ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সচেতন সহজ রূপকথা


    ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী (April 2, 2022)
     

    চলচ্চিত্র– ‘কোডা’
    পরিচালক– সায়ান হেডার
    মুখ্য ভূমিকায়– এমিলিয়া জোনস, ইউজেনিও ডেরবেজ, ট্রয় কটসুর

    ছবিটা দেখার পর মনে হয়েছে ছবিটার ভেতরের গল্প থেকে তার বাইরের গল্পটা আরও কৌতূহলকর; এবং এই বাইরের গল্পটার একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ভবিষ্যতে থাকতে পারে।

    এটা একটা সফল ফরাসি ছবির আমেরিকান রিমেক। তাতে প্রায় কোনও তারকা নেই। মোটামুটি ভাবে সব অর্থেই ছোট/মাঝারি বাজেটের একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি। মূক ও বধির চরিত্রে মূক ও বধির অভিনেতারা অভিনয় করছেন, সম্ভবত এটাই তার একমাত্র, যাকে বলে, মার্কেটিং ইউএসপি। সেই ছবিটি সানডান্সের আমেরিকান ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিকশন কম্পিটিশনে আত্মপ্রকাশ করার দু’দিনের মধ্যে অ্যাপল টিভির মতো একটি বৃহৎ শক্তিশালী স্ট্রিমিং সার্ভিস ২৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে তাকে কিনে নেয়। তারপর সানডান্সে গ্র্যান্ড জুরি প্রাইজ, বাফটা সহ নানা পুরস্কারের পথ পেরিয়ে খোদ অস্কারে সেরা ছবি হিসেবে এটা কীভাবে নির্বাচিত হল, দেখলাম সেটা নিয়ে সমাজমাধ্যমে যথেষ্ট প্রশ্ন এবং খানিকটা উষ্মাও আছে।

    সাধারণ ভাবে যে-ছবিগুলি এখন বিশ্বজুড়ে সিনেমাপ্রেমীদের কাছে মান্য হয় (মানে কল্কে পায়), তাতে ছবি-করিয়েদের ব্যক্তিগত চিহ্ন ও স্বাক্ষর স্পষ্ট। এই সিগনেচার রাখার প্রবণতা একটি যুগচিহ্ন অবশ্যই। একটা ছবি বানালাম এবং তাতে পরিচালকের কোনও বিশেষ লক্ষণ, পছন্দ বা কৌণিকতা থাকল না, তাহলে আর সিনেমা কী হল? এই প্রক্রিয়ায় ছবির বিষয় বা বানানোর ব্যাকরণ যেমন জটিল হয়েছে, গল্প বলা বা না-বলার ধরনও নানা দিকে ধাবিত হয়েছে। ‘ইজ ইট পুশিং দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ ইনটু নিউয়ার ডোমেইনস?’— এইটা ছবিচর্চার একটা অন্যতম মানদণ্ড। এখন সাধারণ ভাবে এতে ছবির যে উপকারই হয়েছে, তা অনস্বীকার্য। নানান দেশ থেকে নানান গল্প বলার অভ্যাসের সঙ্গে ব্যক্তি-পরিচালকের নিজস্ব ভঙ্গি মিশে, ওয়ার্ল্ড সিনেমার একটা বিপুল মহাসমুদ্র তৈরি হয়েছে। এবং হলিউড ইউরোপের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশীয় সিনেমার নানান আঙ্গিকও এই একই কারণে জায়গা করে নিতে পেরেছে। এগুলো অবশ্যই ভাল দিক। কিন্তু এর একটা উল্টো ফলও আছে। প্রায়শই দেখা যায়, স্বাক্ষর তৈরি করা একটা অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কিছু চলতি পদ্ধতিও আছে, যা একজন পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান ও ‘ভাল-ছাত্র’ পরিচালক একটু খেয়াল করলেই নানা ভাবে আয়ত্ত করতে পারেন। বহু ক্ষেত্রেই ছবির মূল আত্মাটিকে পাশ কাটিয়ে ছবি তৈরি করার প্রকরণ অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এটিও একটি যুগের রোগ। এই যে সুপার-হিরো জঁর, যার থেকে সরলীকৃত এককালে আর কিছুই ছিল না, তাও এখন auteur (অতর)-দের হাতে পড়ে, কে কত বেশি ‘dark, edgy ও layered’ তার নিরন্তর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। কিন্তু মানুষের অবচেতনে দীর্ঘ-সময়ব্যাপী কথকের চিহ্নহীন গল্প শোনার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং অভ্যেস আছে, আধুনিক সিনেমা তাকে সচেতন ভাবে বেশ কিছুদিন যাবৎ পাশ কাটিয়ে গেছে। অতএব রূপকথা, লোককথার জঁর এখন অ্যানিমেশনের শ্রেণিভুক্ত, এবং তার মূল বাজার বড়রা নয়। সেখানেও ধীরে-ধীরে auteur নিঃশব্দে প্রবেশ করছেন। বহু সিনেমাপ্রেমী সাধারণ দর্শক এই দেখেশুনে এক ধরনের মুনশিয়ানার ক্লান্তিতে ভোগেন। তাঁদের ভাষায়, ‘দেখতে দারুণ লাগে, কিন্তু কীরকম যেন মন ছুঁল না।’ 

    ‘কোডা’ একটি রূপকথাধর্মী ছবি। তাতে দুটি স্পষ্ট আলাদা থিম। একটি সিন্ডারেলার, একটি শকুন্তলার।

    এমন একটি সময় পরিচালক ও লেখিকা সায়ান হেডার অত্যন্ত সুচতুর ভাবে রূপকথাকে অ্যানিমেশনের খোপ থেকে বের করে একটি আপাত-সরল আমেরিকান মফস্‌সলের গপ্পে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এমন একটি সময় এই কাজটা করেছেন, যখন দীর্ঘ অতিমারীর ক্লান্তি ও হতাশায় মানুষ দীর্ণ। এমনকী যুদ্ধেও পক্ষ নির্বাচন করতে গিয়ে হাজার দ্বিধা ও প্রতিযুক্তি অতিক্রম করা দুরূহ হয়ে ওঠে। বিশ্বব্যাপী স্বৈরাচার ও বৃহৎ বাজারের ট্যাংগোর উল্টোদিকে সাধারণ মানুষের যৌথতার স্বপ্ন মিউমিউ করে বাথরুমে একা গান গায়। 

    রূপকথা যে একটি বৈধ আধুনিক আকাঙ্ক্ষা (ভারী করে বলতে গেলে legitimate contemporary desire) এটিকে বোঝা এবং করে দেখানো, অতিদক্ষ সিনেমা বানানোর থেকে কোনও অংশে কম যোগ্যতার পরিচয় বহন করে না। এবং আমার বিশ্বাস, এটি করার সময় উনি স্থিরভাবে ইতিহাসের দিকে খেয়াল রেখেছিলেন। ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুকাল পরে, ১৯৪৬ সালে ফ্রাঙ্ক কাপরা ‘ইটস আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’ বলে একটি ছবি বানিয়েছিলেন। সেই ছবিটা শুরু হয়, যতদূর মনে পড়ছে, ঈশ্বর ও এক প্রোমোশন-আকাঙ্ক্ষী এঞ্জেলের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে । যে ছবিটার শুরুতে চাইলে উনি অনায়াসেই ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম’ কথাটা নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারতেন। যখন সময়ের চাপ প্রতিনিয়ত টের পাওয়া যায়,  তখনই ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম’-এর চাহিদা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে যায়। ‘ইটস আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’ একটি মাস্টারপিস। তার সঙ্গে ‘কোডা’র তুলনা করা সম্ভবত উচিত নয়। কিন্তু সায়ান হেডার নিশ্চিতভাবে ফ্রাঙ্ক কাপরার পথ ধরে হেঁটেছেন। এবং যে-বাজিমাতটি করেছেন, তা কাকতালীয় নয়।

    রুবি রসি/ এমিলিয়া জোন্স কথা বলতে পারে; শুধু কথা বলতে পারে তা-ই নয়, সে অসম্ভব ভাল গান গায়, যা সে ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ কোনওদিন শোনেনি

    ‘কোডা’ একটি রূপকথাধর্মী ছবি। তাতে দুটি স্পষ্ট আলাদা থিম। একটি সিন্ডারেলার, একটি শকুন্তলার। সিন্ডারেলা, অর্থাৎ একটি নিষ্পাপ, ভাল মনের মেয়ে, যে পরিস্থিতির চাপে কোণঠাসা। যাকে অন্যেরা হেয় করে। যে বৃহৎ পৃথিবীকে ভয় পায়। কিন্তু একদিন তাকে টপকে উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। শকুন্তলা— অর্থাৎ আমার যা স্বপ্ন, আমি যা চাই, তাকে পেতে গেলে, আমি যা ভালবাসি, আমার যা দায়িত্ব, তাকে ছেড়ে যেতে হবে। এই দুটি থিমই বিশ্বজনীন। এর কোনও ভূমিকা এবং কালচারাল ফুটনোট লাগে না। এই ধরনের ছবিতে গল্প খুবই পাতলা হয়। না হলেই বিপদ। কার্য-কারণের বিশদ ব্যাখ্যাও অপ্রয়োজনীয় হয়। 

    ছবিতে আমরা দেখি ম্যাসাচুসেটস-এর একটি ছোট উপকূলবর্তী মফস্‌সল। সেখানে ট্রলারে করে বহু মানুষ সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। কিন্তু মুনাফাখোর ও সরকারি নিয়মাবলির ফাঁসে তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা ক্রমশ দায় হয়ে ওঠে। এরকম একটি পরিবারে বাবা-মা এবং বড়ছেলে মূক ও বধির। কিন্তু ছোট মেয়েটি (রুবি রসি/ এমিলিয়া জোন্স) কথা বলতে পারে। শুধু কথা বলতে পারে তা-ই নয়, সে অসম্ভব ভাল গান গায়। যা সে ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ কোনওদিন শোনেনি। সে পরিবার ছাড়া আর কিছু জানে না, এবং তার বাবা-মা এবং দাদার সঙ্গে বাকি জগতের যোগসূত্র হওয়াই তার জীবনের একমাত্র কাজ। নিয়ম মেনেই সে স্কুলে অনেকের উপহাসের পাত্রী। তার পছন্দের ছেলেটির কাছাকাছি থাকার ইচ্ছায় সে স্কুলে ‘কয়ার’ ক্লাসে জয়েন করে জানতে পারে, সে এত ভাল গান গায় যে সে বার্কলে কলেজ অফ মিউজিকে অ্যাডমিশন পাওয়ার যোগ্য। তার পছন্দের ছেলেটি তার প্রেমে পড়ে, এবং তার বার্কলে যাওয়া ক্রমশ অনিবার্য হয়ে ওঠে, এবং ঠিক তখনই পরিস্থিতির চাপে তার পরিবার বাধ্য হয় অন্যান্য মাছ-মারাদের সাথে যুক্ত হয়ে, বড় ব্যবসায়ীদের পাশ কাটিয়ে, নিজেদের সমবায় তৈরি করে সরাসরি মাছ বিক্রি করতে। এই কাজ না করলে তাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব, এবং এই কাজ করতে গেলে তাদের ছোটমেয়েকে অবশ্যই চাই। রুবিকে ছাড়া তারা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করতে পারে না। অতএব শ্যাম ও কুলের দ্বন্দ্ব ও তার নিরসন।

    এই ছবিতে ভালরা ভাল, কখনও বেশি ভাল, কখনও একটু কম। খারাপরা মোটামুটি খারাপ। মাছ ধরার ব্যবসা নিয়ে বেশি মাথা ঘামানো নেই। দুষ্টু লোকেরা ভাল ধীবরদের কম টাকা দিয়ে অনেক লাভ করে। তারপর একদিন রুবির বাবা রুবির সাহায্য নিয়ে খেপে গিয়ে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে বলে, ‘সাক মাই ডিক।’ 

    তারপর সমবায় হয়। এবং মাছ-মারারা জিতে যায়।

    এইগুলি সিনেমা-বোদ্ধাদের বিরক্তির উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু যাঁরা রূপকথা বোঝেন, তাঁরা সিনেমাপ্রেমীদের খুশি করার অবান্তর চেষ্টায় সময় নষ্ট করবেন না। সায়ান হেডারও করেননি। তিনি রূপকথার নিয়ম মেনে রুবির জীবনের পথ ক্রমশ কণ্টকাকীর্ণ করেছেন। এবং সমাধান করার সময় সব কিছু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেননি। একবারই তিনি বাস্তবের কাছাকাছি এসেছেন। সেটা ছবির এক্সপোসিশনের সময়। মূক ও বধিরদের ভাষার অভিব্যক্তির যে রগরগেপনা তিনি ব্যবহার করেছেন, তা আমাদের চমৎকৃত করে। তাঁরা তাঁদের নিজস্ব জগতে থাকেন। স্বাভাবিক ভাবেই বৃহৎ জগতের নৈতিকতার ধার ধারার দরকার তাঁদের নেই। সাধারণ ছবিতে প্রতিবন্ধীদের প্রায় নিউটার জেন্ডার হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়। এখানে শুধুমাত্র তাঁদের যৌনতা ও ফাজলামির পথ ধরে পরিচালক আমাদের তাদের ঠিক পাশে দাঁড় করিয়ে দেন। তারপর আস্তে আস্তে ছবি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। 

    ছবির কাস্টিং বাড়াবাড়ি রকমের ভাল। বাকি প্রায় সমস্তটাই ‘যথাযথ’। আমার ধারণা এই ‘যথাযথ’টা সুপরিকল্পিত। পরিচালক ও auteur-এর নীরব প্রস্থানে এই ছবি জয়লাভ করে।

    আমার ভবিষ্যৎবাণী: অচিরেই বহু ‘ভাল-ছাত্র’ মূলধারার পরিচালক এই অতরীয় প্রস্থানের শরণাপন্ন হবেন। তাতে একটি নতুন বিপদের সৃষ্টি হবে। তার সমাধান অন্য এক সায়ান হেডার হয়তো করবেন। 

    পুনশ্চ: ছবিটিতে জোনি মিচেলের ‘বোথ সাইডস, নাউ’ বলে একটা গান অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে। এই গানটি একটি অতি উত্তম রূপকথার মতোই সুন্দর। শুধুমাত্র এইটা শোনার জন্য এই ছবিটা দেখে ফেলা যায়।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook