সুস্মিতা বলল, প্রম্পটিং লাগবে না
ওর সঙ্গে আমার দেখা হয় মোট তিনবার। তার মধ্যে প্রথমবার ঠিক মিস ইউনিভার্স হওয়ার পর পরই। আমি তখন সাংবাদিক। মাঝেমধ্যে দূরদর্শনের জন্য সাক্ষাৎকার নিই। সেই সময়ে DD অর্থাৎ সরকারি টিভিই সব। প্রদ্যোৎ সমাদ্দার অনুষ্ঠান করলে আমাকে বলতেন। এভাবেই একবার ওঁর অনুরোধে সুস্মিতা সেনের সাক্ষাৎকার নিই। সেটা ১৯৯৪ সাল। পাঁচতারা হোটেল তখন হাতে গোনা। হয় চৌরঙ্গি, নয় আলিপুর। তারই একটাতে গেলাম সদ্য বিজয়ী মিস ইউনিভার্স-এর মুখোমুখি হতে।
সুস্মিতা বাঙালি মেয়ে হলেও প্রবাসী। টকটক করে ইংরেজি বলে, বাংলা জানে কি? এই আশঙ্কা আমাদের চিরকালীন! কিন্তু সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে অষ্টাদশী স্পষ্ট বাংলায় কথা বলে সবার মন জিতে নিল। ‘বাবা তো বাঙালি, এয়ারফোর্সে থাকলেও আমরা grandparents-এর কাছে আসতাম এবং বাংলাই বলতাম ওঁদের সঙ্গে। অনেক জায়গায় ঘুরেছি, আমার উচ্চতা নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলত আর আজ সেই উচ্চতা আমার মুকুট জেতার অন্যতম কারণ।’ অকপট স্বীকারোক্তি।
আমার থেকে ও বেশ কয়েক বছরের ছোট, কিন্তু কোনওভাবেই কোনও নার্ভাসনেস নেই, আবার উন্নাসিকতার ছিটেফোঁটাও নেই। স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত। প্রথম থেকেই ওকে ভাল লেগে যায়। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি কয়েক বছর। তখন তো আর মোবাইল, ওয়্যাটস্যাপ, মেল, সোশ্যাল মিডিয়ার এত রমরমা ছিল না! সবে স্যাটেলাইট টিভি আসব-আসব করছে।
দ্বিতীয়বার দেখা হয় মুম্বইতে, ১৯৯৯ সাল নাগাদ। গিয়েছিলাম শ্রদ্ধেয় পরিচালক প্রভাত রায়ের সঙ্গে একটি বাংলা ছবিতে সুস্মিতাকে নেওয়ার জন্য। আমাদের সঙ্গে ছিলেন ছবির NRI মহিলা প্রযোজক ও তাঁরই পরিচিত সিনেমাপ্রেমী এক আইনজীবী। গল্পটি প্রযোজকের, চিত্রনাট্য প্রভাতদার লেখা। নারীকেন্দ্রিক ছবি এবং পড়ে মনে হয় সুস্মিতার জন্যই যেন লেখা। সাধারণ এক মহিলাকে কীভাবে এয়ারপোর্টে দেখে, আলাপ করে এক পরিচালক তাঁকে নায়িকা হিসেবে গড়ে তোলেন তার কাহিনি। এই মহিলা গার্হস্থ্য-হিংসার শিকার। আর পরিচালক মুম্বইয়ের এক হিরোইনের কাছে প্রত্যাখ্যাত। হিরোইন যা টাকা চান তা ছবির বাজেটের দুই তৃতীয়াংশ! তাই পরিচালক ঠিক করেন, নিজেই গড়ে তুলবেন নিজের হিরোইন।
গল্পটা নিয়ে প্রায় দু’দিন ধরে আলোচনা হয় সুস্মিতার বাড়ি কাম অফিসে। সুন্দর সাজানো স্ক্রিপ্ট-রিডিং-এর ঘর। মাটিতে গদি ও কুশন। আর্ট ডেকো হালকা ধাঁচের চেয়ার। জানলায় চিক ও পর্দা। একদিকে শেল্ফ-এ কিছু বই । মেঝেতে ডিজাইন করা শতরঞ্চি। খুবই রুচিশীল আসবাব, হালকা স্নিগ্ধ পরিবেশের মাঝে কুশন ছড়াচ্ছে রঙের ছটা। প্রভাতদা একটা চেয়ারে বসলেন। সুস্মিতা মাটিতে কুশন কোলে। চা-স্ন্যাকস সহযোগে চিত্রনাট্য পড়া, গল্প বলা চলল দু’দিন ধরে। সুস্মিতার প্রতিক্রিয়া একেবারে যথাযথ। নায়িকার প্রথম জীবনে যখন সে স্বামীর কাছে প্রতাড়িত তখন সুস্মিতার চোখে ক্ষোভ। আবার বিমানবন্দরে পরিচালকের সঙ্গে দেখা আর তার নায়িকা-বিভ্রাটের গল্প যখন সুস্মিতা শুনল, তখন তার চোখেমুখে বিস্ময়। ভাল চরিত্রের জন্য যে-কোনও শিল্পীর উচিত টাকাটা গৌণ করা। শেষে যখন নায়িকা ফিরে যায় সমাজসেবায় তাতেও সুস্মিতা উচ্ছ্বসিত। ও করবে এই চরিত্র। তার জন্য পেশাদারি কথা বলবেন ওর সেক্রেটারি ও ম্যানেজার। সুস্মিতা তাঁদের বলে দেবে টাকার অঙ্কটা যেন বুঝেশুনে বলেন।
পরদিন সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা। ‘সুস্মিতাজি নেন ৩০ লক্ষ। আমাকে বলেছেন এই চরিত্র ওঁর মনের মতো। তার উপর ইট্স আ রিজিওনাল ফিল্ম, তাই উনি নেবেন ২২।’ ১৯৯৯ সালে ভাল বাজেটের বাংলা ছবি হত ৩৫ লক্ষ টাকায়। সুস্মিতার কথা মাথায় রেখে এই ছবির জন্য বরাদ্দ ছিল ৪০ লক্ষ। কিন্তু বাজেটের অর্ধেকের বেশি ওকে দিলে ছবি হবে কীসে? সেক্রেটারিকে কম করতে বলা হলে উনি অনেক ভেবেচিন্তে, ফোন-টোন করে শেষে বললেন, ‘২০ লক্ষ। তার চেয়ে কম সম্ভবই নয়।’ আর সুস্মিতা চলে গেছে আউটডোরে। কোনওভাবেই কিছু হল না। অনেক অনুনয় করে বললাম, ‘১০ হলে আমরা পারব।’ কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। শুধু রেমুনারেশন তো নয়। সঙ্গে ওর মেক-আপ, হেয়ার স্টাইলিস্ট-এর খরচ, পাঁচতারা হোটেলে রাখা। সব মিলিয়ে আরও অনেক লাগবে। ভেবেচিন্তে দেখলাম, আমাদের পক্ষে সম্ভব না। ফলে, চিত্রনাট্যের পরিচালকের মতোই বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে হল। ছবিটা শেষে অন্য নায়িকা নিয়ে হয়েছিল এবং যথেষ্ট প্রসংশিতও হয়। ছবির নাম: ‘শেষ ঠিকানা’।
তৃতীয়বার দেখা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে। ২০০৩ সাল। ‘চোখের বালি’র শুটিং চলছে। সেই সময় মুম্বই-এর মহেশ মঞ্জরেকর-এর অফিস থেকে ফোন। মহেশ তাঁর হিন্দি ছবি ‘অস্তিত্ব’কে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় করবেন। তব্বু যে-চরিত্রে জাতীয় পুরস্কার পায়, সেই চরিত্রে অভিনয় করবে সুস্মিতা। ইংরেজি ও বাংলা দুটিতেই। ভিক্টর ব্যানার্জিও আছেন এবং তিনিই আমাকে বাংলার জন্য সহকারী হিসেবে নিতে বলেছেন। কথা হয়ে গেল। ইংরেজি চিত্রনাট্যের বাংলা করলাম আমি। পৌঁছে গেলাম নিউ জার্সি। তখনও সুস্মিতার সঙ্গে কথা হয়নি আমার। আমরা উঠলাম হলিডে ইন-এ আর সুস্মিতা ও ভিক্টর পাঁচতারায়। প্রথম দিন শুটে প্রথম দেখা সুস্মিতার সঙ্গে। ভাসা-ভাসা চিনল। তারপর বাংলা সংলাপ নিয়ে বসলাম। এক-একটা শট প্রথমে ইংরিজিতে নেওয়া হবে, তারপর বাংলা। মহেশ যেহেতু সুস্মিতার বিপরীতে অভিনয় করছিলেন, তাই আমাকে বলেছিলেন বাংলাটা প্রম্পট করে দিতে। সুস্মিতা বলল ধরিয়ে দিতে। ভিক্টরও তাই। আর মুনমুন শুনে বলল, আমাকেও।
খাবারঘরের দৃশ্য। সবাই কথা বলছে আর আমি সবাইকে প্রম্পট করে যাচ্ছি। দৃশ্যটা ঝুলে যাচ্ছে। হঠাৎ সুস্মিতা বলল, ‘আমাকে পড়তে দাও।’ রোমান অক্ষরে সংলাপ পড়ে বলল, ‘চলো আমার প্রম্পটিং লাগবে না।’ মহেশও দেখাদেখি চাগিয়ে উঠলেন, সেই সঙ্গে অন্যরাও। নিমেষের মধ্যে দৃশ্য উঠে গেল। লাঞ্চব্রেকে সুস্মিতা বলল, ‘আমাকে পরের সিনটা পড়ে দিও।’ হুড়মুড়িয়ে নিজে খেয়ে গেলাম। তখন ও স্যালাড খাচ্ছে। আমি বেরিয়ে যেতে চাইলে ও বলল, ‘খেতে-খেতেই কথা হোক।’ পড়ে দিলাম সংলাপ। দু’তিনবার। তারপর এটা-সেটা কথা। এবার ও বলল, ‘তুমি কিউ দাও, আমি আমার সংলাপ বলছি।’ একদম পারফেক্ট। অবাক হয়ে বললাম, ‘তুমি দারুণ মনে রাখো তো!’ ইংরেজিতে উত্তর: ‘When you demand a high price and you get it, then you have to be worth it!’
নিউ জার্সির শুট নির্বিঘ্নে শেষ হল। ভোর সাড়ে ছ’টায় ব্রেকফাস্ট। তারপর বাসে করে দু’ঘণ্টা পথ অতিক্রম করে লোকেশনে পৌঁছনো ন’টায়। তার আগে যাঁদের বাড়ি তাঁরা গেট খুলবেন না। আর্টিস্ট পৌঁছত ঠিক সাড়ে ন’টায়। মেক-আপ, আলো করে শুট শুরু সাড়ে দশটায়। একেবারে দেড়টা অব্দি টানা শুট। চা-কফি আর স্ন্যাকস সাজানো বুফে ধাঁচে। কাজের ফাঁকে গিয়ে খেয়ে নাও। দেড়টা থেকে দুটো দশ অব্দি লাঞ্চ। বুফে থেকে নিয়ে টেবিলে বসে খাওয়া। লাঞ্চের পর আবার আড়াইটে থেকে টানা ছ’টা পর্যন্ত শুট। ১৫ মিনিট ব্রেক নিয়ে আবার সাড়ে আটটা অবধি শুট। এরপর বাসে করে সোজা ভারতীয় রেস্তোরাঁতে ডিনার সেরে সাড়ে দশটায় ঘরে গিয়ে স্নান ও ঘুম বা টিভি দেখা। তবে আমরা তখনও মাঝে মাঝে দল বেঁধে বেরোতাম। সুস্মিতাকে বলেছিলাম একদিন আসতে, কিন্তু ও পেশাদারি অভিনেতা। শুটের মধ্যে নো অনিয়ম।
শেষদিন সবার সঙ্গে মিলেমিশে পার্টি করে সুস্মিতা। সাধারণ জিন্স ও টি-শার্ট পরনে। মেক-আপ বিহীন। তবে ঠোঁট রাঙানো। ছবির শেষ ক’দিনের শুট বাকি ছিল। মুম্বইতে ডাক পড়ল মাস দুয়েক পর। গেলাম। সুস্মিতা ঠিক ততটাই উষ্ণতা দিয়ে জড়িয়ে ধরল। রবিবার শুট নেই। বাড়িতে ডাকল। খার-এ নতুন ডুপ্লে ফ্লাট। দারুণ সাজানো। গেলাম বেড়াতে। দুপুরে একটা লঞ্চ ভাড়া করা হল । মেক-আপ ছাড়া স্বাভাবিক পোশাকে ভিড়ের মধ্যে অনায়াসে হেঁটে লাউঞ্জে উঠল বিশ্বসুন্দরী। ‘আমার স্বাভাবিক জীবন পছন্দ। তাই আমি বেরিয়ে পড়ি। মেক-আপ ছাড়া আমাকে চিনতে সময় লাগে। আমি তার মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে যাই।’
মাঝসমুদ্রে গিয়ে নামানো হল বড় টায়ার। স্কার্ট-ব্লাউজ ছেড়ে সাঁতার-বসন পরে জলে ঝাঁপ। আমাকে আশ্বাস, চলে এসো। সাঁতার-বসন নেই যখন আমার, শর্টস আর টি-শার্ট পরেই আমি ওর কথামতো জলে ঝাঁপ দিয়ে টায়ার-এ বসে ভাসতে থাকলাম। জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
ছবিদুটো কোনও কারণে শেষ হয়নি, তবে সুস্মিতা যে অন্য জাতের মহিলা তা উপলব্ধি করেছিলাম ওই শুট-এ।