ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ৪৬


    বিমল মিত্র (January 14, 2022)
     

    পর্ব ৪৫

    তখন আমি মহাবলীপুরম্-এর টুরিস্ট হাউসে বসে-বসে লিখি। আর গুরু সকাল নটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট খেয়ে স্টুডিও চলে যায়। ব্রেকফাস্ট মানে অন্য কিছুই না, শুধু চা। গুরুর জন্য টুরিস্ট হাউসের ম্যানেজার মিস্টার চন্দ্রগেশম্ নানান রকম খাবার তৈরি করে। কিন্তু গুরু খায় না বলে ম্যানেজারের মনে বড় কষ্ট হয়। আমি যখন টেবিলে গিয়ে খেতে বসি তখন ম্যানেজার আমার কাছে দুঃখ করে— মিস্টার গুরু দত্ত তো কিছুই খেলেন না, আমি অনেক কিছু তৈরি করালাম ওঁর জন্যে—

    মিস্টার চন্দ্রগেশম্ এক অদ্ভুত আর অপূর্ব লোক। তাকে নিয়ে পরে একটা গল্পও লিখেছিলাম। শুনেছি এখন আর তিনি সেখানে নেই। এখন পুরোপুরি সরকারী তত্ত্বাবধানেই টুরিস্ট হাউসটা চলছে। এবং যেমন ভাবে অন্যান্য সরকারী বিভাগ চলে, টুরিস্ট-হাউসটাও সেইভাবে চলছে। যা হোক, সেদিন গুরুকে বললাম—আপনি কিছু খান না কেন? চন্দ্রগেশম্ খুব দুঃখ করছিল—

    গুরু বললে— এখানকার খাওয়া আমার ভালো লাগছে না—

    আমি একটু অবাকই হয়ে গেলাম। বললাম— কিন্তু জীবনে এ-রকম আরাম ার যত্ন কখনও পাইনি। আমার মনে হচ্ছে আমি যেন স্বর্গে আছি—

    কথাটা শুনে গুরু খুশি হল। আমি বরাবর দেখেছি বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন যে-কেউ খুশি হলেই গুরু খুব খুশি হত। অন্য লোক সুখী হলে গুরুর সুখের শেষ থাকত না। আমার কথা শুনে গুরু জিজ্ঞেস করলে— আপনার কিছু অসুবিধা হলে বলবেন—

    বললাম—অসুবিধের কথা বলবেন না, জীবনে কখনও এত আনন্দ আমি পাইনি—
    গুরু বললে— আমার সঙ্গে আগে অনেকে এসেছে, কিন্তু এমন কথা কেউ-ই আগে বলেননি—

    সত্যিই অনেকেই আগে এসেছে। আকবার গীতাকেও নিয়ে এসেছিল। গীতার ভালো লাগেনি। বললাম— কেন? ভালো লাগেনি কেন?

    গুরু বললে— কি জানি! আমি গীতাকে সঙ্গে করে স্টুডিওতে নিয়ে যেতাম। আমি যখন শুটিং করতাম, তখন গীতা বাইরে বসে থাকত। তার একঘেয়ে লাগত। অথচ এখানে যারা-যারা শুটিং করতে আসে সবাই, বউ-বাবা-মাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। এদের সকলের থাকা-খাওয়ার খরচ এরাই দেয়, এই ফিল্ম কোম্পানি। কেউ-কেউ দেখেছি আবার শখের কুকুরও সঙ্গে করে নিয়ে আসে—

    বললাম— কেন, নিয়ে আসে কেন?

    গুরু বললে— একলা হোটেলে থাকলে আর্টিস্টের মেজাজ যদি বিগড়ে যায়? মেজাজ বিগড়ে গেলে তার অভিনয় খারাপ হয়ে যাবে—

    কিন্তু সাধারনত গুরুই একলা মাদ্রাজে আসে। এসে কখনও এক মাস থাকে, কখনও পনেরো দিন। কিন্তু বরাবর শুটিং-এর পর কেমন করে একলা কাটাবে, সেই ভয়ে যাকে পায় তাকে ধরে এনে হুইস্কির বোতল খুলে বসে। তারপর একজনই হোক আর দুজনই হোক, তাদের নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত একনাগাড়ে গল্প করে চলে, কিংবা তাস খেলে, কিংবা বই নিয়ে আলোচনা। আর যখন আলোচনার কোনও বিষয়ই থাকে না তখন ভগবান আছে কি না, তাই নিয়েই তর্ক জুড়ে দেয়।

    আমিই কেবল বুঝতাম, কেন এমন করে গুরু? কোথায় যে তার ফাঁক, কোথায় যে তার ফাঁকি, তা আমি যেমন করে বুঝতাম তা আর কেউ হয়তো বোঝেনি। বোঝেনি বলেই হয়তো তাকে দেখেছি ঘন-ঘন বন্ধু বদলাতে। যারা মদ খাওয়ার লোভে তার কাছে আসত, তারা নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধি হয়ে গেলেই আবার তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যেত। কেউ আসত টাকা ছিনিয়ে নিতে, কেউ ভিক্ষে করতে, কেউ ভুল মন্ত্রণা দিয়ে কিছু লোকসান করিয়ে দিতে।

    কিন্তু গুরু কি তা বুঝত না?

    গুরু হাসতো তাদের দেখে। বলত— কিন্তু বিমলবাবু, তা যদি না করি তো ওরা আমার কাছে আসবে কেন? আমারও তো গল্প করবার লোক চাই, আমিও তো লোক খুঁজে বেড়াই! গীতা যদি আসত আমার সঙ্গে তাহলে ওদের আমি প্রশ্রয় দিতাম না। কিন্তু গীতা যে আমার সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকতে চায় না। আমার কাছে বেশিক্ষণ থাকলে তার খারাপ লাগে—

    আমিই কেবল বুঝতাম, কেন এমন করে গুরু? কোথায় যে তার ফাঁক, কোথায় যে তার ফাঁকি, তা আমি যেমন করে বুঝতাম তা আর কেউ হয়তো বোঝেনি। বোঝেনি বলেই হয়তো তাকে দেখেছি ঘন-ঘন বন্ধু বদলাতে। যারা মদ খাওয়ার লোভে তার কাছে আসত, তারা নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধি হয়ে গেলেই আবার তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যেত। কেউ আসত টাকা ছিনিয়ে নিতে, কেউ ভিক্ষে করতে, কেউ ভুল মন্ত্রণা দিয়ে কিছু লোকসান করিয়ে দিতে।


    বললাম— ভুল করছেন, গীতার কাছেও বেশিক্ষণ থাকলে আপনার একঘেয়ে লাগবে। আপনিই কি গীতার কাছে বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন?

    গুরু আমার কথায় অবাক হয়ে গেল। সে যেন আমার কথায় নিজেকে খুঁজে পেল। আমি বললাম— আপনি কি বেশিদিন কাউকে ভালোবাসতে পারেন? আপনার যে সবাইকেই কিছুদিন পরে একঘেয়ে লাগে। আপনি কত কুকুর পুষেছেন বাড়িতে, তাদের তো প্রথমে যত্ন করতেন খুব, কিন্তু পরে কি তাদের দিকেও আর ফিরে দেখেছেন? তারা খেতে পাচ্ছে কি পাচ্ছে না, তা কি চাকরদের কখনও জিজ্ঞেস করেছেন?

    গুরু হতবাক হয়ে আমার দিকে শুধু চেয়ে রইল। তার মুখ দিয়ে খানিকক্ষণের জন্যে কোনও উত্তর বেরোল না।

    সেদিন থেকেই আমাদের গল্প লেখা শুরু হল। গল্পের নাম ‘গুলমোহর’। নামটাও গুরু দত্তের দেওয়া।

    গুরু বললে— আমার বাড়ির পাশের বাড়িটার নাম ‘গুলমোহর’।

    আরো বললে ‘গুলমোহর’ একটা ফুলের নাম। কাশ্মীরে ‘গুলমোহর’ গাছ আছে অনেক। বাংলা দেশে যাকে বলে ‘কৃষ্ণচূড়া’। ওখানে তারই নাম ‘গুলমোহর’। গল্পটা আধা বিলিতি, আধা দিশি। গল্পটা প্রায় পুরো বলে গেল। আমি শুধু ‘হুঁ’ ‘হাঁ’ করে গেলাম। প্রায় একমাস খেটে, আলোচনা করে এক রকম মোটামুটি দাঁড়াল। যেদিন আলোচনা শেষ হল গুরু মহা খুশি। বললে— বিমলদা, প্রত্যেক বছরে একটা করে গল্প লিখে দিয়ে যাবেন—

    আমি অবাক হলাম। বললাম— গল্পটা তো আপনিই পুরো বললেন! এ গল্প তো আপনারই—
    গুরু বললে— কিন্তু আপনি যে জায়গায়-জায়গায় ‘হ্যাঁ’ ‘না’ বললেন— এইটেই তো
    আসল—
    আমি চুপ করে রইলাম। গুরু বললে—আমি জানতুম না যে আপনি এ-সব ক্রাইম গল্পও লিখতে পারেন—

    আমি বললাম— এ-সব গল্প লেখা তো হাতের পাঁচ। এ তো যে কোনও লোক বাঁ হাতে লিখতে পারে— সামাজিক উপন্যাস লেখাই বেশি শক্ত—

    তারপর বললাম— কিন্তু আপনি তো আমাকে একদিন সিনেমার গল্প লিখতে বারণ করেছিলেন? বলেছিলেন সিনেমার গল্প লিখলে আমার কলম খারাপ হয়ে যাবে?

    গুরু বললে— বারণ করেছিলাম বটে, কিন্তু আমাকেও তো স্টুডিও চালাতে হবে। আমি তো আপনাকে বলেইছি যে আমার স্টুডিও চালাবার খরচা মাসে চল্লিশ হাজার টাকা! এই চল্লিশ হাজার টাকা মাসে যোগাবো কেমন করে সেই ভাবনাতেই আমার রাত্রে ঘুম হয় না। এই দেখুন না মাদ্রাজে এসে যা কিছু উপায় করি সব স্টুডিওর পেছনেই খরচ হয়ে যায়। কিছুই থাকে না।

    সত্যিই তাই। শেষের দিকে গুরুর আয় অনেক বেড়ে গিয়েছিল, লক্ষ-লক্ষ টাকা আসত মদ্রাজ থেকে, সে-সমস্ত গিয়ে খরচ হয়ে যেত বোম্বাইতে। টাকা নিজের হাতে রাখতে পারত না গুরু। টাকা এলেই গুরুর মনে হত কেমন করে খরচা করি। আর খেয়ালও ছিল গুরুর অনেক। খেয়াল হল কিছু কিনবে তো সঙ্গে-সঙ্গে দোকানে গিয়ে পকেটের সব কটা টাকা খরচ করে তনে নিশ্চিন্তি। দরকার না থাকলেও কিনবে। বারোটা লুঙ্গি, চব্বিশটা গেঞ্জি।

    মাদ্রাজে যাবার পরদিনই গুরু বললে— চলুন, কিছু শাড়ি কিনতে হবে—
    গেলাম সঙ্গে। দোকানে গিয়ে গুরু নিজের জন্য লুমগি কিনলে এক ডজন। এক-একটা লুঙ্গির দাম তিরিশ-চল্লিশ টাকা করে। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললে—বৌদির জন্যে শাড়ি কিনবেন না?

    আমি একটা শাড়ি পছন্দ করলাম নিজের সাধ্যমতো দামের ভেতরে। তাও দাম নিলে চারশো টাকার মতো। গুরুই শাড়ির ডিজাইনটা পছন্দ করে দিলে। তারপর আমাকে বললে— আপনার মেয়ের জন্য শাড়ি নেবেন না?

    বললাম— সে এখনও শাড়ি পরা শুরু করেনি—

    গুরু বললে— তা হোক, কিনুন একটা শাড়ি—

    শেষ পর্যন্ত কিনতে হল একটা শাড়ি। তাই দুশো টাকার মতো নিলে। টাকা দিতে যাচ্ছিলাম নিজের থেকে।

    গুরু বললে—থাক্, আপনার টাকা তো আমার কাছে আছে—

    Page 176

    বলে ছশো টাকা নিজের ব্যাগ থেকেই দিয়ে দিলে। আমি একটু লজ্জায় পড়ে গেলাম। বললাম— গীতার জন্যে, কি মার জন্যে শাড়ি নেবেন না?

    গুরু বললে— এবার আর নেবো না। প্রত্যেকবারেই আসি মাদ্রাজে আর প্রত্যেকবারই ওদের জন্য শাড়ি নিয়ে যাই। এবার থাক্—

    আমি অবাক হয়ে গুরুর মুখের দিকে তাকালাম। এ লোকটাকে সেই মুহুর্তে যেন আর চিনতে পারলাম না! এ কে? কেন এমন করে আমায় ভালবেসে ফেললে? আমি ওর গল্প লিখে দিয়েছি বলে? না আমার মধ্যে এমন কিছু গুণ দেখতে পেয়েছে যা ওকে আকর্ষণ করেছে। কিন্তু তাই বা বল কি করে? বোম্বাইতে ওর জানা-শোনার মধ্যে এমন একজনকেও কি খুঁজে পাওয়া যাবে যে বলতে পারে গুরুর কাছ থেকে কোনও উপকার সে পায়নি। এ কেমন করে হয়? আর তা ছাড়া আমার সঙ্গে গুরুর কিসের সম্পর্ক? আমি বাঙালি, আর ও কঙ্কনী। ওর সঙ্গে তো আমার মিল হওয়ার কথাও নয়। কেন এমনভাবে আমরা দুজনে এক সূত্রে মিলে গেলাম? কেন?

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook