ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • খুচরো খাবার: পর্ব ১৪


    অর্ক দাশ (Arka Das) (October 15, 2022)
     

    ভুলে যাওয়া বিজয়া

    দশমী চলে গেলে মনটা রুকু-সুকু হয়ে ওঠে। এত বয়স হয়ে গেল, তবুও ছাতিম ফুলের গন্ধে ডিপ্রেশন বই কিছুই হয় না; গোটা শহরটা যেন থোক-থোক মনমাতানো বিষণ্ণতা নিয়েই দিন-প্রতিদিনের রুটিনে ফিরতে চায়। একটা প্রতিনিয়ত স্ট্রাগ্‌ল। 

    আমাদের বাড়িতে বহু বছর কেউ বিজয়া করতে আসেন না। অভিভাবকেরা প্রায় কেউই আর বেঁচে নেই, পরবর্তী প্রজন্মের সময় এবং অবকাশ, দুই-এরই বড় টানটান অভাব। কিন্তু স্মৃতি আছে, টুকরো-টুকরো ছাতিম ফুলের মতো। 

    একটা সময় ছিল, যখন সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে কেউ বিজয়া করতে এলে তাঁর আপ্যায়নে প্লেটভর্তি দোকানের মিষ্টি সাজিয়ে দেওয়ার চল ছিল না। বাড়িতে তৈরি কিছু না কিছু থাকত সে আপ্যায়নে, তা নিমকি হোক বা নাড়ু। উত্তর-মধ্য কলকাতার আত্মীয়ের বাড়ি হলে তো কথাই নেই; বাড়িতে তৈরি ঘুগনি (যাতে মাংসের কিমা থাকার প্রবল সম্ভাবনা) সহযোগে রেগুলেশন দ্বারিক ভীম নাগের গার্গান্টুয়ান সন্দেশের সান্ধ্য জলযোগটা প্রায় গুরুপাকের কাছাকাছি পৌঁছে যেত। বলতে গেলে, বিজয়ার তাৎপর্যই ছিল খুচরো খাবার উদযাপনে।

    সময়টাও অন্যরকম ছিল। চার পিসির শ্বশুরবাড়ি থেকে আমাদের পন্ডিতিয়া রোডের বাড়িতে বিজয়া করতে আসা মানে চারজনের জামাই আদর। সেক্ষেত্রে, যেমনটি হওয়া উচিৎ, আমাদের পরিবারের বিজয়া-আপ্যায়নের প্রধান কাণ্ডারি ছিলেন আমার ঠাকুমা। এবং তাঁর মত ছিল, বিজয়া– বা যে-কোনো লৌকিক অনুষ্ঠানের আপ্যায়নে— একটাই পদ হতে পারে: রেকাবি-ঠাসা ফুলকো লুচি। অনুষ্ঠান অনুযায়ী লুচির পার্শ্ববর্তী পদটা বদলে যেত— নবমী বা কারুর জন্মদিনে পাঁঠার মাংস, জামাই ষষ্ঠীতে চিংড়ি মাছের মালাইকারি, শ্রাদ্ধ-বাৎসরিকে কুমড়োর ছেঁচকি বা নিরামিষ লাবড়া; লক্ষ্মীপুজো এবং বিজয়ায় ছোলার ডাল বা আলুর দম, বিজয়ার ক্ষেত্রে একটা আমিষ পদ সহযোগে, যেমন মাছ বা কিমার চপ। কিছু মিষ্টি বাদে— যেমন নাড়ু বা তক্তি— বাকি পদগুলো বাড়িতেই তৈরি হত, এবং মোটামুটি ভোরবেলা থেকে সারা বাড়ি জুড়ে তোড়জোড় শুরু না করলে বিকেলের জলখাবারে এতগুলো পদ যে তৈরি হয়ে উঠতে পারত না, তা বলাই বাহুল্য। সেখানেই শেষ নয়; লুচি ইনস্ট্যান্ট ভেজে দিতে হয়, সুতরাং অতিথিরা যতক্ষণ না খেয়ে উঠছেন, কেউ না কেউ তদারকি করতে হলেও হেঁশেলে বন্দী!

    ঠাকুমার একটা অ্যাডভান্টেজ ছিল, তাঁর অবিবাহিতা মেয়েরা ছিলেন তাঁর প্রাইমারি ওয়ার্কফোর্স। পিসিদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে আর এই এলাহি বিজয়ার খাওয়া-দাওয়াটা খুব একটা দেখা যায়নি, অন্তত বাড়িতে বানানো পদের ঘনঘটায়। 

    আপ্যায়নের এই বাড়াবাড়িটার একমাত্র উত্তরাধিকার ঘটেছিল আমার ফুলপিসির ক্ষেত্রে, যার বাড়িতে নিমন্ত্রণ মানেই ছিল একটা অ্যান্ডা-গ্যান্ডাসহ সপরিবার জমায়েত। ন্যাশনাল লেভেলে টেবিল-টেনিস চ্যাম্পিয়ন সেই পিসি মোটামুটি ন্যাশনাল লেভেলের রাঁধুনি ছিলেন (এখন বয়স হয়ে গেছে তাই বেশি হাত লাগান না), এবং তাঁর বাড়িতে মিনিমাম ২৫-৩০ জনের পাত পেড়ে খাওয়াটা খুব একটা বিরল দৃশ্য ছিল না। বিজয়া উপলক্ষে তাঁর তৈরি মালপোয়া এবং নাড়ু তো দেদার খেয়েছিই, তার সঙ্গে মনে আছে পাঁঠার কিমার চপ, পুর দেওয়া কাশ্মীরি আলুর অল্প মিষ্টি দম, এবং অসামান্য সেমুই-এর পায়েস; আর লক্ষ্মীপুজোয় একটা এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল আলু-ফুলকপির ডালনা।    

    নিমকি-তক্তি-নাড়ু তো বটেই, বিজয়া স্পেশাল হিসাবে ঢাকা বিক্রমপুরের কাঠবাঙাল আমার মাতামহী এমন একটা পদ বানাতেন যা আমি আর কাউকে করতে দেখিনি— মাছের পাটিসাপটা। মিষ্টি নারকোলের পুরের বদলে রুই মাছের পুর দিয়ে তৈরি এই জিনিসটা বানাতে সময়সাপেক্ষ হলেও, বেশ কিছু একসঙ্গে বানিয়ে ফেললে ঝামেলা মিটে যায়; অতিথি এলে অল্প গরম করে খেতে দিলেই হল। 

    কল্যানীতে আমার মায়ের মামাবাড়ির পরিবারবর্গে এক সময় নিয়মিত বিজয়া করতে যাওয়ার প্রচলন ছিল, যেহেতু অরিজিনাল মামাবাড়িটা আরো বহু দূর, জলপাইগুড়ি। দিদার সঙ্গে খাদ্য প্রস্তুতিতে অদ্ভুত মিল থাকা আমার মামী-দিদাকে দেখেছি বিজয়ার সময়ে কালো জিরে দিয়ে একরাশ নিমকি বানাতে, যা বয়াম-ভর্তি করে তুলে রেখে দিলেও সপ্তাহখানেক তরতাজা থাকত। মজার ব্যাপার, দুজনের হাতের নিমকিই এক্স্যাক্টলি এক স্বাদের হত, যা উত্তর কলকাতার পিসি-ঠাকুমাদের বাড়ির স্বাদ নয়! 

    আমার ছোটবেলার বিজয়ার স্মৃতিতে স্পষ্ট কিছু ইমেজ আছে— সাদা তেল মাখানো বেলুন-চাকিতে সার-সার ময়দার পাত, যা আড়া-আড়ি কেটে নিমকি হয়ে উঠবে; পরতের পর পরত ময়দার ময়ানকে ঠেসে সূক্ষ্ম, নরম করে ছোট-ছোট কাটা কিউব, যাকে ডিপ ফ্রাই করে, চিনির রসে ডুবিয়ে ফাইনাল প্রোডাক্ট হিসাবে উঠে আসবে ছোট গজা, এবং বহু, বহু সংখ্যক নারকোল এবং গুড়ের নাড়ু, সাদা-কালো দুই-ই।

    একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর, মা’কে দেখেছি গোটা ব্যাপারটাকে একটু স্কেল ডাউন করতে। লুচি বা পাটিসাপটার ঝক্কিটা চুকিয়ে দিয়ে, মা স্মুদলি নিমকিতে শিফট করে গিয়েছিলেন। আমার ছোটবেলার বিজয়ার স্মৃতিতে স্পষ্ট কিছু ইমেজ আছে— সাদা তেল মাখানো বেলুন-চাকিতে সার-সার ময়দার পাত, যা আড়া-আড়ি কেটে নিমকি হয়ে উঠবে; পরতের পর পরত ময়দার ময়ানকে ঠেসে সূক্ষ্ম, নরম করে ছোট-ছোট কাটা কিউব, যাকে ডিপ ফ্রাই করে, চিনির রসে ডুবিয়ে ফাইনাল প্রোডাক্ট হিসাবে উঠে আসবে ছোট গজা, এবং বহু, বহু সংখ্যক নারকোল এবং গুড়ের নাড়ু, সাদা-কালো দুই-ই। আমার পছন্দ ছিল সাদা নাড়ু, যা মোটামুটি বিজয়া থেকে সরস্বতী পুজো অবধি বাড়িতে তৈরি হয়েই থাকত, এবং আমি খেয়েই যেতাম। এছাড়া থাকত তিলের নাড়ু আর তক্তি, এবং এক ধরনের মাখা সন্দেশ, দুই দিকের পরিবারেরই গুরুজনেদের থেকে শিখে মা যে-সব দিব্যি বানাতেন। 

    সবটাই বাড়িতে তৈরি খাবার নয়— আমার ছোটবেলায় ডোভার লেন-এর ফ্ল্যাটে আরো একটা স্পষ্ট স্মৃতি রয়েছে অধুনা-বিস্মৃত ‘গ্র্যানিজ’ নামে দোকানের কিমার পুর দিয়ে তৈরি বাজখাঁই শিঙাড়া, যা বিজয়া ইত্যাদি উপলক্ষে বাড়িতে এলে আমরা ছোটরাও তারিয়ে-তারিয়ে খেতাম। ‘দোকান’ বলছি, কেননা ‘গ্র্যানিজ’-কে ঠিক রেস্তোরাঁ বলা চলত না। আজকাল চারদিকে যে নানাবিধ ‘টেক-অ্যাওয়ে’ কাউন্টারের প্রচলন হয়েছেয়, ‘গ্র্যানিজ’ আদতে ছিল তাই-ই। হিন্দুস্তান রোডে হীরা-পান্না অ্যাপার্টমেন্টের গায়ে লাগানো দোকানের মালকিন, নাম-না-জানা ‘গ্র্যানি’-ও বোধহয় মনে-মনে চাইতেন খদ্দেররা খাবারটা নিয়ে সরে পড়ুক! সে যাই হোক, দোকানের সাজসজ্জা খুব সাধারণ হলেও, পণ্যটা অসাধারণ ছিল, বিশেষত ফিশ রোল এবং ওই মাংসের শিঙাড়া। ওই রকম সাইজের শিঙাড়া পরবর্তীকালে কিছু অবাঙালি দোকানে পাওয়া গেলেও, সেগুলো ছিল নিরামিষ। আর স্বাদের কথা উঠলে ‘গ্র্যানিজ’-এর সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না।  

    এত বয়েস হয়ে গেল, এখনও বিজয়ার খাওয়া-দাওয়ার কথা উঠলে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বিশাল পরিবারবর্গকে এক দালানে জড়ো করার শখ জাগে, রান্না-বান্না, ছোটদের হুটোপাটিতে সারা বাড়ি সরগরম হয়ে থাকবে, এ-রকম অলীক সম্ভাবনার কথা মনে হয়। এখনও সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখার কথা মনে পড়ে। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook