১
ছবি তোলা হল না। দেখতে ব্যস্ত এত। সক্কাল ৫টা থেকে। বিছানায়। জলের ট্যাংকে বরফের সূচ। এখন সারা ব্যালকনি রোদ। বাইরে মৌটুসির ঝাঁক। বোতলব্রাশ গাছে রমরমে ফুল। এ-সমস্তকে কবিরা স্বর্গীয় বলে ডাকে। ব্রেথটেকিং। ইত্যাদি। মেনু দেখাচ্ছে এক প্লেট অনিয়ন-ফ্রিটারস, খুদে পেঁয়াজ-পকোড়া, সংখ্যায় ১০টি, ১৫০ টাকা! ম্যাগি – ১০০। এ-পাহাড়ে ইকো হয়, প্রতিধ্বনি। বুঝে উঠতে পারছি না— পেঁয়াজি হচ্ছে! বলে হাঁক পাড়ব কি না।
২
কন্যার স্বাস্থ্যরক্ষার্থে রবীন্দ্রনাথ এ-চত্বরে প্রপার্টি কিনেছিলেন। রামগড়েই। অবশ্য রথীই থেকেছেন
অধিক। টাগোর পয়েন্ট। সিন্ধিয়াদের ফলবাগান (সত্তরে রাষ্ট্রায়ত্ত)-এর পাশ দিয়েই ওঠা যায়। চলনসই রাস্তা। উঠে গেছে, পাহাড়কে বেড় দিয়ে। লি-ওয়ার্ডে খাড়া চট্টান, বিপুল লম্বা চিড়, মাঝারি দেওদার, স্যাঁতসেঁতে। জায়গায় জায়গায় আলোকেও চুঁইয়ে নামতে হয়, ধীর, অনিচ্ছুক আলো। ধ্বসের চিহ্ন, খুচরো বোল্ডার। নিস্তব্ধ। ২০ মিনিট, চড়তে চড়তে খেয়াল হয়, পাখি নেই, কূজন নেই। তেন্দুয়া আছে এ-চত্বরে, বনবিড়াল, বারাসিংগা, ফলের মরশুমে ভাল্লুক। আছে এ-বছর বৃষ্টি বেশ। ক্যাচমেন্ট থেকে জল গড়ায়। পাথরে ঘন মস। ৩.২ কিমি, হাঁটা, মেন রাস্তা থেকে। নির্জন। টাগোর টপে, এখন ভাঙা কিছু দেয়াল, আগাছা। চত্বরে খাদ্য অপশন নগণ্য। ভাবছিলুম, ঠিক কী খেতেন? দাল-চাওল, টিন্ডে কী সবজি? পানুবাবু পাশেই বসে, বল্লেন— ‘মোমো। ওনার প্রিয়তম।’ সন্দেহ প্রকাশ দেখে, খেপে উঠলেন। বললেন— ‘গান পর্যন্ত লিকে গ্যাচেন, স্তুতি, কসীদে— মোমো জীবন যৌবন, মোমো অখিল ভুবন।’ হোয়েন পানুবাবু ইজ নিয়র, থিংকিং এলাউড ইজ নট অ্যান অপশন, হায়!
৩
পঞ্চচুল্লি, ত্রিশুল, নন্দাদেবী। ভওয়ালি রেঞ্জ থেকে এঁরাই দেখা পড়ে। মানুষই এদের মনুষ্যত্ব দেয়। চরিত্র। পরিচিতের সঙ্গে সাদৃশ্য খোঁজে, ডেকে ওঠার মতো নাম। আর পাহাড়ও ত্রুটিযুক্ত হয়, গুণবাহার। ছোট্ট ছোট্ট প্রবৃত্তি তার আঁচলে জামের বনে ফল ধরায়, আড়ু, কাফল। নিবৃত্তি দেয় ধ্বসের প্ররোচনা। কে না শেষ হয়ে যেতে চায়, শেষ দেখে ফেলার আগে!
৪
ঐ যে পাহাড়। আর ত্যারছা ঢাল তার। ঢাল বেয়ে পাথর গড়িয়ে পড়ে, গাড়ির হর্ন, আফশোস, স্নেহ, কৃতজ্ঞতার মতো বিশাল চাঙড়, খুচরো থ্যাংকিউ, সন্ধ্যা নামতে থাকলে ব্লেন্ডারস প্রাইড। গ্লেন খোঁজা বারণ। ব্যাগপাইপও। ইদানীং অভ্যাস নেই। হ্যাং-ওভার হয়, অন্তত সমতলে, আজ হয়নি। ছিটেফোঁটাও। নীলকে নীল বলে ডেকে উঠলে রাগ করবে সে, এই পাহাড়ে, পিতা বলে ডাকি। পুত্র। কন্যা সবুজ স্প্রুস। আর টিলার ভিতে যে-মস, সে সোমালি। এ-চত্বরে আজ কেউ নেই। ট্যুরিস্টরা চলে গেছে, গৃহে, দীপাবলি, তাদের তুররম ঘোরা-ফেরা পাহাড়ের ঢালে ফুল হয়ে ফুটে আছে, চিপ্স-এর প্যাকেট।
৫
দেখো অন্ধের মতো। শোনো শ্রবণবিমুখ কানে। ক্ষমতাহীনের মতো টিপেটুপে ক্ষমতাকে ব্যবহার করো। আর অজস্র অর্থহীন থাকো। চিরনিত্য, তাতে অনিত্য কেন হে লাগাবে? সব কিছু অটুট থাকুক। শুধু, তুমি ঝরে যাও। অটুটের পাকস্থলিতে, অন্ত্রনালীতে, অম্লে, ক্ষারে পরিতাপহীন!
নিজেকেই বলি, মদ হও, মাতালের ভানটুকু ত্যাগ করো, সম্পূর্ণ ভরসা রাখো, কাচের বোতলে, তার নিউট্রালে। ইনার্ট আধার। মানুষের বায়াসগুলি, পক্ষপাতে পতন লাগুক।
৬
শান্তনু, পাহাড়ু, সমতলে এখন। প্রশ্ন করে, ছবিটা কোনদিকে মুখ করে তোলা? ঈশান। উত্তর-পূর্ব। উৎপল বসু হলে হয়তো পূর্বোত্তর বলতেন। আমি চটজলদি কিচ্ছু বলতে পারি না। কারণ এ-ছবির দিশা আমার সাদা-সিধে হেরে যাওয়ার দিকে। নিরাপত্তা মানুষকে বহির্মুখী করে। ক্রনিক সংকট, সারা-সমস্তকে নিজের মুখেই ফুটিয়ে তোলা। ওই আপাত-নির্বিকার পাহাড়ের মুখ, বরফ, তাতে ফাটল ধরলে নিচের যা কিছু বেরিয়ে আসবে, সংরক্ষিত এখন, এক্সপোজারের অপেক্ষায়, পচনের— সে-সমস্ত আমি। সমগ্র আমি। এ-ছবি, স্রেফ নিজের দিকে তোলা।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র