ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ভারত থেকে তিব্বতের পথে তন্ত্র


    দেবদত্ত পট্টনায়েক (Devdutt Pattanaik) (November 26, 2021)
     

    তিব্বতী বৌদ্ধধর্মকে বলা হয় বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম, তাকে আবার তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম নামেও ডাকা হয়। এ-ধর্মে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, যে-কারণে বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের প্রতীক হল বজ্র (দু’পাশে ধারালো ছুরি) এবং ঘণ্টা, যা পুরুষ এবং নারীচরিত্রের প্রতীক, যা আবার আধ্যাত্মিক এবং বস্তুবাদী জগতের প্রতীক। বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের আর একটি প্রতীক হল মড়ার মাথা বা খুলি। গুরুরা তাঁদের হাতে একটি খটভঙ্গ ধরে থাকেন— যষ্টির মাথায় খুলি। নারীর উপস্থিতি যদি যৌনতা এবং জীবনের প্রতীক হয়, তবে খুলির উপস্থিতি চিহ্নিত করে হিংসা এবং মৃত্যুকে। থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম যেমন গুহায় বসে ধ্যানের একক সাধনাকে প্রাধান্য দেয়, মহাযান বৌদ্ধধর্ম যেমন বোধিসত্ত্বকে সকল দুঃখ-ক্লেশের ত্রাতা হিসেবে জ্ঞান করে, বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম তেমনই সিদ্ধ বা মায়াবী শক্তির কথা বলে, যা অর্জন করলে সাধক আকাশে ওড়ার, জলের উপর হাঁটার, শবদেহে প্রবেশ করার এবং জাগিয়ে তোলার, রাক্ষসদের সাথে লড়ার, এবং ত্রিকালদর্শী সর্বজ্ঞ হওয়ার ক্ষমতা লাভ করা যায়।

    বৌদ্ধ ধর্মাচরণের ধারাগুলো উঠে এসেছিল হিন্দু ধারার প্রতিক্রিয়া হিসেবে, এবং উল্টোটাও সত্যি। নির্বাণের সন্ধানের পথ যে-থেরবাদ, বা শাক্যমুনি বুদ্ধের প্রাচীন পন্থা, তার উৎপত্তি ঘটেছিল বৈদিক ধারার প্রতিরোধে, যে-ধারা ধন, ক্ষমতা বা সাফল্য অর্জনের জন্য ইন্দ্রের মতো দেবতাদের পুজো করত। বৈদিক ধর্ম এর পরে নিজের রূপ পালটে সন্ন্যাসের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করল গার্হস্থ্য জীবনকে। অতএব উঠে এল পুরাণের নানা গল্প, যেখানে সন্ন্যাসী শিব বিবাহ করে সংসারধর্ম পালন করতে শুরু করলেন মানবজাতির কল্যাণের জন্য। এ-ধারাতেই আবার গৃহস্থ বিষ্ণু নানা অবতারের রূপে পৃথিবীতে লীলা করলেন মানবজাতির নানা সমস্যার সমাধান করতে। এর প্রতিক্রিয়ায় বৌদ্ধধর্ম হয়ে উঠল মহাযান বৌদ্ধধর্ম, সেখানে একাধিক বুদ্ধ এবং তাঁদের জগৎ। একাধিক বোধিসত্ত্ব, যাঁরা করুণাময়, যাঁরা নিপীড়িতের আর্তি মন দিয়ে শোনেন।

    থেরবাদের প্রচার হল দক্ষিণ দিকে— বার্মা, শ্রীলঙ্কা ও শ্যামদেশে। মহাযান এগিয়ে গেল উত্তরে মধ্য এশিয়া, চিন ও জাপান অভিমুখে। রাজা-রাজড়াদের দরবারে দুই ধর্মই মান্যতা পেল। থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের রক্ষকদের রাজা হিসেবে গণ্য করা হত, আর রাজাদের বোধিসত্ত্বের অবতার হিসেবে চিহ্নিত করত মহাযান বৌদ্ধধর্ম। একই ভাবে যুদ্ধনেতাদের রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার জন্য অশ্বমেধের মতো বৈদিক আচারের সৃজন হল, শিব এবং বিষ্ণুর থেকে সেই রাজারা পেলেন সামাজিক দায়িত্ব বা ধর্মের পরিকাঠামো, রীতিনীতি। তন্ত্রের উত্থানের সাথে-সাথে বৌদ্ধধর্ম এবং হিন্দুধর্ম, এই দুই ধারাতেই আবার নানা পরিবর্তন এল। মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ বছর থেকে শুরু করে প্রায় ১,৫০০ বছর ধরে এইসব পরিবর্তন আস্তে-আস্তে চলে।

    তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম এবং তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম, এই দুই ধারাই মায়াবী শক্তির কথা বলে— সিদ্ধ। সন্ন্যাসীর কাছে যৌনতা আর বিপদ বা প্রলোভন রইল না; যৌনতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সাধক আরও ক্ষমতা অর্জন করে নেওয়ার পথ পেলেন। পৌরাণিক হিন্দুধর্মে মেনকার মতো অপ্সরারা বিশ্বামিত্রের মতো তপস্বীদের মোহগ্রস্ত করতেন, শিবকে গৃহস্থ-জীবনে প্রবেশ করতে বাধ্য করেন শক্তি। কিন্তু তান্ত্রিক হিন্দুধর্মে অপ্সরা হয়ে উঠলেন যোগিনী। যৌনতা এ-ধারায় পুলক বা শিশুর জন্ম দেওয়ার নিমিত্ত নয়, আধ্যাত্মিক শক্তিকে ধারণ করার আধার। নারীকে যৌনসুখ দিয়েও বীর্যের পতন না হতে দেওয়াই ছিল লক্ষ্য। এই আত্মসংযম থাকলেই সন্ন্যাসী হয়ে উঠতে পারেন প্রকৃত বীর। নিজের শরীরজাত রস নারীর শরীরে অর্পণ করা নয়, বরং শরীরজাত রস নিজে অর্জন করে শরীরের পুনর্গঠন, পশুপাখি-গাছপালা, সকল বস্তু এবং নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করা।

    নির্বাণের সন্ধানের পথ যে-থেরবাদ, বা শাক্যমুনি বুদ্ধের প্রাচীন পন্থা, তার উৎপত্তি ঘটেছিল বৈদিক ধারার প্রতিরোধে, যে-ধারা ধন, ক্ষমতা বা সাফল্য অর্জনের জন্য ইন্দ্রের মতো দেবতাদের পুজো করত। বৈদিক ধর্ম এর পরে নিজের রূপ পালটে সন্ন্যাসের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করল গার্হস্থ্য জীবনকে। অতএব উঠে এল পুরাণের নানা গল্প, যেখানে সন্ন্যাসী শিব বিবাহ করে সংসারধর্ম পালন করতে শুরু করলেন মানবজাতির কল্যাণের জন্য।

    তান্ত্রিক হিন্দু কাহিনি এখন মূলত টিকে আছে নাথ-যোগীদের মৌখিক সংস্কৃতিতে, যাঁরা গার্হস্থ্যজীবন ত্যাগ করে গ্রামেগঞ্জে গান গেয়ে গল্প শোনান, কীভাবে গোরখনাথ মাৎস্যেন্দ্রনাথকে ‘নারীর রাজ্য’ থেকে স্বাধীন করেছিলেন, এবং এইভাবেই জীবন-মৃত্যুর অধিপতি হয়ে উঠেছিলেন। ভক্তিবাদী হিন্দুধর্ম এই ধারাকে সরিয়ে নিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, সেখানে যৌনশক্তিকে রূপান্তরিত করে আবেগীশক্তি হিসেবে দেখা হয়। তান্ত্রিক গীতগোবিন্দের মূল বিষয়বস্তুকে অনেকটা চেপে আনন্দ এবং প্রেমের উপর অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভারতবর্ষের অনেকটা জুড়েই এই ভক্তিবাদী হিন্দুধর্ম তান্ত্রিক হিন্দুধর্মকে সরিয়ে দেয়। ভক্তি-পূর্ব যুগের তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম এককালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ক্ষমতাশালী ছিল, এখন নেপালের কিছু জায়গায় বা কেরলের কিছু রীতিনীতিতে টিকে আছে। তবে বৌদ্ধধর্মে ভক্তিবাদ তন্ত্রকে অবদমিত করতে পারেনি। ভুটান থেকে লাদাখ, হিমালয়ের পার্বত্য দেশে সে যেন আবহমান সময়কে নস্যাৎ করে বেঁচে আছে।

    সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দীতে ভারত থেকে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মকে তিব্বতে নিয়ে যান পদ্মসম্ভব। তিনি ছিলেন আদি শঙ্করাচার্যের সমকালীন। পরের জনকে যদি ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মকে বিলীন করার কান্ডারি বলা যায়, তবে আগের জনকে বলতে হয় হিমালয়ে বৌদ্ধধর্মকে নিয়ে যাবার মূল উদ্যোক্তা। আদি শঙ্করাচার্য ছিলেন ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসী, তান্ত্রিক রীতিনীতির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। তুলনামূলক ভাবে, পদ্মসম্ভবের দুই স্ত্রী ছিল, একজন ভারতীয় এবং একজন তিব্বতী। এই দুজন আবার তাঁর শিষ্যা এবং যৌনাচারের সাধনসঙ্গিনী ছিলেন, যে যৌনাচারের সাহায্যে তিনি সিদ্ধশক্তির চাবিকাঠি অর্জন করেন। অতএব বেদান্ত হিন্দুধর্মের প্রবর্তক ছিলেন প্রাচীনকালের বৌদ্ধদের মতো ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসী, আর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মহাপুরুষ ছিলেন প্রাচীনকালের বৈদিক ব্রাহ্মণদের মতো গৃহস্থ। এতেই বোঝা যায় এই দুই ধর্ম প্রতীকে এবং রীতিনীতিতে একে অপরের উপর কতটা প্রভাব ফেলেছে।

    পদ্মসম্ভবের জন্মভূমি উড্ডীয়ানকে আগে চিহ্নিত করা হত পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায়। কিন্তু আধুনিক পণ্ডিতদের দৃঢ় বিশ্বাস, উড্ডীয়ান আসলে উড়িষ্যা। পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে হূনেরা উত্তর-পশ্চিম ভারতে বৌদ্ধধর্মের বেশির ভাগ কেন্দ্রগুলোকেই ধ্বংস করে ফেলেছিল, সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে পুরো এলাকাটাই মুসলমান প্রভাবের আওতায় পড়েছিল। মুসলমানরা সমস্ত রকমের মূর্তিপুজো বা তন্ত্রসাধনাকে খারাপ চোখে দেখতেন।

    পারস্যের ভাষাগুলোয় পুজোর মূর্তিকে বলা হয় ‘বুত’, যা এসেছে ‘বুদ্ধ’ থেকে। এই সময়ে বাংলা, অসম, মিথিলা এবং উড়িষ্যায় ছিল তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের রমরমা। ভুবনেশ্বরে চৌষট্টি যোগিনীকে উৎসর্গ করে তখন গোলাকার ছাদহীন মন্দির নির্মাণ করা হচ্ছে। দ্বাদশ শতাব্দীর মুসলমান আক্রমণ পর্যন্ত এ-ধারার বিকাশ ঘটেছিল, তারপরে জনপ্রিয়তায় অনেক বেড়ে উঠল বৈষ্ণবধর্ম এবং ভক্তিবাদ। পূর্ব ভারতের সঙ্গে তিব্বতের এই যোগসূত্রের কথা না বললেই নয়।

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook