ির আলোয় ফাইনার পয়েন্টগুলোকে মাথার ভিতরে সাজায় বাপি। বারবার জানালার কাছে ফিরে গিয়ে ওপারের সবটা আগের মতোই আছে সে বিষয়েও নিশ্চিত হয়ে নেয় সে। তারপর পিঠের ব্যাগ থেকে সাজসরঞ্জাম বের করে । অনেক দূরে, কোনও এক নিভৃত আবাসনের দোতলার দক্ষিণ খোলা  ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে বাসনপত্র নাড়াচাড়ার অকিঞ্চিৎকর কাজে লিপ্ত এক অতি সামান্য মহিলার কথা ভেবে তার ভয়ানক হাসি পেতে থাকে। ছেলেটার তন্দ্রা যাতে ছুটে না যায়, সেই কারণে বাপি হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে হেসে নেয় খানিকক্ষণ। তাকে সে অবস্থায় দেখে দুজন ট্যাক্সিচালক অন্য অনেকের মতো হিসি না করেই ফিরে যায়। তবে তারা সে ঘটনার কথা কাউকে জানায়নি। 

    তবে ভদ্রলোক বিবাহবার্ষিকীর আয়োজন ছেড়ে, ডেকরেটরদের চেয়ার, প্যান্ডেল, ফুলের হিসেব বোঝানোর মাঝপথে কচি স্ত্রীর একাধারে অনুনয়পূর্ণ, এবং নানাবিধ ইঙ্গতবাহী কটাক্ষ অগ্রাহ্য করে এই যে কাজের প্রতি অসীম নিষ্ঠার পরিচয় দিতে ভোররাত থেকে সুলভ শৌচালয়ে পড়ে থাকলেন, সে কথা কাঁধ থেকে হড়কে পড়া বন্দুকটা সামলাতে নাস্তানাবুদ বুড়ো সেপাইটা বারবার বলছিল।

    শৌচালয়ের পিছনের জানলার বাইরে থেকে বাপির নিথর দেহটা বের করতে পুলিশগুলোকে বিস্তর বেগ পেতে হয়েছিল। ভাঙা কাচ গেঁথে ছিল পেটে, তবে রক্তক্ষরণ নয়, গলায় ঝোলানো ‘দড়িতে ফাঁস লেগেই মৃত্যু’ বলেছিলেন বড়বাবু – আফ্রিকার জঙ্গলে অ্যাডভেঞ্চার করে বেড়ানো সাহেবদের ওই কায়দায় দড়ি ঝোলাতে দেখেছিল বাপি। তোশকের তলায় বিদেশি পর্নোগ্রাফি ম্যাগাজিনে, না কি অন্য কোথাও মনে নেই, চিতাবাঘের চামড়া জড়ানো, আধল্যাংটো মেয়ে জাপ্টে ধরা একটা শিকারির বুকে আড়াআড়ি অমন দড়ির বান্ডিল ছিল। বাপি দড়ি কিনে এনে বাড়িতে দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে সেভাবেই বান্ডিলটা ঝুলিয়ে বারকতক পরীক্ষা করে দেখেছিল নিজেকে কেমন লাগে, এবং এন্ড রেজাল্টে যে সে খুশি হয়েছিল তা তো গলায় ফাঁস লেগে রক্ত-জমাট কালচে মুখ থেকে ইয়াব্বড় জিভ বেরিয়ে থাকা দেখেই পরিষ্কার বোঝা গেছে। বড়বাবু শিকারির ব্যাপারটা জানলে হয়তো কেসটাকে ‘ফাঁস’ আখ্যা দিয়ে নিতান্ত সাধারণের স্তরে নামিয়ে আনতেন না। তবে ভদ্রলোক বিবাহবার্ষিকীর আয়োজন ছেড়ে, ডেকরেটরদের চেয়ার, প্যান্ডেল, ফুলের হিসেব বোঝানোর মাঝপথে কচি স্ত্রীর একাধারে অনুনয়পূর্ণ, এবং নানাবিধ ইঙ্গতবাহী কটাক্ষ অগ্রাহ্য করে এই যে কাজের প্রতি অসীম নিষ্ঠার পরিচয় দিতে ভোররাত থেকে সুলভ শৌচালয়ে পড়ে থাকলেন, সে কথা কাঁধ থেকে হড়কে পড়া বন্দুকটা সামলাতে নাস্তানাবুদ বুড়ো সেপাইটা বারবার বলছিল। সেটা বড়বাবু বাপির দ্বিতীয় রামের বোতলটা দেখেও পরে সেটির হাপিস হওয়া নিয়ে কোনও প্রশ্ন না তোলার কারণে কি না কে জানে। সকলেই ব্যস্ত। ভিড় জমে গেল কাকভোরেই। সমস্ত জাগতিক বিষয় সম্পূর্ণ অগ্রাহ্যপূর্বক অত যত্নের বেঞ্চি, চট, লুঙ্গির পরোয়া না করে ছেলেটা একনাগাড়ে রিপোর্টারদের বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যায় যে সে একবারটির তরেও বুঝতে পারেনি এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। ‘ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে লোহার রড আলগা করেছে স্যার, কী বলব, এত বড় হারামি। আমি তো ওদিকটায় যাই না। লোকটা মালটাল খেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত – মিথ্যে বলব না, আপনারা শিক্ষিত লোক, দাঁড়িয়ে থাকার পয়সাও দিত। আমার কোনও দোষ নেই স্যার। ওই জানলা গলে কেউ বেরোবার চেষ্টা করবে কী করে বুঝব বলুন? বাইরে দিয়েই তো যাওয়া যায়।’ প্রেস ফোটোগ্রাফারদের একজন শৌচালয়ের ছাদে ওঠে টপ অ্যাঙ্গল শট নিতে, তারপর পা পিছলে পড়ে গিয়ে আমতা-আমতা করে বলতে থাকে, ‘খুব পিছল, রুফটা ক্লিন করা দরকার।’ এসব গোবেড়েন কেস দেখে বড়বাবু রেগে গেলেও, সমবেত জনতা – যাদের বেশিরভাগই বেলচা কোদাল ঝুড়ি হাতে দিনমজুর – হাসিতে ফেটে পড়ে এবং বাকি পুলিশগুলো বারংবার লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও প্রতিবার অনেকখানি পিছিয়ে গিয়ে, ফের এগিয়ে এসে ফোটোগ্রাফারটিকে একনাগাড়ে টিটকিরি দিয়ে চলে। 

    হাওয়ায় ঝুলে থাকা লাশটা দেখে মনে হচ্ছিল, বাপি দড়িদড়া ছিঁড়ে হাওয়ায় সাঁতার কেটে ওপারে সার সার মজা দেখতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে-পুরুষদের কাছে পৌঁছোনোর শেষ একটা মরিয়া ঝাঁপ দিয়ে অন্তিম মুহূর্তের ভিতরে হঠাৎ আটকা পড়ে গেছে। যারা বডিটার পা ধরে টেনে স্ট্রেচারে এনে ফেলল, তারাই ওই আটকে পড়া মুহূর্ত থেকে বাপিকে মুক্তি দেয় এবং নতুন গামবুট, খসে পড়া ছুরি, টর্চ ইত্যাদি দেখে তার নতুন নামকরণও সেরে ফেলে – ‘শালা টারজান’। সে রাতে দাড়িওলা লোকটা খাটিয়া কাঁধে যখন ঘুমোতে এল, ততক্ষণে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়েছে, যদিও অস্বাভাবিক এই মৃত্যুর কারণে শৌচালয়টি কিছুকাল তালা-মারা থাকবে জানিয়ে সূর্য অস্ত যাওয়ার অনেক আগেই জিপ উড়িয়ে বিবাহবার্ষিকীর আয়োজনে ফিরে গেছেন বড়বাবু। তাই, শৌচালয়ের দেওয়ালের গায়ে অন্ধকার আর আলোর ভিতর মশারি খাটানো হল আগের মতোই। লোকটি হাতমুখ ধুয়ে, খাওয়াদাওয়া সেরে শুতে গেল, বরাবর যেমন যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, মশারির দড়িতে বসা পাখির কলকাকলিতে ভোরবেলায় তার ঘুম ভাঙে যথাসময়েই।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook