সুমেরীয় পুরাণ
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আসলে আমাদের ধারণার চেয়েও প্রাচীন বিষয়
দুজন বোন ছিলেন যাঁরা একে অপরকে যারপরনাই ঘৃণা করতেন। একজন ইনানা, মর্তের এবং জীবিত প্রাণীদের দুনিয়ার দেবী। অন্যজন এরেশকিগাল, পাতালের এবং মৃতের জগতের দেবী। একবার ইনানার ইচ্ছে হল, পাতালে ঘুরতে যাবেন। তিনি পাতালের দ্বাররক্ষককে গিয়ে বললেন, তিনি তাঁর ভগ্নীপতির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যেতে ইচ্ছুক। তবে আসলে হয়তো তাঁর এই সুযোগে পাতালের রাজত্বটিকেও হাতিয়ে নেবার ইচ্ছে ছিল। মর্ত ছেড়ে আসার আগে ইনানা তাঁর মন্ত্রী নিনশুবুরকে বলে গিয়েছিলেন, তিনি যদি পাতালে কোনও বিপদে পড়েন, মন্ত্রী যেন এনলিল, নান্না আর এনকি নামক তিন দেবতার কাছে আর্জি পেশ করেন তাঁকে উদ্ধার করতে। ইনানা পাতালে গেলেন রীতিমতো জমকালো পোশাক-আশাক পরে। শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানের জন্য নিতান্তই বেমানান এই পোশাকের জাঁকজমক দেখে, এবং পাশাপাশি তাঁর উদ্ধত আচরণ লক্ষ করে, পাতালের দেবীর বেশ সন্দেহ হতে শুরু করল। এরেশকিগালের কথামতো পাতালের দ্বাররক্ষক ইনানাকে জানাল, পাতালের প্রথম দরজা দিয়ে তিনি প্রবেশ করার অনুমতি পাবেন শরীর থেকে একটি কোনও পোশাক খুলে তার হাতে তুলে দেবার পরেই। ইনানা কারণ জিজ্ঞাসা করতে সে জানাল, ‘পাতালের এটাই নিয়ম।’ অতএব তিনিও এ-শর্ত মেনে নিলেন।
সাতটি দরজা দিয়ে এগিয়ে চললেন ইনানা, প্রত্যেকবারই পরে আসা একটি কোনও পোশাক বা অলঙ্কার খুলতে-খুলতে। অবশেষে যখন তাঁর বোনের সামনে গিয়ে তিনি পৌঁছলেন, তখন তিনি নগ্ন, অসহায়। এরেশকিগাল ইনানাকে একটি শবদেহ বানিয়ে একটি শিকে টাঙিয়ে রাখলেন।
তিন দিন, তিন রাত কেটে যাবার পর নিনশুবুর ইনানার কথামতো এনলিল, নান্না আর এনকির মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করলেন— জীবন, জীবিত এবং প্রেমের দেবীকে যেন তাঁরা রক্ষা করেন। প্রথম দুজন দেবতা এ-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, এ-বিপদ ইনানা নিজে ডেকে এনেছেন। তবে এনকির খুবই দুশ্চিন্তা হল, তিনি ইনানাকে উদ্ধার করতে রাজি হলেন। তিনি দুটি লিঙ্গবিহীন জীব সৃষ্টি করলেন (নারীও নয়, পুরুষও নয়), এবং তাঁদের বললেন, পাতালে গিয়ে এরেশকিগালকে তুষ্ট করতে। তিনি যখন প্রসন্ন হয়ে বর দিতে চাইবেন, তখন যেন তাঁরা ইনানার শবদেহে খাদ্য এবং জিয়ন-জল ছিটিয়ে দেয়।
এনকির পরিকল্পনামাফিকই সব হল, দুই লিঙ্গবিহীন জীব বাঁচিয়েও তুলল ইনানাকে। কিন্তু এরেশকিগালের রাক্ষসেরা ইনানার পিছন-পিছন ধাওয়া করে উঠে এল পাতাল থেকে, তাদের দাবি— ইনানার পরিবর্তে অন্য কাউকে না পেলে তাঁকে যেতে দেওয়া হবে না। প্রথমে তারা নিনশুবুরের কাছে এসে তাঁকে বলল, ইনানার স্থানটি গ্রহণ করতে। কিন্তু ইনানা এতে রাজি হলেন না, কারণ নিনশুবুর বাধ্যভাবেই তাঁকে সমস্তভাবে সাহায্য করেছিলেন। এরপরে রাক্ষসেরা ধরল ইনানার স্বামী দুমুজিকে। স্ত্রী পাতালে হারিয়ে গিয়েছেন জেনেও দুমুজি দিব্যি আমোদ-প্রমোদ করে জীবন কাটাচ্ছিলেন। অতএব ইনানা তাঁকে নিয়ে মোটেই খুশি ছিলেন না, তিনি রাক্ষসদের দুমুজিকে ধরে নিয়ে যাবার অনুমতি দিলেন। দুমুজি তাঁর অদৃষ্টকে এড়াতে চেষ্টা করে পালালেন বটে, তবে ইনানা এবং রাক্ষসদের একটি মাছি এসে বলে দিল দুমুজি কোথায় লুকিয়ে আছেন। অতঃপর ঠিক হল, বছরের অর্ধেকটা সময় দুমুজি পাতালে এরেশকিগালের সঙ্গে কাটাবেন এবং বাকি অর্ধেকটা কাটাবেন নিজের স্ত্রী ইনানার সঙ্গে।
জাপানি পুরাণ
এক প্রেমান্ধ স্বামী কীভাবে তাঁর স্ত্রীর খোঁজে যমালয়ে গিয়েছিলেন
আদিম মানব-মানবী ছিলেন ইজানাগি নামে একজন পুরুষ এবং তাঁর দোসর ইজানামি নামে একজন নারী। তাঁরাই সমুদ্রকে মন্থন করে নানা দ্বীপের জন্ম দিয়েছিলেন। সেসব দ্বীপে বসতি বানিয়েছিল তাঁদেরই সন্তান-সন্ততিরা। এঁরাই আসলে জাপানের গ্রাম-বন্দরের নানা দেবদেবী। অগ্নিদেবতার জন্ম দিতে গিয়ে ইজানামির মৃত্যু হয় এবং শোকে পাগল হয়ে ইজানাগি ঠিক করেন, তাঁকে ফিরিয়ে আনবেনই। অতএব তিনি চললেন ইয়োমি নামক ছায়াময় মৃত্যুর জগতে বা যমালয়ে, স্ত্রীকে উদ্ধার করতে। দুর্ভাগ্যবশত, ইজানামি ইয়োমি রাজ্যের খাবার মুখে দিয়ে ফেলেছিলেন, তাই তাঁর আর ফিরে আসার উপায় ছিল না।
স্ত্রীকে নিজের চোখে দেখতে ব্যগ্র হয়ে ইজানাগি একটি প্রদীপ জ্বাললেন এবং ভয়ে হিম হয়ে গিয়ে দেখলেন, তাঁর একদা পরমাসুন্দরী স্ত্রীর শরীরে এখন থিকথিক করছে শবভুক কৃমির দল। ভয়ে তিনি যমালয় থেকে পালিয়ে গেলেন। পিছন-পিছন ধাওয়া করে এলেন ইজানামি; তিনিও স্বামীর বিরহে ব্যাকুল, স্বামীর সঙ্গে থাকতে চান। ইজানাগি শেষপর্যন্ত মর্তে এসে পৌঁছলেন এবং স্ত্রীকে আটকাতে পাতালের প্রবেশপথটি ঢেকে দিলেন একটি বিরাট পাথর দিয়ে। রাগে ইজানামি প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘আমি প্রত্যেকদিন এক হাজার জীবিত প্রাণীকে হত্যা করব।’ ইজানাগি চেঁচিয়ে উত্তর দিলেন, ‘বেশ, আমিও তবে প্রত্যেকদিন দেড় হাজার নতুন জীবন সৃষ্টি করব।’ অতএব এ-কাহিনির সমাপ্তি ঘটে চিরকালীন বিরহ এবং বিতৃষ্ণায়।
আব্রাহামিক পুরাণ
প্রথম পাপের গল্প; আদম, ইভ, একটি আপেল এবং একটি ধূর্ত সাপ
ঈশ্বর ছ’দিনে শূন্যতা থেকে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন, সপ্তম দিনে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন। তিনি নিজের চেহারার মতো করে গড়েছিলেন আদম নামে প্রথম পুরুষটিকে এবং আদমের পাঁজরার হাড় দিয়ে বানিয়েছিলেন প্রথম নারী ইভকে। তিনি আদম ও ইভকে বললেন, তোমরা এই মনোরম ইডেন উদ্যানে সুখে থাকো, আনন্দ করো, তবে ওই জ্ঞানবৃক্ষের ফল কোনওদিন খেও না। তা ছিল নিষিদ্ধ ফল। আদম এবং ইভ ঈশ্বরের হুকুম মেনে চলত, তবে শয়তান একদিন সাপের রূপ ধরে এসে ইভকে ভুল বুঝিয়ে ফলে একটি কামড় বসাতে বাধ্য করল। এরপর ইভও আদমকে বাধ্য করলেন ফলটি খেতে। ফল খাবার পরে অকস্মাৎ দুজনের নিষ্পাপ চরিত্র উধাও হয়ে গেল। তাঁরা প্রথমবার নিজেদের নগ্নতা দেখে লজ্জা পেলেন এবং চেষ্টা করলেন নিজেদের শরীর পোশাক দিয়ে ঢাকার। ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টিদের এই অবাধ্যতায় বড় হতাশ হলেন এবং এই প্রথম পাপ, এই প্রথম অবাধ্যতার অপরাধে তাঁদের ইডেন উদ্যান থেকে বহিষ্কার করলেন। এর পাশাপাশি তিনি এ-ও নিদান দিলেন যে, এখন থেকে নারী পুরুষের বশবর্তী হয়ে চলবে এবং আদম ও ইভের সন্তানেরা, অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতি এই ভুলের মাশুল দেবে।
ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলামি ধর্মের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এই গল্পের খুঁটিনাটির বিষয়ে মতের অমিল আছে। ইহুদি উপকথায় এই ফলটিকে বলা হয় বেদানা। খ্রিস্টানেরা বলেন আপেল। আরবি রূপকথায় আবার এই ফলটিকে কলা ভাবা হয়, কারণ ওটি ভারতের ফল। আরবের কল্পনায় ভারতবর্ষই হচ্ছে উৎকৃষ্ট মশলাপাতির দেশ, সে-দেশেই তাঁরা ইডেনের কল্পনা করতেন।
খ্রিস্টান রূপকথায় প্রথম পাপের উপাখ্যানের গুরুত্ব অপার। কিন্তু ইসলামি রূপকথায় আল্লা আদম এবং ইভকে ক্ষমা করে দেন, অতএব প্রথম পাপ বা এক প্রজন্মের পাপের পরিণাম পরের প্রজন্মে হস্তান্তরিত হবার কোনও ভাবনা নেই।