ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং: পর্ব ২০


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (December 4, 2021)
     

    এক পারিবারিক কাহিনি

    এক প্ল্যাকার্ডে লেখা আছে ‘আমাকে আমার বাচ্চা দাও’, কেরল চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন মা, পাশে বাবা। সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকে, তাঁরা রাত্রে একটা গাড়িতে আশ্রয় নেন, পরের দিন আবার দাঁড়িয়ে থাকা। দু’সপ্তাহের ওপর এই অবস্থান চলল, টনক নড়ল টিভি চ্যানেলের, সোশ্যাল মিডিয়ার, রাজনীতিবিদদের, শেষে মা বাচ্চাকে ফিরে পেলেন, তাকে দত্তক দিয়ে দেওয়া হয়েছিল অন্ধ্র প্রদেশের এক পরিবারের কাছে। কিন্তু কথাটা দত্তক নিয়ে নয়, এই বাচ্চাটিকে কে হঠাৎ দত্তক-কেন্দ্রে দিল? মায়ের বাড়ির লোকেরাই। মা ২২ বছরের যুবতী, আর বাবা ৩৪ বছরের যুবক। এঁদের মিলনে যুবতীর পরিবারের সাংঘাতিক আপত্তি। প্রথমত, মেয়েটি উঁচু-জাত, ছেলেটি দলিত। এ-আপত্তি হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না, সাম্প্রদায়িকতার ঢিপির ওপরে দাঁড়িয়ে বাঁশের লাঠি গুঁজে আমাদের নিজস্ব এলাকা স্থাপন, সাম্প্রদায়িকতার আল্পনা ছেতরে আমাদের ম্যাপ রচনা। যত বড়-বড় কথা বলি, হিন্দু পরিবারে মুসলিম বউ নিয়ে এলে প্রায় সক্কলেরই ভুরু কুঁচকে ওঠে, মুসলিম পরিবারে হিন্দু বউ নিয়ে প্রায় সক্কলেরই মুখ বেঁকে যায়, ভারতের কোত্থাওই অন্য জাতে বিয়েকে দু’হাত তুলে অভিনন্দন জানানো হয় না, বা, আরও জরুরি, নিতান্ত উদাসীন চাউনি নিয়ে দেখা হয় না। জাত-বেজাতের দ্বন্দ্বের প্রতি আদর্শ দৃষ্টি হল শূন্যদৃষ্টি, যেন কেউ পাঁউরুটি খাচ্ছে না শাঁকালু খাচ্ছে তা নিয়ে আচমকা উত্তেজিত হয়ে পড়ার আছেটা কী। কিন্তু এ নিয়ে লেখারও মানে হয় না, তা হবে পৌনঃপুনিক ও নিতান্ত বোর, তাই পরিবারের অসন্তুষ্টির অন্য কারণে নজর দেওযা যাক: ছেলেটি বিবাহিত। যদিও, তিনি স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন না, তবু আইনত বিচ্ছেদ ঘটেনি। মেয়ের বাড়ির পক্ষে এ-ঘটনা মেনে নেওয়ার উদারতা আয়ত্ত করা শক্ত। মেয়ে বিবাহিত পুরুষের সঙ্গ করে, এ জিনিস খুব উপাদেয় নয়। এমনকী ডিভোর্সি পুরুষ বা নারীকেও আমাদের সমাজে ‘খুঁতো’ (‘সেকেন্ড হ্যান্ড’) হিসেবেই দেখা হয়, একটি নলেন ব্যক্তি একটি হাত-ফেরতা ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে করতে চলেছে, এ ধারণা বিবাহের (প্রাথমিক ভাবে যৌন চুক্তি) আদর্শ গতায়াতের বিরোধিতা করে, যা হল: এক কুমার ও এক কুমারীর বিয়ে হবে, তারা প্রথম যৌনতার স্বাদ পাবে পরস্পরের কাছ থেকে, শয্যাতুলুনিতে রক্ত দেখে মেয়ের ব্যাপারটায় আত্মীয় ও প্রতিবেশীরাও নিশ্চিত হবে (কারণ তার সতীত্বই বেশি গুরুত্বপূর্ণ), এরপর বাচ্চা হবে এবং কোনও সন্দেহই থাকবে না এটি কার বাচ্চা। তাহলে যে-পুরুষ (বিয়ের ফলেই) এক নারীর সঙ্গে যৌনতা করেছে, সে কেন আবার একজনের সঙ্গে যৌনতা করবে? এবং দ্বিতীয় নারীটি কেন সম্মত হবে এই সম্পর্কে? মনে রাখতে হবে, বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে সমাজের আপত্তিও একই কারণে, একবার পুরুষের যৌন স্পর্শ পেয়েছে যে, সে কী করে অন্য লোকের যৌনতার যোগ্য হয়? যদিও মেয়েদের ক্ষেত্রে শরীর ‘পূর্ব-ব্যবহৃত’ হলে অনীহাটা বেশি হয়, ছেলেদেরও এক্ষেত্রে একেবারে উদাত্ত ছাড় দেওয়া হয় না। মেয়েটির বাড়ি থেকে তাই অস্বস্তি ও ভ্রুকুটি দিব্যি বোধগম্য। 

    এরপরের ঝামেলাটা আরও বড়, মেয়েটি গর্ভিণী হন এবং সিদ্ধান্ত নেন (ছেলেটির সঙ্গে মিলে), বাচ্চাটিকে তিনি জন্ম দেবেন ও পালন করবেন। নিজের মেয়ে বিবাহিত ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে এই তেতো সত্য যদি-বা চোখকান বুজে গিলে নেওয়া যায় (এই আশায় যে রিলেশন আজ নয় কাল ঠিকই কেটে যাবে এবং তখন এ-আখ্যান ভুলে ও ঢেকে মেয়েকে অন্য-পাত্রস্থ করা যাবে), কিন্তু মেয়েটি এই সম্পর্কের ফলেই বাচ্চা বিয়োবে, মেনে নেওয়া প্রলয়ঙ্কর-প্রকার অসম্ভব, কারণ তাহলে সে তো ‘অবিবাহিতা মা’ হতে চলেছে। এবার সমাজের খর-থাবার ছবি ঘন-ঘন মনশ্চক্ষে উদ্ভাসিত হতে বাধ্য। বিয়েই করোনি, এদিকে যৌনতা করেছ, এবং তার জ্বলজ্বলে প্রমাণ হিসেবে জন্মেছে একটা বাচ্চা, আবার তা নিয়ে তুমি লজ্জিত নও, সে তথ্য তুমি ঢাকার চেষ্টা করছ না, বাচ্চাটাকে লুকিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দিচ্ছ না, ‘ওকে একদিন সমুদ্রের ধারে আচমকা কুড়িয়ে পেলাম’ গল্প বানাচ্ছ না, জোরসে দাপিয়ে ডেঁটে জাহির করছ? এই স্পর্ধা ভারতের কোনও সমাজই মেনে নেয় না, কুন্তীর সময়েও নিত না, এখনকার কেরলেও নেবে না, সাক্ষরতার যত ফড়ফড়ে ফেস্টুনই টাঙানো হোক। বিবাহবন্ধনের বাইরে থাকা মেয়েরা (কুমারী বা বিধবা) সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে তার কী দড়াম-তম দুর্দশা ঘটে তা নিয়ে যুগে-যুগে নাটক কাব্য নভেল সিনেমা মথিত, একরাত্রের ভুলের (মানে, সেক্সের) ফলে রূপ-তেরা-মস্তানা উদ্ভূত গর্ভ নিয়ে শর্মিলা ঠাকুর অন্তহীন নাস্তানাবুদ, সেই বাচ্চাকে অন্যের কাছে মানুষ করতে দিতে হল, তারপর তারই আয়া হয়ে দিন কাটাতে হল, শেষে ঘটনার ঘনঘটার ফলে জেলে পর্যন্ত যেতে হল, কেলেঙ্কারি-খচিত এই মহাকাব্যের সাক্ষী আসমুদ্রহিমাচল। এই ছবি দেখতে-দেখতে ভারতীয় দর্শকের অশ্রুফোয়ারা হুউউশ নির্গত হয়েছিল কারণ শর্মিলা অমন দুর্ধর্ষ রূপসী এবং নিজকাণ্ডের তরে প্রকাণ্ড শরম-নতা। যদি তিনি সবাইকে হেঁকে বলতেন ‘এই যে আমার বাচ্চা, এর বাবা প্লেন ক্র্যাশে মারা গেছে, তার সঙ্গে আমার শরীর-বিনিময় হয়েছিল, কিন্তু লোকসমক্ষে বিয়ে-ফিয়ে হয়নি’, আর বেণী দুলিয়ে পার্কে চলে যেতেন প্যারাম্বুলেটর ঠেলতে-ঠেলতে, তাহলে সুপারহিট ছবি বা ‘সফল হবে তোর আরাধনা’ মার্কা রোদনধর্মী সঙ্গীত, কিস্যুই জন্ম নিত না। লোকে বরং সেই নায়িকাকে পাথর ছোড়ার জন্যে হল-এর পাশে পাটকেল কিনতে লাইন দিত। কারণ লোকলজ্জার, বিশেষত যৌনতা-সম্পৃক্ত লোকলজ্জার, প্রস্তর ঠেলে ফেললে ভারতীয় সমাজের শ্বদাঁত নড়ে যাবে। মেয়েরা এমন পোশাক পরুক যাতে পুরুষের যৌন লোভ না জাগ্রত হয়। পুরুষ ও নারীর মোলাকাত ও মেশামিশি শৈশব থেকেই যথাসম্ভব কম হোক, কারণ এরা মানুষ ও মানুষ নয়, আগুন ও ঘি। শিল্পে অধিক যৌনতা ব্যান হোক। এমনকী বিয়ের পরের যৌনতা, হোক তা লাইসেন্সপ্রাপ্ত, তবু ফিসফিসে গুজগুজে চাপাচুপির স্তরেই থাক, যেন এই যুগল রজনীবিলাস বলতে বোঝে কেবল মাজন ও আলমারির দ্বৈত দুশ্চিন্তা, মঙ্গলসূত্রের বিজ্ঞাপনে যেন কক্ষনও স্বামী ও স্ত্রীর যৌন ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক ঝলকানো না হয়, ক্লেদাক্ত ক্লিভেজ নিলাজ নিমন্ত্রণ চিত্রিত না হয়, তা হবে এই পবিত্র অন্বয়ের অশ্লীল অপমান। এতগুলো অনুশাসন থেকে লিক করা গলিত-পিত্তিতে স্যাঁতস্যাঁতে সমাজটি সারাক্ষণ ‘এই খেয়েছে, যৌনতা হয়ে গেল না তো!’ ভেবে কাঁটা হয়ে থাকে, তাই এ-প্রান্তরে ‘হুঁ, এই একটু সেক্স করে ফেললাম’ হেঁকে মাথা উঁচিয়ে ফানুস খুঁচিয়ে বেড়ানো যায় না।

    বিবাহ প্রাথমিক ভাবে যৌন চুক্তি, ফলে এক কুমার ও এক কুমারীর বিয়ে হবে, তারা প্রথম যৌনতার স্বাদ পাবে পরস্পরের কাছ থেকে, শয্যাতুলুনিতে রক্ত দেখে মেয়ের ব্যাপারটায় আত্মীয় ও প্রতিবেশীরাও নিশ্চিত হবে (কারণ তার সতীত্বই বেশি গুরুত্বপূর্ণ), এরপর বাচ্চা হবে এবং কোনও সন্দেহই থাকবে না এটি কার বাচ্চা, এই হল বিয়ের মূল গতায়াত। 

    নির্ঘাৎ সেসব ভেবেই, মেয়ের বাড়ির লোক, গত বছর অক্টোবর মাসে মেয়ের বাচ্চা হওয়ার পরেই, ‘তিনমাস পর তোর বোনের বিয়ে, বিয়েবাড়িতে লোকে এসে বাচ্চা দেখে গুচ্ছ বেয়াড়া প্রশ্ন করবে, কী উত্তর দেব শুনি?’ বলে শিশুটিকে নিয়ে নেয়, এবং তার জননীকে চালান করে অন্য আত্মীয়ের বাড়িতে। এ-বছর ফেব্রুয়ারিতে, বোনের বিয়েতে এসে, মেয়েটি বুঝতে পারেন, বাচ্চা গায়েব। তিনি বেরিয়ে, ছেলেটির বাড়িতে থাকতে শুরু করেন, এবং বাচ্চার খোঁজ নিতে শুরু করেন প্রেমিক-প্রেমিকা মিলে। পুলিশে গেলে তারা প্রথমে অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে এবং উল্টে বলে, আপনার নামে তো আরেকটা নালিশ রয়েছে, বাপের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার! অগাস্টে পুলিশ বলে, মেয়েটির বাবা জানিয়েছেন, মেয়েটি স্বেচ্ছায় তাঁর বাচ্চাকে একটি দত্তক-কেন্দ্রে দিয়ে দিয়েছেন। এবার মেয়েটি ও ছেলেটি নালিশ দায়ের করতে শুরু করেন, শাসক দলের কাছে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে (যিনি প্রথমটা বলেন, ‘এটা পারিবারিক ঘটনা’), দত্তক-কেন্দ্রটির কাছে, রাজ্যের পুলিশ প্রধানের কাছে। রাজ্যের সংস্কৃতিমন্ত্রী সব শুনেটুনে বলেন, ‘মেয়েটির বাবা-মা তা-ই করেছেন, যা এ-পরিস্থিতিতে সকলেই করতেন।’ তাঁর নামেও নালিশ করেন এই যুবক-যুবতী। তারপরে নিউজ চ্যানেলে ইন্টারভিউ দিতে থাকেন তাঁরা, প্রতিবাদ জানান কেরল সেক্রেটারিয়েটের সামনে দাঁড়িয়ে, তারপর অবস্থান শুরু করেন চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সামনে। মিডিয়ায় হইহই হতেই রাজনীতির পাড়ায় একটু দোলাচল দেখা যায়। এক বিরোধী নেত্রী বলেন, এ হল ‘অনার-ক্রাইম’। এবং তা করা হয়েছে সরকারি শাসনযন্ত্রের সহায়তায়। মেয়েটির বাবা অবশ্য বলেন, কী মুশকিল, আমি একটা বেআইনি বাচ্চাকে তো আর বাড়িতে রাখতে দিতে পারি না! এমনিতে বাচ্চাটা হওয়ার পর থেকে আমার মেয়ের শরীরও ভাল যাচ্ছিল না, তাই ভাবলাম ওই দত্তক দেওয়ার জায়গাটায় রাখলে বাচ্চাটার যত্নের অন্তত ত্রুটি হবে না। শেষে বাবা এও বলেন, তিনি পার্টির এক নেতা এবং উকিলের সঙ্গে কথা বলে তবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পার্টি মানে কমিউনিস্ট পার্টি। মানে সিপিএম। ব্যাপারটা চমৎকার।

    যুবক ও যুবতী দুজনের বাড়িই কমিউনিস্ট পার্টির কট্টর সমর্থক। মেয়েটির ঠাকুর্দা-ঠাকুমা ছিলেন ট্রেড ইউনিয়নের নেতা এবং মিউনিসিপাল কাউন্সিলর। মেয়েটির বাবা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, এবং সিটু-র বেশ গোদা পাণ্ডা। যুবক-যুবতীর আলাপও রাজনীতি করতে গিয়েই। মেয়েটি তাঁর কলেজের এসএফআই ইউনিয়নের প্রথম নারী-প্রধান। আর ছেলেটি ছিলেন ডিওয়াইএফআই-এর এক নেতা। এমনিতে অনেকেই সিপিএম-এর সঙ্গে প্রগতিশীলতার একটা স্পষ্ট সমীকরণে বিশ্বাস করে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে সিপিএম-এর ভিকটিম-অঙ্গে একটা সমবেদনা-কাম-শ্রদ্ধা মার্কা স্টিকার চিপকে আছে। ‘ওবাবাগো কী ভাল ছিল, কী ভদ্র শিক্ষিত আর ঠিকতা-দীক্ষিত’ মার্কা হাহাকার শোনা যায়, তা কিছুটা গজায় ‘যাহা গিয়াছে তাহা নিয্যস হিউজ উত্তম’ টিপিকাল-বাঙালি ধারণা থেকে, আর কিছুটা বর্তমান দাপুটে দলগুলোর অশিক্ষার মেগা-ফর্মা অবলোকনান্তে। কেরলেও সিপিএম বেশ এগিয়ে-থাকা মানসিকতার তকমা পায়। কোভিড-যুগের গোড়ার দিকে তো ‘পার্টি উন্নত, তাই কেরলে করোনা কোণঠাসা’ গোছের তর্জনও সোশ্যাল মিডিয়ায় শোনা গিয়েছিল, সেকেন্ড ওয়েভের পর চুপসেছে। সেই পার্টির লোক হয়ে, পার্টি-অনুগত পরিবার হয়ে, মান্ধাতাধর্মী মনোভাব কথাবার্তা কার্যকলাপের পরাকাষ্ঠা স্থাপন করে এই পরিবার বেশ ঝঞ্ঝাটে ফেলে দিয়েছে কমিউনিস্ট গোষ্ঠীকেও। অনুধাবনযোগ্য: একটা দেশে যখন কমিউনিজম (বা যে-কোনও ইজম) ফুলতে-ফলতে থাকে, তা সেই দেশের জল-কাদাকে অতিক্রম করতে সক্ষম না-হতেই পারে। কয়েকটা বড়-বড় নাম ও তত্ত্ব আওড়ানোর বাইরে, সিপিএমের গায়েও তাই এদেশেরই গ্যাঁজলা। ভারত যদি হয় গোঁয়ার গাঁইয়া, যদি হয় ব্যক্তিস্বাধীনতার শত্রু এবং কুঁদুলে চণ্ডীমণ্ডপের দাস, যদি হয় ধর্ষকামী ও অগণতান্ত্রিক, তাহলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও তার বাইরে থাকবে না। তাদের রং ও চিহ্ন ভিন্ন হোক, তারা সহস্র স্থবির জড় ভারতীয় দলের অন্যতম মাত্র। বিবাহ কাহাকে বলে, কিংবা একজন নারীর শুধু নিজের পরিচয়েই মা হওয়ার অধিকার আছে কি না, এইসব প্রশ্নে তাই কালচার মিনিস্টার সেই স্বরেই জবাব দেবেন, যা লাখো পাবলিকের লকলকে ল্যারিংক্স থেকে ছিটকে ওঠে। আবার ছেলেটি ও মেয়েটি তো কমিউনিস্ট, তাঁদের কাছে নিজেদের সম্পর্ক দিব্যি সহজ। তার মানে কিছু কমিউনিস্ট আধুনিক ভাবনা আত্মস্থ করতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা কম, তাঁদের চিন্তাধারার ওজনও দলের ওপরমহলে উপেক্ষাযোগ্য, নইলে এঁদের সন্তান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কতিপয় সিপিএম-কত্তা অ্যাদ্দূর নির্বিকার নিষ্ঠুর হতে পারতেন না। তাঁদের একবারও মনে হয়নি, যুবক-যুবতীর মতটাও জিজ্ঞেস করা দরকার, এবং তা না করে তাঁদের সন্তানকে অন্যদের কাছে চিরতরে দিয়ে দেওয়া একটা যাচ্ছেতাই পাপ, মিথ্যাচার, অপহরণ, এবং মানবাধিকার হরণ। মনে হয়নি, একটি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে কার সঙ্গে থাকবে কার বাচ্চা প্রসব করবে সে-বিষয়ে এতটুকু জোর কাটানোর কর্তৃত্ব কারও বাবার নেই (বায়োলজিকাল পিতা বা গোষ্ঠী-গার্জেন)। তাঁরা ধরেই নিয়েছেন, ছেলেটি ও মেয়েটি যখন সমাজ-বেপরোয়া বেলেল্লাপনা করেছেন, তখন সমাজ তাঁদের হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেলতেই পারে। চারটে লাল-সালুর স্টল আর কয়েকটা গম্ভীর ও নীরস গ্রন্থ দিয়ে তাই কমিউনিস্ট পার্টিও তাদের এক্সট্রা-শুচি ইমেজ সেঁটে রাখতে পারছে না, অন্তর্নিহিত অশিক্ষার ঢিশুমে তা ফর্দাফাঁই হয়ে যাচ্ছে। বহুদিন ধরেই অভিযোগ চলেছে, ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিতেও পুরুষতন্ত্র বহাল, আর উঁচু জাতের নেতৃত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এও নিশ্চিত, কমিউনিস্ট পার্টি শিল্পের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, আনন্দিত ও খোলাখুলি যৌনতা উদযাপনের বিরুদ্ধে, গোমড়া পণ্ডিতমশাই-বিশেষ। আদালত যখন সবরীমালা মন্দিরে রজস্বলা নারীদের ঢোকার ছাড়পত্র দিল এবং ভক্তরা টেরিফিক গোলমাল পাকাতে লাগল, তখন কেরলের শাসক পার্টির যথেষ্ট দ্বিধান্বিত ঢোক গেলার সাক্ষী থেকেছে এই দেশ। অতএব, এই ‘সম্মানরক্ষার্থে নাতি ছিনতাই’-এর ঘটনায়, এক বছর পর যখন ডিএনএ টেস্টের ফল বুঝে মায়ের কোলে সন্তান ফিরে আসে, আর মা তাকে জড়িয়ে ব্যাকসিটে তাঁর ক্লান্ত অথচ প্রসন্ন মাথাটি রাখেন, আর গাড়ি ভোঁওও করে বেরিয়ে যায়, তখন তাৎক্ষণিক মিলনান্তক বাষ্পটি কেটে যেতেই পথে পড়ে থাকে আমাদের পুংতন্ত্রের গ্যাঁড়াকল, গোটা সমাজের পিছনমুখিতার প্রতিজ্ঞা, নিজেদের ব্যতিক্রমী ঘোষণা করে শাঁখ বাজিয়ে গাল ফোলানো রাজনৈতিক দলের ফোঁপরা শ্যাওলা-খোল, আর ‘ভাঁরোওওত আমার ভাঁরোওওতবর্ষো’ গানের গদগদ পংক্তিনিচয়, যা ক্রমশ প্যারডি মনে হয়।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook