অপুর সংসার’-এর বয়স ষাট বছর পেরিয়ে গিয়েছে। তাই আজ ওই ছবির শুটিং-এর একটি গোপন তথ্য ফাঁস করে দিলে বোধহয় অন্যায় হবে না! ব্যাক প্রজেকশানে শট নেওয়া হচ্ছে টাঙ্গার। অপু-অপর্ণা ভক্ত প্রহ্লাদের বায়োস্কোপ দেখে ফিরছে টাঙ্গা চড়ে। বায়োস্কোপ দেখার আমেজ ধরে রাখতে চেয়ে অপু এই বিলাসিতাটকু করেছে ট্রাম-বাসের ভিড় এড়াতে। দুজনের প্রেম-খুনসুটি মেশানো কথোপকথনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বালিকাসুলভ চাপল্যেই অপর্ণা অপুর ঠোঁটে উদ্যত সিগারেটটি জ্বালিয়ে দিতে, তার কাছে দেশলাই চায়। ব্যস, এখানেই বাঁধে গেরো! সত্যজিৎ রায় (মানিকদা) স্বপ্নেও ভাবেননি এমন সমস্যায় পড়বেন! এক, দুই, তিন— টেক-এর পর টেক চলে যাচ্ছে, দেশলাই আর আমি জ্বালিয়ে উঠতে পারছি না। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়ে মুখের অবস্থা তদৃশ! ভাবটা এমন, যেন ওটা আমার হাতেই ফেটে যাবে!
ছবিতে নির্বাচিত করার পর মানিকদার গোড়ায় অনেক চিন্তা ছিল আমাকে নিয়ে। বাংলাটা ঠিক বলতে পারব কি না, সংলাপ মনে রাখতে পারব কি না, গাঁয়ের মেয়ে হিসাবে কেমন মানাবে— ইত্যাদি। কিন্তু এমন অভিনব সমস্যার কথা উনিও ভাবেননি! শেষপর্যন্ত সমস্যার সমাধান করলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পরামর্শ দিলেন, অফ ক্যামেরা অন্য কেউ কাঠিটা জ্বালিয়ে ওর হাতে দিক। সেটাই হল। এত অপূর্বভাবে সেই শটটি নেওয়া হল, এই এত বছর পরেও কেউ বুঝতে পারেন না, দেশলাইটা আমি জ্বালাইনি।
‘অপুর সংসার’ আমার প্রথম ছবি, মানিকদার সঙ্গে প্রথম কাজ। তাই এর স্মৃতি আমার কাছে অনন্য। কতটুকুই বা বয়স ছিল আমার! দুরু দুরু বক্ষে ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। তখন তো আমি নেহাতই শিশু অভিনেতা। উনি বলে দিতেন দু’পা সামনে হাঁটো, একবার উপরে তাকাও, বাঁয়ে তাকাও। কাট! ব্যস! বুঝতেই পারতাম না কী করছি। সত্যজিৎ রায়ের ওই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব, তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে কোনও ধারণাই তখন আমার ছিল না। অবশ্য আমার বাবার ছিল, নইলে সে-যুগে ছবিতে অভিনয় করতে যাওয়ার অনুমতিই পেতাম না। সে-যুগটা তো আজকের মতো ছিল না। বাড়ি থেকে ছবিতে অভিনয় করা তো দূরস্থান, দেখতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যেত না। কিন্তু সত্যজিৎ রায় যে ভারতীয় সিনেমাকে বদলে দিচ্ছেন, সেটা আমার বাবা জানতেন। ফলে ডায়াসেশন স্কুল থেকে ওঁর লোক (চর!) আমার পিছু নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত আসার পর (আমি অবশ্য জানতাম না!) সেই ভারী কণ্ঠস্বরের ফোন আসে বাবার কাছে। অডিশনের অনুমতি চেয়ে। বাড়িতে রাজি হলেও বেঁকে বসেন স্কুলের প্রিন্সিপাল। বলেন, সিনেমায় ‘নামলে’ স্কুল ছাড়তে হবে। নাহলে অন্যান্যদের মধ্যে নাকি খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। ফলে দুটো ঘটনা একসঙ্গে ঘটল। স্কুল বদল করে আসানসোলে লরেটো কনভেন্টে চলে এলাম আর সেই সঙ্গে শুরু করলাম ‘অপুর সংসার’-এর কাজ।
এই ছবির দুটি দৃশ্য আমার পরবর্তী জীবনের সঙ্গে যেন কোথাও মিলে গিয়েছিল। মানিকদা সবসময়ই ছবির সবচেয়ে কঠিন দৃশ্য প্রথম দিনে শুট করতে পছন্দ করতেন। বোধহয় প্রথম দিনেই বুঝে নিতে চাইতেন, ছবিটা কেমন এগোবে। সেই অনুযায়ীই আমার প্রথম দিনের প্রথম শটগুলি ছিল চিলেকোঠার ঘরে (যা স্টুডিয়োর ভিতর নেওয়া হয়েছিল)। নতুন হতদরিদ্র পরিবেশে গিয়ে অপর্নার মিশ্র আবেগ, কান্না, ছেঁড়া পর্দার মধ্যে দিয়ে দেখার সেই আইকনিক শট সবই প্রথম দিনে। কিন্তু একেবারে প্রথম শটটি ছিল অপুর সঙ্গে অপর্ণা সেই বন্ধ ঘরের ভিতরে ঢুকছে। তবে অনেক পরে যেটা আমার মনে হয়, আমার জন্য বিশেষ ওই শটটা একেবারে প্রথমে কি উনি ইচ্ছা করেই বেছেছিলেন? সেটা কখনও আর জানা হয়নি, কারণ ততদিনে উনি চলে গিয়েছেন। আমার নিজের মনের অবস্থা আর ‘অপুর সংসার’ ছবির অপর্ণা— প্রথম শটের আগে মন তখন ঠিক একই সুরে বাঁধা। ওই বন্ধ দরজার ওপারে কী রয়েছে আমরা দুজনেই তা জানি না! দরজার ওপারে ওই ঘরের মধ্যে কী রয়েছে তা আমাদের কাছে নতুন। ওই বন্ধ ঘরের ভিতরে আমার এবং অপর্ণা— দুজনেরই এক নতুন জীবন যেন অপেক্ষা করছে। অপর্ণার ক্ষেত্রে নতুন সংসার, আমার ক্ষেত্রে সিনেমার নতুন জগৎ।
দ্বিতীয় দৃশ্য, অপু-অপর্ণার ফুলশয্যার। অপু অপর্ণাকে উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করছে, সে এই স্বচ্ছলতা ছেড়ে গরিব বরের সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে থাকতে পারবে কি না। খাটের এক কোনায় দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে অপর্ণা শুধু পরম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিল, ‘পারব।’ পরে আমার মনে হয়, এ যেন মানিকদাকে বলা আমার কথা! মানিকদা যদি জানতে চাইতেন, আমি কি তাঁর ছবিতে অভিনয় করতে পারব, আমি ঠিক এভাবেই এক কথায় উত্তর দিতাম: ‘পারব।’
‘অপুর সংসার’-এ অভিনয় করার ঠিক তিরিশ বছর পর অপুর সেই বিখ্যাত চিলেকোঠার ছাদে ফিরে গিয়েছিলাম একবার। সঙ্গে ছিলেন পরিচালিকা ক্যাথরিন বার্জ, উনি তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উপর তথ্যচিত্র তৈরি করছেন। রেললাইনের ধারে টালায় ওই চিলেকোঠাটি খুঁজে বের করেছিলেন সত্যজিৎ রায় ছবির শুটিং-এর জন্য। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর লক্ষ্য ছিল, ট্রিলজির আগের দুটি ছবি, ‘পথের পাঁচালী’ এবং ‘অপরাজিত’-তে রেলগাড়ির সেই বিশেষ ভূমিকাকে এখানেও হাজির রাখা। এই চিলেকোঠার ধরেই অপু-অপর্ণা সংসার পেতেছিল।
শুটিং-এর তিরিশ বছর পর গিয়ে দেখি অবিকল একই রকম রয়েছে সেই ছাদ এবং চিলেকোঠা, যেন সময় এতটুকুও দাগ বসাতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কি, যখন ওই ছবিতে অভিনয় করেছি তখন কী আর বয়স, মাত্র তেরো। সবটা বুঝে উঠতে পারিনি। পূর্ণ বয়সে গিয়ে যখন সেখানে দাঁড়াই, আমার যেন চোখ খুলে যায়। অপুর লেখকসত্তা এবং ওই ঘরের সঙ্গে তার সম্পর্কের সঠিক ছবিটা যেন আমার সামনে খুলে যায়। উত্তর কলকাতার ওই ঘিঞ্জি ও হইহল্লার মধ্যে অপু বাড়ি পৌঁছে যখন সিঁড়ি ভেঙে ওঠে, চারিদিকে উৎসুক চোখ। শহরের এই অঞ্চলে আর কোথায় নিজস্ব পরিসর বা গোপনীয়তা? কিন্তু যখন সে উপরে উঠে আসে, খোলা আকাশ তার জন্য যেন অপেক্ষা করে।
তিরিশ বছর পর সেখানে পৌঁছে যে-সাউন্ড স্কেপটা আমি পেয়েছিলাম, তা সেই তিন দশক আগের মতোই। ঠিক একই রকম হইচই আর তার সঙ্গে ট্রেন যাওয়ার শব্দ। এ যেন চিরন্তন। প্রত্যেকবার অপু যখন এই ছাদে এসে দাঁড়াত, তখন তার মনোজগতের আঁচ যেন এতদিন পরে স্পষ্ট হল আমার কাছে। ওই ছবিতে অপু চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তার লোকেশন যে কী ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটাও বুঝতে পারলাম।
এই ছবি আজ ফিরে দেখলে মনে হয়, মানিকদা অন্তত দুটো বার্তা তাঁর দর্শককে তথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। প্রথমটি সে-সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশ নতুনও বটে। একটি অল্পবয়সি ছেলে এবং মেয়ে নিজেরা সংসার পাতছে— এটা তখন অভিনব ছিল। অল্প বয়সে বিয়ের পর মেয়েরা হয় তার বাবা মায়ের কাছে থাকত অথবা শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু এখানে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির একটা সূচনা তৈরি করা হল। এবং খুব সূক্ষ্মভাবে দেওয়া হল লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে বার্তা। ছবিতে স্বামী-স্ত্রী তথা নারী-পুরষের সমানাধিকারই প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি আমরা, যখন দেখি অপু খাচ্ছে অপর্ণা বাতাস করছে, আবার অপর্ণার খাওয়ার সময় সারাদিন খেটে-আসা ক্লান্ত অপুও কিন্তু একইভাবে বাতাস করছে। মূল গল্পের লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালে এ ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু মূল গল্প থেকে সরে এসে মানিকদা এটা করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, অপর্ণাকে সি-এ-টি ক্যাট, এম-এ-টি ম্যাট ইত্যাদি শেখানো। অর্থাৎ মেয়েদের ইংরেজি ভাষা শেখানোর বিষয়টি। ‘দেবী’ এবং ‘অপুর সংসার’ ছবিতে মেয়েদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় আলোকিত করার বার্তা মানিকদা দিয়েছিলেন।
আজ ছবিটা দেখতে বসলে অপর্ণার চরিত্রে অভিনয় করা নিজেকে খুব কাঠ-কাঠ লাগে না। বরং বেশ স্বচ্ছন্দই তো লাগে! তার কারণ হল, আগে ছবিতে কাজ না করলেও, আমি অল্প বয়স থেকেই একটু পাকা ছিলাম! প্রেমের গল্প পড়তাম খুব! আর ছিলাম ডে ড্রিমার। তখনও কিন্তু আমার কোনও প্রত্যক্ষ প্রেম নেই, বয়ফ্রেন্ড নেই। বাড়ি ছিল সংরক্ষণশীল। ফলে স্কুল আর আত্মীয়স্বজনের বাইরে কারও সঙ্গে মেশার সুযোগই হয়নি। কিন্তু বই পড়ে-পড়ে রোমান্স সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাই কাঁধে মাথা রাখা, চোখে চোখ পেতে কথা বলার শটগুলো স্বচ্ছন্দেই উতরে দিতে পেরেছিলাম।
অডিশন দিতে মানিকদার বাড়ি যাই মা আর বোন টিংকুর সঙ্গে, ফ্রক পরে। মানিকদা মংকুদিকে বললেন, একটা শাড়ি পরিয়ে কপালে টিপ দিয়ে, কোঁকড়া চুলে সামান্ তেল দিয়ে খোঁপা বানিয়ে দিতে। উনি ততক্ষণ মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি শাড়ি পরে ঘরে ঢুকতেই একঝলক দেখে মানিকদা বলেছিলেন, ‘এসো অপর্ণা।’ বুঝে গিয়েছিলাম, অডিশনে আমি পাশ করে গিয়েছি। সব মিলিয়ে দিন দশেকের কাজ ছিল আমার। টালার বাড়ির ছাদে, দুটো স্টুডিয়োতে, হাওড়ায়। সব কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর উনি আর একবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে। অপর্ণা বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য রেলে চেপে অপুকে শেষ মুহূর্তের সাংসারিক নির্দেশগুলি যখন দিচ্ছে, মাঝে একটা ক্লোজ-আপ ছিল অপর্ণার। মানিকদার মনে হয়েছিল সেটা জরুরি, কারণ তারপরই তো খবর আসবে অপর্ণা মারা গিয়েছে। ওটাই শেষ পর্দায় তাকে শেষবারের মতো দেখানো, তাই ক্লোজ-আপ জরুরি ছিল। সেই ক্লোজ-আপ কিন্তু পরে তোলা হয়।
‘অপুর সংসার’ সেরা ফিচার ফিল্ম-এর ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর মানিকদা দিল্লি যান পুরস্কার নিতে। আমাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই প্রথম যাওয়া রাষ্ট্রপতি ভবনে। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। চা খেয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে আমরা। এক কিশোরীর কাছে সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
এই দীর্ঘ সিনেমার যাত্রা পার হয়ে এসে আজও ‘অপুর সংসার’-এর খুঁটিনাটি স্মৃতি আমার কাছে অমলিন। যার প্রতিটি সংলাপ আমার কাছে একইরকম প্রিয়। আজও মনে হয়, এই তো ক’দিন আগেই টাঙ্গা থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে উঠছি। আমার সামনে বন্ধ একটা ঘরের দরজা খুলে যাচ্ছে। আমি ভিতরে ঢোকার জন্য পা বাড়াচ্ছি…