ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মেসির শাপমোচন


    আত্রেয় মুখোপাধ্যায় (December 30, 2022)
     

    ঘুমিয়ে আছেন লিওনেল মেসি। মাথার পাশে বালিশে সযত্নে রাখা বিশ্বকাপ। বাচ্চারা উপহার পেলে যেমন নিজেদের কাছে রাখে, কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না, ঠিক সেইরকম। ইন্টারনেটের দৌলতে ছড়িয়ে পড়েছে ছবি। দেখেছে গোটা পৃথিবী। ফুটবল-ঈশ্বরের বরপুত্রের কাছে ফুটবলের সর্বোচ্চ পুরস্কার। দেখে মোহিত আমার আপনার মতো কোটি-কোটি মানুষ। 

    বিশ্বকাপ না জিতলে মেসি সর্বকালের সেরা গণ্য হতেন না? তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি থাকত কোনও সংশয়? এত বছর ধরে আপামর বিশ্বের অসংখ্য দর্শকের মন জয় করেছেন, বর্ষসেরা ফুটবলারের মুকুট জিতেছেন সাতবার, ক্লাব পর্যায়ে কোনও খেতাব অধরা নয়। জিতেছেন কোপা আমেরিকা। তা সত্ত্বেও থাকত সন্দেহ? বলা যেত, মেসি আপনি চিরশ্রেষ্ঠ নন? উত্তর হ্যাঁ এবং না।

    হ্যাঁ, কারণ, বলা হত আপনি বিশেষ ঠিকই, কিন্তু আপনার হাতে সেই বিশেষ পুরস্কারটা নেই। আপনি হৃদয় জিতেছেন, জয় করেছেন অন্যান্য অনেক কিছু, আনন্দ বিলিয়েছেন বিস্তর। খ্যাতি, বৈভব, কোনো কিছুরই অভাব নেই। তবু, আপনার হাতে নেই বিশ্বকাপ। যেটা ছাড়া, আপনার কেরিয়ার খানিকটা হলেও অসম্পূর্ণ থেকে যেত। কথা হত, মেসি সব পেয়েছে, পায়নি শুধু ওই দারুন দেখতে ট্রফিটা। কোথাও একটা, খানিক চোনা থেকে যেত বোধহয়।

    না, কারণ, বিশ্বকাপ না জিতলেও, মেসি থাকতেন এমন এক জায়গায়, যেটা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। অসাধারণ ফুটবল খেলেছেন, চোখে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, মন জিতেছেন এমন খেলোয়াড়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। পেলে, ফেরেঙ্ক পুস্কাস, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, ইয়োহান ক্রায়েফ, দিয়েগো মারাদোনা, জিনেদিন জিদান, রোনালডিনহো, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো এবং আরও অনেকের নাম আমাদের জানা। রীতিমতো সাড়া জাগানোর মতো ফুটবলার এঁরা বললে কম বলা হয়। প্রত্যেকেই কিংবদন্তি।

    মেসির সঙ্গে এঁদের তফাত কতদিন এঁরা খ্যাতি বা ফর্মের চূড়ায় ছিলেন, সেই নিরিখে। পেলে প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিলেন ১৯৫৮ সালে। তৃতীয়টা ১৯৭০-এ। অন্তত বারো বছর তিনি নিজের সেরা খেলা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্য যাঁদের নাম নেওয়া হল, তাঁরা অতদিন তুঙ্গে থাকেননি। রোনাল্ডো কাছাকাছি আসবেন। তবে তাঁর হাতে ওঠেনি বিশ্বকাপ। এঁরা সবাই ভীষণ ভাল খেলোয়াড়। এক একটা প্রজন্মে এঁদের মতো ফুটবলার কম আসেন। এঁদের দেখতেই উদ্বেল হয় ফুটবল-জনতা। এঁদের জন্য হয় খেলার বিপণন, মাঠ ফেটে পড়ে দর্শকে। 

    নিঃসংশয়ে বলা যায়, পেলে এবং খানিকটা রোনাল্ডো ছাড়া, মেসির মতো এত বছর ধরে এই ধরনের কর্তৃত্ব কেউ দেখাননি। প্রায় ১৭-১৮ বছর হল, এই আর্জেন্টিনীয়, সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজের জায়গা ধরে রেখেছেন। তর্ক চলতে পারে, তিনি সেরা না অন্য কেউ। মেসিকে বাদ দিয়ে এই তর্ক চলতে পারে না…

    বেশ নিঃসংশয়ে বলা যায়, পেলে এবং খানিকটা রোনাল্ডো ছাড়া, মেসির মতো এত বছর ধরে এই ধরনের কর্তৃত্ব কেউ দেখাননি। প্রায় ১৭-১৮ বছর হল, এই আর্জেন্টিনীয়, সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজের জায়গা ধরে রেখেছেন। তর্ক চলতে পারে, তিনি সেরা না অন্য কেউ। মেসিকে বাদ দিয়ে এই তর্ক চলতে পারে না। বলতে পারেন, তিনি হয়তো দ্বিতীয় বা তৃতীয় ছিলেন কোনও বছর। বলতে পারবেন না, তালিকায় বা আলোচনায় বা লড়াইয়ে তিনি ছিলেন না। তাঁকে ছাড়া, বর্ষসেরা কে, এই বিতর্ক খুব কম হয়েছে। এত বছর এই জায়গায় থাকাটাই মেসির শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। বিশ্বকাপ না জিতলেও, তিনি খুব সম্ভবত সেরাই থাকতেন।

    কাতারে বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে, খুব জোর দিয়ে বলা যাচ্ছিল না, আর্জেন্টিনা জিতবে। মেসি আছেন বটে, ডিফেন্স যথেষ্ট মজবুত কি? প্রশ্ন ছিল। সৌদি আরবের কাছে প্রথম খেলায় হার সেই সওয়াল আরও জোরদার করে দেয়। মেসি আছেন তো কী! বাদবাকি আর কী আছে? একটা প্লেয়ার নিয়ে জিতবে সব থেকে বড় খেতাব? এর থেকে বড় খোয়াব আর হতে পারে? উত্তর ছিল ‘না’। মারাদোনা পেরেছিলেন প্রায় একার দক্ষতায় বিশ্বকাপ জিততে। কিন্তু সেটা ৩৬ বছর আগে। তারপর ফুটবল অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে; এগিয়েছে ধ্যানধারণা, পালটে গিয়েছে খেলার ব্যাকরণ। পারবে আর্জেন্টিনা সেই জোর বা প্রত্যয় দেখাতে?

    এ কোন মেসি? আগে কোনওদিন তাঁকে দেখা গিয়েছে এই অবতারে? এই রূপে? এই রণংদেহী চেহারায়? প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়ে যাচ্ছেন, কটু কথা বলতে পিছপা হচ্ছেন না, নেমে আসছেন ডিফেন্স অঞ্চলে, চোয়ালে চোয়াল মিলিয়ে করছেন সংঘর্ষ। নেতৃত্ব দিচ্ছেন শুধু সামনে থেকে নয়, পিছন থেকেও। আক্রমণ ভাগের কর্ণধার তো বটেই, নিজেদের পক্ষে পেনাল্টিবক্সের সামনেও অভয় দিচ্ছেন তিনি। লড়ছেন বুক চিতিয়ে… এই মেসিকে দেখতে পাওয়া ২০২২ সালের বিশ্বকাপের অন্যতম বড় প্রাপ্তি। চরিত্র বদলে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। এই মেসিকে সম্ভবত আমরা এর আগে দেখিনিশিল্পীকে দেখেছিলাম। ডাকাবুকো, লড়াকু, ছিনিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর যেন-তেন-প্রকারেণ— এই যোদ্ধাকে দেখিনি।

    মেসি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। অবশ্যই একা নন। লড়েছেন তাঁর দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়। গোলকিপার এমিলিয়ানো মারতিনেস, ডিফেন্ডার নিকোলাস ওটামেন্দি, ফরওয়ার্ড আঙ্খেল দি মারিয়া, উঠতি তারকা এনজো মারতিনেস এবং বাদবাকি সকলে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। সংঘর্ষ চালিয়েছেন নব্বই মিনিট এবং তার বেশি। এক সেকেন্ডের জন্য খোয়াননি মনোযোগ। ক্ষণিকের ভুলচুক হলেও, তড়িৎগতিতে ফিরে এসেছেন খেলায়। প্রতিপক্ষকে দাঁত ফোটানোর সুযোগ বিশেষ দেননি। পরিচয় দিয়েছেন অনমনীয় মানসিকতার। দেখিয়েছেন শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার মনের জোর। সংঘবদ্ধ, দলগত খেলার নিদর্শন রেখেছেন বলেই তো তাঁরা জিতেছেন বিশ্বকাপ! সবাই মিলে যুদ্ধ না করলে কি আর হাতে ওঠে এই পুরস্কার!

    আসি মেসির কথায়। এর আগে, অন্তত বিশ্বকাপের প্রসঙ্গ যখন ওঠে, মনে পড়ে এক সহজসরল মানুষের ছবি। দারুন খেলতেন বেশির ভাগ সময়। কখনও-সখনও এমন কাজও করতেন, যা দেখতে বেশ সাদামাটা লাগত। যেমন, ২০১৪-র ফাইনালে জার্মানির বিরুদ্ধে গোলকিপারকে একা পেয়েও বাইরে মারা। তবে প্রায়শই, এমন-এমন ব্যাপারস্যাপার করে দেখাতেন, যা সাধারণ মানুষের কাজ নয়। ২০১৪-য় ইরানের বিরুদ্ধে গোলটা মনে আছে? ম্যাচের শেষ মুহূর্তে হাওয়ায় রামধনু আঁকা সেই ফ্রি-কিক? অবিশ্বাস্য বাঁক খাওয়ানো, গোলকিপারকে ধাঁধাঁয় ফেলা এবং খেলা জিতিয়ে দেওয়া সেই শট?

    এর পাশাপাশি, মনে পড়ছে সেই মানুষটার কথা, যিনি ভাল খেলেও হেরে যেতেন। বেশ দুঃখ-দুঃখ মুখ করে মাঠ ছাড়তেন। মনে হত, সব তিনি জিতবেন, তবে বিশ্বকাপ তাঁর অধরাই থেকে যাবে। তিনি দুর্ধর্ষ খেলবেন, অস্বাভাবিক গোল করবেন, করাবেন। এমন সব কাণ্ডকারখানা করবেন যা আমার আপনার আয়ত্বের বহু বাইরে। চিন্তারও বাইরে। তবু, যখন মোক্ষম সময় আসবে, তিনি পারবেন না। খানিকটা দলগত কারণে, খানিকটা ব্যক্তিগত খামতির জন্য হয়তো, বিশ্বকাপ তাঁর হাতে উঠবে না।

    কাতারে যাকে দেখা গেল, তিনি এক সম্পূর্ণ অ্যান্টিথেসিস। এ কোন মেসি? আগে কোনওদিন তাঁকে দেখা গিয়েছে এই অবতারে? এই রূপে? এই রণংদেহী চেহারায়? প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়ে যাচ্ছেন, কটু কথা বলতে পিছপা হচ্ছেন না, নেমে আসছেন ডিফেন্স অঞ্চলে, চোয়ালে চোয়াল মিলিয়ে করছেন সংঘর্ষ। নেতৃত্ব দিচ্ছেন শুধু সামনে থেকে নয়, পিছন থেকেও। আক্রমণ ভাগের কর্ণধার তো বটেই, নিজেদের পক্ষে পেনাল্টিবক্সের সামনেও অভয় দিচ্ছেন তিনি। লড়ছেন বুক চিতিয়ে। তাঁকে দেখে ভরসা পাচ্ছেন সহ-খেলোয়াড়েরা। 

    এই পর্যায়ের ফুটবলে, একের পর এক কঠিন দলের মুখোমুখি হয়ে জিততে গেলে, ভদ্রলোক হলে চলে না। মেসি সেটা করে দেখালেন। মোক্ষম সময়ে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে প্রমাণ করলেন, তিনি সব পারেন…

    এই মেসিকে দেখতে পাওয়া ২০২২ সালের বিশ্বকাপের অন্যতম বড় প্রাপ্তি। চরিত্র বদলে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। এই মেসিকে সম্ভবত আমরা এর আগে দেখিনি। শিল্পীকে দেখেছিলাম। ডাকাবুকো, লড়াকু, ছিনিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর যেন-তেন-প্রকারেণ— এই যোদ্ধাকে দেখিনি। প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে অঙ্গভঙ্গি করছেন, মেতে উঠছেন জান্তব উল্লাসে। এই পর্যায়ের ফুটবলে, একের পর এক কঠিন দলের মুখোমুখি হয়ে জিততে গেলে, ভদ্রলোক হলে চলে না। মেসি সেটা করে দেখালেন। মোক্ষম সময়ে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে প্রমাণ করলেন, তিনি সব পারেন। সেরার সেরা কে, আর কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না। সর্বকালের অবিসংবাদিত সেরা তিনিই। 

    মেসি বিশ্বকাপ পেলেন, না বিশ্বকাপ তাঁকে পেল, সওয়াল-জবাব জারি থাকুক।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook