ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সমাজমাধ্যম—মূর্খ বড়, সামাজিক নয়?


    মৈত্রীশ ঘটক (October 15, 2022)
     

    এটা ঘটনা যে, নীরবই বলুন বা সরব, সাম্প্রতিককালে সমাজমাধ্যমের প্রসার বৈপ্লবিক বললে একটুও অত্যুক্তি হবে না। এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী। ডেটারিপোর্টাল সংস্থার সর্বশেষ গ্লোবাল ওভারভিউ রিপোর্ট (২০২২) থেকে জানা যাচ্ছে যে, সারা পৃথিবীতে সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৬০ কোটি, যেখানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ৮০০ কোটি। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় ৫৮% মানুষ এখন নিয়মিত সমাজমাধ্যম ব্যবহার করেন। শুধু তাই নয়, এই ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিপুল হারে বাড়ছে। যেমন, গত এক দশকেই তা তিনগুণ বেড়েছে। সমাজমাধ্যমের প্রধান যে-মঞ্চগুলো, তা ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুযায়ী সাজালে এরকম দাঁড়াচ্ছে : ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, এবং মেসেঞ্জার। এ ছাড়াও জনপ্রিয় মঞ্চগুলোর তালিকায় আছে পিন্টারেস্ট, টুইটার এবং লিঙ্কড-ইন। ভারতের ক্ষেত্রে সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৬.৭ কোটি, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এক নজরে কম মনে হলেও, ভারতে জনসংখ্যার একটা বড় অংশের মধ্যে দারিদ্র ও নিরক্ষরতার কথা ভাবলে বা এই মাধ্যমের জন্যে যে যে পরিকাঠামো আবশ্যক তার গ্রামাঞ্চলে সীমিত বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, এই সংখ্যাটা মোটেই অগ্রাহ্য করার মতো নয়। শুধু তাই নয়, ব্যবহারকারীর সংখ্যার সাম্প্রতিক বৃদ্ধির হার দেখলে গত এক বছরেই ভারতে যা বৃদ্ধির হার তা সারা পৃথিবীতে বৃদ্ধির হারের চারগুণের বেশি।  

    উপরোক্ত রিপোর্ট থেকে এও জানা যাচ্ছে যে, সারা বিশ্বে গড়ে সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীরা এই মঞ্চগুলোতে দিনে আড়াই ঘণ্টা মতো কাটাচ্ছেন, যা বছরে প্রায় পাঁচ সপ্তাহের সমান। আর যে-কোনও গড় হিসেবের মতো, এই সংখ্যাটির পেছনেও একটা বিভিন্নতার ছবি লুকিয়ে আছে— কেউ-কেউ সারাদিনের অনেকটা সময় এখানে ব্যয় করছেন। হয়তো করোনাকালের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সমাজমাধ্যমের ব্যবহার বেশি করে বাড়িয়েছে। প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারার মতো এর কিছু ভাল দিক নিশ্চয়ই যেমন আছে, আবার এই পরিসরের সমস্যাগুলো নিয়েও আমরা আগের থেকে বেশি সচেতন হচ্ছি। ঠিকই, সমাজমাধ্যমেই যখন এই সমালোচনা চোখে পড়ে তখন সেটা একটু পানশালায় মদ্যপানের কুফল নিয়ে বক্তব্য রাখার মতো মনে হয়। তাহলেও, এর ব্যাপক প্রসার এবং তার আমাদের জীবনের নানা পরিসরে প্রভাব নিয়ে একটু তলিয়ে না ভেবে ‘সমাজমাধ্যম ভাল না মন্দ’ শুধু এরকম একটা বিতর্কের মধ্যে আটকে থাকলে, সমাজ, প্রযুক্তি, অর্থনীতি আর রাজনীতির যে জটিল মিশেল সমাজমাধ্যমের উত্থান, প্রসার এবং আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ার প্রক্রিয়ার পেছনে কাজ করছে, তার চরিত্র ঠিক করে বোঝা যাবে না আর তার অবাঞ্ছিত প্রভাবগুলো নিয়ন্ত্রণও করা যাবে না। 

    ব্যক্তি, গোষ্ঠী আর সমষ্টির মধ্যে যে-আদানপ্রদানের প্রথাগত রাস্তাগুলো, সমাজমাধ্যম এক অর্থে সেগুলোর ওপর দিয়ে নতুন এক যোগাযোগব্যবস্থা এবং মিলনমঞ্চ স্থাপন করেছে। এই আপাত-গণতান্ত্রিক ও অবাধ প্রবেশাধিকারের দিকের ভাল ও মন্দ দুই দিকই আছে।  

    সমাজমাধ্যমের সে-অর্থে কোনও প্রামাণ্য সংজ্ঞা নেই, কিন্তু এর কতগুলো মূল বৈশিষ্ট্য আছে, যার থেকে একটা কাজ চালানোর মতো বর্ণনা দেওয়া যায়। স্মার্টফোন, কম্পিউটার বা ট্যাবলেট— এই নানা ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করে এবং আন্তর্জাল ভিত্তি করে এই মাধ্যমে যে-বিষয়বস্তু, তা ব্যবহারকারীরা (যা ব্যক্তি বা কোন গোষ্ঠী হতে পারে) নিজেরাই তৈরি করেন বা অন্যদের তৈরি করা বিষয়বস্তু অন্যদের সাথে ভাগ করে তার প্রচার ঘটান, এবং সেই নিয়ে আলোচনা চলে। এই যে ব্যবহারকারীদের সৃষ্টি করা বিষয়বস্তু, সেটাই সমাজমাধ্যমের বহমান উপাদান। আর, সমাজমাধ্যমের যে-কাঠামো, তা হল জালিকা বিন্যাস (নেটওয়ার্ক) ভিত্তিক— আপনি নিজের (বা ছদ্ম) পরিচিতির রেখাচিত্র তৈরি করে এখানে যোগ দিতে পারেন, এবং অন্য ব্যবহারকারী ও তাদের সামাজিক বৃত্তে প্রবেশ করতে পারেন। কার সাথে কতটা মিশবেন বা আপনার দ্বারা পরিবেশিত বিষয়বস্তু কার কতটা নাগালের মধ্যে রাখবেন, তার ওপর আপনার খানিক নিয়ন্ত্রণ থাকলেও, প্রযুক্তির কারণে আপনার দ্বারা পরিবেশিত যে-কোনও বিষয়বস্তুই যে অন্য নানা বৃত্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে (বা ক্ষেত্রবিশেষে ভাইরাল হয়ে যেতে পারে) সে-সম্ভাবনা থেকেই যায়। অর্থাৎ, ব্যক্তি, গোষ্ঠী আর সমষ্টির মধ্যে যে-আদানপ্রদানের প্রথাগত রাস্তাগুলো, সমাজমাধ্যম এক অর্থে সেগুলোর ওপর দিয়ে নতুন এক যোগাযোগব্যবস্থা এবং মিলনমঞ্চ স্থাপন করেছে। এই আপাত-গণতান্ত্রিক ও অবাধ প্রবেশাধিকারের দিকের ভাল ও মন্দ দুই দিকই আছে।  

    ব্যক্তিগত ব্যবহারকারীর দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে দেখলে এর একটা দিক হল ভোক্তা হিসেবে আমাদের চয়নের যে-পরিসর তা অনেকটা বেড়ে যাওয়া। আমরা কী পড়ব, কী শুনব, কোন আড্ডা বা কী আলোচনায় অংশগ্রহণ করব, তার ওপর আমাদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যাওয়া। আমরা সমাজমাধ্যমে যা দেখি, তা আমাদের পছন্দের ওপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নির্ভর করে— এক তো আমাদের যা ইচ্ছে সেইরকম বিষয়বস্তু আমরা দেখি, শুনি, বা পড়ি; আবার আমরা যা দেখি, শুনি বা পড়ি, তার থেকে আমাদের পছন্দ আন্দাজ করে এইসব সমাজমাধ্যমের  পেছনে যে কম্পিউটার অ্যালগোরিদম কাজ করে তাদের যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়, তার প্রভাবে সেইরকম পোস্ট আমরা বেশি করে পেতে থাকি। 

    ব্যাবেলের মিনারের মতো কোলাহলে, কোনও নির্বাচন বা গুণমান নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া না থাকলে মুড়ি আর মিছরি আলাদা করা মুশকিল হতে পারে। সেইরকম সমাজমাধ্যমে যে-রাজনৈতিক মতামত বা খবর প্রচারিত হয় (যার থেকে ‘হোয়াটস্যাপ জ্যাঠা’ বা ‘হোয়াটস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়’ কথাগুলো  এসেছে) তার মধ্যে সত্যতা কতটা আর কতটা সম্পূর্ণ মতাদর্শগত পক্ষপাতে দুষ্ট প্রোপাগান্ডা, তা অনভিজ্ঞ প্রাপকের কাছে পরিষ্কার না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। 

    এর সম্পূর্ণ উল্টো একটা উদাহরণ ভাবা যাক— ধরুন আমাদের সমস্ত খবর বা বিনোদন বা সাংস্কৃতিক চাহিদা তৃপ্ত হবার একটিই মাত্র উৎস হল কোনও একচেটিয়া সংস্থা; যেমন, আমাদের দেশে টিভি চালু হবার পর সরকারি সংস্থা ‘দূরদর্শন’ ছিল। সেখানে চয়নের স্বাধীনতা বা বক্তব্যের নিরপেক্ষতা বা ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের নিশ্চয়তা (দূরদর্শনে এক সময়ে অনেক ভাল অনুষ্ঠানের কথা মাথায় রেখেই বলছি) কোনওটাই আশা করা যায় না।  আবার উল্টোদিকটাও দেখতে হবে। অবাধ প্রবেশাধিকার এবং যে যা খুশি বলছে, লিখছে এবং তার প্রচার হচ্ছে, তার খারাপ দিকও আছে। এই প্রসঙ্গে সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু সিরিজের ‘আশ্চর্য কবিতা’ গল্পে স্কুল ইন্সপেক্টরের সামনে সব ছাত্রের চেঁচিয়ে কবিতা পড়া শোনার অত্যাচারের কথা মনে পড়ে যেতে পারে। 

    তবে এখানে মনে রাখতে হবে যে, উৎকর্ষ চিরকালই শিক্ষিত সংখ্যালঘু একটা গোষ্ঠীর চর্চার বিষয়। সংস্কৃতি হোক বা জ্ঞানচর্চা, সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা হোক বা বিতর্ক, যে-কোনও ক্ষেত্রেই এলিটদের আর আমজনতার চর্চার মধ্যে একটা বড় ফারাক চিরকালই ছিল। প্রশ্ন হল, সমাজমাধ্যম কি এই ফারাক বাড়িয়ে দিচ্ছে? ব্যাবেলের মিনারের মতো কোলাহলে, কোনও নির্বাচন বা গুণমান নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া না থাকলে মুড়ি আর মিছরি আলাদা করা মুশকিল হতে পারে। সেইরকম সমাজমাধ্যমে যে-রাজনৈতিক মতামত বা খবর প্রচারিত হয় (যার থেকে ‘হোয়াটস্যাপ জ্যাঠা’ বা ‘হোয়াটস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়’ কথাগুলো  এসেছে) তার মধ্যে সত্যতা কতটা আর কতটা সম্পূর্ণ মতাদর্শগত পক্ষপাতে দুষ্ট প্রোপাগান্ডা, তা অনভিজ্ঞ প্রাপকের কাছে পরিষ্কার না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। 

    আর নামের মধ্যে ‘সমাজ’ থাকলেও কার্যত কি এ এক নতুন নেশা, যা আমাদের আরও অসামাজিক করে তুলছে? সকল লোকের মাঝে বসে, নিজের মুদ্রাদোষে আমরা আরও একা হয়ে যাচ্ছি কি? আসক্তি থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ, মানসিক অবসাদ হওয়া স্বাভাবিক, এবং অবাধ সামাজিক আদানপ্রদানের যে অবাঞ্ছিত ও অন্ধকার দিকগুলো (যেমন, ঈর্ষা, মনোমালিন্য, মানসিক হেনস্থা), সেগুলো সারাক্ষণ বৈদ্যুতিন জানলা দিয়ে আমাদের নিজস্ব জগতে টেনে আনলে নানা মানসিক সমস্যা গুরুতর আকার নিতে পারে।  

    শুধু তাই নয়, প্রযুক্তি অনেক সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দেয় ঠিকই, কিন্তু তার সার্বিক সামাজিক প্রভাব শুধু তার প্রযুক্তিগত দিকের ওপর নির্ভর করে না। তার প্রয়োগ নির্ভর করবে ক্ষমতাসীন শক্তির কেন্দ্রগুলো— তা বাণিজ্যিকই হোক বা রাজনৈতিক— সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করবে। এই প্রযুক্তি ও তার ব্যবহার আপাতভাবে বিনামূল্যে আয়ত্ত হলেও, বড় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো সমাজমাধ্যমে মানুষের আচরণ এবং পরস্পরের সাথে আদানপ্রদান খুব মনযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে, অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছ দেখার মতো করে, এবং তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে— যার একমাত্র উদ্দেশ্য মুনাফা, সমাজকল্যাণ নয়। আপনি সম্প্রতি গুগলে কী খুঁজেছেন, ফেসবুকের পাতায় কী লিখেছেন, এবং ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কী কিনছেন, এইসব বিশ্লেষণ করেই শুধু আপনার নয়, সমাজমাধ্যমে আপনি যাদের সাথে বেশি মেশেন তাদের ফেসবুক পাতাতেও সেই অনুযায়ী বিজ্ঞাপন আসতে থাকবে।  

    রাষ্ট্রও কীভাবে এর মাধ্যমে নাগরিকদের উপর নজরদারি করার চমৎকার ও সুলভ উপায় পেয়ে গিয়েছে, সেগুলো ভুললে চলবে না। আবার, গুজব বা ভুল খবর খুব ঠান্ডা মাথায় এবং সংগঠিতভাবে ব্যবহার করে রাজনীতির পরিসরে যে-হিংসাত্মক ঘটনাগুলো ঘটছে, তা যে গণতন্ত্রের পক্ষে আশঙ্কাজনক, তা নিয়েও আজ দ্বিমত নেই।  

    ২.

    সমাজমাধ্যম হোক বা অন্য কোনও প্রযুক্তির ভাল-মন্দ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করার সময় মনে রাখতে হবে একই সাথে অনেক কিছু হচ্ছে মানে একটা একটার কারণ নাই হতে পারে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় বললে যাকে বলা হয় সহগতি বা পারম্পর্য (correlation), তার থেকে কার্যকারণ (causality) অনুমান করার অনেক সমস্যা। 

    হতেই পারে সমাজমাধ্যমের প্রসারের সাথে-সাথে কিছু সমস্যা বেড়ে গেছে, কিন্তু এই দুই প্রবণতাই অন্য কোনও কারণের উপসর্গ হতে পারে। যেমন, যে-সময়ে সমাজমাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে সেই সময় আরও অনেক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের ঢেউ দেশে ও সারা পৃথিবীতে ক্রমাগত আছড়ে পড়েছে। সারা বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে এর মধ্যে রাজনৈতিক পরিসরে দক্ষিণপন্থী জনবাদের উত্থান আছে, আর অর্থনীতির পরিসরে আর্থিক অসাম্যের আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি, ২০০৮ সালের অর্থসংকট যার অভিঘাত সারা বিশ্বের ওপর পড়েছে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং বিশ্বায়নের ফলে কাঠামোগত বেকারির সমস্যার বৃদ্ধি, এগুলো পড়বে। ভারতের ক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান আর্থিক বৃদ্ধির হার, সংগঠিত ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বেকারির সমস্যা, এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে মৌলবাদের উত্থান এবং নাগরিক পরিসরে গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর ক্রমাগত নানা আঘাত এসে পড়ার কথা সর্বজনবিদিত। এই ধরনের পরিস্থিতি এবং সেই থেকে নানা দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের প্রভাব সমাজের এবং মানুষের মনের ওপর পড়তে বাধ্য, এবং সমাজমাধ্যমের উপস্থিতি ছাড়াও তার লক্ষণ দেখা যেত। তাই, সমাজমাধ্যম কি একটি পরিসর যেখানে সামাজিক নানা প্রবণতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে, না কি সমাজমাধ্যম আমাদের বাস্তবটাকেই বিকৃত করে দিচ্ছে এবং বৃহত্তর সমাজে তার প্রতিফলন ঘটছে, সেটা আলাদা করা সোজা নয়।      

    সমাজমাধ্যমের প্রভাব বোঝার পথে আরেকটা সমস্যা হল, যাঁরা এই মাধ্যমে বেশি সময় দিচ্ছেন, তাঁদের কি কিছু প্রবণতা আছে, যা এই মাধ্যম না থাকলেও অন্যভাবে প্রকাশ পেত? যেমন, যাঁদের আসক্তির বা মানসিক অবসাদের প্রবণতা আছে, তাঁরা সমাজমাধ্যমে অনেকটা সময় দিচ্ছেন মানে এই নয় যে, সমাজমাধ্যম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলে তিনি অন্য কিছুতে আসক্ত হবেন না (যেমন, অতিরিক্ত টিভি দেখা)। অর্থাৎ, সমাজমাধ্যম ও মানসিক অসুখের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্কটা বিপরীতমুখীও হতে পারে। এর মানে এই নয় যে, সমাজমাধ্যমের উপস্থিতি এই প্রবণতাগুলো বাড়িয়ে দিতে পারে না, কিন্তু কোনটা উপসর্গ আর কোনটা কারণ সেটা নির্ধারণ করতে গেলে আরও তলিয়ে ভাবা দরকার।  

    তত্ত্ব দিয়ে এই ধাঁধার উত্তর মিলবে না, উত্তর খুঁজতে হবে তথ্যে ও পরিসংখ্যানে। কিশোরবয়স্কদের সমাজমাধ্যম ব্যবহার এবং তাদের মানসিক সমস্যা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। এখানে একটা বড় সমস্যা হল, সমীক্ষা করে যদি দেখা যায় যে যাঁরা সমাজমাধ্যম বেশি বা কম ব্যবহার করেন তাঁদের মধ্যে মানসিক সমস্যার ব্যাপ্তি বেশি বা কম, তার থেকে কোনটা কারণ আর কোনটা ফল বা দুটোই তৃতীয় কোনও কারণে হচ্ছে কি না (যেমন, পারিবারিক অশান্তি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা) সেটা অনুমান করা সোজা নয়। 

    এখন অবধি যে-গবেষণা হয়েছে, তার যে প্রণালীবদ্ধ সমীক্ষা বা সরকারি রিপোর্ট (যেমন, ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটি ফর পাবলিক হেল্‌থ, ২০১৯) সেগুলো থেকে যা জানা যাচ্ছে, তা হল এই বিষয় নিয়ে সতর্ক থাকার এবং আরও গবেষণা করার প্রয়োজন, কিন্তু কোনও কিছু মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকারক (যেমন, আসক্তিমূলক অভ্যাস) এবং তাই তাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হলে তার জন্যে যে-ধরনের জোরদার তথ্যপ্রমাণ প্রয়োজন তা এখনও পাওয়া যাচ্ছে না।  

    গুজব বা ভুল খবর আগেও ছড়াত, তাই ভেবে দেখা দরকার সমাজমাধ্যম কেন বিশেষভাবে আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম সমস্যা হল, সমাজমাধ্যমে যাই দেখা যায় তার একটা আপাত বিশ্বাসযোগ্য আঙ্গিক থাকে— ছাপা অক্ষরের এবং ছবির যে আপাতগুরুত্ব থাকে, উড়ো কথায় থাকে না। কোনটা সত্যি খবর আর কোনটা সম্পূর্ণ গুজব এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার তা বিচার করার কাজটা সোজা নয়। দ্বিতীয়ত, মানুষের মনস্তত্ত্ব এমন যে, নেতিবাচক কথা যা রাগ, ঘৃণা বা ভয় এই ধরনের আবেগকে উসকে দেয় তার বিস্তার জোট সহজে হয়; সদর্থক চিন্তা বা আবেগের ক্ষেত্রে তা হয় না।

    রাজনীতির পরিসরে বিভিন্ন দেশে সমাজমাধ্যমের প্রভাব নিয়ে যা তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তার থেকে দেখা যাচ্ছে (এই বিষয়ে ‘অ্যানুয়াল রিভিউ অফ ইকোনোমিক্স’-এ ২০২০ সালে প্রকাশিত জুরাভস্কায়া, পেট্রোভা ও এনিকোলোপভের ‘পলিটিকাল এফেক্টস অফ সোশ্যাল মিডিয়া’ নামক প্রবন্ধটি বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য) রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক ক্ষমতার অলিন্দ থেকে খবরের প্রচার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আগের থেকে অনেক কমেছে এবং ক্ষমতাসীন সরকারেরর পক্ষে অস্বস্তিকর খবর এখন চেপে রাখা অনেক শক্ত হয়ে গেছে। এর প্রভাব গণতান্ত্রিক অধিকারের বিস্তারের দিক থেকে, বিশেষত যেসব জমানায় গণতন্ত্রের ভিত নড়বড়ে, অবশ্যই ভাল। আবার নানা চরমপন্থী মতামত, ভুল খবর বা গুজব প্রচারেরও সহায়ক সমাজমাধ্যম। প্রথাগত মাধ্যমে এ-ধরনের বিষয়গুলোতে যে-সাবধানতা বা যত্ন নেওয়া হয়— নাহলে তাদের ভাবমূর্তি এবং আয়ে টান পড়বে— আন্তর্জালের ‘আমরা সবাই রাজা’ দুনিয়ায় এগুলো কাজ করে না।  

    গুজব বা ভুল খবর আগেও ছড়াত, তাই ভেবে দেখা দরকার সমাজমাধ্যম কেন বিশেষভাবে আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম সমস্যা হল, সমাজমাধ্যমে যাই দেখা যায় তার একটা আপাত বিশ্বাসযোগ্য আঙ্গিক থাকে— ছাপা অক্ষরের এবং ছবির যে আপাতগুরুত্ব থাকে, উড়ো কথায় থাকে না। কোনটা সত্যি খবর আর কোনটা সম্পূর্ণ গুজব এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার তা বিচার করার কাজটা সোজা নয়। দ্বিতীয়ত, মানুষের মনস্তত্ত্ব এমন যে, নেতিবাচক কথা যা রাগ, ঘৃণা বা ভয় এই ধরনের আবেগকে উসকে দেয় তার বিস্তার জোট সহজে হয়; সদর্থক চিন্তা বা আবেগের ক্ষেত্রে তা হয় না। তৃতীয়ত, যে-কোনও বিষয় নিয়ে তথ্যপ্রমাণ যাচাই করার যে-প্রবণতা, আমাদের মতাদর্শগত পক্ষপাতের কারণে এই ধরনের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে সেটা খানিক কম কাজ করে। চতুর্থত, সমাজমাধ্যমের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল, সমমনস্ক মানুষদের মধ্যেই মেলামেশা ও চর্চা হবার প্রবণতা থাকে, তাই তথ্য যাচাই করতে গেলে বিভিন্ন সূত্র থেকে খবরাখবর নিয়ে একটা অবস্থানে আসার যে-সম্ভাবনা, তা অনেকটাই কমে যায় এবং আমরা যে পক্ষপাতদুষ্ট একটা প্রতিধ্বনিকক্ষে আবদ্ধ আছি, সেই সচেতনতা অনেক সময়েই হারিয়ে যায়।   

    এই প্রবণতাগুলো নিয়ে বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যান থেকে যে-তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তার থেকে জানা যাচ্ছে, যে-দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নেই বা থাকলেও খানিকটা নড়বড়ে, সেখানে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হওয়ার ক্ষেত্রে সমাজমাধ্যম সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে (যেমন, মধ্যপ্রাচ্যে এবং উত্তর আফ্রিকায় যে গণতন্ত্রের সমর্থনে আন্দোলন, যাকে ‘আরব বসন্ত’ বলা হয়)। আবার দেখা যাচ্ছে, গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে দক্ষিণপন্থী জনবাদের উত্থানের ক্ষেত্রেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। 

    তবে এখানেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যে, বামপন্থী গণআন্দোলনের যে-ইতিহাস আমরা জানি, সমাজমাধ্যমের ফলে তার উত্থান বা প্রসার কেন হচ্ছে না? এর একটা সোজা উত্তর হল, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে-কায়েমি স্বার্থগুলো, তাদের হাতে সম্পদ এবং সংগঠিত হবার ক্ষমতা দুয়েরই জোর বেশি— যেমন, কিছু রাজনৈতিক দলের অনেক সম্পদপুষ্ট আইটি সেল। তাই সব মাধ্যমের মতো সমাজমাধ্যমেও তাদের প্রচার করার সুযোগ ও ক্ষমতা অনেক বেশি। তুলনায় বামপন্থী দলগুলোর পেছনে আর্থিক শক্তি কম। আর তা ছাড়া দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষদের সংঘবদ্ধ করা শক্ত, কারণ তারা সংখ্যাগুরু হলেও অনেক ছড়িয়ে আছেন, এবং তাঁদের নিজস্ব দৈনন্দিন জীবনযাপনের সংগ্রাম তাঁদের মনোযোগ অনেকটাই নিয়ে নেয় আর এছাড়া তাঁদের শিক্ষা ও আন্তর্জালে উপস্থিতিও অনেক কম। সমাজমাধ্যমের প্রচলনের আগেও ছবিটা এইরকমই ছিল, সমাজমাধ্যম এই প্রবণতাগুলোকে আরও অনেক প্রকট করে দিয়েছে। আর এও ভুললে চলবে না যে, নিরপেক্ষ না হলেও বা নানা বিকৃতি থাকলেও শেষ বিচারে সমাজমাধ্যম বাস্তব পৃথিবী থেকে বিযুক্ত নয়। বর্তমান পৃথিবীতে ঐতিহাসিক নানা কারণে বামপন্থী বা প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিগুলো দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে আর তাই আরও সমস্ত পরিসরের মতো সমাজমাধ্যমেও তা গুণগতভাবে আলাদা হবে, সেটা আশা করার কোনও কারণ নেই। সময় পাল্টালে, এই ছবিটাও পাল্টে যেতে পারে। বামপন্থী গণআন্দোলনের যে-ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তগুলো আমরা জানি, সেখানে সমাজমাধ্যমের উপস্থিতি থাকলে যে তাদের ব্যাপ্তি ও জোর অনেকটা বাড়ত সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। আবার দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোর প্রত্যাঘাতও আসত— ফলে নিট ফল কী হত, তা বলা যায় না।  

    ৩.

    তাহলে কী সিদ্ধান্তে আসা গেল? সমাজমাধ্যম সমাজেরই দর্পণ। সমাজে যা ভাল বা মন্দ, এতে তাই প্রতিফলিত হয়। সমস্যা হল, এই প্রতিফলন নিরপেক্ষ নয়। প্রযুক্তিগত কারণে কিছু প্রবণতা বেড়ে গিয়ে গুরুতর সমস্যার আকার নিতে পারে, এবং শুধু আমরা বাস্তবকে কীভাবে দেখছি শুধু তাই না, আমাদের আচরণের ওপর এর যে প্রভাব তার প্রতিফলন বাস্তবের ওপরেও পড়তে পারে। 

    এখানে কতগুলো কথা মনে রাখা দরকার। 

    প্রথমত, কোনও নতুন প্রযুক্তির প্রভাব সবার ওপরে সমান হয় না, বিভিন্ন লোকের ওপরে বিভিন্নরকম হয়। সমাজমাধ্যমের এখন অবধি যা তথ্যপ্রমাণ আছে, তাতে তার গড়পড়তা লোকের ওপর কুপ্রভাব খুব বেশি এরকম সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। কিন্তু তার মানে এই নয়, যাদের এর থেকে ক্ষতি হবার ঝুঁকি বেশি (যেমন, যাদের মানসিক স্বাস্থ্য গড়পড়তা লোকের তুলনায় কম মজবুত) তাদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনও অবকাশ নেই।  

    একই কথা খাটে বেনোজলের মতো সবার সব বিষয়ে মতামত দেওয়া বা কোনও গুণমানের বাছবিচার ছাড়াই সবার নানা শিল্প-সাহিত্য বা সাংস্কৃতিক প্রয়াস পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের সামনে বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রেও। যাঁরা পারেন তাঁরা বেছে নিয়ে যা মনোযোগের দাবি রাখে সেগুলোর ওপর মনোনিবেশ করেন। সেটা এক ধরনের সুযোগের সমতা সৃষ্টি করে— যাঁরা গুণী কিন্তু প্রতিষ্ঠিত নন, এবং বাণিজ্যিক, সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অলিন্দ থেকে দূরে, সমাজমাধ্যম তাঁদের আত্মপ্রকাশের একটা মঞ্চ তৈরি করে দেয়। এই প্রসঙ্গে বলতে পারি, বাংলা ভাষার চর্চা কমে আসা নিয়ে যে একটা পরিচিত খেদ শোনা যায়, সমাজমাধ্যমে খানিক বিচরণ করে, তা অনেকটাই অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়েছে আমার। আবার যাঁরা এই বাছাইয়ের কাজটা করতে পারেন না বা অতটা সময় দিতে রাজি নন, তাঁদের মনে হতেই পারে, গড় উৎকর্ষের অবনতির ফলে সমাজমাধ্যমের প্রসারে সার্বিকভাবে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সব পরিসরেই বিষয়বস্তু, শৈলী, নান্দনিকতা সব দিক থেকেই উৎকর্ষের অবনতি হবার আশঙ্কা থেকে যায়।   

    যাই আমাদের সামাজিক বৃত্তের প্রসার ঘটায়, তার থেকে আমাদের অনেক লাভ হয়, আবার কিছু ক্ষতিরও সম্ভাবনা থেকে যায়। যেমন বাচ্চারা যখন স্কুলে যায়, পারিবারিক বা পাড়া-প্রতিবেশীর গণ্ডি ছাড়িয়ে তারা একটা নতুন পরিসরে প্রবেশ করে। তার ভাল দিক হল শিক্ষা এবং সামাজিকীকরণ, কিন্তু তার সাথে কিছু ঝুঁকি এবং বিপদও আছে— যেমন স্কুলে সহপাঠীদের দ্বারা হেনস্থা হওয়া, অন্যদের সাথে নিজেকে তুলনা করে মানসিক অবসাদে ভোগা। তার জন্যে কিছু-কিছু শিশুর ক্ষেত্রে অবশ্যই আশঙ্কার কারণ থাকে, কিন্তু আবার তাতে শুধু মনযোগ দিলে শিক্ষাব্যবস্থাই তুলে দিতে হয়।

    দ্বিতীয়ত, যে যে গবেষণায় সমাজমাধ্যমের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কুপ্রভাব ধরা পড়ছে, সেখানেও একই সাথে কিছু আশার আলোও দেখা যাচ্ছে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ফেসবুক ব্যবহার করার প্রভাব নিয়ে একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে (ব্রাঘিয়েরি, লেভি, ও মাকারিন, ২০২২) দেখা যাচ্ছে যে, ফেসবুক ব্যবহার করার সাথে মানসিক অবসাদের উপসর্গ বাড়ার সম্ভাবনা যেমন দেখা দিচ্ছে, তেমনই যাদের মানসিক অবসাদের প্রবণতা বেশি, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সাহায্য খোঁজার সম্ভাবনা— যা একটা সদর্থক পদক্ষেপ— তাও ফেসবুক ব্যবহারের সঙ্গেই বাড়ছে। আবার যে কিশোর-কিশোরীরা তাদের নিজস্ব পরিধির মধ্যে মূলধারার বাইরে (সে তাদের সামাজিক বা রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার ধরনের জন্যেই হোক, বা তারা যদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অংশ হন, যা শুধু লিঙ্গ, বর্ণ বা ধর্ম নয়, যৌন অভিমুখিতার দিক থেকেও হতে পারে), সেখানে বৃহত্তর একটা পৃথিবী আছে, এবং সেখানে অনেক সমমনস্ক মানুষ আছে এটা জানার যে সদর্থক প্রভাব, তাতে সমাজমাধ্যমের একটা ভূমিকা থাকতে পারে, সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই এখানেও দেখা যাচ্ছে, সমাজমাধ্যমের ব্যবহার কতটা হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে, কে করছে সেটা না দেখে ভাল না মন্দ এই দ্বিত্বের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে চলবে না। 

    তৃতীয়ত, যাই আমাদের সামাজিক বৃত্তের প্রসার ঘটায়, তার থেকে আমাদের অনেক লাভ হয়, আবার কিছু ক্ষতিরও সম্ভাবনা থেকে যায়। যেমন বাচ্চারা যখন স্কুলে যায়, পারিবারিক বা পাড়া-প্রতিবেশীর গণ্ডি ছাড়িয়ে তারা একটা নতুন পরিসরে প্রবেশ করে। তার ভাল দিক হল শিক্ষা এবং সামাজিকীকরণ, কিন্তু তার সাথে কিছু ঝুঁকি এবং বিপদও আছে— যেমন স্কুলে সহপাঠীদের দ্বারা হেনস্থা হওয়া, অন্যদের সাথে নিজেকে তুলনা করে মানসিক অবসাদে ভোগা। তার জন্যে কিছু-কিছু শিশুর ক্ষেত্রে অবশ্যই আশঙ্কার কারণ থাকে, কিন্তু আবার তাতে শুধু মনযোগ দিলে শিক্ষাব্যবস্থাই তুলে দিতে হয়। তাই, সমাজমাধ্যমের খারাপ কিছু প্রভাব থাকলেও, তাকে সম্পূর্ণ বাদ দিলে যে ভাল হবে, সে-কথা বলা যায় না। 

    তাহলে করণীয় কী?   

    গণতান্ত্রিক সমাজে যাই ভাল লাগে না বা যার কুফল সম্পর্কে চিন্তার কারণ আছে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, করা কাম্যও নয়। কারো ব্যক্তিগত মতামত বা পছন্দ কী তা নিয়ে তর্ক চলে না— তা নিয়ে আমাদের নিজস্ব মতামত থাকতেই পারে, কিন্তু একই সাথে কে কী দেখবে, বলবে, বা চর্চা করবে সেটা তার ব্যাপার— সেই নিয়ে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিমত হওয়া মুশকিল। তা না হলে, অবসর সময়ে বাকিদের কী করা উচিত সেই নিয়ে ফরমান দেওয়ার অবস্থান নিতে হয়— যাকে দর্শনের পরিভাষায় অভিভাবকবাদ বা paternalism বলে— যা উদারনীতিবাদ বা liberalism-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে কাম্য নয় আর গণতান্ত্রিক সমাজে সম্ভবও নয়।   

    নতুন যে-কোনও প্রযুক্তি যখন আমাদের জীবনে প্রবেশ করে, তখন তাই নিয়ে রক্ষণশীলদের ‘গেল গেল’ বা ‘যুবসমাজ উচ্ছন্নে যাচ্ছে’ এই রব যুগে যুগে উঠেছে— নাটক-নভেলই হোক বা সিনেমা-থিয়েটার-টিভি বা আধুনিককালে সমাজমাধ্যম বা আন্তর্জাল, তার ব্যতিক্রম নয়। জুকারবার্গের অনেক আগে গুটেনবার্গের সৌজন্যে যখন প্রথম বই ছাপার প্রযুক্তি প্রচলিত হয়, সেই সময়েও এই রকম প্রতিক্রিয়ার কথা শোনা যায়। তাই আলোচনাটা কৈশোরের সেই ‘বিজ্ঞান: আশীর্বাদ না অভিশাপ’ রচনা লেখার মতো হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়, তাই ভাল না মন্দ এই দ্বিত্বের বাইরে বেরোতে হবে।  

    আন্তর্জালের বিস্তার কোনও ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়, তাই সেখানে আইনের প্রয়োগ করা সোজা নয়। আর যে-ব্যবসায়িক সংস্থাগুলো সমাজমাধ্যম পরিচালনা করে, তাঁরা কোন পোস্ট দেখতে পাচ্ছেন আর কোন পোস্ট বেশি ছড়িয়ে পড়ছে এইসব নিয়ে যে-অ্যালগোরিদম ব্যবহার করেন তাদের স্বচ্ছতা এবং এই নিয়ে এই সংস্থাগুলোর দায়বদ্ধতার প্রশ্ন  ন্যায্য কারণেই উঠছে

    আর এও মনে রাখতে হবে— ইচ্ছে করলেও ঘড়ির কাঁটা পিছনে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। আমরা ইচ্ছে করলেই সমাজমাধ্যম উধাও হয়ে যাবে না। আর সব কিছু তো আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সমাজের অন্য যে-কোনও পরিসরের মতো এখানেও যে অবাঞ্ছিত আচরণ পারস্পরিক বিনিময়ের পরিবেশটি দূষিত করে দেয়, তার বিরুদ্ধে কিছু সামাজিক আচরণবিধি ও রীতিনীতি তৈরি হওয়া প্রয়োজন। আরও এক সমস্যা হল আত্মনিয়ন্ত্রণের। যে-কোনও আসক্তিমূলক দ্রব্য বা অভ্যাসের বিপদ সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রয়োজন। 

    তবে প্রযুক্তিই হোক আর সামাজিক যে-কোনও পরিসরই হোক— তার মধ্যে পরিবারও পড়ে— সম্পূর্ণ কোনও আইন বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা যায় না। আমার মনে হয়, আসল বিষয় এটাই। 

    আন্তর্জালের পরিসরে কীভাবে এই আইন বা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োগ করা যেতে পারে তা নিয়ে অনেক বেশি ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন, কারণ প্রযুক্তিগত কারণে তা খুব সহজসাধ্য কাজ নয়। অনলাইন হেনস্থা বা অন্যান্য অসামাজিক কাজ যদি সমাজমাধ্যমের মঞ্চ ব্যবহার করে হয়, তার জন্যে আইন থাকা উচিত, আছেও (যেমন বিলেতে অনলাইন হেনস্থা শাস্তিযোগ্য অপরাধ)। তাহলেও, এখানে কতগুলো বড় সমস্যা আছে। আন্তর্জালের বিস্তার কোনও ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়, তাই সেখানে আইনের প্রয়োগ করা সোজা নয়। আর যে-ব্যবসায়িক সংস্থাগুলো সমাজমাধ্যম পরিচালনা করে, তাঁরা কোন পোস্ট দেখতে পাচ্ছেন আর কোন পোস্ট বেশি ছড়িয়ে পড়ছে এইসব নিয়ে যে-অ্যালগোরিদম ব্যবহার করেন তাদের স্বচ্ছতা এবং এই নিয়ে এই সংস্থাগুলোর দায়বদ্ধতার প্রশ্ন  ন্যায্য কারণেই উঠছে। তার ওপর এই পরিসরের সাধারণ নাগরিকদের ওপর নজরদারি করা বা প্রচারমঞ্চ হিসেবে কাজ করার ক্ষমতার সাথে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রিয় সমাজমাধ্যমগুলোর মালিকানায় তাদের একচেটিয়া ক্ষমতা মিশলে তাদের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রশক্তির সাথে যোগসাজশ করার ক্ষমতা নিয়ে আশঙ্কিত থাকার যথেষ্ট কারণ আছে। সাম্প্রতিক নানা খবর থেকে এই আশঙ্কা যে অমূলক তা মোটেই বলা যাচ্ছে না। 

    এই কারণেই, সমাজমাধ্যমের পরিসরে নজরদারি করবে যে-প্রতিষ্ঠানগুলো, তাদের নিরপেক্ষতা এবং স্বাধীনতা কীভাবে বজায় রাখা যায় এবং সার্বিকভাবে এই পরিসরকে নাগরিক সমাজের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের আওতায় কীভাবে আনা যায়, সমাজমাধ্যম ভাল না মন্দ এই নিরর্থক বিতর্ক থেকে বেরিয়ে এসে এগুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook