ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • উত্তরবঙ্গ ডায়েরি: পর্ব ১১


    সুমনা রায় (Sumana Roy) (January 8, 2022)
     


    স্রোতের বিপরীতে তিস্তার পুরাণ 

    বাইশ বছর আগে এক জানুয়ারির দিনে, লেখক দেবেশ রায় তাঁর ‘তিস্তাপুরাণ’ উপন্যাসের মুখবন্ধ লিখেছিলেন। ছোট্ট একটা লেখা। এর তাৎপর্য আলোচনা করার আগে এখানে সেটা তুলে দিলাম:        

    একটি কথা স্পষ্ট করে রাখার দায় বোধ করছি। 

    এই উপন্যাসটি কোনোভাবেই আমার ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-এর পরবর্তী কোনো অংশ নয়—ঘটনায় ও মানুষজনে তো নয়ই, গল্পের গড়ন-পেটন বা হদিশ-নিশানাতেও নয়। সহজ করে নেয়ার কোনও ত্বরিত সুবিধেয় বা কঠিন করে তোলার কোনো সামর্থ্যে ও-রকম ভেবে নিলে দুটি লেখারই স্বায়ত্ত স্বাতন্ত্রের হয়তো ক্ষতি ঘটতে পারে। নদীমানুষের একই ভুবনে যে এমন ঘুরছি সে হয়তো বেরিয়ে আসার পথ জানি না বলে। বা, হয়তো বেরিয়ে আসার পথ চাই না বলেও। বা, হয়তো বেরনোর পথ নেই বলেই। 

    দেবেশ এই লেখাটা লিখছেন জলপাইগুড়ির ‘সোনাপদ্মা’ থেকে, বাংলা ১৪০৬ সালের মকর সংক্রান্তির দিন। এই তথ্যটা এই কারণে লিখলাম না যে ওই পাতায় আর কিছু ছাপা নেই, এ তথ্যটা প্রয়োজনীয় কারণ এটা মুখবন্ধটার সঙ্গে সম্পৃক্ত, আর দুটো অন্য জিনিসের সঙ্গে যুক্ত, যেগুলো হয়তো বইটার নির্দিষ্ট সাহিত্যমূল্যের বাইরে অবস্থিত।

    এর মধ্যে প্রথমটা হল উপন্যাসের সূত্র-লিপি, বা এপিগ্রাফ, যা একটা রাজবংশী প্রবাদ: দিন যায়, কথা রয়। 

    বাংলায় ‘কথা’ মানে ‘শব্দ’ এবং ‘গল্প’, দুই-ই। এটা যেন ‘নদীমানুষ(লেখকের কথা)-বিষয়ক উপন্যাসটার একটা ট্রেলার, যেখানে ‘কথা’ শব্দের দুই অর্থই প্রযোজ্য, সেই মৌখিক কথকতার ধারাকে একরকম সম্মান জানানো। বাংলায় কতগুলো উপন্যাস আছে, যেখানে একটা রাজবংশী প্রবাদ মুখবন্ধে খুঁজে পাওয়া যাবে? রাজবংশী ভাষার প্রবচনটা ব্যবহার করে দেবেশ রায় খুব সূক্ষ্মভাবে দুটো কাজ করছেন— এক, একটা মৌখিক ঐতিহ্যকে লিখিত জগতে স্থাপন করা (প্রবাদ-প্রবচনের উৎস মুখ্যত মৌখিক), এবং তাঁর নিজের রাজনৈতিক অবস্থান স্থিরভাবে নির্দেশ করা।     

    যাঁরা উপন্যাসটা পড়েছেন, তাঁদের কাছে এসবই অজানা নয়। আমার কাছে যেটা লক্ষণীয়, তা হল কীভাবে এই প্রবাদ নদীমাতৃক একদল মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, কীভাবে তাঁদের দিনের এবং কথার ছন্দ নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে বয়ে চলে— নদী প্রত্যহ কিছু নিয়ে ভেসে যায়, ফেলে রেখে যায় জীবন।  

          

    কেন দেবেশ রায় উপন্যাসের মুখবন্ধেই এই উদ্দেশ্য তুলে ধরছেন? মুখবন্ধে লেখক তিস্তার আশেপাশের মানুষকে নিয়ে লেখা তাঁর একটি উপন্যাসের কথা তুলে লিখছেন যে দুটো কাজ একে অপরের সম্প্রসারণ নয়; তিস্তা নদীর দ্বারা যাদের জীবন চালিত, এমন সম্প্রদায়ের মানুষের কথা হওয়া সত্ত্বেও একটা আরেকটার পরবর্তী অংশের কাহিনি নয়। এই পার্থক্য রাজনৈতিক, এবং লেখকের নান্দনিক অবস্থানগত। তিস্তার প্রেক্ষাপটে লেখা প্রতিটা উপন্যাস একই সম্প্রদায়ের উপরে লেখা নয়, ঠিক যেমন কলকাতা-বিষয়ক প্রতিটা উপন্যাস একই মানুষের জীবন তুলে ধরে না, ঠিক যেমন ‘কলকাতা নভেল’ বলে কিছু থাকতে পারে না। 

    দেবেশ ‘তিস্তাপুরাণ’ উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর ভাইঝিকে, এই কথাগুলো লিখে— ‘একদিন তোকে এই গল্পের পাকে পড়তেই হবে’।
    ‘পাক’ কথাটাকে ‘ঘূর্ণণ’ বা ‘আবর্ত’; ‘whirl’ হিসাবেই ধরা যায়, কেননা এই ব্যাখ্যাতে নদীর চরিত্র এবং গল্পের মধ্যে সম্পর্কটা ফুটে ওঠে, যার উপর দেবেশ তাঁর আখ্যান সাজিয়েছেন। নদীকে বারংবার একটা মেটাফর হিসাবে ব্যবহার করায় দেবেশ একটা গোটা অঞ্চল এবং তার বাসিন্দাদের ইতিহাস কথনের দাবি করে যান, যা লিখিত ইতিবৃত্তে অস্বীকৃত রয়ে গেছে। 

    কিন্তু এর কারণ কী? কেন দেবেশ রায় উপন্যাসের মুখবন্ধেই এই উদ্দেশ্য তুলে ধরছেন? মুখবন্ধে লেখক তিস্তার আশেপাশের মানুষকে নিয়ে লেখা তাঁর একটি উপন্যাসের কথা তুলে লিখছেন যে দুটো কাজ একে অপরের সম্প্রসারণ নয়; তিস্তা নদীর দ্বারা যাদের জীবন চালিত, এমন সম্প্রদায়ের মানুষের কথা হওয়া সত্ত্বেও একটা আরেকটার পরবর্তী অংশের কাহিনি নয়। এই পার্থক্য রাজনৈতিক, এবং লেখকের নান্দনিক অবস্থানগত। তিস্তার প্রেক্ষাপটে লেখা প্রতিটা উপন্যাস একই সম্প্রদায়ের উপরে লেখা নয়, ঠিক যেমন কলকাতা-বিষয়ক প্রতিটা উপন্যাস একই মানুষের জীবন তুলে ধরে না, ঠিক যেমন ‘কলকাতা নভেল’ বলে কিছু থাকতে পারে না।   

    চিহ্নিত করার অভ্যাসের প্রতিবাদে, ‘উত্তরবঙ্গের লেখা’, বা ‘রাজবংশী-বিষয়ক’ লেখা ধারণাগুলোর মূলে আঘাত হানা আপত্তি দেবেশের এই মুখবন্ধ। তিস্তা-পারের জীবন-বিষয়ক দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন উপন্যাসের গঠন-চলন-আকৃতিতে যে ফারাক, সে-বিষয়ে পাঠকের মনোযোগ টেনে লেখক এই অঞ্চল এবং তার মানুষকে কেন্দ্র করে লেখার বিপুল সম্ভাবনার ইঙ্গিত করেছেন।   

    ‘তিস্তাপুরাণ’ নামকরণের একটা আলাদা তাৎপর্য রয়েছে; নামের শেষের ‘পুরাণ’ যেন প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী, কিন্তু একই সঙ্গে, ‘ইতিহাস’ বলে বিবেচিত নয়। দেবেশের কাজের নামকরণ তাঁর নিজের নান্দনিক অবস্থান এবং সাহিত্যক্ষেত্র ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে তাঁর বিতর্কের প্রমাণ। তাঁর কাজে ‘বৃত্তান্ত’ ঘুরে-ফিরে আসে, যার মধ্যে ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ সবচেয়ে পরিচিত। ‘বৃত্তান্ত’, যার অর্থ ধরে নেওয়া যেতে পারে ‘বর্ণনা’, একটা উদ্দেশ্যমূলক নাম, যেমন ‘পুরাণ’— দুটোই বিংশ শতাব্দীর শহুরে উপন্যাস-বোধের থেকে দূরে অবস্থিত যে শিল্পরুচি, তার তাৎপর্য তুলে ধরে, এদের মাঝের ফারাকটা স্পষ্ট করে তোলে। ‘বৃত্তান্ত’ এবং ‘পুরাণ’ যেন লিখিত ইতিহাসের সাবভার্সনে দেবেশের নিজস্ব পন্থা। 

    বাঁধ এবং হাইডেল প্রজেক্টে ক্ষতবিক্ষত, মৃতপ্রায় তিস্তার থেকে একটু দূরে বসে ‘তিস্তাপুরাণ’ পড়তে-পড়তে উপলব্ধি করি, উত্তরবঙ্গের লেখকদের কতটা স্রোতের বিপরীতে সাঁতরাতে হয়েছে, গতানুগতিক লেখার বিপরীতে অবস্থান করে, একটা পড়ে-পাওয়া সাহিত্য-ঐতিহ্যের ঢলকে ক্রমাগত পাশ কাটিয়ে লিখতে হয়েছে এ-অঞ্চল এবং তার মানুষের কথা। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook