ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • তোমারে বধিবে যে


    পৃথ্বী বসু (October 30, 2021)
     

    সমালোচনা— সিনেমা, ‘সর্দার উধম’
    মুখ্য চরিত্রে— ভিকি কৌশল, শন স্কট, স্টিফেন হোগান, অমল পরাশর
    পরিচালক— সুজিত সরকার
    সঙ্গীত— শান্তনু মৈত্র

    সুজিত সরকার পরিচালিত ছবি ‘সর্দার উধম’ বেরোল কি বেরোল না, চতুর্দিকে গুজগুজ-ফুসফুস শুরু হয়ে গেছে। দুনিয়ার লোকে হামলে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। একদলের বক্তব্য, এতদিন পরে পুরনো ক্ষত
    দেখানোর কী দরকার ছিল, বেশ তো বাবা অন্য ধরনের ছবি বানিয়ে নাম করেছিলি!
    অন্যদিকে, অস্কার মনোনয়নের জন্য নির্দিষ্ট জুরি বোর্ডের মত— এর মধ্যে ‘ব্রিটিশ-ঘৃণা’ দেখানো হয়েছে, যা পুরনো ক্ষত জাগিয়ে তুলবে। মনোভাব এইরকম যে, যেচে পড়ে ঝামেলা নিয়ে আসার কোনও দরকার ছিল কী? আর ঠিক সেই কারণেই অর্থাৎ গা বাঁচিয়ে পরিচালক সেফ খেলেননি বলেই পরিচালককে অভিনন্দন জানানো অবশ্যকর্তব্য হয়ে পড়ে আমাদের। জালিওয়ানওয়ালাবাগ-হত্যাকাণ্ডের ১০০ বছর পরে তিনি ফের প্রসঙ্গটাকে আরও একবার তুলে আনলেন আমাদের সামনে এবং অন্যায়টাকে মনে করিয়ে দিলেন। 

    ‘সর্দার উধম’ ছবিতে ভিকি কৌশল ও কির্স্টি অ্যাভারটনউধম-চরিত্রে কৌশলের অভিনয় সত্যিই মনে রাখবার মতন।

    এখন কেউ এ-কথা বলতেই পারেন যে, আসলে পুরোটাই ব্যবসা মশাই, জালিওয়ানওয়ালাবাগ-হত্যাকাণ্ডের ১০০ বছর হল তো, সেই কারণে মার্কেটে খাবে বলে নামিয়ে দিয়েছে। এ-কথা আমিও যে পুরোপুরি অস্বীকার করি, তা নয়! কারণ, সিনেমায় বাণিজ্যিক সাফল্য একটা বড় ব্যাপার। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, শুধুই কি ‘বাজার’? অন্য কোনও কারণ নেই? একজন সংবেদনশীল ভারতীয় নাগরিক যদি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, ১০০ বছর আগের সেই নারকীয় ঘটনাকে ফিরে দেখতে চান, তাঁর প্রতিক্রিয়া ঠিক কী হওয়ার কথা? খানিক আহা-উহু? হতে পারে! আবার সমবেদনার পাশাপাশি কারোর মনে জন্ম নিতে পারে একরাশ ক্ষোভ। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই সময়ে দাঁড়িয়ে যথার্থ ক্ষোভটাই বা কী? যে মাইকেল ও’ডয়্যার ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ছিলেন, উধম সিং তো ২১ বছর পরে হলেও লন্ডনে গিয়ে তাঁকে খুন করে এসেছেন! ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ঔপনিবেশিক পরাধীনতার যন্ত্রণাও আর নেই। তাহলে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে সাধ হল কেন পরিচালক সুজিতের? কারণ একটাই, ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে  এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরে শ্বেতাঙ্গরা যেভাবে হাঁটু মুড়ে বসে শোক প্রকাশ করেছিলেন, নিদেনপক্ষে তেমনটা হলেও চলত!) আজ অবধি আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনওরকম কোনও ক্ষমা চাওয়া হয়নি। ফলে সুজিতের এই রাগ, ১০০ বছর পরে এসেও হওয়া খুব স্বাভাবিক এবং তার ফলস্বরূপই তিনি এই ছবি বানিয়েছেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

    এবারে আসা যাক, ছবিটার অভিমুখ নিয়ে। রাগের কথা তো বললাম। প্রশ্ন হচ্ছে, আমি যদি জালিওয়ানওয়ালাবাগ-হত্যাকাণ্ড নিয়ে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ছবি বানাই, আমি কি শুধুমাত্র তৎকালীন উত্তপ্ত পরিস্থিতি দেখিয়ে, নৃশংসতা-বীভৎসতা দেখিয়েই ছবিটা শেষ করে দেব? আমার উদ্দেশ্য কি হবে কেবল নিহত ভারতবাসীর প্রতি একধরনের ট্রিবিউট? নাকি ওই ঘটনার অনুষঙ্গ ধরে আমার কিছু বলার থাকবে? ‘সর্দার উধম’ দেখলে এই শুকনো শ্রদ্ধাঞ্জলি ছাপিয়ে আরও বড় কিছু চোখে পড়ে যেন, যা মানসিক ভাবে আমাদের অস্থির করে তোলে কখনও-কখনও। সুজিত সরকার কার্যত এই ছবির মধ্যে দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন দুটো বিষয়কে— এক, ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিলের ভয়াবহতা (ইচ্ছাকৃত ভাবেই যা প্রায় কুড়ি মিনিটের বেশি সময় ধরে দেখানো হয় সিনেমায়)। দুই, সর্দার উধম সিং-এর আত্মত্যাগ এবং লড়াই।

    উধম সিং-এর জীবন যে বর্ণময়, এ নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই, কিন্তু সুজিত সরকার কেবল সেটাই দেখাতে চাননি এই ছবিতে। ১৯১৯ থেকে ১৯৪০ সালে মাইকেল ও’ডয়্যারকে খুন করে ফাঁসিতে চড়া অবধি উধমের জীবন দেখানো হয়েছে। তাও খুবই সুনির্দিষ্ট পথে। সুজিতের মূল বক্তব্য ছিল— কী করে একজন দেশপ্রেমী যুবক আত্মত্যাগ আর লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে খোদ লন্ডনের মাটিতে গিয়ে নির্ভীকচিত্তে মাইকেল ও’ডয়্যারকে (তৎকালীন পঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নর) গুলি করে জালিওয়ানওয়ালাবাগ-হত্যাকণ্ডের প্রতিশোধ নেন।

    উধম সিং-এর জীবন যে বর্ণময়, এ নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই, কিন্তু সুজিত সরকার কেবল সেটাই দেখাতে চাননি এই ছবিতে। ১৯১৯ থেকে ১৯৪০ সালে মাইকেল ও’ডয়্যারকে খুন করে ফাঁসিতে চড়া অবধি উধমের জীবন দেখানো হয়েছে। তাও খুবই সুনির্দিষ্ট পথে। সুজিতের মূল বক্তব্য ছিল— কী করে একজন দেশপ্রেমী যুবক আত্মত্যাগ আর লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে খোদ লন্ডনের মাটিতে গিয়ে নির্ভীকচিত্তে মাইকেল ও’ডয়্যারকে (তৎকালীন পঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নর) গুলি করে জালিওয়ানওয়ালাবাগ-হত্যাকণ্ডের প্রতিশোধ নেন। ডয়্যার ছিলেন, ওই গণহত্যার মূল পাণ্ডা। তাঁর নির্দেশেই রেজিনাল্ড ডায়ার সেইদিন চারিদিক ঘিরে ফেলে আট থেকে দশ মিনিট টানা গুলি চালান। লাশের পাহাড় তৈরি করেন। এবং অবশ্যই ‘যা করেছি বেশ করেছি’ ভাব নিয়ে। এই অত্যাচারী-অহংকে কী করে একদিন দুরমুশ করে দেওয়া হল সবার চোখের সামনে, সুজিত তারই যাত্রাপথ বুনেছেন। দেখাতে চেয়েছেন, একদল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা ‘সফল প্রতিবাদ’কে (ব্রিটিশ সরকার এতদিনে যদি প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে ফেলত, তাহলে আর এই সিনেমা আদৌ হত কি না, সে-তর্ক অবশ্য রয়েই যায়!)। এবং এই ‘সফল প্রতিবাদ’ দেখাবেন বলেই তাঁর কোনও উপায় ছিল না, উধম সিং-কে বাদ দেওয়ার! কেননা, উধম সিং-ই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ওই দিনের (১৩ এপ্রিল, ১৯১৯) ক্ষতে খানিক হলেও প্রলেপ লাগাতে পেরেছিলেন।

    সর্দার উধম’ ছবিতে ভগত সিং এবং উধম সিং-এর ভূমিকায় অমল পরাশর (বাঁ-দিকে) এবং ভিকি কৌশল

    ‘সর্দার উধম’ ছবিটা শুরু হয় একটা জেলদৃশ্য থেকে। ১৯৩১ সালের পঞ্জাব। উধম সিং ছাড়া পাচ্ছেন। আর ছাড়া পাওয়া মাত্রই তিনি পালিয়ে প্রথমে লন্ডন, তারপর রাশিয়া, আবার লন্ডন, আবার অন্য কোথাও— এই করতে করতে অবশেষে ১৯৪০ সালের ১৩ মার্চ লন্ডনের ক্যাক্সটন হলে মাইকেল ও’ডয়্যারকে হত্যা করেন। তারপর তদন্ত হয়ে, বিচার হয়ে, ফাঁসি। গোটা সিনেমার বুননটাও তারিফ করার মতন। মোট ২১ বছরের ঘটনা দেখানো হয় ঠিকই, তবে তা এক সরলরেখায় চলে না। সময়কে এগিয়ে-পিছিয়ে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ডয়্যার-হত্যার পরে ব্রিটিশ গোয়েন্দা যখন তদন্তে নামেন তার সূত্র ধরে কিছু ঘটনা উঠে আসে, উধমের নিজের জবানবন্দি থেকে কিছুটা জানা যায়, এবং বাকিটা (খুব অল্পই) উধমের মনোজগত বোঝাতে গিয়ে (অর্থাৎ সেখানে কী চলছে) দেখানো হয়। এই সিনেমা দেখে আমরা জানতে পারি, উধম-এর ছ’বছর বয়স হতে না হতেই একে একে তাঁর বাবা-মা’র মৃত্যু হয়। তিনি হয়ে পড়েন অনাথ। ১৯১৯ সালের জালিওয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার সময় উধম তখন একটা কাপড়ের কলে কর্মরত। রাওলাট আইনের প্রতিবাদে ১৩ এপ্রিলের জনসভায় তিনি যেতে পারেননি, তাই প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু রাতের অন্ধকারে ওই লাশের পাহাড়ে গিয়ে দাঁড়াতে হয় তাঁকে। চোখের সামনে দেখতে হয় রক্তগঙ্গা। বাঁচানোর প্রাণপন চেষ্টা করেও তিনি সেইদিন বাঁচাতে পারেননি বহু প্রাণ। চিল-শকুনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাই তাঁর মনে হয়েছিল, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। 

    আগেই বলেছি এই ছবিতে সুজিত একেবারেই চাননি উধম সিং-এর জীবনটুকু শুধু বর্ণনা করে যেতে। তিনি কেবল দেখাতে চেয়েছেন, একজন দেশপ্রেমিকের আত্মত্যাগ, তাঁর লড়াই, তাঁর অসহায়তা এবং তাঁর ভেতরে যে প্রতিশোধের আগুন ছিল, সেই আগুনটুকু। এই ছবিতে এটাই মুখ্য, বাকি সব গৌণ। ফলে ক্ষতকে কেন্দ্র করে কোনও ‘আমোদ’ এই ছবিতে ঢোকানো হয়নি। আর উধম-চরিত্রে ভিকি কৌশলের অভিনয় সত্যিই মনে রাখবার মতন। দু’ঘণ্টা বিয়াল্লিশ মিনিটের এই ছবিতে তাঁকে যতবারই দেখা গেছে, পরিস্থিতি সাপেক্ষে তাঁর অভিব্যক্তি প্রতিবারই যথাযথ মনে হয়েছে (দু’একটা দৃশ্য বাদ দিলে)। একটা গুমোট, দমবন্ধ পরিবেশ যেন আগাগোড়া তিনি তৈরি করতে পেরেছেন তাঁর চাউনি আর কথা বলার ধরনের মধ্যে দিয়ে। যে-উধম সিং ১৩ এপ্রিলের রাতের বীভৎসতা নিজে চোখে প্রত্যক্ষ করেন, তাঁর যে কিছু একটা না করা অবধি শান্তি ছিল না— সেটা আমরা ছবিটা দেখতে দেখতেই টের পেয়ে যাই। 

    জালিওয়ানওয়ালাবাগ-হত্যাকণ্ডের মূল পাণ্ডা মাইকেল ও’ডয়্যার-এর ভূমিকায় শন স্কট

    চরিত্রের মনস্তত্ত্ব এত নিপুণ দক্ষতায় সুজিত দেখিয়েছেন, সিনেমাটা দেখতে দেখতে আমরাও যেন তার অংশীদার হয়ে উঠি। মনে রাখতে হবে, উধম-এর সামনে কিন্তু এরকম কোনও স্তোকবাক্য ছিল না, যা ছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অর্জুনের সামনে (কৃষ্ণ সেখানে যেমন অর্জুনকে বলেছিলেন, ‘আমি সবাইকে আগে থাকতেই মেরে রেখছি, তুমি কেবল ওদের মৃত্যুর নিমিত্তমাত্র হও’)। ফলে দ্বিধা, সংশয় এবং একটা টান-টান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ক্যাক্সটন হলে মাইকেল ও’ডয়্যারকে আমরা খুন হতে দেখি। জখম হতে দেখি লর্ড জেটল্যান্ড, লর্ড ল্যামিংটন ও লুই ডেন-কে। ইতিহাসের ফুটনোট বড় পর্দায় ভেসে ওঠে।

    সবশেষে ‘সর্দার উধম’ নিয়ে আরও একটা ভাবনা মনের ভেতরে জোনাকির মতন জ্বলতে-নিভতে থাকে। সেটা হল এই, একজন অত্যাচারী শাসক যখন নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে থাকেন, তার পরিণাম কী হতে পারে, তারই একটা আভাস কি সুজিত তুলে ধরলেন না এই ছবিতে? এই ছবি কি আরও একবার একটা সতর্কবার্তা হয়ে ঝুলে রইল না আজকের স্বৈরাচারী শাসক-সম্প্রদায়ের চোখের সামনে? কী জানি! কাকে বধ করার জন্য কে যে গোকুলে চোখের আড়ালে বেড়ে উঠছে, তার হদিশ সত্যিই কি আগে থেকে জানতে পারি আমরা?

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook