১৫ অগস্ট ভারত স্বাধীনতা অর্জন করবে— এ কথা বেশ কিছু দিন আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। ১৫ অগস্ট আসার কয়েক মাস আগে থেকেই বর্ডার পার হচ্ছিল মানুষজন। লাহৌর আর অমৃতসরের মধ্যে তখন লাশ ভর্তি ট্রেন চলাচল করত। তবু ১৪ অগস্ট দিনটায় আশ্চর্য একটা উত্তেজনা, উন্মাদনা, ছটফটানি ছিল মানুষের মধ্যে।
কেমন ছটফটানি? এই মনের মধ্যে এক এক দিন কেমন একটা গুড়গুড় করে না? কোনও কাজে মন বসে না, হঠাৎ করে কেউ দু-বার স্নান করে নেয়, কেউ একটু বেশি খেয়ে ফেলে, কেউ সাইকেল নিয়ে বাজার ঘুরে আসে ছ-বার। খামোখাই বার বার ছাদে উঠে আকাশ দেখে— সেই দিনটাও ওই রকমই ছিল। কখন আসবে, কখন আসবে থেকে ব্যাপারটা পৌঁছল ঘন্টা গোনার দিকে, তার পর মিনিট গোনার দিকে। তার পর পাঁচ, চার তিন দুই, একের শেষে যখন বিউগল বেজে উঠল রাত বারোটায়, কী যেন একটা হল চারপাশে। কেউ কেউ আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল, কেউ কারও কোলে চেপে পড়ল, কেউ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে হাওয়ায় ছুঁড়তে লাগল আর কেউ কেউ এমন কান্নায় ভেঙে পড়ল যে মনে হল, তার হৃৎপিণ্ড কেউ উপড়ে নিয়েছে। সে যেন শেষবারের মতো কাঁদছে, আর কোনও দিন চোখের জন সে ফেলবে না।
গান্ধীজী, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, তখন কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সামলাচ্ছেন। অনশনে কাটাচ্ছেন রাত। আমরা রেডিও-য় কান খাড়া করে শুনছি স্বাধীন ভারতের রূপকারের কথা। পণ্ডিত নেহরু তখন তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা দিচ্ছেন আর ধীরে ধীরে বদলের সূচনা হচ্ছে ভারতের।
তখন কী এত সব ভাল করে বুঝেছিলাম। তা বলতে পারব না। কিন্তু ওই যে স্মৃতিগুলো রয়ে গিয়েছিল, সেগুলোয় ভাবনার পলি পড়ে অনুভূতি উর্বর হয়েছে। দশকের পর দশক যখন চোখের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে, বোধের সঙ্গ নিয়ে এগিয়েছি, অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে উঠেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, তখন আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছি স্বাধীনতার মর্ম, দেশ তৈরি হওয়ার দীর্ঘ পদ্ধতি। ৭৫ বছর একটা দেশের পক্ষে এমন কিছু বয়স নয়, কিন্তু ভারতের ঐতিহ্য, তার মিলনের সংস্কৃতি এর মধ্যেই তাকে সমৃদ্ধশালী করে তুলেছে। আর দেশ তো সব সময় সুসময়ের মধ্যে দিয়ে যাবে এমন কোনও কথা নেই, দুঃসময় আসবেই, কিন্তু গেল গেল রব তুললে চলবে না। ভারতের ভিত কি এতই ঠুনকো যে অল্প দুঃসময়, মুক্তচিন্তায় বাধা পড়লেই তা ভেঙে ঝুরঝুরে হয়ে যাবে। মোটেই নয়। দেশের যেমন সমালোচনা করতে হবে, তেমনই বিশ্বাসও রাখতে হবে, কারণ কারও ভাবনাকে আটকে রাখা যায় না। আর সঠিক ভবিষ্যৎ ভাবনাকে তো নয়ই।
মন খোলা রাখলে দেশ এগোবেই।
এনসিপিএ-মুম্বই আয়োজিত ডন অ্যাট মিডনাইট অনুষ্ঠানে এমনটাই জানালেন গুলজারজী।